।। একইসঙ্গে স্নেহময়ী রক্ষাকর্ত্রী এবং রণরঙ্গিনী মা নিস্তারিণী ।।
জয়িতা সরকার
।। একটি প্রতিবেদন ।।
কত রকমের ভাঙ্গা- গড়া, সাফল্য- ব্যর্থতা, লাভ- লোকসান পার করে আবার চলে গেল একটা বছর ,এল নতুন বাংলা বছর ।আরো নানা রকমের বিশেষ তিথির মতন এই বিশেষ দিনে শেওড়াফুলি নিস্তারিণী মায়ের মন্দিরে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন প্রার্থনা নিয়ে উপস্থিত হবেন। পুণ্যার্থীদের হাতে হাতে ফুলমালা- লাল খাতা- ধূপ -দীপ- মিষ্টান্নে ভরে যাবে মন্দির চত্বর। এই ভরসার আশ্রয় তো আসলে একদিনের নয়।বাংলার দিকে দিকে বনে- জঙ্গলে- পাহাড়ে- মণ্ডপে-মন্দিরে-বাড়িতে- শ্মশানে মা কালীর পূজার প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে । আহ্লাদী মনের কোণায় কোণায় মাতৃ আশ্রয়ের জন্য অপরিসীম আকাঙ্ক্ষা। সেই চাহিদা গিয়ে মিশেছে পুরাণে উল্লিখিত দেবীরূপের সঙ্গে।কালের নিয়ন্ত্রণকারিণী কালী নানা রূপে নানাস্তরের মানুষের দ্বারা পূজিতা। বিপর্যস্ত মানুষ তাঁর কোলে ও চরণতলে আশ্রয় খোঁজে।। হুগলি জেলার মানুষও ব্যতিক্রমী নয়। ভাগীরথী তীরবর্তী বৈদ্যবাটী- শেওড়াফুলির জীবনযাত্রা অনেকটাই ব্যবসা কেন্দ্রিক- ধর্মকেন্দ্রিক। এই দৈনন্দিন জীবনে মিশে আছে বাংলার বাইরে থেকে আসা মানুষজনের সংস্কৃতি, ইসলামিক সংস্কৃতির কিছু দিক এবং বাকি বা মূল অংশটি হলো বৈষ্ণব -শাক্ত-শৈব সবকিছুই। কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে চলে গঙ্গা। তার পাশে স্থাপিত আছে একাধিক শিক্ষালয়। পাশে সুপ্রাচীন সুসমৃদ্ধ বাজার । তার গা ঘেঁষে রেল লাইন ,স্টেশন, জি টি রোড ।রেলপথে হাওড়া থেকে প্রায় ২২ কিমি দূরত্ব শেওড়াফুলির। প্রাচীন নাম সারাপুলি। “দু-পয়সা ফেরিঘাটে”র মাধ্যমে ওপারের বা ব্যারাকপুরের জীবনযাত্রার সঙ্গে মিলন ঘটে বৈদ্যবাটী- শেওড়াফুলির। সবকিছু বুঝি তরবারি হস্তে রক্ষা করেন এবং নজরে রাখেন মা নিস্তারিণী স্বয়ং!শুধু এই এলাকার নয়, আশেপাশের বহু মানুষের পরমপ্রিয় ইষ্টদেবীর মতন একটা বড় ঠাঁই তিনি। সুখে-দুখে , কোন শুভ সূচনায় তাঁর মন্দিরে ছুটে আসেন ভক্ত মানুষ। বিশেষভাবে পুজো দেন ধনী-দরিদ্র সকলে।থাকে বিভিন্ন ‘মানসিক’।এমনকি বিবাহের মতন সামাজিক অনুষ্ঠানও এখানে সম্পন্ন করেন বহু মানুষ। গঙ্গার স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এই মন্দির দু’শো বছরের দোরগোড়ায় এসে পড়েছে।
শেওড়াফুলির রাজবংশ বেশ প্রাচীন। তাদের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল পাটুলি (কাটোয়ার কাছে)। মোগল সম্রাটের কাছ থেকে নানা স্বীকৃতি পেয়ে রাজবংশের মনোহর রায় শেওড়াফুলিতে বসবাস করতে থাকেন। তাই বলা হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে শেওড়াফুলি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা। পরবর্তী সময়ে ওই বংশের রাজা হরিশচন্দ্র পাটুলি ত্যাগ করে দিয়ে স্থায়ীভাবে এখানে প্রাসাদে বাস করতে থাকেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে (১২৩৪ বঙ্গাব্দে) এক জ্যৈষ্ঠ শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা হরিশচন্দ্র রায়। অনাড়ম্বর এই মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসনে চতুর্ভূজা দক্ষিণাকালীর পাষাণমূর্তি অধিষ্ঠিতা।নিস্তারিণী কালী মা । শিবের উপর দাঁড়িয়ে ত্রিনয়নী,এলোকেশী দেবী । তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বাম দিকের উপরের হাতে রাজকীয় শৌর্যস্বরূপ তরবারি। চিরাচরিত খড়গের পরিবর্তে এই রাজপরিবারের স্মারক আছে । হাতে নরমুণ্ড, দক্ষিণ হাতে বর ও অভয় দান করছেন, দৃষ্টিতে অপার করুণা, যেন মায়ের আশ্রয়দানে রক্ষা করার জন্য আশ্বাস প্রদান। পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর তামার পাপড়িওয়ালা বড় পদ্মের উপর দেবী স্থাপিত রয়েছেন, সম্ভবত দুই -আড়াই ফুট উচ্চতায়। বেদীটাও অনুচ্চ। মন্দির সমতল ছাদ যুক্ত, দক্ষিণমুখী দালান। বিশালাকার এই মন্দিরের সামনের দিকে সাতটি খিলান এবং পাশে (পূর্ব-পশ্চিমে) পাঁচটি খিলান। খিলানগুলি থামের উপর স্থাপিত।
এক একটি থাম ‘কলাগেছ্যা’ রীতির, কিছু পর পর চারটি সরু সরু গোল গোল থামের সমাহারে তৈরি। পরবর্তী কালে সিসিটিভি দিয়ে ঘেরা হয়ে গেছে সবটা। কড়িকাঠে পাখির বাসা গুলি এবং তাদের কিচিরমিচিরও বেশ লাগে । গঙ্গার পার্শ্ববর্তী রাস্তার উপর ব্যস্ত বাজার এলাকায় কিছু সিঁড়ি দিয়ে উঠে অপূর্ব সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত প্রবেশদ্বার তথা তোরণ পার করে মন্দির চত্বর। চত্বরে বেশকিছু দোকান রয়েছে,যেমন পুজো দেওয়ার জন্য ফুল-মিষ্টি-সামগ্রীর দোকান, চপ-জিলিপি-মুড়ি-তেলেভাজার দোকান রয়েছে, মানুষের প্রয়োজনীয় নানা জিনিস, শাঁখা- পলা,প্লাস্টিক, খেলনা, লোহার জিনিসপত্রের দোকান, পাথরের জিনিস,ছোট দেবমূর্তি প্রভৃতির দোকান। গর্ভগৃহ বারান্দা দিয়ে ঘেরা এবং পুণ্যার্থীরা অনেকেই প্রদক্ষিণ করেন।
রাজপরিবারের প্রাচীন কিছু বিগ্রহ রয়েছে মন্দিরের ভেতরে।মায়ের ডান হাতের দিকের ঘরে রয়েছেন মহিষমর্দিনী দশভূজা। কষ্টিপাথরের বহু প্রাচীন এই বিগ্রহ।আছেন অষ্টাদশভূজা দুর্গা, দশভূজা দুর্গা, বিশ্বেশ্বর,লক্ষ্মী, গণেশ,দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি। মায়ের বাম দিকের ঘরে রয়েছে বাঁশি হাতে কৃষ্ণ ও বালগোপাল বিগ্রহ। এছাড়াও রয়েছেন শ্বেতপাথরের শিবলিঙ্গ এবং তুলসী তলা। সর্বত্র নিত্য সেবা এবং আরতি হয় যথানিয়মে। সন্ধ্যা আরতির সময় বেশ কয়েক জন ভক্ত মদনমোহনের সামনে নামগান করেন। আরতির শেষে প্রায়ই হরিলুট দেওয়া হয়। মন্দির চত্বরে রয়েছে বড় বড় থামওয়ালা নাটমন্দির এবং হাঁড়িকাঠ। দেবসেবা ও মন্দির পরিচালনার সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক বরাবরই শেওড়াফুলি রাজপরিবার।
নিত্য পূজা হয় বিধিমতন, তন্ত্রমতে । দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরোহিতরা আছেন। তিথি অনুযায়ী বিশেষ পুজো হয়, নিয়ম মতন মা-কে লুচি ভোগ দেওয়া হয়।ভক্তরা নিয়মিত আসেন, বসেন,পুজো দেন। অমাবস্যায় বলি হয় । করোনাকালে কিছুদিন ভক্ত সমাগম বন্ধ রাখা হয়েছিল। তারপর যথাসম্ভব বিধি মেনে পুজো প্রদান হতে থাকে।
এই মন্দির স্থাপনের অন্তরালে বেশ চমকপ্রদ কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত আছে।শোনা যায়, উক্ত রাজা হরিশ্চন্দ্র স্ত্রী হত্যার দায়ে জড়িয়ে পড়ে (এটি ধোঁয়াশার।কোন অপঘাতে মৃত্যুও হতে পারে রাণীর) অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে কাউকে কিছু না জানিয়েই বেরিয়ে পড়েন। আত্মহত্যাও করতে যান বিভ্রান্ত হয়ে।ঘোড়া নিয়ে এদিক ওদিক দিশেহারা হয়ে ঘুরতে থাকেন। গভীর জঙ্গলে, শ্রীরামপুরের কালীমন্দিরে যান। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে স্বপ্নে পেলেন দেবীর আদেশ, তিনি যেন গঙ্গাতীরে মন্দির ও দক্ষিণা কালীর মূর্তি স্থাপন করেন। যে শিলাখণ্ডের উপর তিনি শুয়ে আছেন সেটি দিয়েই নির্মাণ করতে হবে বিগ্রহ। (মতান্তরে গঙ্গায় শিলাখণ্ড পান)। যাই হোক,সেটি ছিল মূল্যবান কষ্টিপাথর। এরপর নাকি সেসময় আশ্চর্যজনকভাবে রাজবাড়িতে এক ভাস্কর এসে জানালেন, দেবী কালিকার আদেশেই তিনি মূর্তি গড়তে এসেছেন। বিস্মিত রাজা মূর্তি নির্মাণের আদেশ দিলেন। যথাসময়ে সঠিক নিয়মে গড়া হল মায়ের মূর্তি। মূর্তি নির্মাণ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠা বিষয়ে পণ্ডিতদের বিধান অবশ্যই অনুসরণ করা হয়েছিল ।রাজা হরিশ্চন্দ্র মন্দিরের পশ্চিমে যে কুটির তৈরি করান, দিনের বেশিরভাগ সময়ই নাকি সেখানে কাটাতেন। এইভাবে বিষণ্ণ রাজা শান্তি খুঁজে নিয়েছিলেন। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে মন্দিরের এবং মায়ের মহিমার কথা। কথিত আছে, রাজার ভাবনায় প্রয়াত রাণী সর্বমঙ্গলা কালীমাতার সঙ্গে অভিন্ন রূপে অবস্থান করছেন।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা যায়,কারো জীবিকার ক্ষতি না করে মন্দির চত্বরের দোকানগুলি সুন্দর করে সাজালে এবং প্রবেশদ্বারের সিঁড়ির আশেপাশের অংশ ও নাটমন্দিরের অংশের দোকানদারদের অন্যত্র দোকান দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে মন্দির চত্বর আরো অনেক বেশী সুন্দর হবে এবং সুস্থ পরিবেশ হবে। সেখানে সঙ্গীত- সাহিত্য ইত্যাদি সুপরিকল্পিত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হবে, যদি রাজপরিবার স্বীকৃত যোগ্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উপযুক্ত দেখভালের ব্যবস্থা থাকে।
শহরের সার্বিক সৌন্দর্যবর্ধনের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটা উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে শেওড়াফুলির এই প্রাণকেন্দ্রের।
প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য,অতীতের পাতা ওল্টালে জানা যায়, এই মন্দিরে শুধু পুজোই হয়নি,সেই সন্ধানটুকু পেয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছি। রাজবংশের সমাজসেবী মানুষ নির্মল চন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে নিস্তারিণী মন্দিরে নাকি স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ।আবার রাজা হরিশ্চন্দ্রের উদ্যোগে নিস্তারিণী কালী মন্দিরের উপর পশ্চিম দিকের দালানে “নিস্তারিণী চতুষ্পাঠী” খোলা হয়েছিল এবং পন্ডিত বর্গ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। হুগলির বিভিন্নজায়গা, যেমন চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর, বাঁশবেড়িয়া, বৈদ্যবাটী প্রভৃতি জায়গাতে বেশ কিছুকাল চতুষ্পাঠী বা টোলের রমরমা ছিল, যেখানে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করানো হতো, চর্চার সূত্রে পণ্ডিতেরা এখানে আশেপাশে বসবাস করতেন। প্রতিবছর এখানে কালীপুজোর আগে ঢাকিদের বাজার বসে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকিরা আসেন মন্দির চত্বর ঘিরে পাশের রাস্তার অনেকটা পর্যন্ত তাঁদের বাজনা শোনা যায়। আশেপাশের বিভিন্ন কালীপুজোর কর্মকর্তাদের বায়নার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করেন।
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে রাণী রাসমণি এখানে এসেছেন গঙ্গাপথে বজরা নিয়ে। জনশ্রুতি বলে, স্বয়ং মা তাঁকে স্বপ্নে এবং একটি মেয়ের রূপে বাস্তবে দেখা দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেবীদর্শন করে, পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তৃপ্ত হন তিনি। ধর্মপরায়ণা রানী অনেক জায়গাতেই গেছেন এবং দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজস্ব চিন্তনকে পুষ্ট করেছেন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ভবতারিণী মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, বিশিষ্টজনেরা যাঁর সঙ্গে নিস্তারিণী মায়ের মূর্তির সাদৃশ্য দেখতে পান।
আবার ১৮৮৫ সালে শেওড়াফুলিতে তারকেশ্বর শাখার রেল লাইন উদ্বোধন করতে এসে লর্ড ও লেডি ডাফরিন রাজা পূর্ণচন্দ্রের আতিথেয়তায় দেবী নিস্তারিণীকে দর্শন করতে এসেছিলেন। এইভাবে বারবার মন্দিরে বহু বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী মানুষের পদধূলি পড়েছে। আর প্রতিনিয়ত পুণ্যার্থীদের সমাগমে ভরে থাকে এই পবিত্র স্থান।
******************************