Shadow

পাওয়া, না পাওয়া – চন্দ্রকান্তি দত্ত

PC: Google sites

পাওয়া, না পাওয়া

চন্দ্রকান্তি দত্ত

গড়িয়াহাটে পাঞ্জাবীর দোকানে এই মুহূর্তে বেশী ক্রেতা নেই। প্রণবেশ দেখলেন, তিনি ছাড়া আর মাত্র এক মা-মেয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত। প্রণবেশ নিজের জন্য একটা কেতাদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবী কিনলেন। ভাগ্নের বিয়ে দুর্গাপুরে, তার জন্যই বিশেষ পোষাকের ব্যবস্থা।
টাকা নেওয়ার সময় দোকানের ভদ্রলোক বললেন,  “আপনার যা চেহারা স্যার, এই পোষাকটাতে আপনাকে দারুণ মানাবে।”
চেহারার কথাতেই হয়ত, অন্য ক্রেতারা এক ঝলক তাকালেন মনে হল। প্রণবেশ কথা না বাড়িয়ে মৃদু হেসে প্যাকেটটা নিলেন ও নমস্কার বিনিময় করে দোকানের বাইরে এলেন।
হাতে এখনও সময় আছে। ফ্লাইওভারের নীচে ছেলেটা খুব ভাল কফি তৈরি করে। এক কাপ খেয়ে যাওয়া যেতে পারে। প্রণবেশ সে পথেই পা বাড়ালেন।
“মানুদা!” বাড়ির বাইরে অব্যবহৃত তাঁর ডাকনাম ধরে কেউ ডাকছে। প্রণবেশ চকিতে পিছনে ফিরে চাইলেন। কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। চিনতে পারলেন। ঝিনুক।
এক গাল হেসে উচ্ছ্বসিত প্রণবেশ বলে উঠলেন, “কিম্ আশ্চর্যম্ ! ঝিনুক তুই? কত বছর পরে দেখলাম! কিন্তু তুই আমাদের পাড়ায় কি করছিস?”
– “যাক! চিনতে পেরেছ তাহলে। দোকানে তোমার দিকে তাকালাম। তখন তো চিনতেই পারো নি।”
– “দোকানে ঠিক সেভাবে দেখিনি। অযাচিতভাবে কোন ভদ্রমহিলার দিকে তাকাবার বয়সটা আর নেই যে।”
– “কবে ছিল? যাক গে, কোথায় থাক? বিয়ে করেছ?”
– “তুই কি এখানে দাঁড়িয়েই আমাকে জেরা করবি নাকি? হাতে সময় আছে?”
– “হ্যাঁ। আরও ঘন্টাখানেক সময় আছে।”
– “তাহলে আয়। সামনে ‘কাফে কফি ডে’ আছে। ওখানে একটু বসি।”
– “ওখানে তো ঢুকলেই গলাটা কাটবে। অন্য কোথাও চলো না।”
– “ওসব তোকে ভাবতে হবে না। চল তো। বেশ জায়গা। নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে।”
যেতে যেতে প্রণবেশ ঝিনুকের মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার নাম কি মা?”
– “ঐন্দ্রিলা।”
– “বাবা! এ তো বেশ জমকালো নাম। সে নাহয় হল। কিন্তু মা নিশ্চয় ওই নামে ডাকে না।”
– “মা পিউ বলে ডাকে।”
– “বেশ। আমিও পিউ বলে ডাকব। আপত্তি নেই তো?”
একথার উত্তরে পিউ কিছু বলার আগেই ঝিনুক বলল, “কেন? আপত্তি হবে কেন? আমি কি খারাপ নামে ডাকি নাকি?”
প্রণবেশ হেসে বললেন, “তোমার মা কিন্তু ক্ষেপে গেছে। এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ানো চলবে না।”
কাফেতে বসে প্রণবেশ বললেন, “ঝিনুক, তুই কি খাবি বল? তারপর তোর মেয়ের মত নেব।”
– “কি আবার খাব? কফি খাওয়াবে বললে তো।”
– “কফি তো আছেই। সাথে একটু অন্য কিছু হলে মন্দ কি? কি বলিস পিউ?”
আবারও পিউ জবাব দেওয়ার আগেই ঝিনুক বলে উঠল, “ওর তো বাইরের খাবার পেলেই হল। বাড়ির খাবার আজকাল আর মুখে রোচে না।”
পিউ এবার বেশ জোরের সাথে প্রতিবাদ জানাল, “না মামা। মা সবসময় বাড়িয়ে বলে। আমি সাতদিনে একবার বাইরে খাই কিনা সন্দেহ। আর মা বলবে রোজ রোজ।”
“সে কি রে? সা–ত দি–ন? সে তো দীর্ঘ সময়। তোর তো পুষ্টি হবে না। তা ছাড়া বন্ধুদের কাছেও তো তোর মান থাকবে না।” প্রণবেশ মজা করলেন।
ঝিনুক মানতে পারল না। বলল, “তুমি ওকে আরও প্রশ্রয় দাও। এবার আমার মাথাটা খাবে।”
খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। এসে পড়ল। খেতে শুরু করে ঝিনুক আবার প্রসঙ্গটা তুলল, “তুমি কিন্তু আমার একটা কথারও জবাব দাওনি মানুদা।”
– “ও হ্যাঁ। কি যেন বলছিলি? কোথায় থাকি? থাকি এখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে, পূর্ণদাস রোডে। ওখানেই আমার ফ্ল্যাট। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর তুই নিজেই দিয়েছিস একটু আগে। মনে করে দ্যাখ।”
মা ও মেয়ে দুজনেরই খাওয়া থেমে গেল। মেয়ের দিকে খানিক চেয়ে নিয়ে ঝিনুক বলল, “আমি আবার এর মধ্যে কখন তোমার বিয়ের ব্যাপারে জানালাম? আমি তো নিজেই কিছু জানি না।”
প্রণবেশের মুখে একই ভাবে ঝুলে রয়েছে একটা হালকা হাসি। বললেন, “তাহলে আমিই বলি। তুই ঠিকই বলেছিস। মহিলাদের দিকে তাকানোটা আর হয়ে ওঠে নি। নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে কবে যেন তাকানোর বয়সটাই পেরিয়ে গেল। ও পথে আর হাঁটা হল না।”
– “সে কি? তুমি একেবারে একা? দুর্গাপুরে কেল্টুদাও তো তাই। সে ও তো বিয়ে করে নি।”
– “না না। কেল্টু বিয়ে করেছে। এখন স্ত্রী-পুত্র নিয়ে চুটিয়ে সংসার করছে।”
– “একটা কথা বলব, রাগ করবে না তো? কেল্টুদা স্বভাবটা পাল্টেছে?”
প্রণবেশ হাসলেন। বললেন, “হ্যাঁ। এখন খুব নম্র ভদ্র। তোর কি সেই ঘটনাটা এখনও মনে আছে?”
– “সে আবার মনে থাকবে না। দোলের দিনের কি সুন্দর একটা রিচুয়াল। অথচ, হঠাৎ করে কি খারাপ ব্যবহারটাই না করল।”
– “তবে এর পরেও আমাদের বাড়িতে তোর যাতায়াত কিন্তু বন্ধ হয় নি। দোলের দিনগুলো অবশ্য এড়িয়ে গেছিস। এখানেই তোর মহত্ত্বকে আমি সেলাম করেছিলাম।”
– “মহত্ত্ব না হাতি। বিজ্ঞের মত বললেই তো হল না। কিছুই বোঝ নি। যাক গে। ওসব কথা এখন থাক। আমাদের ওখানে কবে আসছ বলো।”
– “যাব, নিশ্চয় যাব। তুই এখানে আছিস জানার পর না যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে খুব তাড়াতাড়ি যেতে পারব না। অন্ততঃ এ মাসে তো নয়ই।”
– “কেন? সবে তো মাস শুরু হয়েছে। তোমার কি এমন রাজকাজ যে পুরো মাসেই তোমার সময় হবে না?”
– “না রে। রাজকাজ না হলেও এমন কয়েকটা কাজ আছে, যেগুলো সবই আমার হাতের বাইরে।”
– “তাই?”
– “হ্যাঁ। দ্যাখ না, কালকে জামাইবাবু আসছেন ছেলে টুকাই-এর বিয়ের কেনাকাটা করতে। দিন দুয়েক থাকবেন। কেনাকাটা হলে সেগুলো দিতে জামাইবাবুর সাথে দুর্গাপুরে যেতে হবে শুক্রবার। সেদিনই ফিরব। পরদিন শনিবার অফিস করে আবার দুর্গাপুর। মঙ্গলবার টুকাই-এর বিয়ে। ফিরব  সেই শুক্রবার। একদিন বাদে রবিবারই উড়ে যাব পুনের দিকে। পুনেতে আমাদের অ্যাকাডেমিতে থাকব চোদ্দদিন। ফিরতে ফিরতে সেই শনিবার আঠাশে।”
– “বাব্বা! তোমার তো দেখছি সত্যিই রাজকাজ গো! কিন্তু দিদির ছেলের বিয়ে দুর্গাপুরে কেন? দিদি তো হেতমপুরে থাকত।”
– “জামাইবাবু গত ডিসেম্বরে রিটায়ার করেছেন। তারপর হেতমপুরের পাট চুকিয়ে সিটি সেন্টারে উদয়শংকর বীথিতে একটা বাড়ি কিনেছেন। সেখানেই এখন স্থায়ী আস্তানা।”
– “বাঃ! এটা খুব ভাল হয়েছে। দিদি কেল্টুদা আর মণি – সবাই এক জায়গায়।”
– “তোদের দুর্গাপুরের বাড়ির খবর কি? টুনি কি করছে?”
– “দুর্গাপুরের বাড়িতে এখন টুনিই তো আছে। বাবা, মা দুজনেই গত হয়েছেন। টুনি আর ওর বর দুজনেই একটা প্রাইভেট স্কুলের টিচার।”
– “দুর্গাপুরে যাস?”
– “যাই মাঝে মাঝে। তবে পাড়াটা আর ভাল লাগে না। এত পাল্টে গেছে যে আগের সাথে মেলাতেই পারি না।”
– “হ্যাঁ। পরিবর্তন তো সব জায়গায়। আমাদের ছেলেবেলার মত পরিবেশ এখন কোথাও নেই। কেল্টুও বলছিল, ও পাড়াটা আর ভাল নেই। আমাদের বাড়িটা বিক্রি করার কথা ভাবছে।”
“তোমাদের তো কথা শেষই হচ্ছে না। এদিকে ঘড়ি তো থেমে থাকছে না। কটা বাজে সে খেয়াল আছে?” দুজনের একটানা কথার মাঝে পিউ মনে করিয়ে দিল।
“ও হ্যাঁ, তাই তো।” প্রণবেশ বললেন, “কোন কথাই বলা হল না। কত কথা যে মনে পড়ছে। একটা কাজ কর না। উনত্রিশে তো আমার কোন কাজ নেই। সারা মাসের ছোটাছুটির পর একদিন পুরো বিশ্রাম। তোরা ওইদিন আমার ওখানে আয় না। সারাদিন দিন গল্প করা যাবে। এই নে আমার কার্ড। এতে ঠিকানা, ফোন নম্বর সব লেখা  আছে।”
– “ঠিক আছে। চেষ্টা করব।”
– “চেষ্টা নয়। অবশ্যই আসবি। আমার ওখানে আসতে হলে রেলের অ্যাডভান্স বুকিং করতে হয় না। হোটেল বুকিংও করতে হয় না। শুধু দরকার একটা বাহন। সেটা ট্যাক্সি বা বাস, কিছু একটা হলেই হল। অতএব, নো এক্সকিউজ।”
এবার কথা বলল পিউ, “ঠিক আছে মামা, আমরা যাব।”
– “সবাই মিলে কিন্তু। মানে তোর বাবাও। সে ভদ্রলোককে তো জানলামই না।
আবহাওয়াটা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। মা-মেয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল। অর্থপূর্ণ সে চাউনি।
ঝিনুক বলল, “তার কথা বলতে পারছি না। তবে পিউ যেমন বলেছে, আমরা দুজন যাবই।”
প্রণবেশ কিছু আন্দাজ করলেন, কিন্তু কোন মন্তব্য করলেন না। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “কিরে পিউ, তোর তো একটাতে কিছুই হল না। আমারটাতে এখনও হাত লাগাই নি। নিয়ে নে।”
ঝিনুক আপত্তি করল, “না না, সে আবার হয় নাকি? তুমি তাহলে কি খাবে?”
“আমি বিকেলে চা-কফি ছাড়া সাধারণত কিছু খাই না। পিউ এটা স্বচ্ছন্দে নিতে পারে।” বলে প্রণবেশ নিজেই খাবারটা তুলে পিউ-এর প্লেটে দিয়ে দিলেন। পিউকে বললেন, “মাকে দেখাস না। চুপিচুপি খেয়ে নে।”
ঝিনুক মন্তব্য না করে পারল না, “তুমি চিরকাল একই রকম রয়ে গেলে মানুদা।”
এক ঝলক নির্মল হাসিতে পরিবেশটা নিমেষে হালকা হয়ে গেল।
পিউ খাবারটা আর ব্যাগ তুলে নিয়ে বলল,”মামা, আমার পড়তে যাবার সময় হয়ে গেছে। আমি চললাম। রাস্তায় খেয়ে নেব। মা, তুমি বাড়ি চলে যেও। আমি তাতাই-এর মায়ের সংগে চলে যাব।”
ঝিনুকও মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল,”হ্যাঁ, তুই আর দেরি করিস না। আমি দেশপ্রিয় পার্কের কাজটা সেরে বাড়ি চলে যাব, কেমন ? “
পিউ চলে যেতে প্রণবেশ ঝিনুককে বললেন,”আমি তো পূর্ণদাস রোডে ঢুকব। তুই দেশপ্রিয় যাবি। এটুকু পথ একসাথে হেঁটে গেলে কেমন হয়? পারবি?”
– “কেন পারব না। তোমার সাথে যাব। না পারার তো কোন কারণ নেই।”
ফুটপাথ ধরে নীরবে মিনিট দুয়েক হাঁটার পর ঝিনুকই প্রথমে কথা বলল, “আচ্ছা মানুদা! আমার বিয়েতে তুমি আসোনি কেন গো? কাজে ব্যস্ত ছিলে?”
প্রণবেশ ঝিনুকের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। এত বছরের ব্যবধানে ঝিনুকের চেহারায় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ওর চোখের সেই মুগ্ধ করে দেওয়া সরল চাউনিটা এখনও একইরকম আছে। ভাল লাগল প্রণবেশের। একটু থেমে থেকে সেই সরল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিটা উপভোগ করলেন। তারপর বললেল, “যদি বলি তেমন কোন কাজ ছিল না?”
– “তবু এলে না?”
– “না রে। পারলাম না। শুধু আমার জন্য তোর বিয়েটা প্রায় বছর দুয়েক পিছিয়ে গিয়েছিল। আমি গেলে আবারও যদি বাধা পড়ে, সেই ভয়ে তৈরী হয়েও শেষ মুহূর্তে আর যেতে পারলাম না।”
– “আমি কিন্তু তোমার উপর রাগ করিনি। কারণ, নেপথ্যের ঘটনাটা আমি জানতাম।”
– “জানতিস? কে বলেছিল? আমি তো কারও সাথে আলোচনা করি নি।”
– “তুমি আলোচনা করবে, তারপর তোমার ছোট বোন জানবে, এ ধারণা তোমার কবে থেকে হল মানুদা?”
– “তোকে মণি বলেছিল?”
– “হ্যাঁ গো হ্যাঁ। তুমি হয়ত জানো যে, তোমার ভাই-বোনেদের মধ্যে মণিই তোমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। তুমি তোমার মনের কথাগুলো সবার কাছে লুকোলেও মণি কিন্তু সব বুঝেছিল।”
– “আমার অবস্থাটা কেমন ছিল জানিস, আমার মনেও যে কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, মা সেটা কোনদিনই ভাবেন নি। আর আমিও মাকে অমান্য করার কথা কখনও ভাবি নি।”
– “তোমাকে এত ভাল চিনি যে সে কথাটা না বললেও বুঝতে পেরেছিলাম।”
আবারও দুজনে নীরবে হাঁটতে লাগলেন। অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে। পথ যে বড়ই কম। ঝিনুকই আবার মুখ খুলল, “আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না তো?”
– “খুব ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু পারছিলাম না দুটো কারণে। প্রথমত : ,আজ এই মুহূর্তে আমার কতটা অধিকার আছে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়তঃ, তোদের সম্পর্কটা খুব ভাল জায়গায় নেই বলেই মনে হয়েছে।”
– “বুঝেছ তাহলে। ভাল খারাপ নয় মানুদা। আমাদের কোন সম্পর্কই নেই। আমি আর পিউ প্রায় বারো বছর আলাদা থাকি।”
চকিতে ঘুরে তাকালেন প্রণবেশ। না। ঝিনুকের চোখে মুখে ঠাট্টার লেশমাত্র নেই। তবে কি ওদের বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে?”
– “কি হয়েছিল?”
– “অত্যাচারটা প্রথম থেকেই ছিল। বছর দুয়েকের মাথায় মেয়ে হওয়ার পর সেটা বাড়ল। এতটাই যে ন-মাসের মেয়েকে নিয়ে আলাদা হলাম। পরে আইনগত ভাবে ব্যাপারটা পাকা করলাম। গোলপার্কের কাছে একটা স্কুলে চাকরি করি। আমাদের দুজনের ভালভাবে চলে যায়। পিউ-এর পড়ারও কোন ক্ষতি হতে দিই নি।” ঝিনুকের কথায় বেশ প্রত্যয় প্রকাশ পেল।
“এর জন্য কিছুটা হলেও আমিই দায়ী।” প্রণবেশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, “শুধু কিছু পুরনো মূল্যবোধের জন্য দুজনের জীবনই সঠিক পথ হারিয়ে ফেলল।”
– “না মানুদা। মূল্যবোধকে দোষ দিও না। সবই কপালের ফের। না হলে, পরস্পরকে ভাললাগাটা দুজনের কেউই প্রকাশ করতে পারলাম না কেন ৷ তুমি কেন বলতে পারো নি জানি। কিন্তু আমিও তো পারতাম একবার অন্ততঃ আমার মা কে বলতে। কই, পারি নি তো।”
কয়েক মুহূর্ত আবারও চুপ করে থেকে প্রণবেশ বললেন, “আজ কি মনে হচ্ছে জানিস? মনে হচ্ছে, বারো-তেরো বছর আগেই কেন তোর সাথে দেখা হল না? আমাদের ভুলের মেরামতির একটা চেষ্টা অন্ততঃ করা যেত।”
“মানুদা! মনি বলেছিল, তুমি নাকি আমার জন্য একটা আংটি গড়িয়েছিলে। সে আংটিটা কি করেছ? বিক্রি করে দিয়েছ?” একই ভাবে মাটির দিকে চেয়ে ঝিনুক প্রসঙ্গ বদলাল।
– “না রে। ওটা আমার কাছেই আছে। বিক্রি করলে দোকান থেকে অন্য কেউ কিনে নিয়ে যেত। যে আংটি তোর জন্য গড়ানো, সেটা অন্য কারও আঙ্গুলে উঠবে, এটা মেনে নিতে পারি নি।”
– “কোথায় তুমি আর কোথায় কিংশুক রায়। ভালই হয়েছে। এই লোকটাকে পিউ কোনদিন বাবা বলে ডাকে নি। বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতাই লোকটার নেই।”
– “একটা প্রশ্ন করব ঝিনুক?”
– “বলো।”
– “জীবনটা কি এভাবেই কাটবে?”
– “প্রশ্নটা নিজেকে কখনও করেছ মানুদা?”
প্রণবেশের কাছে এর কোন উত্তর ছিল না। নীরবেই চলতে লাগলেন।
পূর্ণদাস রোডের প্রায় মুখে এসে ঝিনুক বলল, “তোমার বাড়ির পথ তো এসে গেল মানুদা। এবার আলাদা হতে হবে। কিন্তু যাবার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাবে?”
প্রণবেশ নিঃশব্দে ঝিনুকের দিকে তাকালেন। চোখে তাঁর একরাশ জিজ্ঞাসা।
ঝিনুক একটু থেমে ধীরে ধীরে প্রশ্নটা করল, “আচ্ছা মানুদা, বলতে পারো, সমান্তরালে চলতে থাকা দুটো রেখাকে চিরকাল সমান্তরালেই চলতে হবে, এ নিয়মই কি সমাজে শাশ্বত?”
ঝিনুক চলে যাচ্ছে। প্রণবেশ দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। একইভাবে, ধীর পদক্ষেপে, বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে। ঝিনুকের ডানহাতটা কাঁধ থেকে ঝোলানো ব্যাগটা ধরে আছে। মুক্ত বাঁহাতটা অল্প অল্প দুলছে। কিছুটা বাতাস আছে। ঝিনুকের কয়েকগাছা চুল সে বাতাসে উড়ছে। কিন্তু তাঁতের শাড়ির ভারী আঁচলটা সেভাবে উড়ছে না।
কয়েক মুহূর্ত মাত্র। প্রণবেশ ডাকলেন, “ঝিনুক।”
চকিতে ঘুরে তাকালো ঝিনুক। ত্রস্তপায়ে এগিয়ে এসে বলল, “কি হয়েছে মানুদা? কিছু বলবে?”
– “তোর দেশপ্রিয়র কাজটা কি খুব জরুরী?”
– “না, তেমন কিছু জরুরী নয়। আজকে না হলেও চলবে।”
– “ঝিনুক! তোর মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে তুই নিয়মিত এলেও তোর সাথে আমার সবসময় কথা হোত না। আমি কোন কাজে হয়ত অন্য ঘরে ব্যস্ত থাকতাম। তুই কিন্তু খোঁজ করে ‘মানুদা গেলাম’ বলে যেতিস। আমিও অপেক্ষায় থাকতাম এই মুহূর্তটুকুর জন্য। এক ঝলক দেখা হওয়ার তাগিদটা কিন্তু দুজনেরই ছিল।”
প্রণবেশের চোখে চোখ রাখল ঝিনুক। গহীন আঁধারে এক ফোঁটা আলোর আভা।
প্রণবেশই আবার কথা বললেন,”আজ এতগুলো বছর পরে যখন দেখা হলই, থাক না নিয়ম নীতির কথা। আলাদা পথে আর না-ই বা হাঁটলাম। দীর্ঘ অন্ধকার নিশার শেষে ঝকঝকে ভোরে, ছেলেবেলার সেই অসম্পূর্ণ অনুচ্ছেদগুলোকে যদি দুজনে নতুন করে রচনা করি, তাতে সমাজের কোন ক্ষতি তো নেই।”
প্রণবেশ অনুভব করলেন,প্রবল এক উত্তেজনায় তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপছে। প্রাণপণে নিজেকে সামলে, বিস্মিত, বাকরূদ্ধ ঝিনুকের দিকে নিজের হাতদুটো ঈষৎ বাড়িয়ে ধীর লয়ে বললেন, “আসবি ঝিনুক?”
ঝিনুকের চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। আয়ত, বিস্মিত চোখের কোণে দু-ফোঁটা আনন্দবিন্দু কিছুক্ষণ টলটল করে প্রায় একই সাথে ঝরে পড়ল। ঝিনুক লুকোবার চেষ্টাটুকুও করল না। প্রণবেশের ডান হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আলতো চাপ দিয়ে বলল, “বাড়ি যাবেনা মানুদা?”
হঠাৎ একটা গাড়ির হর্নের আওয়াজে চমক ভাঙ্গল প্রণবেশের। তখনও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছেন, একইভাবে। ঝিনুক দেশপ্রিয় পার্কের দিকে এগিয়ে গেছে। ওকে আর দেখা যাচ্ছে না। তাহলে? এতক্ষণ কি দেখছিলেন প্রণবেশ? দিবাস্বপ্ন?
নিজের চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একটা ঘটনার অভিঘাতে ব্যতিব্যস্ত প্রণবেশ নিজের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। এতকাল পরে, এই বয়সে এসে, এ ধরনের একটা দিবাস্বপ্ন দেখা বাতুলতা মাত্র। প্রণবেশ হাসলেন। হাসিটা উচ্চকিত নয়, নিঃশব্দ। ঊনচল্লিশের প্রণবেশের নিজের প্রতি করুণার হাসি।
এক ভদ্রলোক পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রণবেশকে একা দাঁড়িয়ে হেসে উঠতে দেখে হয়ত একটু অবাক হলেন। অন্ততঃ তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তা-ই মনে হল। প্রণবেশ অবশ্য দেখতে পান নি। পারিপার্শ্বিক জগৎকে ভুলে তিনি তখন নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
গাড়ির শব্দে কঠোর বাস্তবে ফিরে এসে ধীর পদক্ষেপে পূর্ণদাস রোডের ফুটপাথ ধরে প্রণবেশ নিজের বাসার দিকে রওনা হলেন।
**************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে, তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও, শারীরিক অসুস্হতার কারণে  লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন, চাকরী থেকে অবসরের পরে, প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।
চন্দ্রকান্তি দত্ত

 


                 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!