বিষ
কাজরী বসু
(এখনকার কথা)
(১)
“ফ্লাইটে এবার বোর্ডিং হবে তো! ওঠো, ওঠো..চলো…”
বিমানবন্দরের নরম সোফায় বসে বসে কখন যেন চোখটা লেগে এসেছিল রত্নার। পাবলো ডাকতেই ধড়মড় করে উঠলেন। আসলে বিগত অনেকগুলো দিন নির্ঘুম কেটেছে তাঁর। নানাবিধ হুমকির চোটে ঘুম আর শান্তির বারোটা বেজে বসেছিল। এখন তাই চোখে রাজ্যের ঘুম…
কাঁধে ব্যাগ তুলে নিয়ে এগিয়ে চললেন রত্না পাবলোর পিছু পিছু। পৃথিবী কতভাবে মানুষকে শিক্ষা দেয়…
ভাবতে ভাবতে…
পূর্বকথা
(১)
__তুমি কি জেগে? জানিও আমার যাওয়ার ব্যবস্থা কতদূর। আর কতদিন চলবে এই শবরীর প্রতীক্ষা?
ঘুম ভেঙে উঠে পাবলো দেখল টফি টেক্সট করে রেখেছে অনেক আগে। প্রতিদিন এমন টেক্সট করে টফি। আর কতদিন পাবলো,আর কতদিন! কতদিন এভাবে একা থাকতে হবে,আর কত মাস…
এত অবুঝ মেয়েটা। ছেলেমানুষ একেবারে।
ব্রাশ করে কিছু খেয়ে কল করবে ৷ এতক্ষণে ওর অফিসের কাজ শেষ হয়েছে হয়তো।
টফিকে যখন বলবে ওর আসার ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ওয়াইফের ডিপেন্ডেন্ট ভিসার জন্য অফিসের যাবতীয় কাজ কারবার সব সম্পন্ন,ওর মুখটা কেমন হবে! দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছে পাবলো।
সত্যিই তো,সেই যে বিয়ে করে একা চলে এল পৃথিবীর বিপরীত গোলার্ধে,অপেক্ষা করতে করতে একটা মেয়ে যে পাগল হতে বসেছে,তা কি ও বুঝছে না! বুঝছে তো বটেই,পাবলো নিজেই যে আর অপেক্ষা করতে পারছে না…
সুন্দরী বৌ ৷ অপেক্ষা কি করা যায় সত্যিই?
রিয়ালি! সত্যি বলছ!
টফির উত্তেজিত মুখটা ফোনের এদিকে বসেও পাবলোর প্রাণে দিল বসন্তের হাওয়ার পরশ।
ইয়েস টফি। আজই ফ্লাইটের টিকিট বুক করে দাও। আমি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
হ্যাঁ অফিসে তো দু মাসের নোটিস পিরিয়ড। কালই পাতা ফেলব। আমায় তো আর অনসাইট দিল না। দু মাস বাদে একদম সোঁওওওও…
না দিক। এখানে আমি তো পি আর অ্যাপ্লাই করেছি। পেয়ে যাব,চিন্তা নেই।
যাই মাকে বলে আসি।
এর দু মাস দশ দিনের মাথায় টফি কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিতেই পাবলোর ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে সাজো সাজো রব।
প্রায় এক বছরের বিরহের খরা কাটবে…
অফিসের বাঙালি কলিগ তথা বন্ধুদের বাড়িতে ডিনারে ডাকল পাবলো। সেলিব্রেশন আজ না হলে আর কবে!
(২)
“…একটু ঘুমোতে দাও টফি। কাল সারারাত ঘুমোইনি,আমার মাথা ব্যথা করছে…উঃ ”
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল পাবলো। যে চিমটিটা টফি কেটেছে তার বিষয়েই কি অভিধানে রামচিমটি লেখা আছে!
“…কী হচ্ছেটা কী!”
“ঘুম বের করছি তোমার।”
সাপের মতো হিসহিসিয়ে উঠল টফি।
“আমার কলকাতার ব্যাঙ্কে পাঁচ লাখ টাকা এখনো যায়নি। হোয়াই! আন্সার মি পাবলো। ”
“এই তো কদিন আগেই তোমার অ্যাকাউন্টে টাকা দিলাম টফি। এ মাসে আমার মাকে টাকা পাঠাতে হবে,মায়ের চোখ অপারেশন… ”
“লিসন। আমি এসব একটাও কথা শুনতে চাই না। তোমার মায়ের নিজের টাকা নেই! তুমি ছেলে না তোমার মা বাবার ইনভেস্টমেন্ট! ”
“কী বলছ কি টফি! এসব কী ধরনের কথা! বাবা মারা যাওয়ার আগে কত টাকা জলের মতো খরচ হয়েছে ওদের,তুমি জানো না! মাকে আমি টাকা দেব না তো কে দেবে!”
“ওসব আমার জানার কথা নয় পাবলো। আমাকে যখন এখানে চাকরি ছাড়িয়ে ঘরের বৌ করে নিয়ে এসেছ তখন তোমার বোঝা উচিত ছিল না যে আমার সব কিছু…”
“হোয়াট আর ইউ সেয়িং! আমি তোমায় চাকরি ছাড়িয়েছি! আমি!”
“আলবাত তুমি। এখানে এসেছি বলেই আমায় রিজাইন করে আসতে হয়েছে…”
“সো! কে বলেছিল তোমায় রেজিগনেশন দিতে! আমি বলেছিলাম! কবে এখানে আসবে তা নিয়ে আমায় প্রতিদিন টেক্সট করত কে! আমি তোমায় এখানে আসার জন্য চাপ দিয়েছি না তুমি আমায় তোমাকে এদেশে আনার জন্য! কোনটা!”
“একদম ফালতু কথা বলবে না। বেশি কথা বললে আমি তোমার নামে পুলিশে কমপ্লেইন করব, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর চার্জে,শুনে রাখো…আর হ্যাঁ কাল সকালেই যেন দেখি আমার অ্যাকাউন্টে মানি ট্রান্সফার কমপ্লিট… টোটাল পাঁচ লাখ। অ্যাম আই ক্লিয়ার মাই বিলাভেড হাজবেন্ড? গুড নাইট।”
পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল টফি ৷ পকেট থেকে মোবাইল বের করল পাবলো। রেকর্ডিং বাটন অফ করল। প্রতিদিনের টফির এই সংলাপগুলো রেকর্ড করে রাখার অভ্যেস করে নিয়েছে ও। প্রমাণ রাখতে হবে সব। যে বিষ গাছ ও অজ্ঞাতসারে আমদানি আর রোপণ করেছে,সেই গাছ ওকে হাজতবাস না করায়,সেই আশঙ্কায়।
গাছও নয়, বিষাক্ত এক কালনাগিনী আজ কয়েকমাস ধরে পাবলোকে বিষের জ্বালায় শেষ করে দিচ্ছে। কীভাবে মুক্তি পাবে তা এই মুহূর্তে ও জানে না। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য রাখতে হবে সঙ্গে,নইলে আত্মরক্ষার আর উপায় থাকবে না।
(৩)
“মায়ের সার্জারি করিয়ে আমি ফিরব। তুমি আজকালের মধ্যে কলকাতায় আমার অ্যাকাউন্টে পাঁচ লাখ সেন্ড করে দেবে ৷”
“আমার কাছে এই মুহূর্তে অত টাকা নেই।”
“ফালতু কথা বলে লাভ নেই পাবলো। ইউ আর মাই হাজবেন্ড। আমার সব কিছুর দায়িত্ব তোমার। বিয়ে করার সময় মনে ছিল না? এই লিসন, বেশি তেন্ডাইমেন্ডাই করলে কলকাতায় গিয়ে তোমার মাকে আমি জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করব। সেটা ভালো হবে কিনা ভেবে নিয়ো। ফোর নাইন্টি এইট এর সব কাগজপত্র আমার রেডি। কারোর বাবা এলেও বাঁচাতে পারবে না আমার বিলাভেড মাদার ইন ল কে। সুতরাং ভালো চাও তো টাকাটা আজই পাঠিয়ে দাও। আমি এলাম। টা টা।”
গা টা শিরশির করে উঠল পাবলোর। টফি লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যেতেই ফোনের রেকর্ডিং বাটন অফ করল। গত এক বছর ধরে অনেক কষ্টে এই রেকর্ড করা অডিও ও বাঁচিয়ে রেখেছে৷ ওয়াশরুমে গেছে ফোন সঙ্গে নিয়ে। পুলিশের ভয়ে কিছুই করতে পারেনি।
এবার সুযোগ। টফি খেয়াল করেনি,ওর ডিপেন্ডেন্ট ভিসার মেয়াদ আর মাত্র একমাস। এই একমাসের মধ্যে না ফিরলে এবং ভিসা নবীকরণ না হলে আর ফিরতেই পারবে না এদেশে। হাতে একটা মাস আছে আর সেই ফাঁকে ওকে যা করার করে ফেলতে হবে। ইন্ডিয়ায় মায়ের ভিসার অ্যাপ্লাই করতে হবে অবিলম্বে।
সেটা একবার হাতে পেলেই…
(৪)
“পাবলো,তুই কি উঠেছিস?”
মায়ের হোয়াটসঅ্যাপ কলে ঘুম ভাঙল পাবলোর।
“হ্যাঁ এই জাস্ট,বলো..”
“কী বদমাইশি করছে ভাবতে পারবি না। সকালে আমায় ফোন করেছে একটা লোক,কে একটা লাল্টু বলে,আমায় যা নয় তাই বলে কথা শোনাচ্ছে ৷”
“কী বলছেটা কী শুনি?”
“বলছে কি,আমি নাকি ওর বৌভাতের শাড়ি চুরি করেছি,তুই জানিস ও আমায় বলেছিল মা আপনি এই শাড়িটা রেখে দিন,এটা আমার পছন্দ নয়,আপনারাই পছন্দ করে কিনেছিলেন,আর তো পরব না,কাউকে দিয়ে দিন,আর আমি তাই টুম্পাকে দিয়ে দিয়েছিলাম,এখন আমায় চোর বলছে,বলে কি,শাড়িটা রেডি করে রাখুন,আমি আনতে যাব।”
“মা একদম ভয় পেয়ো না ৷ মন দিয়ে আমার কথা শোনো,আবার ফোন করলেই বলবে হ্যাঁ আমি যাকে দিয়েছিলাম সে কলকাতায় নেই,এলেই দিয়ে যাবে,একটু অপেক্ষা করুন।”
“পাবলো, এ কী অদ্ভুত মেয়ের পাল্লায় পড়ে গেছি আমরা,এ কাকে পছন্দ করেছিলি পাবলো?”
“মা, আমি অন্তর্যামী নই যে আগেই সব বুঝে যাব…”
“আমার খুব ভয় করে জানিস,তোর বাবাও নেই,আমায় যদি ওরা কিছু করে… জানিস কত ষণ্ডা গুণ্ডা লোকের সঙ্গে মেয়েটার চেনাজানা, মনে হয় পার্টির লোকজন,আমায় থ্রেট করে সারাক্ষণ… তুই ফিরবি কবে বল…”
“মা শোনো,যা বলছি,শোনো,কাউকে বলবে না,আমি গেলে আমাকেও জেলে ভরে দেবে,আমি ভেবেছি কি, তোমায় এখানে নিয়ে আসব আমার সঙ্গে,তোমায় কী কী করতে হবে শুনে নাও ভালো করে…”
(৫)
তিন মাস হয়ে গেছে টফি কলকাতায়,মাসে মাসে জলের মতো অর্থ গুণাগার দিয়ে চলেছে পাবলো। আলিবাবার গুহা ভেবে পাবলোকে ট্র্যাপে ফেলেছিল কি টফি!
তল্লাশির মাধ্যমে জেনেছে পাবলো,ওর বয়ফ্রেন্ডের সংখ্যা প্রচুর।
“এ মাসের টাকাটা এখনো আসেনি পাবলো। জাস্ট রিমাইন্ডার দিলাম।”
ভাবতে ভাবতে টফির ফোন।
“আমি এখন আর টাকা দিতে পারব না। গত একবছরে তোমায় আমি সব মিলে কুড়ি থেকে পঁচিশ লাখ টাকা দিয়েছি। আর এক পয়সা তুমি পাবে না ৷ আর লিসন,আমার উকিল তোমায় চিঠি পাঠাবে,আমি ডিভোর্স ফাইল করেছি,তোমার যা করার করে নিয়ো…”
“হোয়াট!”
“হ্যাঁ, আর শোনো,তুমি এখন আর মন্ট্রিয়লে আসতে পারবে না। হয়তো খেয়াল করোনি, তোমার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ।”
“হোয়াট! তুমি আগে বলোনি কেন তাহলে!”
“আমার বলার কী আছে! তুমি পাসপোর্টে দেখোনি সে তো আমার ভুল নয়!”
“পাবলো,তুমি কিন্তু নিজের আর তোমার মায়ের বিপদ ডেকে আনছ…”
ফোনটা কেটে দিল পাবলো। টফি জানেও না,হোয়াটসঅ্যাপ অডিও কলটা ও কলকাতায় বসেই রিসিভ করেছে,মাকে নিয়ে মন্ট্রিয়াল ফেরার ঠিক আগের দিন…
(এখনকার কথা)
(২)
ফ্লাইট ছেড়ে দিয়েছে। রত্না ঘুমিয়ে পড়েছেন। কতদিন যে ঘুমোননি শান্তিতে।
ভেবেছিল ফুল। ফুলের গাছ রোপণ করার আগে বিষের সন্ধান না পাওয়ায় এই দুর্ভোগ! এই বিষ এবার ঝেড়ে ফেলার অপেক্ষা।
বিষের নাম টফি।
বিষের ওঝার নাম ডিপেন্ডেন্ট ভিসা। ভিসা রিনিউ না হলে মন্ট্রিয়ল ফিরতে পারবে না টফি। ওদেশের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট এর পেপার হাতে এসে গেছে পাবলোর। এখন শুধু ফিরবে বিবাহবিচ্ছেদের শুনানির সময়…
খড়কুটো ধরেই তো বাঁচে মানুষ ডুবতে ডুবতে।।
*************************
কাজরী বসু পরিচিতি :
কাজরী বসু কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সাম্মানিক বাংলায় স্নাতক। স্নাতকোত্তর পড়াশোনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলায় মাস্টার্স করার পর শিক্ষাব্রতী কাজরী নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন। নিজস্ব একক চারটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন কাব্যসংকলনে কবিতা,রহস্য উপন্যাস,গদ্য প্রকাশিত হয়ে থাকে। সঙ্গীতে সমানভাবে আগ্রহী কাজরী নিয়মিত সঙ্গীতচর্চা করেন। গীতবিতান শিক্ষায়তনের গীতভারতী ডিগ্রির পরে শ্রী সুবিনয় রায়ের কাছে দীর্ঘদিন তালিমপ্রাপ্ত। পরিবারে আছেন স্বামী ও একমাত্র কন্যা।