রোদন ভরা হিয়া
নাজির হোসেন বিশ্বাস
দোতলার ব্যালকনিতে নরম রোদ বিড়াল ছানার মত খেলায় মত্ত। সাদা মার্বেল পাথরের বারান্দাটি ঝকঝক করছে। এককোণে সুন্দর কারুকার্য খচিত রঙিন পাথরের টবে মানিপ্ল্যান্টের লকলকে লতাটি সবুজ পাতার ঢেউ তুলে পাশের রেলিংয়ে ভর দিয়ে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। নীচের সবুজ লন জুড়ে নানা রকম দেশী বিদেশী ফুলেরা মাথা দুলিয়ে আলাপন জুড়েছে।ভুবন ডাঙ্গার এই দ্বিতল বাড়ির মালিক সুবিমল বোস। এই মুহূর্তে ব্যালকনিতে সকালের সোনারঙা রোদ্দুরটুকু উপভোগ করছেন। ডিসেম্বরের শেষ, ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে বসেছে, গাছের পাতায় শিশির বিন্দু রোদের আলোয় হীরকদ্যুতি বিচ্ছুরণ করছে অকৃপণ ভাবে।
এমন সময়ে গুটিগুটি পা’য়ে এসে দাদার অদূরে দাঁড়িয়ে, কোন ভণিতা ছাড়াই নির্মল বলে উঠলো,
-“দাদা আমার পক্ষে আর এই বাড়িতে থাকা কোন ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না…আলাদা হতে চাই”।
হতভম্ব দাদা কোন কথা না বলে ফ্যালফ্যাল করে ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইলেন।
–“না দাদা চুপ করে থাকলে চলবে না, বিদিশাও চায় না, এই মফস্বল অঞ্চলে পড়ে থাকতে, সবাই চায় একটু স্বাচ্ছন্দ্য, প্রয়োজনে বাড়ি ভাগাভাগি করে নাও।”বলেই গটগট করে নির্মল বাবু দোতলার ব্যালকনি থেকে চলে গেলেন।
সুবিমল বাবু ছোট ভাইয়ের অপসৃয়মান পথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পৌঁছে গেলেন স্কুল জীবনে।
–“সুবিমল তোকে নিয়ে আমি ভীষন গর্বিত, আমি জানি তুই-ই পারবি স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করতে। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমি পাশে রয়েছি।” বলেই ফুলমনি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সুবিমলের গায়ে হাত রাখলেন। তাঁর স্নেহস্পর্শে সুবিমলের চোখের কোণা ভিজে উঠলো।
স্কুল থেকে ফিরেই অসুস্থ বাবার ঘরে গিয়ে শিয়রে বসে বলে,
-“বাবা এখন কেমন আছো? ব্যথাটা কমেছে”?
–“সুবি এসেছিস?” বলেই শীর্ণ হাত দিয়ে সুবির হাতটা ধরে বলে,
-“সুবি আর বোধ হয় বাঁচবো না, তোর ছোট ভাই বোনটিকে আগলে রাখিস। ওদের যে তুই ছাড়া কেউ নেইরে! তোর মা যে আমাকে ডাকছে।”
–“তুমি কী বকছো বাবা? তুমি ভালো হয়ে যাবে, আমি ডাক্তার ডেকে আনছি…”
–“ডাক্তার কাকু বাবার অসুখটা খুব বেড়েছে, একটু চলুন না!“
-“ওষুধগুলো ঠিকঠাক খাইয়েছিলিস? বাড়াবাড়ি বলছিস, চল দেখেই আসি।”
ডাক্তার বাবু ঘরে ঢুকে আধ ময়লা কাঁথায় শোয়া অখিল বাবুর হাতটা ধরেই চমকে উঠলেন, স্টেথো লাগিয়ে বুঝলেন, সব শেষ। হতাশ গলায় বলে উঠলেন,
– “সুবি তোর বাবা…”! বলেই ডাক্তার কাকু মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেলেন।
মৃত বাবাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সুবি। তার ছোটভাই বোন তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। তাদের কি সর্বনাশ হয়ে গেছে। দুই ভাইবোন বলে চলেছে,
– “দাদাই কাঁদছিস কেন?”
–“কোথায় কাঁদছিরে?“ সুবির কান্নার সময় কোথায়? ওর কত কাজ এখন। ছোট ভাইবোনকে লেখা পড়া শেখানো, মানুষ করা। কত দায়িত্ব।
–“কিগো তুমি এখানে চুপ করে বসে আছো? নিমু না খেয়ে বেরিয়ে গেল, ওদিকে অঞ্জনাও ফোন করেছিলো, কি বলছে ফোনে শুনবে না?”
তখন নদীর পাড় ভাঙ্গার মত নীরবে সুবিমল বাবুর বুক ভাঙছে, কিন্তু মুখে বললেন,
-“কি বলছে অঞ্জনা”?
–“বাড়ি ভাগ না কি সব বলছে!”
–“নিমুও বাড়ি ভাগাভাগি করে দিতে বললো।”
–“ভাগাভাগি! নিমু! ওদের বুকে পিঠে করে মানুষ করলাম, তাছাড়া কি ছিল তোমার বাবার? হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, ওদের মানুষ করেছো। তোমার এই সাফল্যের পেছনে কী অবদান রয়েছে ওদের, ভাগ চাইছে?”
–“ওরা ছেলে মানুষ, কি বলতে কি বলছে, সব ধরলে চলে? তাছাড়া ওরা ঠিকই তো বলেছে। বাবার সম্পত্তির ভাগ তো চাইবেই।”
–“বাবার সম্পত্তি মানে? কি ছিল তোমার বাবার? সেই তো টালির চালা দেওয়া এক কামরা ঘর। ওরা কী খাবে, কী পরবে তাই নিয়ে দিনরাত্রি এক করে পরিশ্রম করেছো। এই তার প্রতিদান?”
–“আর এক কাপ চা খাওয়াতে পারো কুশিলা? গলাটা শুকিয়ে গেছে।”
–“গলার আর দোষ কী, রক্ত জল করে ওদের আগলে রেখেছো, পড়াশোনা শিখিয়ে ইঞ্জিনিয়ার করলে, অঞ্জনাকে কলেজ পাশ করিয়ে উচ্চ শিক্ষিতা করে, দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিলে। কী করোনি ওদের জন্য?”
সুবিমলের যখন বিয়ে হয়, ওরা দুজন পঞ্চম ও সপ্তম শ্রেনীতে পড়ে। পাড়া প্রতিবেশীর অনুরোধে সুবিমল বিয়ে করেছিল, মাতৃহারা ভাইবোন সময় মতো খেতে পাবে, মায়ের স্নেহ পাবে। কুশিলাও মায়ের স্নেহ দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সুবিমল বাবু বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন। ছোট ভাইবোনকে কুশিলার হাতে তুলে দিয়ে, ব্যবসার জন্য দিনের পর দিন বাইরে কাটিয়েছেন।
–“দাদা কি ভাবছেন অত? খেয়ে নিন।”
–“আসলে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে রে। তোর বৌদিরা কি করছে কী জানি?”
–“না খেলে যে আপনার শরীর ভেঙ্গে পড়বে? এত পরিশ্রম সইবে?”
–“বাবাকে মৃত্যু শয্যায় কথা দিয়েছি, মানুষ ওদের করতেই হবে। এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য, বুঝলি আলমগীর?”
চায়ের কাপ দিয়ে,
– “ভেতরে ভেতরে পুড়বে তবুও কোন কথা বলবে না। ফুলশয্যার রাত থেকে তোমাকে দেখছি, শুধু ওদের কথাই ভেবেছো। আজ কী ব্যবহার ফেরৎ পেলে?”
–“তাহলে কি ওদের জলে ফেলে দিলে ভালো হতো? তুমিই কী পেরেছো ফেলে দিতে?”
–“তাহলে বসে অত কী ভাবছো? সব দিয়ে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ো।”
–“শোনো, এই বাড়ি নির্মলকে দিয়ে দেব। আর মোড়ের মাথায় যে অনুষ্ঠান বাড়িটা আছে, অঞ্জনাকে দিয়ে দেব।”
–“বাহ্ খুব ভালো সিদ্ধান্ত তোমার। আমরা কোন চুলোয় যাবো শুনি? নিজের ছেলেটা কোথায় যাবে?”
–“তুমি ভাবছো কেন? আমি তো বেঁচে রয়েছি নাকি? একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
–“যা ভালো লাগে করোগে, আমি কিছু জানি না”। বলেই রাগ দেখিয়ে নীচে চলে গেলেন কুশিলাদেবী।
–“বাবা, কাকাইকে এ বাড়ি লিখে দেবে? আমরা আর এ বাড়িতে থাকব না?”
–“আয় বিশাল, এ বাড়ি থেকে যেতে তোর বুঝি খুব কষ্ট হবে? আমরা যদি দূরে কোথাও চলে যাই, পারবি না আমার সঙ্গে যেতে?”
–“মা নীচের ঘরে কান্নাকাটি করছে। মা কি যেতে পারবে? এই বাড়ি যে মা নিজের হাতে তৈরী করেছে।”
–“আরে তোর মা কাঁদুক। দেখবি মেঘে যতই বৃষ্টি হোক এক সময়ে ঝলমলে রোদ উঠবে।”
–“বাবা আমার এবারে ফাইনাল ইয়ার। কোর্সটা কমপ্লিট হলেই আমিও চাকরী পেয়ে যাবো, তখন আর তোমাদের কষ্ট হতে দেব না।”
–“সুবিমল বাবু হো হো করে হেসে উঠলেন এই তো বাপের ব্যাটার মত কথা। তুই থাকতে আমার কষ্ট কিসের রে?”
কাদঁতে কাঁদতে কুশিলাদেবী উপরে উঠে আসে।
–“এই অবস্থায় তোমার হাসি আসে কোথা থেকে? তোমার বুকে কি পাথর বসানো রয়েছে? হাজার দুঃখেও কোন দিন কাঁদতে দেখিনি। সব হেসেই উড়িয়ে দিয়েছো। কিন্তু আমি জানি তোমার
কে যন্ত্রণা কিলবিল করছে।”
ডিনার টেবিলে বসেই সুবিমল বাবু বলে উঠলেন, “নিমুরা খাবে না? ওদের ডাকো।”
–“না দাদা আমরা বাইরে খেয়ে এসেছি। কী ভাবলে সকালের কথাটা দাদা?”
–“ঠিক আছে যা চাইছিস পাবি, বিদিশাকে ডাক একসঙ্গে খেয়ে নিই। একা একা তো কোনদিন খাই নি।”
–“না দাদা বিদিশা আসবে না। তুমি কী সিদ্ধান্ত নিলে সেটা শুনতে চাই।”
–“এখনই শুনবি?”
–“হ্যাঁ আমি কোন কাজ ফেলে রাখা পছন্দ করিনা।”
“ঠিক আছে অঞ্জনাকে ভিডিও কল কর।”
–“হ্যাঁ ছোটদা বল।”
“দাদা তোর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলবে, মোবাইলটা অন কর।”
–“তুমি আগে খাওয়া দাওয়া করে নাও, খেয়ে কী কথা বলা যাবে না?”
–“না বৌদি একদিন না খেলে কোন কিছু হয় না, কথাটা আগে হয়ে যাক।”
–“আমি ভেবেছি, এই বাড়ি তোকে দিয়ে দেব, আর অঞ্জনাকে অনুষ্ঠান বাড়িটা। তোদের কী সম্মতি রয়েছে?”
–“আর কিছু দেবে না? মানে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স?”
–“ব্যাঙ্কে তেমন টাকা নেই, ছেলের নামে দশ লাখ ফিক্সড আছে, আর তোর বৌদির নামে পাঁচ লাখ টাকা।”
–“সত্যি বলছো দাদা? তাহলে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তুমি কোথায় যাবে?”
–“আরে এখনও আমি শক্ত রয়েছি, তোর বৌদিকে খেটেখুটে ডালভাত খাওয়াতে পারবো।”
–“বেশ তাই হবে। আমি রাজি। অঞ্জনা তুই রাজি?”
–“রাজি, কিন্তু বড়দা সকালে পাল্টি খেয়ে যাবে নাতো?”
–“নারে বোন পাল্টি খাবো না, ভরসা রাখতে পারিস, ঠকাবো না। তাহলে কুশিলা তোমার ব্যাগ গুছিয়ে নাও গে, আমরা সকালেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”
–“সে তো যাবে কিন্তু সোনাদানা নিয়ে তো কোন কথা হলো না।“
–“সে সকালে ব্যাগ পত্তর সার্চ করে নিস।”
–“দুধ কলা দিয়ে আমি এতদিন কাল সাপ মানুষ করেছি। শেষ বেলায় তোরা মানুষটাকে এই প্রতিদান দিলি?” বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো কুশিলা।
“আরে কাঁদ কেন কুশিলা? ছোটদের অমন করে বলতে নেই।”
–“না বলতে নেই? তুমি কী মানুষ? জানি না তোমার মনটা কি দিয়ে তৈরী”। বলেই হাত–পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলো বড় বৌ কুশিলাদেবী।
আর সুবিমল বাবু দেওয়ালে ঝোলানো বাবার ফটোটার দিকে চেয়ে রইলেন…….।
************************************
নাজির হোসেন বিশ্বাস পরিচিতিঃ
নাজির হোসেন বিশ্বাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। পেশায় রাজ্য সরকারের স্কীম, স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পের, প্রকল্প সহায়ক। লেখালেখি সেই স্কুল জীবন থেকে। পত্রপত্রিকায় কিছু কবিতা গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ভালো গল্প কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক।