শিরোনাম স্নেহের-পরশ
কলমে – রিমা মজুমদার
মা,দেখো না,দাদাভাই আমার পুতুলটা নিয়ে নিয়েছে…ওওওও…মাআআআ.. বোনের এই নাকি কান্নাটা বেশ উপভোগ করে ছোট্ট পাবলো!..তাই হাততালি দিয়ে বলতে থাকে দেবো না..দেবো না!!..কি করবি!যা আরো কাঁদ গিয়ে ..মা কে বল গিয়ে.. পাবলোর কথাটা শেষ হতে না হতেই ওদের মা দীপা দুম করে পাবলোর পিঠে একটা কিল মেরে বলে, –অসভ্য ছেলে কোথাকার!!..সবসময় ছোট বোনের পিছনে লাগা ..খালি ওর জিনিস নিয়ে কেন এত টানাটানি করিস বল!পাবলোর হাত থেকে টান মেরে টুকুর পুতুলটা ছিনিয়ে নেয় দীপা!আজ আসুক বাবা তারপর তোর হচ্ছে দাঁড়া.. পাঁচ বছরের ছোট্ট টুকুকে নিয়ে পাবলোর সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায় দীপা,বারো বছরের পাবলোর দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করে না ও। ঠাম্মির ঘরে খাটের একটা কোণায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে কাঁদতে থাকে পাবলো..
—’বাবা গো!..আর পারিনা..’ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাঁটুর ব্যথায় কাহিল অনিমা নিজের ঘরে ঢুকে নাতিকে কাঁদতে দেখে বলেন
––দাদুভাই!..ও দাদুভাই..দেখি, দেখি হয়েছেটা কি?…এ..মা এত্ত বড় ছেলের চোখে জল.. ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে পাবলো বলে
—মা সবসময় আমাকে এমন করে!..একটুও ভালোবাসে না,শুধু বোনুকে ভালোবাসে মা।ছোট্ট পাবলোর মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে অনিমা দেবী বলেন “ছিঃ দাদুভাই!..এমন কথা বলতে আছে?..মা যে আজ তোমার পছন্দ মত মাংস রান্না করেছে! তুমি কেন ছেলে হয়ে ছোট বোনের পুতুল নিয়ে টানাটানি কর ,সেটা বল! এ তো ভারী অন্যায়.. ঠাম্মির কথায় আরো কেঁদে ওঠে পাবলো
—ওই দেখো ছেলের কান্ড!…তুমি না বড় দাদা ,তুমি কি মেয়ে!..যে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্নাকাটি করছ!.. ঠাম্মির কথায় একটু যেন প্রতিবাদের সুরেই বলে ওঠে পাবলো
— আমার কি কষ্ট হয় না?..
—ওরে বাবা !তুমি না ছেলে!বাবাকে কখনো দেখেছো কাঁদতে?..যারা পুরুষ মানুষ হয় তারা কখনো কাঁদে না.. ঠাম্মির কথায় খানিকটা অবাক হয়েই পাবলো বলে ওঠে
—কেন কাঁদলে কি হয় ঠাম্মি! নাতির কথায় এবার যেন বেশ খানিকটা বিরক্ত হন অনিমা দেবী,একটু বিরক্তি মেশানো কন্ঠেই বলে ওঠেন
—তুই কি মেয়ে?..মেয়েরা এমন কথায় কথায় কাঁদে! নিজের চোখ দুটো মুছতে মুছতে পাবলো বলে
—আমার কষ্ট হলে চোখে যে জল আসে ঠাম্মি! এবার নাতিকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে অনিমা বলেন
—চোখে জল এলেও সবার সামনে কাঁদবে না, তুমি ছেলে!..পুরুষ মানুষদের ওরকম ছিঁচকাঁদুনে হলে চলে না। আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে পাবলো।লম্বায় এখন দীপাকে ছাড়িয়ে গেছে,গলার স্বরেও এখন আমূল পরিবর্তন!..নাহ্ আগের মত ছোট বোনের পিছনে আর লাগে না পাবলো!তার পরিবর্তে টুকুকে রাস্তা ঘাটে,কোচিং ক্লাস থেকে ফেরার পথে যত্ন করে আগলে রাখে পাবলো,পাছে বোনের কোন বিপদ হয়! ছোটবেলার ভাই বোনের সেই খুনসুটির পরিবর্তে টুকুর মনের অনেক খানি জায়গা জুড়ে ওর একমাত্র বড় দাদা পাবলো। টুকু খেয়াল করে,ওর দাদাটি বেজায় গম্ভীর,না আছে তার কোন বায়না না আছে কোন শখ!..বরং বাবা শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়ার পর সংসারের হাল নিজের কাঁধে তুলে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি পাবলো।সংসারের সমস্ত খরচ,বাবার ওষুধপত্র,টুকুর কলেজের খরচ,উপরোন্তু ওর যাবতীয় হাতখরচ হাসি মুখে বহন করে যায় পাবলো।
কেন জানিনা আজকাল দাদার জন্য বড্ড কষ্ট হয় টুকুর।বিশেষ করে নিজের হাতখরচের টাকাটা দাদার থেকে নিতে বেশ খারাপই লাগে ওর,তাই পাবলোকে না জানিয়ে নিজে কতগুলো ছোট ক্লাসের বাচ্চাকে টিউশন পড়াতে শুরু করেছে । কলেজ থেকে ফেরার পর টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফেরার পথে, পরিচিত গম্ভীর গলায় চমকে ওঠে টুকু,অস্ফুটে স্বরে শুধু বলে
—দা…দা.. নিজের বাইকটা টুকুর সামনে দাঁড় করিয়ে ঠান্ডা দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলে
—হ্যাঁ… দেখতে এসেছিলাম তুই কেমন কলেজ থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরীতে পড়িস !মাথা নিচু করে টুকু বলে
–না…! মানে দাদা..অ্যাকচুয়েলি একটা বাচ্চাকে পড়ানোর জন্য বলেছিল…..আমিও ভাবলাম যে….টুকুর কথা শেষ হওয়ার আগেই পাবলো বলে—চুপচাপ বাইকে উঠে বস! …..তোকে এত পাকামো করতে কে বলেছে !…আগে মন দিয়ে পড়াশুনো কর!.তারপর রোজগারের কথা ভাববি।
দাদা…..আর কোন কথা না!..তোর মাথার উপর আমি আছি..চিন্তা করিস না কেটে গেছে আরো পাঁচটা বছর! …..টুকু এখন একটা স্কুলের শিক্ষিকা। রবিবার একটা ছুটির দিন বেশ আরাম করেই বেলা অবধি বিছানায় শুয়েছিল ও।ঘর থেকেই শুনতে পায় ওর মায়ের গলা –পাবলো …বাবা!..বোনের তো বয়স বাড়ছে!..এবার তো আস্তে আস্তে বিয়ের ব্যবস্হা মায়ের কথার মাঝেই গুরুগম্ভীর স্বরে পাবলো বলে –আমি ও তাই ভাবছিলাম মা..কিন্তু টুকের যদি নিজের কোন পছন্দ থাকে–ধুস !..আমার মেয়েকে আমি ভালোই জানি!..ওসব কিছু নেই ….ঠিক আছে….তাহলে দেখো যদি কোন ভালো ছেলের খোঁজ —ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না!..আমারই এক বান্ধবীর ছেলে,ইঞ্জিনিয়ার!..টুকুর ছবি দেখে ওদের খুব পছন্দ….মানে ওদের পছন্দ !..কিন্তু বোনুকে কি তুমি দেখিয়েছো ছেলের ছবি টা..? ওর ও তো একটা মত আছে!একটু যেন উত্তেজিত হয়ে ওঠে পাবলো না আর নিজের ঘরে চুপ করে শুয়ে থাকতে পারে না টুকু!..ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তাই ওর মা কে বলে….মা এত কিছু আগে থেকে যখন ঠিক করে রেখেছ?তাহলে দাদা কে আর বলার কি আছে?…খরচা পাতি সামাল দেওয়ার জন্য? মেয়ের কথায় খানিকটা যেন বিরক্ত হয় দীপা,কড়া দৃষ্টি তে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে — কি ভাবে কথা বলছিস টুকু! …. বেপরোয়া ভঙ্গিতে টুকু বলে —যা বলছি ঠিকই বলছি মা!..দাদার দিকে তাকিয়ে দেখেছো কখনো?..শুধু চাহিদা আর চাহিদা..দাদার ও তো বিয়ে দেওয়া টা দরকার!..সেটা তো মনে আসে নি তোমার কখনো… মেয়ের কথায় এবার গলা চড়ায় দীপা — তুই থাম!..ঘরে ছোট বোন থাকলে দাদা হিসাবে প্রতিটা ছেলেরই কর্তব্য থাকে!….পরিস্থিতি সামাল দিতে ঠাট্টার সুরে পাবলো বলে….বাপ রে বাপ….তুই যা ঝগড়ুটে মেয়ে !! তোকে বিদায় না করে আমি বাবা বিয়ে করছি না…সেদিন প্রথম টুকু খেয়াল করে ওর দাদার আড়াল করা চোখের জল! ….ওই দমফাটা হাসির আড়ালে বুক ফাটা কান্না চেপে রাখার কি অদম্য ইচ্ছা ওর দাদাভাইয়ের,তাই রাগের বশেই ও বলে বসে…সহেলি দি কেন তোমাকে ছেড়ে দিল বল দাদা!..কিসের জন্য নিজের ভালোবাসাকে তুমি..টুকু জানে সহেলির সঙ্গে ওর দাদার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারন পরোক্ষ ভাবে ও নিজেই! ….সহেলির বাড়ির লোক মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল,কিন্তু সংসারের চাপ,বোনের পড়াশুনো সব কিছু মিলিয়ে পাবলোর পক্ষে সম্ভব হয় নি অত তাড়াতাড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসা সম্ভব হয় নি পাবলোর!…আর তাতেই সম্পর্কের ইতি টেনেছে সহেলি–তুই থামবি বোন! ….খুব বড় বড় কথা হয়েছে না? এটুকু বলেই ডাইনিং রুম ছেড়ে ব্যস্ততার সঙ্গে বেরিয়ে যায় পাবলো! ….আর ওর চলে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে টুকু। শুধু আপন মনে একটা কথাই বলে..এত ত্যাগ কিসের জন্য দাদা!..শুধুই কি ছেলে হয়েছিস বলে!..শুধু ছেলে বলে কি নিজের কষ্ট গুলোকে এভাবে মনে চেপে রাখবি তুই! খুব ধুমধাম করে বোনের বিয়ের আয়োজন করে পাবলো। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সকলের মুখে এক কথা….পাবলোর মত ছেলেই হয় না! ….নিজের সন্তান সৌভাগ্যে গর্বের হাসি হাসে দীপা! বিদায় বেলায় টুকু যখন আপনজনকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় আকুল, কাঁদতে কাঁদতেই পাবলো কে জড়িয়ে ধরে ও…দাদা আমাকে কেন পর করে দিলে?..তোমাদের কে না দেখে কি করে থাকব আমি? বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে পাবলো বলে..ধুর পাগলি!! ….আমি তো আছি! ….ইচ্ছে হলেই চলে আসবি এখানে..আর আমি যখন তখন তোর বাড়ি গিয়ে হামলা করব দেখিস….টুকু চলে গেলে,একবুক ব্যথা নিয়ে ওর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে পাবলো..বোন ছাড়া যে এ বাড়িতে ও নিজেও খুব অসহায়!..আজ বড্ড কষ্ট হলেও নিজের চোখের জলকে আড়াল করে মায়ের পাশে দাঁড়ায় পাবলো!ও ভেঙে পড়লে যে মা আরো ভেঙে পড়বে!! সাত বছর পর….টুকটুক নিজে এখন মা, পাঁচ বছরের জিকোকে নিয়ে ওর সুখের সংসার। সেদিন দুপুরে খাওয়ার তৈরীতে ব্যস্ত ছিল টুকু,এমন সময় ব্যালকনিতে বল খেলতে গিয়ে পড়ে যায় ছোট্ট জিকো। জিকোর কান্না শুনে ওখানে ছুটে যায় টুকুর শাশুড়ি। রান্নাঘর থেকে ও শুনতে পায়..ওর শাশুড়ি মা জিকোকে বলছেন..ছিঃ!!..তুমি না ছেলে!..ছেলেরা কি এমন ভাবে কাঁদে নাকি..শাশুড়ির আজকের কথাটা হঠাৎ করেই যেন বড্ড কানে লাগে ওর!…তাহলে কি দাদার মতই আজীবন..! একথা ভাবতেই এক অজানা আশঙ্কায় যেন বুক কেঁপে ওঠে টুকুর…রান্নাঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে ও বলে….”মা…ওকে কাঁদতে দিন..ব্যথা লেগেছে তাই তো কাঁদছে!..ছেলে বলে কি ওর কোন কষ্ট নেই? কাঁদতেও নেই!…” জিকো কে কোলে নিয়ে ওর কপালে হামি খেয়ে টুকু বলে..”তোকে আমি বড় করবো মানুষের পরিচয় দিয়ে বাবু !..ছেলে হিসাবে নয়!..”
সমাপ্ত
***************************
রিমা মজুমদার পরিচিতি
বাসন্তী দেবী কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর।ছোটবেলা থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা,ভালোলাগা থেকে শুরু কলমের আঁকি-বুকি। স্কুল কলেজে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে গল্প লেখার সূচনা,বর্তমানে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা, গল্পসংকলনে ছড়িয়ে রয়েছে তার সৃষ্টি গুলি।