ব্যান্ডেল চার্চ এবং তৎকালীন ইন্ডিয়া
সুলগ্না চক্রবর্তী
খবর পাওয়া মাত্র মাহমুদ শাহ চোখে অন্ধকার দেখলেন। কী করবেন ভেবে পেলেন না। পশ্চিম থেকে শেরশাহ আসছে তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে। এই আক্রমণ রুখে দেওয়ার মতো লোকবল তাঁর কাছে থাকলেও তা যে খুব একটা কার্যকর হবে না তা তিনি জানতেন। তাই খবর পাঠালেন গোয়াতে পর্তুগীজদের কাছে , সাহায্যের জন্য। পর্তুগীজরা সাহায্য করতে রাজি হলো একটা শর্তে। মাহমুদ শাহ ভেবে দেখলেন আগে তো রাজ্য সামলানো যাক তারপর পর্তুগীজদের ব্যবসা করার অধিকার নিয়ে ভাবা যাবে। রাজি হয়ে গেলেন তিনি।
মাহমুদ শাহের রাজ্য আক্রমণ করলেন শেরশাহ বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে। পর্তুগীজদের কিছু করার ছিলো না এবং গৌড় দখল হলো। শেরশাহ প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে গৌড় ছাড়লেন আর এই যুদ্ধে পূর্ব শর্ত অনুযায়ী পর্তুগীজরা গৌড়ে বাণিজ্য করার অধিকার পেলো। যখন সপ্তগ্রামে পর্তুগীজরা বাণিজ্য করে মোটা লাভের মুখ দেখবো দেখবো করছে তখন সরস্বতী আর বাণিজ্যের নদী হিসাবে শুকাতে শুরু করেছে। এই সব দেখেশুনে পর্তুগীজরা ভাগিরথীর পাশেই নিজেদের কলোনি স্থাপন করলো। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লো উগুলীর (হুগলি) নাম। অসংখ্য পর্তুগীজ ভীড় করলো উগলীতে। বেশিরভাগের সাথেই সরকারের কোন সম্পর্ক ছিলো না।
শুধু কী তাই এরা পয়সার জন্য ইস্তাদো দা ইন্ডিয়ার মানে নিজের লোকেদের ক্ষতি করতেও দ্বিধা বোধ করতো না। করবেই বা কেন তারা যে ক্যাসাদো। উঁচু সমাজের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই এবং অন্যান্য সুবিধাও নেই যা ফিদেলদোরা পায়। এমন কী গির্জাতেও ফিদেলদো ও ক্যাসাদোদের একসাথে বসার অনুমতি নেই। কী কারণে তারা সন্মান দেবে ইস্তাদো দা ইন্ডিয়াকে?
গোয়ার ইস্তাদো দা ইন্ডিয়ার লোকেরা এ খবর জানতো ও বুঝতো। তাই তারা চেষ্টা করলো এইসব ক্যাসাদো বা প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে। ইস্তাদো দা ইন্ডিয়ার উৎসাহে উগলীর কাছে সৃষ্টি হলো গির্জা। এই গির্জার ফাদারের বেশ কিছু কাজ ছিলো যা ধর্মের সাথে কোনো ভাবে যুক্ত ছিলো না। যেমন উগলীর বাণিজ্যের খবর গোয়াতে পাঠানো, ধর্মের নাম করে বেপরোয়া ক্যাসাদোদের লাভের কিছু অংশ গোয়াতে পাঠানো, আশেপাশের গ্রাম লুঠ করে মানুষ এনে তাদের হাতের চেটো ফুটো করে বেত দিয়ে বেঁধে বিক্রির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ১৫৯৯ সালে তৈরী হওয়া চার্চে ফাদারের প্রধান কাজ ছিলো ক্যাসাদো আর ফিদেলদোর মধ্যে যোগাযোগ রাখা। এইরকম করেই চলছিলো সবকিছু ১৬৩২ সাল অবধি।
১৬৩২ এ শাহজাহানের নির্দেশে হুগলী আক্রমণ, চার্চের ক্ষতিসাধন, পর্তুগীজদের বন্দী করে আগ্রাতে নিয়ে যাওয়া, সেখানে চার্চের ফাদারকে হাতি দিয়ে দলতে গেলে হাতি শুঁড় নিয়ে পিঠে বসানোর মতো অদ্ভুদ ঘটনা, শাহজাহানের ৭৭৭ বিঘা জমি ফাদারকে আবার ফেরত পাঠানো সবই আজ ইতিহাস । ১৬৩৩ থেকে উগলী মানে হুগলী নয়, পর্তুগীজদের নতুন বন্দর হলো বনহুগ মানে ব্যান্ডেল।
বন্দর হয়তো পর্তুগীজদের মুখে বনদেল হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বনদেল শব্দ পর্তুগীজ ভাষাতেও আছে যার অর্থ হলো জাহাজের মাস্তুল । যারা পুরানো জলযান নিয়ে পড়াশোনা করে তারা বলে এই বনদেল বন্দরে নাকি বেশীরভাগ জাহাজ ছিলো ক্যারাভেল প্রকৃতির। এই জাহাজ তৈরী হতো হালকা কাঠ দিয়ে ও জাহাজের তিনটি পাল থাকতো। এই জাহাজ বেশ দ্রুতগামী ছিলো এবং এর মাস্তুল থেকে রংবেরঙা ঝাণ্ডা উড়তো পতপত করে যা পর্তুগীজদের নিজেদের অস্মিতা প্রকাশ করত স্বদর্পে । সেই থেকেই জায়গাটার নাম বন্দেল হয়েছিলো। যা পরে বাঙালীদের মুখে ব্যান্ডেল হয়ে যায়।
যাক সে সব কথা। ১৬৩২ সালে মোগলদের আক্রমণে গীর্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। এটা ছিলো বাংলায় নির্মিত খ্রিস্টানদের প্রথম উপাসনা গৃহ । ১৬৪০ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যে আবার নির্মিত হয় । তবে এই গীর্জা আবার আক্রান্ত হয় সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার হাতে যখন সিরাজ উদ-দ্দৌল্লা কলকাতাকে আলীনগর করে ফিরছিলেন। তার পরের বছর মানে ১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধের সময় গীর্জা হয়ে যায় ইংরেজদের সামরিক শিবির। এই গীর্জা আজও দাঁড়িয়ে আছে পাঁচশো বছরের ইতিহাস নিয়ে। মিথ আর মিথ্যা একাকার হয়ে গেছে । এর মধ্যে দুটো মিথ আজও জনপ্রিয় স্থানীয় লোকেদের কাছে। একটা মা মেরীর মূর্তি নিয়ে আর একটা জাহাজের মাস্তুল নিয়ে। মনে করা হয় এখানকার মেরী মাতার মূর্তি ছিলো হুগলীর আর এক চ্যাপেলে। ১৬৩২এ যখন মোগলদের আক্রমণ হয় তখন এক পর্তুগীজ এই মূর্তিটি নিয়ে নদী পেরিয়ে পালাতে গেলে মূর্তিটির সলিল সমাধি ঘটে। পরে যখন ব্যান্ডেল চার্চ আবার নির্মিত হয় তখন চার্চের ফাদার রাতে দৈববাণী শোনেন ও সকালে নদীর ধার থেকে মেরী মাতার মূর্তিটি উদ্ধার করেন। আর একটা গল্প হলো এক পর্তুগীজ জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়লে মনে মনে মানত করেন যে ঝড় থেকে রক্ষা পেলে যে গীর্জা চোখে প্রথম দেখবেন সেখানে জাহাজের মাস্তুল দান করবেন। সেই মাস্তুল এখনো আছে যা ৩৫ ফুট লম্বা শক্ত কাঠের তৈরী। আগে গীর্জা সংলগ্ন কারখানাতে থাকতো এখন আছে গীর্জার নিজস্ব সংগ্রহশালায়।
ব্যান্ডেলের এই গীর্জার এক আলাদা গুরুত্ব আছে। এটা বাংলার প্রথম গীর্জা। এখানে সেন্ট নিকোলাস এবং লেডি রোজারি দুই জনের কাছেই প্রার্থনা নিবেদন করা হয়। এই চার্চে অনেক ক্যাপ্টেনই আসতো জাহাজ ছাড়ার আগে প্রার্থনার জন্য। প্রার্থনা করতো যাত্রা যাতে শুভ হয়। আজও নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে নভেনা প্রেয়ার হয়। আশেপাশে তো বটেই কলকাতা থেকেও অনেক খ্রিস্টান ধর্মালম্বীরা এই সময় আসে। এদের মধ্যে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ও সামাজিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত যারা, তারা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চলে যায় গোয়াতে। সেখানে বোম জেসাস ব্যাসিলিকাতে রক্ষিত সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্সের অবিকৃত দেহ নিয়ে যে বিশেষ অনুষ্ঠান হয় তাতে অংশগ্রহণ করে,।এই অনুষ্ঠানে ব্যান্ডেল চার্চ থেকে আগত অতিথিরা বিশেষ মর্যাদা পায় ।
এই বিশেষ মর্যাদা পূর্ণ অবস্থান কেন তা নিয়ে উত্তর দিতে গেলে ব্যান্ডেল চার্চের সাথে গোয়ার চার্চের সম্পর্ক জানা দরকার। ব্যান্ডেল চার্চ শুধু যে বাংলার প্রথম চার্চ ছিলো তাই না, এই চার্চ বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করতো। যদিও এই চার্চ কেরালার কোচিন শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলো কিন্তু এখানকার অগষ্টানিয়ানরা আসতো গোয়া থেকে। ১৭৯৭ অবধি তারা পর্তুগীজ সম্প্রদায়ের সব রকম সমস্যার সমাধান করতো। একমাত্র ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট তাদের হাতে ছিল না। বাংলা থেকে টেক্সটাইল ও সল্টপিটার পাঠানোর দায়িত্ব তারাই নিতো। কারা পর্তুগাল ও ব্রাজিল যাবে সেই সিদ্ধান্ত তারা নিতো। এই ব্যাপারে কেরালার কোচিন ও তামিলনাড়ুর মাইলাপুর থেকে অনেক বেশী ক্ষমতা ভোগ করতো ব্যান্ডেলের চার্চ।অনেক সময় ব্যান্ডেল চার্চের অগষ্টানিয়ানদের বলা হতো ব্রাজিলে ভালো তাঁতী পাঠাতে। ১৬৯৪ এ চার্চের ফাদার ফ্রান্সিস্কো দি আশামকা আশে পাশের অঞ্চল থেকে ভালো তাঁতী ব্রাজিলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ব্রাজিলে সল্টপিটার আবিষ্কৃত হলেও ব্যান্ডেলের ফাদার দক্ষ শ্রমিক পাঠান। অনেক সময় এইসব ফাদার গোয়ার চার্চের কথা অগ্রাহ্য করত। ১৭০৪ এ গোয়া থেকে নির্দেশ আসে বাংলাতে যেসব চার্চের ফাদাররা নিজেদের ব্যবসা বাড়াচ্ছে তাদের যেন তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ব্রাজিল থেকে বাহিয়ান তামাক আসতো তা নিয়েও অনেক ঝামেলা ব্যান্ডেলের ফাদারকে সমাধান করতে হতো। এছাড়া খ্রীষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা ও দাস ব্যবসার কাজ যে ছিলোনা এমন নয়। তাই ব্যান্ডেল চার্চের সাথে গোয়ার চার্চের সরাসরি যোগাযোগ ছিলো ও ব্যান্ডেল চার্চের ফাদাররা বিশেষ ক্ষমতাশালী ছিলো।
গোটা বাংলা জুড়ে ব্যান্ডেল চার্চের ক্ষমতা স্তিমিত হয়ে যায় ১৮৩৪ সালে। ব্রিটিশরা প্রপোগান্ডা ফিডের বলে বলীয়ান হয়ে নিজেদের পছন্দের লোক চার্চে আনতে শুরু করে বাংলা জুড়ে। ব্যান্ডেল চার্চের খ্রীষ্টান সম্প্রদায় প্রতিবাদ করে । ব্যান্ডেল চার্চের খ্রীষ্টানদের বিশেষ অধিকার ছিলো যা পর্তুগালের রাজা দ্বারা স্বীকৃত। কিন্ত ততদিনে ব্রিটিশরা বুঝে গেছে তারাই বাংলা তথা ভারতের বিধাতা। তাই বাংলার প্রাচীনতম চার্চের প্রতিবাদের গুরুত্ব আর দেয়নি। আস্তে আস্তে কলকাতাতে নতুন চার্চ এসে যায় যাদের পরিবেশ- লোকজন – কর্মপদ্ধতি ছিলো আলাদা। তবে আজও বড়দিনে অনুষ্ঠানের দিনে বহু লোক জাতি-ধর্ম ভুলে ব্যান্ডেল চার্চ ঘুরতে যায়। অগষ্টাইন সেন্ট নিকোলাস ও লেডি রোজারির কাছে প্রার্থনা সংগীত আজও ভেসে যায় বাতাসে – –
“in ages past, the mariner belated
By stormy winds upon a roaring sea,
Inroked thy help, and as the storm abated,
Sailed to the shrine in thankfulness …..”
================
সুত্র:
====
1.Hooghly jelar itihas o bangosamaj by Sudhir kumar Mitra, Deys Publication.
2.Blue Print to Blue Water ,The Indian Navy ,1951-65/ Satyindra Singh/ Lancer International.
3.Europe and the hooghly by Suranjan Das and Basudeb Chattapadhya , KP Bagchi and Company.
4.Sunlight on the garden by Andre Beteille , Penguin Viking.
5.Hooghly district Gazetteer by Amiya Kumar Banerjee.
6.Smriti ta Sakal by Jogendra kumar Chattapadhya ,Charchapod.
7.Samakal of bibriti ,Edited , Hooghly Book Fair 2017.
=============
# ইন্টারনেট থেকে পাওয়া গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্য এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
*************************************************
সুলগ্না চক্রবর্তী পরিচিতিঃ
সুলগ্না চক্রবর্তী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে মাষ্টার করলেও ভালোবাসার জায়গা হলো সাহিত্য ও ইতিহাস।বিভিন্ন পত্রপত্রিকা,রেডিওতে সুলগ্না চক্রবর্তীর প্রবন্ধ,গল্প,কবিতা এসেছে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের প্রজেক্টেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে।
খুব সুন্দর তথ্য সমৃদ্ধ লেখা..