সেলফি
দেবাশিস দণ্ড
না,শেষে চমক দেব না,শুরুতেই বলে রাখি আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নের বইমেলায় ঘুরছিলাম। বই কিনছিলাম না,কারণ বাস্তবেও বই বিশেষ কিনি না। পড়লে চেয়েচিন্তে পড়ি। আদ্ধেক পড়েই ভালো মন্দ বলার অসম্ভব প্রতিভা আছে আমার। তাই পুরোটা পড়তেই হয় না। যেহেতু আদ্ধেক বই বিক্রি হয় না,পুরোটাই কিনতে হয়,তাই আমার কাছে বই কেনা ঠকা। রানুদিকে দেখতে পেলাম। আমার স্বপ্নের রানুদি। আহা কী কন্ঠ! এই কন্ঠই তো ছড়িয়ে পড়েছে রানাঘাট থেকে নানা ঘাটে। আমি সেলফি নেব। রানুদির পাশে দাঁড়ালাম। মোবাইলটা তেরচা করে উপরে তুললাম। রানুদি যথাসম্ভব মিষ্টি করে হাসল,কিন্তু ক্লিক করা হল না।
আনন্দর কাউন্টারের পাশ থেকে রাধারমণ চেঁচিয়ে উঠল-শিগগির আয়,শ্রীজাতদা…শ্রীজাতদা…
রানুদিকে পরেও পাব,পহলে শ্রীজাত। জাতকবি বলতে আমি শ্রীজাতই বুঝি। আমার স্বপ্নের শ্রীজাতদার সঙ্গে ছবি তুলব। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢেউ তুলব। লহরীর পর লহরী তুলিয়া আঘাতের পর আঘাত কর। কবি এককথায় পোজ দিলেন। ঠোঁটের ভাঁজে সেই সুগন্ধি হাসি। কিন্তু ক্লিক করা আর হল না। পেছন থেকে বিশু কানে কানে বলল- ওই দ্যাখ দাদা…
: কে দাদা? কার দাদা?
: দাদা তো একটাই…. গাঙ্গুলী… শিগগির যা,নইলে মিস করবি…
বিশুর ফিসফিসে কথায় অদ্ভুত একটা ঘোর লেগে গেল। সেই দুরন্ত টরেন্টো… লর্ডসের গ্যালারি… জার্সি ওড়ানো দিনগুলো ফিল্মের মতো আসাযাওয়া করতে লাগল চোখের সামনে। আহা আমার স্বপ্নের মহারাজ। সব ছবি পড়ে থাক। সবার ছবি পড়ে থাক। আমি মহারাজের সঙ্গে ছবি তুলব। ভাইরাল করে দেব পৃথিবীর সব কোণে। লাগাও ছুট।
মহারাজের কাছে প্রায় পৌঁছিয়ে গেছিলাম। ঠিক তখুনি কাঁধে হাত। ভার নেই। আদর আছে। চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম। সার্থক হল চোখ। সার্থক হল জীবন। সার্থক জনম আমার তোমায় ভালোবেসে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আমার প্রাণের ঠাকুর। তাঁকে দেখামাত্রই শত শত গান,সহস্র কবিতা আবহ হয়ে বেজে উঠল মেলাপ্রাঙ্গণে।
রবীন্দ্রনাথ বললেন-অমন হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিলি?
কোথায় যাচ্ছিলাম? কোথায় যেন যাচ্ছিলাম আমি? অস্ফুটে বলে উঠলাম-ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা শুধু তোমার পানে…তোমার পানে…
রবীন্দ্রনাথ হাসলেন। ওই হাসিটায় প্রশ্রয় ছিল। আমি সাহস করে বললাম-আপনার সঙ্গে একটা সেলফি তুলব গুরুদেব?
: আবার ছুট লাগাবি না তো?
: আর কোথায় ছুটব গুরুদেব? আমি তো আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। রবীন্দ্রনাথ আবার হাসলেন। এই হাসিটা আগের মতো নয়। কিছু একটা ধরে ফেলার হাসি। বললেন-বেশ,তোল ছবি। ছোট্ট একটা স্বপ্নপূরণের ক্লিক। মোবাইলের পর্দায় ধরা দিল ছবি। হায় রে,এ কোন্ ছবি? ছবিতে শুধুই আমার মুখ। লোভী একটা মুখ। গুরুদেব কোত্থাও নেই।
চিৎকার করে উঠলাম-গুরুদেব?
বুকের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠলেন-আমি এখানে।
নিজের চিৎকারে নিজেরই ঘুম গেল চটকে। গতকালের পোস্টটার কথা মনে পড়ল। এক জীবন্ত কিংবদন্তী শিল্পীর সঙ্গে ছবি তুলে পোস্ট করেছিলাম।
পোস্টটা খুলে দেখি অজস্র অভিবাদনের ফাঁকে বেমানানের মতো আটকে আছে এক গেঁয়ো কবিবন্ধুর কমেন্ট। সে লিখেছে-
তুমি তো নিজেকে অনায়াসে বড় করে মেলে ধরতে পার ভাই। কত সম্পদই তো আছে তোমার। কেন তুমি বড় থেকে আরও বড়র পাশে দাঁড়ানোর উন্মাদনায় ছুটছ? যতখানি বৃহতের পাশে দাঁড়াও,ততটাই ক্ষুদ্র দেখায় তোমাকে।
******************************************************
দেবাশিস দণ্ড পরিচিতি:
জন্ম ২০ আগস্ট ১৯৬৭, পেশা শিক্ষকতা। ১৩ বছর বয়সে বাবার দেখাদেখি কলম ধরা। এপারওপার দুই বাংলার বহু বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত। আঞ্চলিক উপভাষায় লেখা অসংখ্য কবিতা রয়েছে, যেগুলি বাচিকশিল্পীমহলে সমাদৃত। শালবেলা, আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি,শনি ঠাকুর রবি ঠাকুর,ব্যইললে হবেক?,মিঠে কথা মেঠো সুর ইত্যাদি কবিতার অ্যালবামগুলি দারুণ জনপ্রিয়। জি বাংলা,ইটিভি বাংলা,ডিডি বাংলা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর টিভি চ্যানেলে কবিকন্ঠে কবিতা পরিবেশিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিতার বই:ঠোঁটকাটার নোটবুক,ঝাড়ের বাঁশ,শব্দ শতাব্দ,বনফুল ইত্যাদি।