খড়কুটো
জলি চক্রবর্তী শীল
“পুরুষ কাঁদে” অন্তরে আমাদের মত তোমরা তো কাঁদতে পার না‚ তাই ভেতরে ভেতরে গুমরে মর| প্লীজ মহী সামলে ওঠ| ‘ কথাগুলো বলতে বলতে চোখভরা জল উপচে পড়ে|
‘আমি ঠিক আছি’|
‘না ঠিক নেই তুমি‚ ঠিক নেই| নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছ? দেড়দিনে কি হাল হয়েছে| এই পরিণতিটা তো তুমি-আমি জানতাম| তবু দুজনের তৃষিত হৃদয়কে বোঝাতে পারিনি সেদিন|’
‘তোমার চেহারাটা আয়নায় দেখেছ?’
‘আমি ‚ আমি সামলে নেব মহী| আমি ঠিক সামলে নেব| দেখবে একটা সময় চোখের জল শুকিয়ে গেছে| কিন্তু আমার চিন্তা আমাকে নিয়ে নয়‚ তোমাকে নিয়ে’|
‘আমি সামলে নিয়েছি’| কথাগুলো যেন মহীরূহকেই ব্যঙ্গ করে|
‘সামলে নেওয়া কি এতই সহজ মহী? হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে এতগুলো বছর ধরে যাকে আগলে আগলে রাখলাম‚ যার সুখ কিসে‚ দুঃখ কিসে‚ ভালো লাগা কিসে এতটাই জানি আমরা দুজনে‚ তার শোক এত সহজে সামলে ওঠা যায় না| তবু সামলে উঠতে তো হবেই| আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই মহী|’ ধরা গলা যেন আরও ধরে আসে বেলীর|
‘আমারই বা কে আছে বেলী?’ মৃদুস্বরে কথাগুলো উচ্চারণ করে মহী|
এই ঝড়টা তো আসার কথাই ছিল| শুধু ঝড়টার অস্তিত্ব ভুলে থাকতে চেয়েছিল তারা দুটিতে| দুটো ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় চেয়েছিল একটু আশ্রয় পেতে| তৃষ্ণার্ত হৃদয়দুটি পেতে চেয়েছিল উষ্ণতা| যতদিন সে ছিল, উষ্ণতা বিলিয়ে গেছে‚ আর তার চলে যাওয়ার সাথে সাথেই নেমে এসেছে শীতলতা| ভীষন শীত করতে থাকে বেলীর অ্থচ বাইরে প্রখর রোদ্দুর| ঘড়ির কাঁটা যেন হঠাৎ করেই শ্লথ হয়ে গেছে| ভুলে গেছে ঘর বদল করতে| দিন কি এত লম্বা হতে পারে! প্রাত্যহিক কাজ-কর্মগুলো হঠাৎ করেই প্রাসঙ্গিতা হারিয়েছে| হয়ত সাময়িক‚ হয়ত ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি‚ তবু তো ফিরে যেতে হবে নিজের ছন্দে| তারা দুজনেই সেই চেষ্টা করছে|
জিনিয়া চলে গেছে হঠাৎ করেই| না ঠিক চলে যায়নি‚ ফিরে গেছে তার নিজের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে| কিছুটা সময় জিনিয়াকে তারা রেখেছিল মহীরূহ আর বেলীর সংসারে| যে সংসারে কখনও পড়েনি শিশুর পায়ের ছাপ‚ কখনও শিশুর কান্নার শব্দ শোনা যায়নি অ্থচ খুব খুব চেষ্টা করেছিল মহীরূহ আর বেলী তাদের সন্তানকে নিয়ে আসার| লাখ লাখ টাকা খরচ করেছে তারা আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে| নাহ‚ তারপরেও ফাঁকা থেকে গেছে তাদের কুটীর| তাদের হৃদয়ের পান্থশালায় একের পর এক শিশু কদিনের অ্তিথি হয়ে এসেছে ‚ তাদের কেউ বা ভাইপো‚ কেউ বা ভাগ্নে‚ কেউ বা বোনঝি কেউ বা বোনপো| তারপর তারা চলেও গেছে| প্রতিটা চলে যাওয়া কষ্ট দিয়েছে তাদের| শেষ এসেছে জিনিয়া| একটা ফুল ছিল সে| ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা নিয়ে খেলা করত সে| সারাদিনে গুগুগু করে কত কথা বলত| একটাও গরম পোষাক ছিল না জিনিয়ার| মহী মুখ ফেরাতে পারেনি‚ কিনে এনে দিয়েছিল| সারাটাদিন লালা ফেলত জিনিয়া| সারাগায়ে মুখে সেই লালা মেখে জিনিয়াকে সামলাত মহী| মহীর উঁচু উঁচু বুকদুটোকে পরম আশ্লেষে চুষত সে| বড় মায়া লাগত বেলীর| আহারে তার যে শুকনো স্তনে দুধ নেই|
‘দাও না‚ দাও না ওকে লেখাপড়া করে| আমাদের কাছে ভালো থাকবে ও’|
‘তোমাদের কাছেই তো আছে‚ থাকছে লেখাপড়ার দরকার কি?’
‘পাকাপাকি একটা কিছু’
ওরা হাসে‚ ওরা মজা পায় আর মহীরূহ -বেলী কষ্ট পায়| একটু একটু করে কথা বলতে শেখে জিনিয়া| প্রথম ডাকে বাব বলে| বাব‚ মহীরূহর চোখ জ্বালা করে ওঠে| কদিন ধরে কেউ তাকে বাবা বলে ডাকছে না| কদিন হবে? কেন সে মেয়ে হল না‚ কেন সে হুরহুর করে কেঁদে ফেলতে পারছে না| অ্থচ চাইছে সে‚ খুব চাইছে বেলীর মত কাঁদতে| ভেতরটা জ্বলছে‚ ভেতরটা পুড়ছে‚ ভেতরটা কাঁদছে| চোখ শুধু মরুভুমি|
চারিদিকে শুধু জিনিয়ার স্মৃতি| জিনিয়ার ছোটো হয়ে যাওয়া ফ্রকগুলোকে প্রাণে ধরে কাউকে দিয়ে দিতে পারেনি বেলী| ছোট ছোট জুতো জমে গেছে| জমে আছে একগাদা বই-খাতা| কাঁচা কাঁচা হাতের আঁকা বাঁকা লেখা| ড্রয়িং খাতাজুড়ে বাবার ফটো| কোনটাই মহী নয়‚ তবু সবকটাই মহী| জিনিয়া আঁকতে পারত না| শুধু রং করতে ওর ভালো লাগত| লাগত কেন এখনও সেটাই লাগে হয়ত| সবে ছত্রিশ ঘন্টা হল জিনিয়া চলে গেছে‚ না ফিরে গেছে| মনে হচ্ছে যেন কত যুগ হয়ে গেল| চোখ শুকোয়-ভেজে-শুকোয়|
‘বেলী‚ একবার কি ফোন করব জিনিয়াকে?’
‘ও তো একবার করতে পারত| ও আমাদের ভুলে গেছে গো| আমাদেরও ওকে ভুলে যেতে হবে|’
‘ঠিক ঠিক| না ভুলতেই হবে| তবে কি জান কটা দিন হয়ে গেল কেউ আমাকে বাবা বলে ডাকছে না তো‚ প্রাণটা কেমন ছটপট করছে|’
‘দেড়দিন’|
‘দেড়দিন!! মাত্র দেড়দিন? তাই হবে‚ আমার কেমন যেন অনন্তকাল মনে হচ্ছে‚ অ্থচ‚ জিনিয়া তো সারাক্ষণ আমাদের কাছে থাকত না| কতক্ষণ বাড়ি থাকতাম আমরা দুজনে বল| আমাদের অফিসে থাকার সময় তো জিনিয়া সেখানে অনুপস্থিত| তবু জিনিয়া আছে এই বোধটাই কোনদিন বুঝতেই দেয়নি জিনিয়ার অভাব| আজ বুঝছি|’
‘বড্ড ফাঁকা লাগছে মহী| চল না আমরা কোথাও চলে যাই| এখান থেকে অনেকটা দূরে কোথাও‚ যেখানে জিনিয়ার কোন স্মৃতি থাকবে না|’ উপচে পরা চোখে বলে বেলী|
‘কোথায় যাবে‚ মনের ভিতরে যে জিনিয়ার এত স্মৃতি‚ কোথায় রাখবে তাদের সরিয়ে?’
‘আমি যে না খাওয়ালে জিনিয়ার পেট ভরে না মহী? ও ঠিক করে খাচ্ছে তো? একটা ফোন করে খবর নাও না প্লিজ|’
পেটের সন্তান না‚ মাত্র কয়েকটা বছর শুধু হাতে করে লালন-পালন| তার কি কোন দাম আছে? সবটাই বেকার| জিনিয়ার মনে কি কোন ছাপ ফেলেছে এই কটা বছরের আদর-ভালোবাসা? ফেললে কি এত সহজে সবকিছু ছেড়ে সে ফিরে যেতে পারে| বেলী নিজের পাতের খাবার তুলে খাইয়েছে‚ নিজে অভুক্ত থেকেছে কতদিন| আর সে নিজে‚ সে যতক্ষণ না ঘুমোত জিনিয়া জেগে বসে থাকত| বাবার পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আর মাঈ-য়ের গায়ের ওপর পা তুলে সে ঘুমাত| দেহাতী কুন্দনবাঈ দুধ দিতে এসে মাঈ বলে ডাকত| সেই ডাক শুনে শুনে জিনিয়াও ডাকত বেলীকে মাঈ বলে| বেলী দুঃখ করত তোমাকে বাবা বলে ডাকে‚ কই একবারও তো আমাকে মা বলে ডাকে না| সবাই বলেছিল‚ ‘কেন পরের সন্তানকে নিয়ে এত মাতামাতি‚ দেখবে একদিন ও চলে যাবে‚ আর যেদিন যাবে সেদিনটা তোমরা সহ্য করতে পারবে? কথায় আছে পরের সোনা দিও না কানে‚ কান যাবে তার হ্যাঁচকা টানে|’ বোঝেনি কি তারা দুজনে? বুঝেছে তবু পারেনি নিজেদের বোঝাতে| তৃষিত হৃদয়ের বেদনা কে বুঝবে? কে জানবে তাদের দুজনের কষ্ট? তাই খড়কুটো ভেসে গেছে‚ যাওয়ারই তো ছিল| মহীর মন জ্বলে যাচ্ছে‚ ভিতরটায় চলেছে খান্ডবদহনের মত জ্বালা‚ কিন্তু বাইরে স্বাভাবিক থাকতেই হবে| স্বাভাবিক থাকতেই হবে‚ ভুলতেই হবে মাঝের এই সময়টাকে‚ ভুলতে হবে জিনিয়াকে|
‘ওঠো বেলী‚ চল কটা দিন কোথা থেকে ঘুরে আসি|’
‘জিনিয়াকে ছাড়াই?’
‘হ্যাঁ জিনিয়াকে ছাড়াই অভ্যস্ত হতে হবে আমাদের|’
‘আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে মহী| তুমিও কষ্ট পাচ্ছ মহী| আমি জানি তুমি কষ্ট পাছ|’
‘ঐ যে তুমি তখন বললে‚ পুরুষ কাঁদে অন্তরে| বাইরে পুরুষকে কাঁদতে নেই বেলী| অন্তরের ক্ষরণ দেখানো যায় না‚ দেখাতে নেই| চল তৈরী হয়ে নাও’|
*******************************************
জলি চক্রবর্তী শীল পরিচিতিঃ
পেশাগতভাবে একজন কম্পিউটার অপারেটর একটি সওদাগরী আপিসে। নেশা বই পড়া এবং কিছু লিখতে চেষ্টা করা। জলির লিখতে ভালো লাগে সেইসব প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, জীবন যাদের কাছে প্রাত্যহিক লড়াইয়ের নাম। এক টুকরো রুটি বা এক থালা ভাতের কদর যেখানে সবচেয়ে বেশি সেইসব মানুষদের সুখ-দুঃখ-বেদনা-ভালোবাসার দৈনন্দিন গাঁথাই জলির লেখার উপজীব্য।