নীরব কোলাহলে
সুলগ্না চক্রবর্তী
গভীর রাত। গোটা শহর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে। শুধু তঁলেরু বসে আছে সদ্য তৈরী করা প্রাসাদের মতো বাড়ীর বারান্দার চেয়ারে। চরাচর ভেসে যাচ্ছে পূর্ণিমার আলোতে, সামনে বয়ে চলা গঙ্গাতে ভেসে যাচ্ছে চাঁদ খণ্ড খণ্ড হয়ে,আর তঁলেরুর দুই চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। ফ্রান্স থেকে যে চিঠি দুটো এসেছে সেগুলো পাশের ছোট্ট টেবিলটাতে রাখা।
তঁলেরুর বাবা জানিয়েছে তার মতো ছেলের বাবা হওয়ার জন্য সে লজ্জিত। প্রেমিকা সিলভিয়া জানিয়েছে এই তাঁর শেষ চিঠি তঁলেরুকে। সে,ফ্রান্সের ব্রিটন অঞ্চলের লজ্জা নয়, গোটা ফরাসী সাম্রাজ্যের লজ্জা। তার জন্যই ব্রিটিশদের কাছে সাঁদেরনগর হারাতে হলো তাদের। কি এমন হয়েছিলো যে তঁলেরু আজ শেষ হয়ে গেলো?
সাঁদেরনগর মানে চন্দননগর দখল করা প্রায় দুষ্কর ছিলো রবার্ট ক্লাইভের পক্ষে। অথচ চন্দননগর দখল না করলে কোম্পানীর বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হারানো প্রায় অসম্ভব ছিলো। নবাবের সাথে ফরাসীদের ভালো সম্পর্ক কোম্পানীর জন্য ভালো ছিলোনা। তাছাড়া আসন্ন যে যুদ্ধ আসছে তার জন্য অর্থবল -লোকবল দরকার হয়ে পড়েছিলো। যেমন ছিলো চন্দননগরের অঁরলিও দুর্গ,তেমন ছিলো চন্দননগরের তৎকালীন গভর্নর রেঁনের কূটচাল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করতে পারে। তাই মুর্শিদাবাদে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে নবাবের সৈন্যরা চন্দননগরের ফরাসীদের সাহায্য করে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তখন মুর্শিদাবাদের বাইরে। তবু তার দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী সৈন্যরা বেরিয়ে পড়েছিলো চন্দননগরের উদ্দেশ্যে। তবে তাদের চন্দননগর পৌঁছানোর আগেই শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। একদিকে ফরাসীপক্ষের রেঁনে-ভিগেনে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে ক্লাইভ ও ওয়াটসন। ক্লাইভের সৈন্যরা যখন অনেক চেষ্টা করেও অঁরলিও দুর্গের কাছে যেতে পারলোনা বলে রাতে দুঃখ করছিলো রেঁনে তখন অঁরলিও দুর্গের একটা ঘরে বসে কাঁদছিলেন। ঘরে তিনি একা এখন! একটু পরেই মঁশিয়ে ভিগেনে এল এক বোতল সুপেয় বঁশা নিয়ে। মঁশিয়ে ভিগেনে শুরু করলেন –
“কি ব্যাপার? আপনাকে খুব শুকনো লাগছে। শরীর ভালো তো?”
”পন্ডিচেরীতে খবর পাঠিয়েছিলাম। ওখান থেকে মাত্র ৬১ জন ইউরোপীয়ান সেপাই এসেছে।”
“বলেন কী ? এত কম সৈন্য পাঠিয়েছে ওরা! দেশী সৈন্য কত এসেছে?”
“বেশী না।”
“তবে তো খুব মুশকিল দেখছি। তবে আপনি চন্দননগরে ঢোকার মুখে নৌকা ডুবিয়ে ডুবিয়ে যা করে রেখেছেন ওয়াটসন চেষ্টা করলেও ঢুকতে পারবে না। রাস্তার প্রত্যেক মোড়ে ব্যাটারী রাখা আছে। ওরা প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে। ততক্ষনে নবাবের সৈন্যরা এসে যাবে। চিন্তা করবেন না।”
কথা শেষ করে বঁশার বোতল খুললেন ভিগেনে। রেঁনে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে গ্লাস ভরে নিলেন। রেঁনে আর ভিগেনে যখন বঁশা পান করছিলেন তখন গঙ্গার দিকে মুখ করে একা বসেছিলো তঁলেরু। মনের ভেতর তখন তার ঝড় চলছে। একদিকে তার ভেতর ফরাসী রক্ত গুমরে গুমরে উঠছে আর বলছে ইংরেজদের কাছে কখনোই মাথা নত করবে না আর মন বলছিলো ইংরেজদের কাছে যদি গঙ্গাতে নৌকা ডোবানোর মধ্যে যে রাস্তাটা খোলা আছে সেটা বলে দেওয়া যায় ভালমতো পুরস্কার আসবে। তার পরিবারকে আর কষ্ট করে খেতে হবে না। চন্দননগরে বড়ো বাড়ী করে সিলভিয়াকে জানাবে। নিজে মুর্শিদাবাদ বা কাশিমবাজার গিয়ে হীরের আংটি কিনে আনবে। বাবা-মাকে কিছুদিনের জন্য চন্দননগর নিয়ে আসবে। কিন্তু বিবেক যেন বারে বারে বলে যাচ্ছে ভুল পথ নিওনা, তোমার জন্য দেশ মাথা নত করবে ইংরেজদের কাছে যারা কিনা ফরাসীদের চিরশত্রু। কী করবে তঁলেরু ?
১৯ আর ২০ মার্চ, ১৭৫৭ ছিলো যুদ্ধের দিন ও রাত। সারাদিন সারারাত যুদ্ধ চললো। অঁরলিও দুর্গের চারদিকে কামান বসানো। তোপধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে চন্দননগর। কিন্তু ক্লাইভ বুঝতে পারছিলেন জলপথে ওয়াটসন না ঢুকলে চন্দননগর কব্জা করা যাবে না। এদিকে ওয়াটসনও বুঝতে পারছে না কী করে ঢুকবে চন্দননগরে। উত্তর চন্দননগরের তালডাঙ্গা নামে যে জায়গাটা আছে সেখানে যুদ্ধ শিবির পড়েছিলো ইংরেজদের। সেখানেই একটা তাঁবুর ভেতরে ক্লাইভ ও ওয়াটসন একটা ম্যাপ নিয়ে কিছু আলোচনা করছিলেন। হঠাৎ একটা হইচই শুনতে পেলেন। দেখলেন এক শ্বেতাঙ্গ ছেলেকে তাঁর রক্ষীরা ধরে আছে। তাঁকে দেখে রক্ষীরা বলে উঠলো-
“একটা ফরাসী গুপ্তচরকে ধরেছি । শেষ করে দেবো স্যার ?”
ক্লাইভ কে দেখে শ্বেতাঙ্গ ছেলেটি বলে উঠলো-“আমি তঁলেরু,আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি যদি আপনারা আমার শর্ত মানেন। আমার সাথে কোনো অস্ত্র নেই কিন্তু আপনার রক্ষীরা আমার হাত পেছনে বেঁধে রেখেছে। আমার লাগছে।”
ক্লাইভ রক্ষীদের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওকে ভিতরে আসতে দাও হাত দুটো খুলে। তোমরা যাও। আমরা দুজন ওর সাথে কথা বলতে চাই।
এল ২৩শে মার্চ,১৭৫৭। ওয়াটসন ঢুকে পড়লেন চন্দননগর গঙ্গাবক্ষে তঁলেরুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী। ক্ষণে ক্ষণে অঁরলিও দুর্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিভাবে ইংরেজদের রণতরী ঢুকলো? কে সেই বিশ্বাসঘাতক যে বলে দিয়েছে ডুবানো নৌকার মধ্যে খোলা পথটাকে? নবাবের সৈন্যরা আসেনি মহারাজ নন্দকুমারের কারসাজিতে। এদিকে আবার পাশের শহর চিনসুরার ডাচ ডাইরেক্টর বিসডম রেঁনের সাহায্য প্রার্থনা ফিরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের রোষে পড়তে চায় না। রেঁনে বুঝতে পারলেন তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। তবুও গোলন্দাজদের বললেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে।
ছয় জন ডাক্তার অঁরলিও দুর্গের ভিতরে তখনও চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিল। খবর পাঠালেন কুঠিঘাটে। মালভর্তি যেসব জাহাজ রপ্তানির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো সেগুলো ডুবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আর চলে এলেন অঁরলিওর সেই গুদামঘরে যেখানে রেশমী কাপড়ের থান রাখা থাকে। মনে পড়ে গেল ১৭৫৬ তে তাঁর আগমনের কথা। তাঁর চন্দননগরে আসা উপলক্ষে একটা পার্টি হয়েছিলো। তাকে আগের গভর্নর বলেছিলেন –
“১৬৭৩ দ্যু প্লেসি এখানে জমি কিনেছিলেন কুড়ি আঁড়পা। আর আজ চন্দননগর ইন্ডিয়ার এক বিখ্যাত বন্দর। কেন সে কথা কি জানো? আমাদের হাতে আছে সুতো ও রেশমের ম্যাজিক। চট্টগ্রাম, ঢাকা, বালেশ্বর, পাটনা, জগদীয়া, কাশেমবাজার থেকে মাল আনি আমরা।”
রেঁনের চোখ জ্বালা করছে, গলাতে কেমন যেন শুকনো ভাব। দু পায়ে যেন শেকড় জন্মে গেছে। লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। নিজেই দেখলেন রেশম কাপড়ের উপর টপ টপ করে জল পড়ছে। সকলেই যুদ্ধে ব্যস্ত। গুদাম ঘরের দিকে কেই বা আসবে? নীরব কোলাহলের সাক্ষী থাকলো রেঁনের চোখের জল। কিন্তু পুরুষেরা কি কাঁদে না কাঁদতে আছে ? রেঁনে চোখের জল মুছে বেরিয়ে এলেন। অঁরলিও দুর্গের ছাদে সাদা পতাকা দেখালেন আত্মসমর্পণের ।
গোটা চন্দননগরে নেমে এলো কালো দিন। ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের বিখ্যাত নন্দদুলাল মন্দির আক্রমণ করে টাকা ও সোনা লুঠ করলো। চন্দননগরের দেওয়ান প্রবাদতুল্য পুরুষ ইন্দ্রনারায়ন চৌধুরীর বাড়ী লুঠ হলো। চন্দননগরের বড়ো বড়ো বণিক ও ধনীদের বাড়ী লুঠ হলো। মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার চললো। এর পর যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে যাওয়া হলো কলকাতায় হাঁটিয়ে। যে চন্দননগরে গোটা পৃথিবীর জাহাজ ভিড়তো তা শূন্য হয়ে গেলো কোন এক কালের অঙ্গুলিহেলনে। বন্দর ঘিরে জন্মাতে লাগলো গুল্ম-লতা-ঘাস । অনেক ফরাসীরা ফিরে গেলো ফ্রান্সে। কিছুরা থেকে গেলো যাদের ফেরার আর জায়গা নেই। শহর জুড়ে ইংরেজ পুলিশদের দাপাদাপি শুরু হলো ।
এর মধ্যেই তঁলেরু শর্তানুযায়ী টাকা পেয়ে বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়ে ফেললো। কাশেমবাজার থেকে ঝাড়লন্ঠন আনলো। পূর্ব দিক থেকে সূর্য এসে ঝাড়লন্ঠনে লেগে কত যে কুচি কুচি আলোতে ভেঙ্গে যায়। তঁলেরু স্বপ্ন দেখে সিলভিয়া আর সে এই ঘরে নাচছে। দুই-চার জন হাসছে। তঁলেরুর বিশ্বাসঘাতকতার কথা অনেকেই জানতে পেরেছিলো। তাই ফরাসী সমাজের বেশিরভাগই কথা বলতো না তঁলেরুর সাথে । দুই-চার জন বিনা পয়সার দামী মদের লোভে তার বাড়ী আসতো। সে ফ্রান্সে বাবাকে টাকা পাঠিয়েছিলো বেশ খানিকটা। সিলভিয়াকে চিঠি পাঠিয়েছিলো যে ছয় মাস পরেই সে ফ্রান্সে আসছে । সে যেন বিয়ের জন্য তৈরী হয়ে থাকে। সে যুগে চিঠি যেতে ও আসতে সময় নিতো।
তবে এবার যেন একটু তাড়াতাড়ি চিঠি এলো। তাও আবার দুটো একসাথে। তঁলেরু বসে থাকলো বারান্দাতে চিঠি দুটো পড়ার পর। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া যেন এক নিমেষে চিঠি দুটো শেষ করে দিয়েছে। দিন শেষ হয়ে রাত হলো। গভীর রাত। গোটা শহর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে। রাত আবার দিন হতে চললো। পূর্ব দিক লাল হয়ে আসছে । তঁলেরু বুঝতে পারলো তার জীবনের শেষকৃত্য সাড়া প্রায়। চিঠি গুলো কুচিয়ে ফেললো চোখের জল মুছে। শক্ত তাকে হতেই হবে। কিছুই তো তার নেই। এমনকি চোখের এক ফোঁটা জল ফেলার লোকও। তবু কেন এত পিছু ডাকছে মন ? সিদ্ধান্ত তো নেওয়া হয়ে গেছে একটু আগেই।
পরের দিন বাগানের মালি, মালি থেকে মহল্লা,মহল্লা থেকে চন্দননগর জানলো বিশ্বাসঘাতকটা মরেছে গলায় দড়ি দিয়ে। তার দুইদিন পর ফ্রান্স থেকে তঁলেরুর বাবাকে পাঠানো মানি অর্ডার ফেরৎ এলো। তঁলেরুর বাবা ছেলের টাকা নিতে অস্বীকার করেছে। আজও সেই মানিঅর্ডার হুগলী আদালতে রয়ে গেছে দুই পুরুষের চোখের জলে ভিজে। একজন ধনী হবার আনন্দাশ্রুতে বাবাকে টাকা পাঠিয়েছিলো,আর একজন অপমানে কেঁদে ফেরত পাঠিয়েছিলো সেই টাকা। দুই জনাই ছিলো পুরুষ, তাদের কান্না কেউ দেখেনি কোনোদিন। শুধু কালের গর্ভে সঞ্চিত আছে তারা নীরবে। এমন শব্দহীন পুরুষদের অন্তরের কান্না মাঠে-ঘাটে পড়ে থাকে আজও আড়ালে-আবডালে, সমাজের চোখ বাঁচিয়ে।
******************************************************
সুলগ্না চক্রবর্তী পরিচিতিঃ
সুলগ্না চক্রবর্তী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে মাষ্টার করলেও ভালোবাসার জায়গা হলো সাহিত্য ও ইতিহাস।বিভিন্ন পত্রপত্রিকা,রেডিওতে সুলগ্না চক্রবর্তীর প্রবন্ধ,গল্প,কবিতা এসেছে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের প্রজেক্টেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে।