।। পৌষ পার্বণ : স্মৃতির জানলা বেয়ে।।
সোনালী গুহ
পৌষ সংক্রান্তিতে শীতের ওম মেখে পিঠে পুলি খাওয়ার মজাই আলাদা। খুব মনে পড়ছে, ছোটবেলায় এইদিনে সকাল থেকেই শুরু হতো আমাদের যাদবপুরের বাড়িতে বাস্তুপুজো। আগের দিন বাগানের একটি জায়গায় মাটি খুঁড়ে উনান বানানো হতো। জায়গাটা লেপা হতো গোবর দিয়ে।সংক্রান্তির ভোরে পুরোহিত মশাই এসে শুকনো ডালপালা, নারকেল পাতা দিয়ে উনান জ্বালাতেন। পৌষ বা মকর সংক্রান্তিকে উত্তরায়ণ সংক্রান্তিও বলে। কারণ, এই দিন থেকে সূর্য উত্তরায়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে। উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে বাস্তুপূজার প্রচলন আছে। শঙ্খপাল বঙ্কপাল ক্ষেত্রপাল নাগপালের ধ্যান করে বাস্তুর ধ্যান করা হয় এইদিনে। বাস্তুর প্রণাম মন্ত্র হল,“ওঁ বাস্তুরাজ নমস্তুভ্যং পরমস্থানদায়ক। সর্বভূতজিতস্ত্বঞ্চ বাস্তুরাজ নমোহস্তুতে।“
সেইমতো গৃহ পুরোহিত উনান জ্বালিয়ে পেতলের কড়াইতে পায়েস রান্না করতেন। উপাদেয় সেই পায়েসকে ‘চরু‘ বলা হতো। আগেকার দিনে ‘চরু’ রান্না হতো পাটকলমির আগুনে নতুন মাটির হাঁড়িতে দুধ-চাল-বাতাসা ফুটিয়ে। তারপর বাস্তু দেবতার পুজো অনুষ্ঠিত হতো। একদিকে পুজো হচ্ছে আরেকদিকে কিন্তু পিঠা পুলির আয়োজন শুরু হয়ে যেত রান্নাঘরে।
সংক্রান্তির আগেরদিন অনেক জায়গায় ভাজা পিঠে হয়; তা সেদিন ও পরদিন সকালে খাওয়া হয়। সংক্রান্তির দিন তৈরি হয় নানান পিঠে,সেগুলি সেদিন ও পরদিন খাওয়া হয়। পৌষ পার্বণের পরদিনও পিঠে তৈরি হয় যা তার পর দিন পর্যন্ত খাওয়া হয়। এইভাবে গ্রাম বাংলায় পরপর চারদিন পিঠে উত্সব পালন হয়।
পৌষ সংক্রান্তিকে,তিল সংক্রান্তিও বলে। এদিন তিল দিয়ে নাড়ু,মিষ্টি তৈরি করে পুজোয় দেওয়া হয়। এই দিন তিল না খেলে নাকি দিন বাড়ে না অর্থাত্ সূর্যের মকর যাত্রা হয় না।
আমাদের ছোটবেলাতেও সকাল সকাল রান্নাঘর মুছে, একদিকে পাটিসাপটা, সরুচাকলি ভাজা হতো। নতুন খেজুরের গুড়, নারকেল, ক্ষীরই প্রধান উপকরণ। ঝোলা গুড় ,নারকেল কোরা দিয়ে সরুচাকলি খাওয়া হতো। এছাড়া পুলি পিঠা, গোকুল পিঠা বানানো হতো।ঠাকুমার নিরামিষ বাসনে এইসব তৈরী হতো।পরিষ্কার কাপড় পরে,শুদ্ধ ভাবে এই আয়োজন করতে হতো।একটা বেগুন বোঁটাসহ কেটে ঘিতে ভিজিয়ে লোহার চাটুতে ভাজা হতো পাটিসাপটা।সেই সুগন্ধে সারা বাড়ি ম ম করতো।মিষ্টি আলুর পুলি হতো।দুধে পশিয়ে ,চশি পুলি ও হতো।আগে থেকেই সারাদুপুর সব কাজের অবসরে চশি বানিয়ে রাখতেন ঠাকুমা।প্রথম পিঠা টা দেওয়া হতো উনানে।অগ্নি দেবতাকে।পরেরটা কাককে। আমাদের বাড়িতে যেহেতু দুর্গা পুজো হতো,তাই বড় বড় পিতলের থালা, বারকোশ,গামলা ইত্যাদি ছিল।সেগুলো ভর্তি পিঠা ভাজা হতো।গোবিন্দভোগ চাল,খেজুরের গুড়ের পাটালি দিয়ে ক্ষীরের মত দারুণ পায়েসও হতো।আরেকটা জিনিস হবেই, সেটা হল মিষ্টি অম্বল।পৌষ মাসের পর মুলো খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আসলে সেইসময় মুলো শক্ত হয়ে যেত। মুলো গোলগোল পাতলা পাতলা করে কেটে, নারকেল কোরা,পাটালি গুড়ের রসে ফোটানো হতো। সঙ্গে থাকত লম্বা লম্বা করে কাটা চালতা। সর্ষে ফোড়ন দিয়ে এই মিষ্টি অম্বল বাসী হলে আরো স্বাদু হতো।
এসব খাওয়াদাওয়া পূজা শেষ হলে ,প্রসাদ খাবার পরেই শুরু হতো। বেশ উৎসব এর আমেজ। শীতের মিঠে রোদে বসে বড়রা,আমরা ছোটরাও ছুটে ছুটে গরম গরম পাটিসাপটা খেতে ব্যস্ত থাকতাম। বাস্তু পূজার চরু খুব সুন্দর খেতে লাগতো। শুকনো পাতা পোড়ার গন্ধ মিশে স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
দুপুরে সেদিন নিরামিষ খাবার। ঠাকুরের ভোগ দেওয়া হতো,খিচুড়ি, শীতের সবজি দিয়ে,লাবড়া,চাটনি। আমাদের খুব বড় বড় ঘর ছিল। সেদিন নীচে আসন পেতে সকলে খেতে বসতাম। রাতে কিন্তু পিঠা, পায়েস ই থাকতো মেনুতে ভাইবোনরা কম্পিটিশন করে প্রাণভরে খেতাম।পৌষ পার্বণ এইভাবেই হতো উদযাপিত।কিন্তু আজ সবই স্মৃতি।মিষ্টির দোকানে,নানান মেলায় এখন পিঠা,পুলি খেতে ভিড় জমায় মানুষ।ব্যতিক্রম আমিও নই। পাড়ায় পাড়ায় পিঠে পুলি উৎসব ও হয় ।সেখানে মানুষের ভীড় দেখলে বোঝা যায়,আজকের ব্যস্ত বাঙালি পুরাতনের স্বাদ নিতে আগ্রহী কিন্তু বানাতে নয় ।সেই দলে আমিও।কিছুই পারিনা।পায়েস,পাটিসাপটা,পুলি পিঠা ছাড়া কোনোদিন কিছুই করিনি। কিন্তু স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেছে,আজ সংক্রান্তির দিনে খুব মনে হচ্ছে সেই ছেলেবেলার সোনার দিনগুলি।।
**********************************************
সোনালী গুহ পরিচিতি:
পেশায় শিক্ষিকা। মাতৃভাষায় কিছুটা মনের আনন্দে লেখালিখি করেন। অত্যন্ত অমায়িক, সবার সাথে মিলেমিশে, সবাইকে নিয়ে চলতে স্বস্তি অনুভব করেন।
খুব সুন্দর। ছোট বেলার স্মৃতি উসকে দিলেন।👍