ব্যথা
কাজরী বসু
দরজাটা সামান্য ফাঁক করে ঈশিতা দেখল হাত মুখ নেড়ে ঋষির সঙ্গে গল্প করছে ঋদ্ধি। ঋষিও শুনছে খুব মন দিয়ে। মধ্যে মধ্যে হেসে উঠছে হো হো করে,ঋদ্ধিও হাসছে পাহাড়ী ঝর্নার মতো কলকলিয়ে,অনাবিল খুশিতে। ঋষিকে কেমন অচেনা লাগছে,শিশুদের সঙ্গে মেলামেশায় এত সাবলীল কবে থেকে হলো ঋষি?
ঈশিতা অবাক।
কাস্টডি মামলায় ঈশিতা ছেলের দখল পেলেও ডিভোর্সের সময় কোর্টের নির্দেশ ছিল ঋদ্ধিকে সপ্তাহে একবার ওর বাবার কাছে নিয়ে যেতে হবে। ছেলের হেফাজত পেতে খুব লড়েছিল ঋষি। মামলায় হেরে গিয়ে খুব মুষড়ে পড়েছিল সম্ভবত আর তারপরেই চাকরি থেকে দীর্ঘকালীন ছুটি নিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। ঋদ্ধিকে যে আনবে,অনেক চেষ্টা করেও ঋষির পাত্তাই পায়নি ঈশিতা। ইতিমধ্যে প্রীতমকে বিয়ে করে নতুন সংসারের গোড়াপত্তন করার কাজটিও মিটে গেছে। দুম করে গতকালই হোয়াতে মেসেজ করে ঋষি জানায় সে ফিরেছে, ঋদ্ধিকে দেখতে চায়।
সেই অনুযায়ী বেলতলা রোডের এই ফ্ল্যাটে পুনর্বার ঈশিতার সপুত্র আগমন। অনেকদিন পর দেখা,ঋদ্ধির গল্পের পাহাড় স্বাভাবিক ভাবেই জমে উঠেছে বাপির জন্য। প্রীতম ঋদ্ধিকে বাপি বা বাবা নয়,দোস্ত বলতে শিখিয়েছে,নিজেও ঋদ্ধিকে দোস্ত বলেই ডাকে।
এসেই চুপচাপ বেডরুমে সেঁধিয়ে গেছে ঈশিতা। প্রথমে ধক করে উঠেছিল বুক। একদিন এই ঘর,এই খাট ঈশিতার ছিল। কত রাত এই খাটেই তো নিজেকে কতভাবে বেআব্রু করেছে ঈশিতা। প্রাথমিকভাবে শরীরের পর ধীরে ধীরে বেআব্রু হয়েছে সবটাই। শরীর বেআব্রু হলে একসময় তা আবৃত করা যায়,রাগ,ক্ষোভ,অহংকার,জেদ, চাহিদা,রিরংসা যখন বেআব্রু হয় তখন তার আর আবরণ খুঁজে পাওয়া যায়না। সেই নগ্ন অভ্যন্তরকে আবৃত করার চেষ্টা করেও লাভ হয় না কিছু। আবরণহীন সেই নগ্নতার হাত থেকে বাঁচার জন্য ধীরে ধীরে সরে যাওয়া জরুরি হতে থাকে।
তা নাহলে পালাতে হতো না ঈশিতাকে…খুঁজতে হতো না এক নতুন আলয়. …
কিন্তু ঋষি কি বিয়ে করবে না আর?
ভেবেও পরক্ষণেই ভাবল ঈশিতা,থাক,না করাই ভালো,ওর সৌন্দর্য আর তুখোড় কথার জালে ধরা দিলেই একটি মেয়ের জীবন একেবারে নরক,যেমন ঈশিতার হয়েছিল। একবার ওর আওতায় এসে পড়লে সেই মেয়ের আর নিজস্ব ইচ্ছে বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ভাগ্যিস প্রীতম এসেছিল ঈশিতার জীবনে আর মুক্তিপথের একটা দরজা খুঁজে পেয়েছিল ঈশিতা! বেঁচে গেছে ও..নিজেকে নতুন ভাবে খুঁজে পেয়েছে..
ভাগ্যিস..
বিছানার চাদরটা কুঁচকে আছে,খুব অপরিচ্ছন্নও। অভ্যেসবশে টানটান করে দিল ঈশিতা। আর আধঘণ্টার মধ্যেই ঋদ্ধিকে নিয়ে ফিরবে,প্রীতম সিনেমার টিকিট কেটে মাল্টিপ্লেক্সে অপেক্ষা করবে।
“মা,একটু শোনো”..ঋদ্ধির ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ঈশিতা।
“বলছি যে,আজকের রাতটা থেকে যাই মা,কত কিছু বলা বাকিই তো রয়ে গেল,কাল সক্কাল সক্কাল বাপি নিজে পৌঁছে দেবে,কথা দিয়েছে।”
অবাক হয়ে তাকাল ঈশিতা,এরকম তো কথা ছিলনা,ভ্রূ কুঁচকে উঠেছে,মুখটাও একটু ম্লান হলো..”কিন্তু..”
“মা তোমার আপত্তি থাকলে আমি থাকব না।”
কী বলবে ঈশিতা,এর উপর আর কথা চলে না,ঋষি জানলার পাশে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে সিগারেট টানছে।
সোফা থেকে কাঁধের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঈশিতা ঋষির উদ্দেশে বলল,”বেডশিটটা নোংরা খুব,পাল্টে নিও,আর ঋদ্ধির সামনে বসে সিগারেটটা দয়া করে খেয়ো না। কাল কিন্তু ঋদ্ধির স্কুল আছে,মনে রেখো।”
ঋষি শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না,ঘাড় ঘোরায়নি একবারও।
অন্যমনস্ক ভাবে বেরোতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেল ঈশিতা,বুড়ো আঙুলে লাগল খুব,”উফ বাবা গো”আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে।
ছুটে এসেছে বাপ ছেলে দুজনেই।
“উফ,কী যে করো,এখনো হাঁটতে চলতে শিখলে না,এমনি করে তুমি ছেলে মানুষ করবে? কোন দিকে তাকিয়ে হাঁটো শুনি! নিজেকেই যে সামলাতে শেখেনি সে মা হয় কোন আক্কেলে!” ব্যথা ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ঈশিতা। সেই চেনা ঋষি! অহঙ্কারী,শুধু ঝাঁঝটা যেন একটু কম। “চুপ করে বোসো এখানে,ওষুধের টিউবটা কোথায় আছে বলো তো,কোন ড্রয়ারে,ডানদিকেরটায় না নিচেরটায়?”
যেন ঋষির সংসারে কোথায় কী আছে আজও ঈশিতারই জানার কথা!
খুঁজেপেতে ওষুধ নিয়ে এসেছে ঋষি,“বলো তো ঠিক কোন জায়গায় ব্যথাটা লাগল! বুড়ো আঙুলে,নাকি এখানটায়..
ঈশিতার পায়ের পাতা স্পর্শ করে জিজ্ঞেস করছে ঋষি। কেঁপে উঠছে ঈশিতা,সেই প্রথম রাতগুলোর মতো..
“ও মা,তোমার কোথায় ব্যথা লেগেছে,”ঋদ্ধির কোমল কচি মুখ উদ্বেগে মাখামাখি,”বলো,মা,কোথায় লেগেছে,বাপি তোমায় ওষুধ লাগিয়ে দেবে”..
টপ টপ করে জল পড়ছে ঈশিতার চোখ দিয়ে। কী করে বলবে,আসলে ও তো নিজেই জানেনা,ব্যথাটা ঠিক কোথায় লেগেছে।
******************************************
কাজরী বসু :
কাজরী বসু কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সাম্মানিক বাংলায় স্নাতক। স্নাতকোত্তর পড়াশোনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলায় মাস্টার্স করার পর শিক্ষাব্রতী কাজরী নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন। নিজস্ব একক চারটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন কাব্যসংকলনে কবিতা , রহস্য উপন্যাস,গদ্য প্রকাশিত হয়ে থাকে। সঙ্গীতে সমানভাবে আগ্রহী কাজরী নিয়মিত সঙ্গীতচর্চা করেন। গীতবিতান শিক্ষায়তনের গীতভারতী ডিগ্রির পরে শ্রী সুবিনয় রায়ের কাছে দীর্ঘদিন তালিমপ্রাপ্ত। পরিবারে আছেন স্বামী ও একমাত্র কন্যা।
দারুন লাগলো।👌👌