Shadow

তাজপুর কটন মিল – বিদ্যুৎ পাল

তাজপুর কটন মিল

বিদ্যুৎ পাল

তাজপুরের বিলেতফেরত জমিদার জ্ঞানশঙ্কর কুমার স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পরিবারের আরো কয়েক সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন তাজপুর কটন মিল। পাব্লিক লিমিটেড কোম্পানি। বাজারে শেয়ার ছাড়েন। প্রথম বছরের শেষে উৎসাহিত হয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদেরও কিছু কিছু শেয়ার দেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অধিকাংশ এধরণের প্রয়াসের মত এই উদ্যমটিরও ভরাডুবি হয়। তাজপুর কটন মিলের পরিসর আগাছায় ভরে যায়। কয়েক দশকে সবাই ভুলে যায় উদ্যমটির কথা। শ্রমিক-কর্মচারীরা যারা আশেপাশে ঘর নিয়ে ছিল বা মিল পরিসরে ব্যারাক পেয়েছিল তারাও এক এক করে সবাই চলে যায় নতুন রোজগারের খোঁজে। কিছু কেস-মোকদ্দমা হয়েছিল সেসব কুশল ভাবে মিটিয়ে নেয় তাঁর, ততদিনে বড় হয়ে ওঠা ছেলে কৃপাশঙ্কর।
কৃপাশঙ্কর স্বদেশপ্রেমে বেশি উদ্বুদ্ধ কোনদিনই  হন নি । সোজা ঠিকেদারী শুরু করেন নেপালে, হাইওয়ে মেরামত করার কাজে। ভালো মত টাকা উপার্জন করে ফিরে এসে নিজের এলাকায় ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা ধরেন। তাজপুর ট্র্যাভেলসের নামে বাস ছুটতে শুরু করে উত্তর বিহারের বিভিন্ন শহরে। বাবার যা ক্ষতি হয়েছিল সব উসুল করে ঘরে আনেন কয়েক বছরে।
বাবার পথে না চললেও বাবাকে শ্রদ্ধা করতেন কৃপাশঙ্কর। তাই বৃদ্ধ বয়সে ছেলের কাছে একটি আব্দার রাখেন বাবা। ছেলে সেদিনই প্রথম জানতে পারে যে সে যখন বাইরে কোথাও বেশ কিছু দিনের জন্য গিয়েছিল, বাবা নিজের পুরোনো অফিসঘরে ঢুকে যত কাগজপত্র ছিল সব বার করে চাকরবাকরদের দেন জ্বালিয়ে দিতে। কিন্তু আজ, শেষবয়সে বাবার আপশোস  হয় যে তাজপুর কটন মিলের একটাও শেয়ার সার্টিফিকেট তাঁর নিজেরই কাছে নেই। আর কারোর কাছে থাকার কথাও নয় কেন না ওগুলো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বাতিল হওয়া কাগজ। তাও আবার লোকসান দেওয়া কাগজ। জ্ঞানশঙ্কর ছাড়া আর কার সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে থাকতে পারে ওই কাগজটির সাথে! তবু কৃপাশঙ্কর খোঁজ নেন। পান না। তখন আত্মীয়স্বজনের মধ্যেই ঘোষণা করেন যে বাবা মুখ ফুটে যেহেতু কিছু চেয়েছেন ছেলের কাছে, তাই কাগজটা কেউ যোগাড় করে দিলে তাকে একলক্ষ টাকা অব্দি তিনি দিতে রাজি আছেন।
এসবও প্রায় সাত বছর আগেকার কথা।

দুই বন্ধু সাংবাদিক। গিরীশ এবং মণিকান্ত। পাঁচ বছর আগে স্বনামধন্য এক মহিলা চালিত একটি এন জি ও’র কাজকর্ম নিয়ে ফিচার করতে তারা দুজনে পৌঁছোয় ওই এন জি ও’র ‘পরিত্যক্ত মহিলা’ আশ্রমে। সেখানে তারা দেখা পায় প্রভা দেবী নামে এক অপ্রকৃতিস্থ বৃদ্ধার। সদ্য তাঁকে রেলস্টেশন থেকে উঠিয়েছিল জি আর পি। হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। সেখান থেকে আইনী পথ-টথ পার করিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছে এন জি ও’টি। পুনর্বাসনের পথ খোঁজা চলছে বাড়ির ঠিকানা জানার চেষ্টা করে, নানারকম হাতের কাজে লাগিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মহিলার সঙ্গে কী কী ছিল জানতে চাওয়ায় আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত মহিলা একটি পুঁটুলি মেলে ধরে গিরীশ আর মণিকান্তের সামনে। পুঁটুলির মধ্যে বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু কিছু কাগজপত্রের মধ্যে একটা শেয়ার সার্টিফিকেট ছিল উনিশশো ছাপ্পান্নোর। কোনো এক তাজপুর কটন মিলস লিমিটেডের। ভারপ্রাপ্ত মহিলাটি একবার ফোন ধরতে গিয়েছিলেন, মণিকান্ত পীড়িতার ছবি তুলছিল, তখন গিরীশ ওই সার্টিফিকেটটি হস্তগত করে।
গিরীশ জানত ওই শেয়ার সার্টিফিকেটটার দাম।
মণিকান্ত কিছুদিন পর দেখে গিরীশের নতুন বাইক। একটা নতুন, দামী ক্যামেরা। অনেক চাপ খাটিয়ে জানতে পারে যে গিরিশ সেদিন সার্টিফিকেটটা হাতিয়ে নিয়েছিল। পরে তার মরে যাওয়া কাকার বাক্স থেকে পাওয়া বলে একলাখ টাকায় ঝেড়ে দিয়েছে তাজপুর কটন মিলসের মালিকের ওয়ারিশকে। 

  • আর ওই মহিলার পুনর্বাস? তাঁর চিকিৎসা? গিয়েছিলি তাঁর কাছে?
  • পাগল! এন জি ও গুলো গ্রান্ট পায় না লাখ লাখ টাকার? 
  • এ তো চিটিং! যদি জানতে পারে ওরা?
  • প্রমাণ? 

মণিকান্ত অত্যন্ত বিচলিত হয়। গিরীশের এই নীচতায় তো বটেই তবে তারই সাথে কিছুটা ঈর্ষাতেও। দুজনেই লাইনে নতুন, বেশি রোজগার নেই, মণিকান্তের  ছিল বলতে একটা লজ্ঝড় পুরোনো স্কুটার যাতে দুজনেই যাওয়া আসা করেছে এত দিন অব্দি। একে অন্যের বীটে সাহায্য করেছে। আর সেই  গিরীশ কিনা চিটিংবাজি করে একলাখ টাকা কামিয়ে নিল! রোসো, আমিও দেখাব।
মণিকান্তের একটা ভরসা ছিল নিজের ওপরে যে ও স্টোরিগুলো সাজায়  খুব গুছিয়ে। শুধু গিরীশ কেন,আরো অনেক বন্ধু সাংবাদিককে ও সাহায্য করে এ ব্যাপারে।
ওই এন জি ও’তে দ্বিতীয়বার গিয়ে বিশেষ ক্লু পেল না। সার্টিফিকেটটার গল্প আর জানাল না ভারপ্রাপ্ত মহিলাটিকে। জানাজানি হলে বেচারির ছোটো চাকরিটা নিয়ে টানাটানি হতে পারে। প্রভা দেবী তেমনই আছেন। হাতের কাজকর্ম ওনাকে শেখাতে হয়নি। খুব ভালো করেন সেলাই-ফোঁড়াই, আচার তৈরি করা–তবে নিজেকে এখনো চেনেন না। অতীত মনে নেই। যে কাগজটি, মানে তাঁর ওই পুটুলিতে রাখা পুরনো একটা প্রেস্ক্রিপশন, দেখে জানা গিয়েছিল তাঁর নাম প্রভা দেবী, তার ডাক্তারের নামটাও ছিঁড়ে উড়ে গেছে। শুধু ক্লিনিকের ঠিকানা পাওয়া গেল মুসরিগঞ্জ মোড়; জেলার নাম জলে খাওয়া। তবে তাজপুর যেখানে সেখানেই হবে আর কি।
মণিকান্ত খুব বেশি অসাধ্যসাধনের দিকে গেল না। তাজপুর কোথায় সেটা গিরীশের কাছেই জেনে নিল। এটাও জেনে গেল যে প্রধান চরিত্র জ্ঞানশঙ্কর মনের ইচ্ছে মনে রেখেই মারা গেছেন দশ বছর আগে। কৃপাশঙ্কর এখন দিল্লীতে থাকেন। তাঁর ছেলের ব্যবসা জামশেদপুরে। আর প্রপৌত্র দীপক পাটনা, দিল্লী আসাযাওয়া করে। এটাও জেনে নিল বন্ধুবান্ধবদের প্রশ্ন করে যে মুসরিগঞ্জ অন্য জায়গায়, অর্থাৎ প্রভা দেবীর পরিবার মিল বন্ধ হবার পর মাইগ্রেট করেছিল।
মণিকান্ত তাজপুর গেল। বন্ধ মিলের আগাছায় ভরা পরিসরটা ঘুরে ঘুরে দেখল স্থানীয় লোকজনের সাহায্যে। তাদের কাছেই জানল যে জমিটা কেনার পার্টি অনেক এসে এসে ফিরে গেছে, দীপক কুমার অর্থাৎ নন্‌হ্‌কিসাহব ধরে রেখেছেন – এখানে কিছু একটা প্রজেক্ট করার ইচ্ছে আছে তাঁর। মোড়ের কাছে দেখল তাজপুর ট্র্যাভেলসের দুটো বাস যাত্রীদের আকর্ষণ করতে নিউট্রাল গিয়ারে গোঁ গোঁ করছে।
তাজপুরের বৃদ্ধ কয়েকজনের কাছে প্রশ্ন করে করে মাথায় আঁকল পঞ্চাশ বছর আগের ছবিটা। তাজপুর তখন গোটা এলাকাটার ভবিষ্যৎ ! এখন কিছু বোঝা যায়?
বাকি রইল প্রভা দেবীর সূত্র। স্থানীয় লোকজন কিছু মনে করতে পারলনা। এত এত শ্রমিক কর্মচারী। স্বামীর নাম বলতে পারলে তবু চেষ্টা করে দেখা যেত। ঘরওয়ালির নাম কে জানে? কে মনে রাখে?
এই শেষ সত্যটাই সূত্র ধরিয়ে দিল মণিকান্তকে।
…কে মনে রাখে সেই মা-বাপমরা ছোট্টো কিশোরীটির নাম যে চোখের মণির মত আগলে রেখেছিল দুজন বিপ্লবীকে! সেটা উনিশশো উনপঞ্চাশ সাল। তিনদিন আগে জমিদারের গোলায় আগুন লেগেছে। আগুন লাগিয়েছে জমিদার নিজেই, কিন্তু পুলিশের খাতায় নাম চড়িয়েছে সব ক’জন কিসান সভা কর্মীর। কেন না তারাই উস্কেছিল চাষীদের, নদীর চরের কাছে জমিদারের আঠারো বিঘা বেনামী জমি কব্জা করে ফসল ফলাতে।…
ব্যাস, আর কী চাই! কিছুটা তার নিজের গ্রামের শোনা গল্প। কিছুটা কিসান সভার ডকুমেন্ট। কিছুটা নেট। লিখতে শুরু করেই বুঝতে পারল মণিকান্ত যে সে ভালো লিখছে। ভাষার একটা স্টাইল ধরে নিতে পেরেছে সে।
উপন্যাস পুরো হল। ছাপা হল। বিক্রী হল ভালো। কিছু রয়াল্টি পেল। তারপর হঠাৎ একদিন দুপুরে ফোন। ভিজিয়ন এন্টারটেনমেন্টের মালিক গৌতম শাহ। উপন্যাসটা নিয়ে সিরিয়াল করবেন। সিরিয়াল হল আর হিট করল সন্ধ্যের প্রাইম স্লটে।
মণিকান্ত এখন এই শহরের গুটিকয়েক সেলিব্রিটিদের একজন। গিরীশের থেকে অনেক বেশি টাকা তার কাছে। তার ওপর একটা নতুন ক্যেরিয়র ধরার সম্ভাবনা।

রেস্তোরাঁ  বলতে অনেকখানি ঘাসের উঠোন জুড়ে ছড়ান ছোটো ছোটো কুঁড়েঘর। দুএকটি বড় কুঁড়ে বা গোলার মতও আছে মাঝখানে, বিয়েশাদি বা পার্টির জন্য। ভিতরের সাজসজ্জায় গ্রাম্য ও ঐতিহ্য সচেতন ভাবটা ধরে রাখার চেষ্টা। কর্মচারীদের পোষাক। বাসনপত্রের রঙ। এমনকি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাটাও মা যশোদার ক্ষীরের হাঁড়ির পিছনে; অফিস ঘরের স্ক্রীনে সবচে’ বড় প্রোফাইলে বাঁদিকে,যদিও ইষৎ আউট অফ ফোকাস, বালকৃষ্ণ দৃশ্যমান নিশ্চই।
ওদের চারজনের সামনে শুধু কফির কাপ। খাওয়ার এঁটো প্লেট, বোল ইত্যাদি একটু আগেই উঠিয়ে নিয়ে গেছে বেয়ারা। কুঁড়ের প্রবেশ পথ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গিরীশই প্রথম দেখতে পেল বৃদ্ধ কৃপাশঙ্করজী অথবা কে এস কুমারকে। সঙ্গে তাঁর প্রপৌত্র দীপক আর দুজন ব্যক্তিগত রক্ষী। উঠে দৌড়ে কাছে গিয়ে অতিবিনীত প্রণাম ঠুকল। আপনি এখানে স্যার? ভালো আছেন?

  • আপনাকে চিনলাম না!
  • আমি গিরীশ! পাঁচ বছর আগে আপনাকে তাজপুর কটন মিলের একটা শেয়ার সার্টিফিকেট…সেই নাইন্টিন ফিফটির…
  • আরে হ্যাঁ! আপনিই তো। তা আপনি এখানে কী করছেন?… যাক, ভালোই হল আপনাকে পেয়ে। শ্রী মণিকান্তজী, লেখক, তাঁকে আপনি চেনেন?
  • (ইষৎ থতমত খেয়ে) অ্যাঁ…হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?
  • উনিও এখানেই আছেন। ওনার সাথেই দেখা করতে এসেছি। 
  • আসুন স্যার, আপনাকে মণিকান্তের সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।  

কুঁড়েঘরের ভিতরে টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে নিজের চেয়ারে কৃপাশঙ্করজীকে বসায়। অন্য খালি টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে তাঁর প্রপৌত্রকে বসায়। রক্ষী দুজন বাইরেই থাকে। মণিকান্তের চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গিরীশ আলাপ করায়।
এই মণিকান্ত, স্যার। আমরা পুরোনো দিনের বন্ধু। আর মণিকান্ত! ইনিই হলেন কৃপাশঙ্করজী, মিস্টার কে এস কুমার, যাঁর পরিচয় আশা করি তোমাকে দেওয়ার দরকার নেই (মণিকান্ত এবং বাকি যে দুজন তারাও শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে)। আর সঙ্গে ওনার প্রপৌত্র দীপক কুমার, জে এস মোটরস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

  • বাহ, আপনি দেখছি আমাদের পরিবারের নাড়িনক্ষত্র…
  • ওভাবে বলবেন না স্যার! বিজনেসের বীটে যে ক’জন রিপোর্টার ঘোরাফেরা করে, তারা সবাই এটুকু জানে।
  • আর বাকি দুজন কে?
  • (মেয়েটি নিজেই পরিচয় দেয়) আমি রিতিকা, স্যার! এ সুহেল। আমরা দুজনে মণিকান্তজীর একটা ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম। 
  • কোনো খবরের কাগজ? না কি চ্যানেল?
  • না স্যার, দৈনিক সবেরা। 
  • আমরা কি ভুল সময়ে এসে পড়েছি?
  • (মণিকান্ত হাত জোড় করে উঠে দাঁড়ায়) দয়া করে এরকম বলবেন না। কবে থেকে ইচ্ছে ছিল দেখা করি আপনার সাথে।
  • এক শর্তে থাকব। (সবাই প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকায়) আপনার ইন্টারভিউ যদি শেষ না হয়ে থাকে, সেটা আগে শেষ করে নিন। তারপর আপনারা সবাই এখানে ডিনারে আমার অতিথি হবেন। রাজি? 

দীপক কুমার সবাইকে হাতজোড় করে উঠে দাঁড়ায়, “আমায় ক্ষমা করবেন। আমার একটা অন্য এনগেজমেন্ট আছে। শুধু দাদুকে নিয়ে এসে মণিকান্তজীর সাথে দেখা করিয়ে দেওয়া আমার কাজ ছিল” বলে বেরিয়ে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রক্ষী তার সঙ্গ নেয়।
মণিকান্ত, রিতিকা আর সুহেলের দিকে তাকিয়ে চলতে থাকা গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যায়।
“না, আমার মাথায় কোনো নতুন উপন্যাস নেই। আমি জানি না, যদি এই গল্প লেখকের কাজটা আমাকে ক্যেরিয়র হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় আমি কিভাবে এগোবো। তবে… একটা কাজ হাতে আছে। যদি সেটা সফল ভাবে করতে পারি, হয়ত নতুন রাস্তা খুলবে!… 

  • একটা প্রশ্ন স্যার। উপন্যাসটা আপনি কিভাবে লিখলেন সেটা জানলাম। কিন্তু কেন লিখলেন? মানে আপনি তো সাংবাদিক। হঠাৎ উপন্যাস লেখার কথা মাথায় এল কেন? কোনো অনুপ্রেরণা?
  • অনুপ্রেরণা! (মণিকান্ত চকিত দৃষ্টি হানল গিরীশের দিকে; গিরীশের মুখটা প্রথমে হাসিহাসি ছিল কিন্তু মণিকান্তের দৃষ্টির স্থিরতায় ঈষৎ বিভ্রান্ত তারপর কালো হয়ে উঠল) অনুপ্রেরণা বলব না, কেন না যাঁর কথা লিখব ভেবেছিলাম তাঁর কথা তো আর লেখা হল না। তবে সেটা লেখার তাগিদটাই যেহেতু শেষ অব্দি এই উপন্যাসটা লিখিয়ে নিল আমাকে দিয়ে, তাই তাঁর নামটাই বলতে হয়!
  • বুঝলাম না স্যার।
  • দেখুন, উপন্যাসটাতো বলতে গেলে উন্নয়ন নিয়ে! একটা অখ্যাত আধা-গ্রাম আধা-শহরতলী জনপদের মানুষজনের পিছিয়ে থাকা জীবন, স্বাধীনতা-উত্তর কালে সেখানে একটা কটন মিল গড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে থাকা অর্থনীতি – মানুষজনের মধ্যে উৎসাহ, শয়ে শয়ে নতুন মানুষের প্রবেশ, ব্যবসা,বাজার, রাস্তা, পরিবহন ইত্যাদিতে জমজমাট বদল – এবং শেষে মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবার সেই পুরোনো পশ্চাৎপদতায়, অনেকগুলো নাগরিক বিকৃতি সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্ত্তন! এই তো উপন্যাসের তিনটে পর্ব! এরই মাঝে যোগসূত্র হয়ে আছে তিনটে পরিবারেরও কাহিনী। ওই তিনটে পরিবারের একটি, বাইরে থেকে এসে কটন মিলে চাকরী নিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করা সিংহেশ্বর যাদব এবং তাঁর স্ত্রী কমলা দেবী…
  • এবং তাঁদের মেয়ে নির্মলা…
  • হ্যাঁ, সে তো আছেই। তা, ওই কমলা দেবীর চরিত্রটা যাঁকে দেখে তৈরি করা, তাঁর নাম প্রভা দেবী। আমি এবং (গিরীশের দিকে ইশারা করে) ইনি পাঁচ বছর আগে একটা বৃদ্ধাশ্রমে তাঁর দেখা পাই। তিনি এখন সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত, অনেক চেষ্টা করেও তাঁর অতীত জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু সেটা নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়েই এই উপন্যাসটা মাথায় রূপ নেয়। কাজেই বলতে পারেন সেটাই অনুপ্রেরণা বা তাগিদ!
  • কোথায় আছেন এই প্রভা দেবী?
  • (মণিকান্ত ঠিকানাটা লিখিয়ে দেয়) আর কিছু?
  • না স্যার। থ্যাঙ্ক ইউ! পরে প্রয়োজন হলে আবার কিন্তু বিরক্ত করব।
  • স্বাগত।

“তাহলে” কে এস কুমার এতক্ষণে মুখ খোলেন, “লেট দ্য পার্টি বিগিন! কী বলেন?”
খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেলে মণিকান্তর দিকে তাকান। 

  • আমি যে প্রশ্নটা করতে আপনার সাথে দেখা করার চেষ্টা করছিলাম এতদিন ধরে, তার উত্তর তো আমি মনে হচ্ছে পেয়ে গেলাম। আমি যা ভাবছিলাম সেটাই তো সত্যি? আপনার উপন্যাস এবং ওই সিরিয়াল – কী যেন নাম?

(সুহেল ধরিয়ে দেয়, ‘ছোট্‌কি কা ঝুলা’) হ্যাঁ, ওটা আমাদের তাজপুর কটন মিল নিয়েই তো লেখা? (মণিকান্ত স্বীকৃতিসূচক মাথা নাড়ে) সত্যিই ভালো লিখেছেন। অভিনন্দন! কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না। আপনার বাড়িও তো ওই এলাকায় নয়। তাহলে এক আত্মবিস্মৃত মহিলা, কী নাম বললেন, প্রভা দেবী…তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ আপনাকে তাজপুর পৌঁছে দিল কিভাবে?

  • (গিরীশের দিকে আরো একবার তাকিয়ে নিল মণিকান্ত) আসলে ওই মহিলার জিনিষপত্রের মধ্যে একটা শেয়ার সার্টিফিকেট দেখেছিলাম, তাজপুর কটন মিলস লিমিটেডের। আর তো বিশেষকিছু ছিল না ওর কাছে। তাই ওটাকেই ওর পরিচয়ের একমাত্র সূত্র ধরে এগোতে শুরু করলাম!
  • আরো একটা শেয়ার সার্টফিকেট! 
  • নাহ ছিল না তো একটাও ছিল না আর এখন দুটো! এবার তো মনে হচ্ছে আরো কিছু পাওয়া যাবে অন্য অনেকের কাছে!
  • দুটো মানে?
  • একটাতো আপনাদের এই বন্ধু গিরীশজী আমাকে বিক্রী করেছিলেন এক লক্ষ টাকায়। (চমকে ওঠে রিতিকা আর সুহেল, “একলক্ষ টাকায়!”) হ্যাঁ, ওটাই পুরষ্কার ধার্য করেছিলাম শেয়ার সার্টিফিকেটটা পাওয়ার আশায়।… তাহলে একবার যেতে হয় প্রভা দেবীর কাছে। (গিরীশের দিকে) তা’ আপনাদের দেশের বাড়িও তো বোধহয় তাজপুরের দিকে নয়। অবশ্য হয়ত মার্কেটে কিনেছিলেন। শেয়ারটেয়ার কিনতেন আপনার কাকা তার মানে।

গলায় খাবারটা দলা পাকিয়ে কাশি এল গিরীশের, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল সুহেলের কাশিতে। হঠাৎ প্রায় দমবন্ধ হবার যোগাড় ছেলেটির। জলের গেলাসটা হাতে নিয়ে ছুটে কুঁড়েঘরটির বাইরে চলে গেল। পিছন পিছন ছুটল রিতিকা। পিঠে হাত বুলিয়ে টুলিয়ে দেওয়াতে ধাতস্থ হল ছেলেটি। সবাই চুপচাপ ডিনার শেষ করছে। হঠাৎ রিতিকা প্রশ্ন করল কৃপাশঙ্করকে।

  • শেয়ার সার্টিফিকেটটার জন্য পুরষ্কার ধার্য করেছিলেন কেন স্যার?
  • করেছিলাম। তখন একটাও পাওয়া যাচ্ছিল না খুঁজে। আর বাবার আব্দার ছিল।  
  • আব্দার! 
  • বৃদ্ধবয়সে যা হয়, নিজের পুরোনো, অসফল স্বপ্নগুলো ঘিরে ধরে। এই তো, গিরীশজীই আপনাদের সব বলতে পারবেন। মণিকান্তজীও তো রিসার্চ করেছেন তাজপুর কটন মিলের মালিকের পরিবারের কাহিনী নিয়ে।… বাবা মারা গেছেন দশ বছর হল। ইন ফ্যাক্ট, গিরীশজী যখন এনেছিলেন, তখন বাবা মৃত। তবু বাবার সামনে দেওয়া কথা। তাই পুরষ্কারের টাকাটা ওনাকে দিয়ে দিই।

রিতিকার মাথায় তখন অন্য কথা ঘুরছে। ‘শালা এই সুহেল, একলাখ টাকার নামে ফুসফুসে ফ্রায়েড রাইস আটকে গেল! গাধা!… মণিকান্তজী তাঁর পরের প্রজেক্টটা ভাবার আগে তাঁর উপন্যাস লেখার গল্প নিয়ে আমিও বাজারে ঝাড়ব এক অনকহী, অব্যক্ত কাহিনী! মার্কেটে খেয়ে নিলে আমিও রাণী। কাল যেতে হবে প্রভা দেবীর কাছে। কোনো ক্লু যদি পাওয়া যায় !
রিতিকা পরের দিনই পৌঁছেছিল। প্রভা দেবী একটা বটুয়ায় পুঁতি দিয়ে ফুল তৈরি করছিলেন। রিতিকার কথা শেষ হলে এনজিওর ভারপ্রাপ্ত দিদির সাথে কথা বলে বটুয়াটা কিনে নিল রিতিকা। 

  • উনি কি স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন, ম্যাডাম?
  • না। তবে ফিরে পাবেন, কিছুদিনে, ডাক্তার বলছেন। 

সদ্য কেনা বটুয়াটার দিকে তাকাল রিতিকা। অধীর ভাবে জিজ্ঞেস করল, “কত দিনে, আন্দাজ?”
*******************************************

বিদ্যুৎ পাল পরিচিতি
জন্মতারিখ ২৪শে জুলাই ১৯৫২। জন্মস্থান পাটনা (বিহার)। পড়াশুনো সবটাই পাটনায়। চাকরি  ব্যাঙ্কে,বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সারাদিনের ব্যস্ততায় শামিল নিজের লেখালিখি,পড়াশুনো,বিহার হেরল্ডের সম্পাদনা,দেশবিদেশের সঙ্গীত শোনা,বইপত্র সম্পাদনা। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা,গল্প ও প্রবন্ধ (প্রবন্ধটা অবশ্য বাংলা,হিন্দী এবং ইংরেজি,তিন ভাষাতেই লিখতে হয়) প্রকাশিত। আপাততঃ ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘বিহার হেরল্ড’এর সম্পাদক,ও বিহার বাঙালি সমিতির মুখপত্র ‘সঞ্চিতা’র যুগ্মসম্পাদক।

 

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!