সিন্দ্রির দুর্গোৎসব
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
সিন্দ্রি – নগরজীবন
নামেই বিহার! অবশ্য এখন ঝাড়খণ্ড। কয়লা-খনি শোভিত ধানবাদ জেলার একপ্রান্তে দামোদরের তীরে একটি নিরিবিলি শহর সিন্দ্রি। যেমন সেখানে বিহারির তুলনায় বঙ্গভাষী আর কুর্মি-আদিবাসী বেশি, তেমনি সিন্দ্রি নামে শহর হলেও গাছগাছড়া, নদী, পুকুর, পার্ক, প্রচুর খেলার মাঠ- এসব নিয়ে সেখানে গ্রামের ছোঁয়াই স্পষ্ট। অন্যদিকে এশিয়ার বৃহত্তম সার কারখানা FCI, PDIL (আগে নাম ছিল P & D) নামে গবেষণা সংস্থা, ACC সিমেন্ট কারখানা আর রাজ্যের সবচেয়ে বড় আর নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ BIT- তা সত্ত্বেও বসবাসের চমৎকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। নদীর ওপারে বাংলার পুরুলিয়া জেলা, কলকাতা থেকে মাত্র ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা। এমন একটা জায়গায় ধূমধাম করে দুর্গাপূজা হবে না- এটা ভাবা যায়?
যুবশক্তি আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ছিল এই শহর, অভাব ছিল না মাঠ-ঘাটের। তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ক্লাব গড়ে তুলতে কোন অসুবিধা হয়নি। সিন্দ্রি শহরের প্রতিষ্ঠা হয় মোটামুটি ১৯৪৯-৫০ সালে। তারপর একে একে গড়ে ওঠে রেনেসাঁ, তরুণ উদয়, ভ্রাতৃসঙ্ঘ, জয়হিন্দ, ডোমগড় ইউনাইটেড- এসব ক্লাব যারা খেলাধূলা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গোৎসব-কালীপূজাও সমান তালে করে গেছে। একটা এক-দেড় লক্ষ জনবসতিওয়ালা শহরে গোটাকুড়ি দুর্গাপুজো নামানো- চাট্টিখানি কথা ছিল না সেই বাজারে, বাঙালির সংখ্যা যদিও প্রায় ২০% ছিল। চলুন এবারের পুজোটা তাহলে সিন্দ্রি থেকে ঘুরেই আসি।
সিন্দ্রির দুর্গাপূজা – সেকাল
সিন্দ্রির স্বর্ণযুগে, মানে ১৯৬৫-৮৫-র মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে সেখানে প্রায় কুড়িখানা পুজো হত। পুরনো হাট, রাঙামাটি জলট্যাঙ্ক, এসিসি, মাতৃপূজা, জয়হিন্দ, পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, সেন্ট্রাল, পোস্ট-অফিস মাঠ, মনোহরটাঁড়, ডোমগড়ে তিনটে, বি আই টি কলোনি, গোশালা, রামকৃষ্ণ মিশন- আরো বোধহয় ছিল দু-তিনটে। ডেকরেশন বা জাঁকজমক হয়ত তেমন আহামরি কিছু ছিল না, তবে ভাইবোন বা বন্ধুরা মিলে ঘুরে ঘুরে পুজো দেখার মজাই আলাদা ছিল। আর ছিল ট্রাকে করে নাচতে নাচতে মূর্তি-গড়ার একমাত্র কারিগর শিবমঙ্গলের বাসা ছাড়িয়ে জি এম পুকুরে বিসর্জনের পর্ব।
যতদূর জানি পুরনো শহর সিন্দ্রি বস্তিতে গ্রামবাসীরা একটা পুজো করত, তার সঙ্গে অধুনা সিন্দ্রি শহরের পুজোর তেমন সম্বন্ধ নেই। তবে সার কারখানার প্রাচীনতম বসতি রিভারসাইড কলোনিতে পাঁচের দশকের গোড়াতেই শুরু হয় সিন্দ্রির প্রাচীনতম দুর্গাপুজো। তেমন জাঁক-জমক না থাকলেও একঘেয়ে আধা-নগরের জীবনে বৈচিত্র্য এনে দিত সন্তোষ কর্মকার, গোপালদা, পাহাড়িদা, লালুদাদের উদ্যোগে আনা যাত্রাপালা আর বাঁকুড়ার মীরা-ভজন জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো। শহর গড়ে ওঠার পর ডাউনটাউন সহরপুরা বাজারের মধ্যে দোকানদারদের সহযোগিতায় আর উদ্যমে মহা ধূমধাম করে শুরু হল হাটের ভেতরের ঐতিহ্যবাহী পুজো, আর বাইরের সেন্ট্রাল মাঠের সর্বজনীন, সেটা বোধহয় ১৯৫৩ সাল। শহরের অন্য দুই প্রান্ত ডোমগড় আর রাঙামাটিতে তার পরে পরেই স্থানীয় উদ্যোগে শুরু হয় একটি করে দুর্গাপূজা আর স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে শুরু হল পূর্বাঞ্চল, মাতৃপূজা, পশ্চিমাঞ্চল, আর রোহরাবাঁধ পোস্ট অফিসের মাঠের পুজো। পূর্বপ্রান্তে এসিসি সিমেন্ট কলোনির সেন্ট্রাল ময়দানে কোম্পানি-কর্মচারিদের মিলিত উৎসাহে যে পূজা শুরু হয় তার ডেকরেশন সিন্দ্রি ছাড়িয়ে আশেপাশের গ্রামগুলি আর পাথরডিহ-ডিগোয়াডিহ-ঝরিয়া-ধানবাদের মানুষদেরও টেনে আনতো সিন্দ্রিতে। এরপর স্থানীয় মানুষদের অনুরোধ-উপরোধে ক্লাবগুলোও নাম লেখাল দুর্গোৎসবের আয়োজনে। রাঙামাটি আর সহরপুরার মাঝামাঝি বিশাল একখানা মাঠের অর্ধেকটা ছিল জয়হিন্দ ক্লাবের দখলে, সেখানে, ডোমগড় ইউনাইটেডের মাঠে আর রাঙামাটির রেনেসাঁ ক্লাবের মাঠে শুরু হল দুর্গোৎসব।
তবে ছয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিন্দ্রির দুর্গোৎসব মানে ছিল তখনকার দৈনন্দিন সাদামাটা জীবনযাত্রায় একঘেয়েমির মাঝে কিছুটা বৈচিত্র্য, একটা পরিবর্তন। পুজোর অনুষঙ্গ হিসেবে আসত জলসা, নাটক, যাত্রাপালা, রামলীলা আর নানা মেলার আয়োজন। তারমধ্যে ছিল দলবেঁধে পুজো দেখতে বেরোন, আড্ডা আর ফিরে এসে বিভিন্ন সংস্থার সাজসজ্জা, প্রতিমা আর আলোর কাজ, অনুষ্ঠান আর সংলগ্ন মেলার গল্প আর তাদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। ১৯৬৫তে সার কলোনীর একপ্রান্তে বি-আই-টির হোস্টেল আর ময়ূর গেটের পাশে বড় একটা জমি নিয়ে গড়ে উঠল রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম সংঘ,সংক্ষেপে মিশন। এফ-সি-আই, পি-অ্যাণ্ড-ডির অফিসার আর বি-আই-টির প্রফেসারদের সমন্বয়, সহযোগিতা আর পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হল দুর্গাপূজা-সেটা বোধহয় ১৯৬৬ হবে। প্রথমে রামকৃষ্ণ মন্দিরের ভেতরে শুরু হয়ে পরে বাইরে গড়ে তোলা মঞ্চে নিয়ে আসা হয় পূজার আয়োজনকে। এই প্রথম যেন পুজোর মধ্যে সত্যিকারের ভক্তিভাবের প্রাধান্য দেখতে পেল সিন্দ্রিবাসী। মিশনের পুজো নিয়ে এক অখ্যাত কবি লেখেন-
“শারদ রাতের পেলেই আভাস
ছাতিম ছড়ায় নবীন সুবাস
মন্দিরে শিউ, গৌরী, কিষণ,
রামকৃষ্ণের শান্তি মিশন।
আনন্দময়ী দশভূজা
আস্তে ধীরে নিলেন পূজা।
মন্দিরা ঢোল বাজায় ক’জন
মাইক বিনাই ভক্তি-ভজন।
সবার মাথা পড়ল নুয়ে
আলপনাময় পৈঠা ছুঁয়ে।”
আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে জানাই, ওই পাড়ার বাসিন্দা হিসেবে ১৯৬৬ সাল থেকেই দেখে আসছি মিশনের পুজো। ছোটবেলায় ছিল শুধু পুজো দেখা আর প্রসাদ খাওয়া, একটু বড় হতেই নিয়েছি আশ্রমের হয়ে উদ্বোধন প্রকাশনের ধর্মপুস্তক বিক্রি আর প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব, আর একটু বড় হতে চাঁদা তোলা থেকে জোগাড়-যন্ত্র, সবকিছুতেই দল বেঁধে হাত লাগিয়েছি। মহানবমীর ভোগের ডোঙাভর্তি খিচুড়ি-পায়েস-লাবড়া প্রসাদের আকর্ষণে সারা শহর ভেঙে পড়ত, তার অমৃতসম স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।
তারপর সত্তরের দশকে সিন্দ্রির পশ্চিমে মনোহরটাঁড় অঞ্চলে গড়ে ওঠে লোকালয়, অগত্যা একটা দুর্গাপূজাও শুরু হয় এর মধ্যখানের অর্ধ-গোলাকার মাঠে। এছাড়া ডোমগড়ের নতুন তৈরি শিবমন্দিরেও বোধহয় হত একটা পুজো।
সিন্দ্রির দুর্গোৎসবের মূল আকর্ষণের সেরাটাই তো বলা হয়নি- তা ছিল রাবণ-দহন। এটা সে যুগে তো বটেই আজও খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। মূলতঃ ব্যবসায়ী-সংঘের সহযোগিতায় আর মন্দির-কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে সহরপুরার শিব মন্দির প্রাঙ্গনে প্রায় সত্তর ফুট উঁচু খড়-বিচালি-কাপড়-রঙ এসব দাহ্য-পদার্থ দিয়ে গড়ে তোলা হয় দশানন রাবণের বিশাল মূর্তি। ভেতরে ঠাসা থাকে বারুদ-বাজি-পটকার স্তুপ। কথিত আছে ত্রেতাযুগে শারদীয়া দুর্গাপূজা শেষ করে শ্রীরামচন্দ্র সীতা-উদ্ধার লক্ষ্যে লঙ্কার রাবণকে বধ করেছিলেন, সেই বিজয়োৎসবের স্মৃতিতেই পালিত হয় বিজয়া। অগত্যা রাবণের সৎকার কার্যও রামভক্তদেরই করণীয়। একজন রাম সেজে জ্বলন্ত অগ্নিবান ছুঁড়ে মারে রাবণের মুখে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে জ্বলে ওঠে সেই মূর্তি, পটকার আওয়াজের মধ্যে কয়েক মিনিটেই ভস্মীভূত হয়ে যায় সেই বিশাল রাবণের দেহ। এই রাবণ-দহন দেখতে সিন্দ্রিবাসীর সাথে সাথে সংলগ্ন গ্রামগুলোর থেকেও হাজার-হাজার দর্শক আসে দল বেঁধে, তারপর কিছুদূরের জি-এম পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন হয় একে একে।
সিন্দ্রির দুর্গাপুজো- একাল
২০০২-০৩ এ বিভিন্ন ঔদ্যোগিক-রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক কারণে বেজে ওঠে সিন্দ্রির সার কারখানার মৃত্যুঘণ্টা,বন্ধ হয়ে যায় ভারতের প্রথম আর এককালের এশিয়ার বৃহত্তম সারের কারখানাটি। ছাঁটাই ঠিক না হলেও অসময়ে অবসর নিতে হয় এর কয়েক হাজার কর্মচারীকে। যদিও সবাই সরকারি বাসা ছাড়েনি,তবু ক্রমে সিন্দ্রির সার কলোনী অনিবার্যভাবে এক অর্ধ-শ্মশানে পরিণত হয়। তবে জনজীবন থেমে থাকে না। অর্থাভাব আর শহরের উন্নয়ন আর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হলেও যাঁরা রয়ে গেছিলেন তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় চালু রইল দুর্গাপূজা, শ্যামাপূজা, এমনকি গড়ে উঠল নতুন কিছু মন্দির আর প্রতিষ্ঠানও-যেমন সাইবাবা মন্দির, তালতলা কালীবাড়ি ইত্যাদি। বহুদিন ধরে নানা রাজনৈতিক টানা-পোড়েন পেরিয়ে ২০২১-এ সিন্দ্রির পরিত্যক্ত কারখানার একাংশে চালু হয় CIL, NTPC, FCI, IOCLও HFCL, পাঁচটি কোম্পানির যৌথ-উদ্যমে নতুন উদ্যোগ- হিন্দুস্তান উর্বরক অ্যান্ড রসায়ন লিমিটেড (HURL)। এই কোম্পানির কর্মচারি আর কনট্রাক্টাররা মিলে সহরপুরার নাঙ্গল হোস্টেলের হলঘরে গত বছর প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করে। অর্থাৎ- “মৃত্যুই জীবনের শেষ নহে নহে”! জীবন থেমে থাকে না, ছাইয়ের ভেতর থেকেই ফিনিক্স পা সিন্দ্রির জনজীবনের নতুন অধ্যায়ে স্মরণ করি কবিগুরুর গানের পংক্তি ক’টি-
“তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয় নাহি শেষ-
নাহি নাহি দৈন্য-লেশ,
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।।”
সিন্দ্রির দুর্গাপূজা- কিছু ছবি ঋণস্বীকারঃ
১) সিন্দ্রি, উইকিপেডিয়া
২) বৈশাখ গুপ্ত
৩) শ্যামল বিশ্বাস
৪) অনুপম চ্যাটার্জি
৫) প্রিয়দীপ ঘোষ
৬) ফেসবুক পেজ- রাজেন্দ্র হাইস্কুল ও রবীন্দ্র পরিষদ ফোরাম, সিন্দ্রি।
************************************
পল্লব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতক। কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের খনিজ তৈলক্ষেত্রে কাটিয়েছেন সারাজীবন, সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত। বিহারের, অধুনা ঝাড়খণ্ড, যে অঞ্চলে তিনি মানুষ সেখানে ‘নানা ভাষা, নানা জাতি, নানা পরিধান’ হলেও একসময় বাংলাভাষা শিক্ষা ও চর্চার আবহ ছিল। সেই শিক্ষা থেকে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মায় ও বিগত কয়েক বছরে অবসর, জয়ঢাক, ম্যাজিক-ল্যাম্প, ছুটির ঘন্টা, আদরের নৌকা, ঋতবাক ইত্যাদি নেট-পত্রিকা ও যুগ, ট্রৈনিক, বোম্বে-ডাক ইত্যাদি মুদ্রিত পত্রিকায়, ক্যাফে-টেবল প্রকাশিত শরদিন্দু স্মৃতি-সংখ্যায় লিখে আসছেন। তাঁর প্রকাশিতব্য গল্প সংগ্রহ ‘আড্ডা আনলিমিটেড’ ও ‘বরাহ-নন্দন ও অন্যান্য গল্প’- দুটিই এখন যন্ত্রস্থ।