Shadow

বিস্মৃতির অতল থেকে – প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

PC: Wikimedia Commons

বিস্মৃতির অতল থেকে

প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

সে অনেকদিন আগের কথা। গোয়া-র একটি ছোট্ট গ্রাম কুর্দি। বর্ধিষ্ণু এই গ্রাম ছিল কৃষিসম্পদে সম্পন্ন। প্রায় সাড়ে চারশ পরিবারে আনুমানিক তিন হাজার জনবসতির এই গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জয়শ্রীবাঈ-এর গর্ভে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। তখন বৃটিশ শাসন। সময়কাল ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দ। জয়শ্রী তাঁর আদরের মেয়ের নাম রাখলেন মোগু। জয়শ্রী নিজে ছিলেন সুমিষ্ট ও সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিণী। ছোট্ট মোগুর সুরের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম দেখে জয়শ্রী মোগুকে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন মনস্থ করেন। তাছাড়া, অমন প্রত্যন্ত গ্রামে সেসময় সেভাবে পৌঁছয়নি শিক্ষার আলো। নিজের অপ্রাপ্তি তিনি কন্যার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়ার দৃঢ় সংকল্পে মাত্র দশ বছর বয়সের মোগু কে পার্শ্ববর্তী জাম্বোলিম গ্রামের মন্দিরে রেখে আসেন, যাতে সেখানে মোগু সংগীত শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ প্রাপ্ত হয়। জাম্বোলিমে এক ভবঘুরে গায়কের কাছে মোগুর সঙ্গীতশিক্ষার প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। কিছুদিন এভাবে চলার পরে জয়শ্রী মোগু কে নিয়ে যান “চন্দ্রেশ্বর ভূতনাথ সঙ্গীতমণ্ডলী” নামে এক ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার দলের অধিকারীর কাছে। ১৯১৪ সালে স্বল্পকালীন রোগভোগের পর জয়শ্রীর অকালমৃত্যু মোগুর জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। মৃত্যুর পুর্বে জয়শ্রী মোগুকে বলেন, “তুমি ভারতবিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী না হওয়া অবধি আমার আত্মার শান্তি হবে না।“
মৃত্যুশয্যায় বলা মায়ের কথাগুলোকে মূলধন করে মোগু স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু, দুর্ভাগ্য একা আসে না। মায়ের মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যেই “চন্দ্রেশ্বর ভূতনাথ সঙ্গীতমণ্ডলী” দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তখন “সাতারকর স্ত্রী সঙ্গীতমণ্ডলী” মোগুকে তাদের দলে সামিল করে নেয়। সেখানে “চিন্তভুবা গুরব” নামের এক শিক্ষকের কাছে মোগু তালিম নিতে থাকে। একই সাথে “দত্তারামজী নানোদকার” তাকে গজল শেখাতে থাকেন। ইতিমধ্যে “পুণ্যপ্রভাব” নাটকে “কিঙ্কিনি” এবং “সুভদ্রা” নাটকে “সুভদ্রা”-র চরিত্রে নেচে গেয়ে অভিনয় করে মোগু বেশ নাম কিনেছে। কিন্তু, তার এই উত্তরণ মেনে নিতে পারেনি সেই দলেরই এক বয়স্কা অভিনেত্রী। তিনি কায়দাকানুন করে মোগু কে সেই দল থেকে বহিষ্কার করেন। মোগু তখন অকূলপাথারে। চোখে স্বপ্ন, কানে মায়ের শেষবেলার কথাগুলো, অথচ সামনে গাঢ় অন্ধকার। অর্ধাহার ও দুশ্চিন্তায় মোগু অসুস্থ হয়ে পড়ে।
১৯১৯-শে মোগু যখন গুরুতর অসুস্থ, তখন তার এক আত্মীয়া তার চিকিৎসার জন্য মোগু কে নিয়ে সাংলি চলে যান। সাংলি মহারাষ্ট্রের এক জেলা সদর। সেখানে এসে মোগু এক নতুন আশার আলো দেখতে পায়। সেখানে সে “রামলাল” নামক এক নৃত্যগুরু-র কাছে কত্থক নৃত্যের তালিম নেওয়া শুরু করে এবং একই সাথে উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখতে থাকে “খান ইনায়েত পাঠান” নামক এক সংগীতশিক্ষকের কাছে। সেই সময় “বাবাসাহেব সামবারে”-র কাছে চিকিৎসার প্রয়োজনে আগ্রা ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতবর্ষের প্রাতস্মরণীয় সংগীতজ্ঞ উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেব সাংলিতে অবস্থান করছিলেন। তিনি তাঁর চিকিৎসাস্থল থেকে বাসায় যাতায়াতের পথে মোগু-র আত্মীয়ার বাড়ীর পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করতেন। প্রতিদিনই মোগু-র রিওয়াজ শুনে তিনি সেখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে, মোগু-র গান শুনে তারপর যেতেন। একদিন কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে তিনি সিঁড়ি ভেঙে সেই বাড়ীতে প্রবেশ করেন। মোগু অপরিচিত আগন্তুককে দেখে গান থামিয়ে দিলে তিনি গান শুরু করতে বলেন। গান শুনে উস্তাদজী মোগু কে অনেক প্রশংসা করেন এবং নিজেই গান শেখাতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। সেখানেই সেদিন মোগু উস্তাদজীর কাছে প্রথম শিক্ষালাভ করলেও উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেবের সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিলনা। যখন সে সব জানতে পারে, আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ে।
এভাবে প্রায় আঠারো মাস চলে মোগু-র সঙ্গীতশিক্ষা। তার পরে ১৯২১-এর শেষের দিকে উস্তাদজী বোম্বে চলে যান। ১৯২২-শে মোগু-ও গুরু কে অনুসরণ করে। বোম্বে শহরের খেতওয়াড়ি এলাকায় একটা বাসা ভাড়া নিয়ে মোগু থাকতে শুরু করে এবং ১৯২৩-শে মাধব দাস ভাটিয়া-র সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এইবার শুরু হয় এক নতুন সমস্যা, যা মোগুকে ভিতর থেকে আরও শক্তপোক্ত করে তোলে। মোগু-র প্রতিভা, পরিশ্রম এবং অনমনীয় মনোভাবের জন্য তার উত্তরোত্তর উন্নতি বোম্বের ধনী সমাজ এবং উচ্চাঙ্গ সংগীত জগতের কয়েকজনের বিষনজরে পড়ে। তাদের মিলিত ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয় মোগুকে। সে যুগে মঞ্চে উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশনের সুযোগ প্রায় ছিলনা বললেই চলে। উস্তাদজী-র মতো শিল্পীদের তখন করদ রাজ্যগুলো সভাগায়ক করে রেখে দিত। উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেব ছিলেন তৎকালীন কোলাপুর এস্টেটের সভাগায়ক। কিন্তু তিনি বেশি সময় বোম্বে তে অবস্থান করতেন তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের সংগীত শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে। বোম্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ শুধুমাত্র তাঁদের সন্তানদেরই শিক্ষাদানের জন্য উস্তাদজীকে চাপ দিতে থাকেন। বাধ্য হয়ে উস্তাদজী মোগুকে শিক্ষাদান বন্ধ করে দেন।
শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শে মোগু আগ্রা ঘরানার উস্তাদ বশির খান সাহেবের কাছে সংগীত শিক্ষা শুরু করে। বশির খান সাহেব মোগুকে আগ্রা ঘরানার বিলায়েত হুসেন খান সাহেবের কাছা গান্ডা বাঁধতে পরামর্শ দিলে মোগু সেই মতো উস্তাদ বিলায়েত হুসেন খান সাহেবের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেওয়া শুরু করে। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস যেতেই উস্তাদজী বোম্বে ছেড়ে চলে গেলে মোগু-র সংগীত শিক্ষা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেবের কানে সেই খবর গেলে তিনি মোগুকে তাঁরই ছোট ভাই হায়দার খানের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু মোগু ইতস্তত করে। কারণ, হায়দার খান ছিলেন জয়পুর-আত্রৌলি ঘরানার শিল্পী। ইতিমধ্যেই মোগু আগ্রা ঘরানার সংগীতজ্ঞদের ক্ষমতার দৌড় দেখে ফেলেছে। যার জন্য বিস্তর ভোগান্তি হয়েছে তার ব্যক্তিগত জীবনেও। তবু, আলাদিয়া খান সাহেবের আদেশে মোগু রাজী হয়। উস্তাদজীর তলব পেয়ে হায়দার খান কোলাপুর থেকে বোম্বে তে আসেন মোগুকে তালিম দেওয়ার জন্য। সন ১৯২৬-শে শুরু হয় জয়পুর-আত্রৌলি ঘরানার শিক্ষায় মোগু-র শিক্ষালাভের।
কিন্তু, সমস্যার শেষ নেই। আবারও বোম্বের ধনী সমাজ উস্তাদজী কে চাপ দিতে শুরু করে মোগু-র শিক্ষা বন্ধ করতে। বাধ্য হয়ে উস্তাদজী হায়দার খান কে বোম্বে ত্যাগ করতে বলেন এবং নিজে মোগুকে গিয়ে তাঁর অপারগতার কথা ব্যক্ত করেন। এই সময় মোগু ইচ্ছে করলে সারা ভারত জুড়ে সংগীত পরিবেশন করতেই পারতো। কিন্তু সে চেয়েছিলো আরও শিখতে, আরও পরিশ্রম করে ভারতসেরা হতে, যা ছিল মা জয়শ্রী-র অন্তিম ইচ্ছা। সে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে নিজেকে নিবিড় অনুশীলনে ডুবিয়ে রাখলো। ১৯৩২-র ১০-ই এপ্রিল মোগু-র এক কন্যা সন্তান জন্ম নিল। মোগুকে নিয়ে যেমন জয়শ্রী স্বপ্ন দেখেছিলেন, মোগু-ও তেমনই সদ্যজাতা কন্যা কে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলো। সেদিনের সেই সদ্যজাতা কন্যা “কিশোরী”-ই পরবর্তীকালে মোগু-র সেরা শিষ্যা এবং ভারত বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কিশোরী আমোনকর।
শিশুকন্যার দেখভাল করেও মোগু তার অনুশীলন চালিয়ে যায়, যতোদিন না উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেব ফিরে আসেন। অবশেষে উস্তাদজী সকল বাধা কাটিয়ে মোগু কে স্বয়ং শিক্ষাদান শুরু করেন। ১৯৩৪ সালে মোগু উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেবের কাছে গান্ডা বাঁধে। শোনা যায় মোগু তার সঞ্চিত স্বর্ণালঙ্কার বিক্রী করে সেই অর্থে গুরুদক্ষিণা দিয়ে গান্ডা বাঁধে। পাঁচটা বছর মোটামুটি নিরুপদ্রবে কাটার পরে ১৯৩৯-শে স্বামী মাধবদাস ইহলোক ত্যাগ করেন।  পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪০ থেকে মোগু শুরু করে সারা ভারত জুড়ে অনুষ্ঠান। নাম হয় মোগু বাঈ কুর্দিকার। শুরু করেন আকাশবাণীতে সংগীত পরিবেশন। ১৯৪৬-শে উস্তাদ আলাদিয়া খান সাহেবের মৃত্যু পর্যন্ত মোগুবাঈ তাঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকেন। মোগুবাঈয়ের লক্ষ্য ছিল শুদ্ধ খেয়াল পরিবেশন। সেই কারণে তিনি ঠুমড়ি, নাট্যসঙ্গীত ইত্যাদি পরিহার করে চলতেন। ধীরে ধীরে মোগুবাঈ কুর্দিকার হয়ে ওঠেন জয়পুর-আত্রৌলি ঘরানার অগ্রগণ্য শিল্পীদের একজন।  এখানে স্মর্তব্য, সে যুগে মহিলা শিল্পীদের সেভাবে সম্মান দেওয়া হতোনা এবং যথেষ্ট হীন চোখে দেখা হতো। কিশোরী আমোনকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ভারত সেরা শিল্পীদের একজন হওয়া সত্ত্বেও মা কে কম পয়সায় অনুষ্ঠান করতে হতো। তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় অসংরক্ষিত আসনে বসে অনুষ্ঠান করতে যেতে হতো। গেস্ট হাউস নয়,তাঁকে কারো বাড়ীতে থাকতে বাধ্য করা হতো।“
কিশোরী আমোনকার ছাড়াও পদ্মা তালওয়ালকার, বামনরাও দেশপান্ডে,ডঃ অরুণ দ্রাভিদের মতো শিষ্য-শিষ্যা তৈরি করে গেছেন মোগুবাঈ কুর্দিকার। ১৯৬৮ সালে তাঁকে সঙ্গীতনাটক একাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। ১৯৭৪ সালে দেশ তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করে। ২০০১ সালে ৯৬ বছর বয়সে এই বিদুষী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরিশেষে ফিরে আসি কুর্দি গ্রামের কথায়। ১৯৭১ সালে বাঁধ তৈরির কারণে কুর্দি সহ কুড়িটি গ্রাম খালি করে দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে সেই বাঁধ নির্মাণের সাথেই হারিয়ে যায় মোগুবাঈ কুর্দিকারের শৈশবের গ্রাম কুর্দি। 

সূত্রঃ
“The Last Titan: Mogubai Kurdikar – The writings of Mohan Nadkarni”
“The loneliness of Kishori Amonkar”indianexpress.com. 3 April 2018
*******************************************************
প্রসেনজিৎ ছবি

প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচিতি
ফরিদপুর কাউলিপাড়ার শেষ জমিদার নন্দমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের  বংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ও নিবাস ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। ১৯৬৫-তে তাঁর জন্ম হয় ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিবেশে এমন এক পরিবারে, যেখানে ভারতবিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের যাতায়াত ছিলো অবারিত। কৈশোরে কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যানুরাগের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে জেলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়েছেন। বাড়িতে সঙ্গীতাবহে বড় হয়ে ওঠায় সঙ্গীতের প্রতি প্রসেনজিৎ যথেষ্ট অনুরক্ত। ব্যাঙ্ক কর্মচারীর গুরুদায়িত্ব সামলিয়েও তিনি ইতিহাস, সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অনুরাগ যে এতোটুকুও নষ্ট হতে দেননি, তার প্রমাণ তাঁর এই প্রবন্ধ।

1 Comment

  • নন্দিতা ঘোষ

    অনেক কিছুই জানতে পারলাম এই প্রতিবেদন থেকে ,মোগু বাই কুর্দি র নাম একদম ই জানা ছিল না, কিন্তু তার কন্যা কিশোরী আমণকার এর প্রোগ্রাম দেখার সৌভাগ্য হোয়েছিল নাগপুরে থাকা কালীন দেশপান্ডে সভাগৃহে,অনেক কিছুই জানতে পারলাম আপনার এই লেখা থেকে, খুব ভালো লাগলো

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!