দারুশিল্পীদের গ্রাম নতুনগ্রামের ইতিকথা
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়
রংবেরঙের বিচিত্র গড়নের বিভিন্ন রকমের পুতুল। সবই কাঠের পুতুল। উজ্জ্বল নানা রঙের বৈভবে গোল গোল চোখওয়ালা তিন কোণা ছোটো-বড় পেঁচাগুলো সবার আগে নজর কাড়ত। রাজা-রানী,বর-বউ বা উদ্বাহু নৃত্যরত গৌর-নিতাই পুতুলগুলো দেখেও মজা পেতাম। নিজের হাতে বানানো এইসব পুতুল ঝুড়িতে সাজিয়ে বিক্রি করতেন এক ফেরিওয়ালা। জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় চন্দননগর স্টেশন রোডে শ্যাম মাস্টারের গলির কাছে। প্রতি বছর মোটামুটি একই জায়গায় তিনি তাঁর পসরা নিয়ে বসতেন। তাঁকে দেখলেই ‘ভানু পেলো লটারী’ ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লিপ’-এ শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘পুতুল নেবে গো পুতুল’ গানটা মনে পড়ে যেত। গানটা সেইসময় রেডিওতে প্রায়ই বাজানো হত। ‘সেইসময়’ বলতে আমার তখন শৈশবকাল। স্কুলে নীচু ক্লাসে পড়তাম। একবার একটা পেঁচা কিনেছিলাম। আর একবার একটা বউপুতুল। সেটিকে দেখতে অনেকটা মিশরের মমির মতো। খেলার ছলে তার মুখে যা হোক একটু কিছু খাবার গুঁজে দিয়ে বলতাম,”কাঠের পুতুল! খাবার খাও,আবার তুমি জ্যান্ত হও,আমার সঙ্গে কথা কও।” কিন্তু সুকুমার রায়ের ‘ওয়াসিলিসা’ গল্পের কাঠের পুতুলের মতো তার চোখ দুটো জ্বলে উঠত না,ঠোঁট দুটো নড়ে উঠত না। সে কোনো কথাই বলতে পারত না। তবু সে ছিল আমার খুব প্রিয়।
একটু বড় হওয়ার পর ফেরিওয়ালার নাম জানতে চেয়েছিলাম। তিনি নামধাম সবই বলেছিলেন। নামটা ভুলে গেলেও মনে আছে তাঁর বাড়ি কাটোয়ার কাছে নতুনগ্রামে। সেখানে ঘরে ঘরে বংশ পরম্পরায় একই শৈলীতে তৈরি হয়ে থাকে এই ধরনের কাঠের পুতুল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মেলাতে নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল বিক্রি হতে দেখেছি। তবে সম্প্রতি সেই গ্রামে যাওয়ার আগে ‘গুগল ম্যাপ’-এ তার অবস্থান বুঝে নিতে গিয়ে দেখেছি কাটোয়ার কাছে দুটো নতুনগ্রাম আছে। বিভ্রান্ত হয়ে শেষে ‘Wooden Doll Natungram’ লিখে খোঁজাখুঁজি করতে কাঙ্খিত জায়গাটির সন্ধান মেলে। ‘কাঠপুতুলের আঁতুড় ঘর’ নতুনগ্রাম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলী ২ ব্লকের পিলা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। নিকটবর্তী রেলস্টেশন অগ্রদ্বীপ। স্টেশন থেকে দূরত্ব মাত্র ২ কিলোমিটার। এখন টোটো-তেও যাওয়া যায়। ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে।
বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক ও লোকসংস্কৃতির গবেষক বিনয় ঘোষ রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি নতুনগ্রামে গিয়েছিলেন। ‘অল-ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফ্টস বোর্ড’-এর জন্য পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্পীদের সম্বন্ধে একটি সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষার কাজে। তখন নতুনগ্রাম ছিল খুব সাধারণ একটি গ্রাম। তেমন কোনো খ্যাতিই ছিল না। জাতিতে ‘সূত্রধর’ মাত্র পনেরো-ষোলো ঘর দারুশিল্পী (wood carving artisan) সেখানে বাস করতেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র।
১৯৬৬ সালে শম্ভুনাথ সূত্রধর কাঠ কুঁদে একটি দশ মাথা রাবণের মূর্তি বানান। তাঁর এই অসামান্য শিল্পকীর্তির জন্য তিনি ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের হাত থেকে ‘জাতীয় পুরস্কার’ পান। এর ফলে তাঁর পরিবারে খানিক আর্থিক উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু বাকি সূত্রধরদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। পুজোর সময় ও রাসের মেলায় তাঁদের তৈরি কাঠের পুতুল ও মূর্তি কিছু বিক্রি হত। বছরের অন্য সময় তাঁরা কোনোরকমে দিন গুজরান করতেন।
বিনয় বাবুর লেখা থেকে আরো জানা যায় যে,পার্শ্ববর্তী দাঁইহাটের ভাস্করদের সঙ্গে নতুনগ্রামের সূত্রধরদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। শম্ভুনাথের পিসেমশাইয়ের বাবা ছিলেন দাঁইহাটের বিখ্যাত নবীন ভাস্কর। যিনি দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী ও বর্ধমান জেলার সতীপীঠ ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মূর্তি তৈরি করেছিলেন। সতেরো শতকের শেষ বা আঠারো শতকের প্রথম দিকে দাঁইহাটের ভাস্কররা লাহোর থেকে বাংলায় আসেন। পাথরের মূর্তি গড়ার কাজের জন্য বর্ধমানের রাজারা তাঁদের নিয়ে আসেন। তাঁরা দেবদেবীর মূর্তি ছাড়াও রাজাদের মূর্তিও গড়তেন।
নতুনগ্রাম সফরকালে শম্ভুনাথের নাতি মাধব ভাস্করের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি শম্ভুনাথের ছেলে তপন ভাস্করের ছেলে এবং রাজ্যস্তরে পুরস্কৃত একজন অসাধারণ দারুশিল্পী। এখানে বলে রাখি শম্ভুনাথ ‘ভাস্কর’ হিসাবে জাতীয় স্বীকৃতি লাভের পর থেকে এই গ্রামের প্রায় সব ‘সূত্রধর’ দারুশিল্পীই নিজেদের নামের শেষে ‘ভাস্কর’ লেখেন। মাধব ভাস্কর-ও জানান তাঁর পূর্বপুরুষেরা তৎকালীন দাঁইহাটের ভাস্করগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বর্ধমানের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁরা পাথরের মূর্তি গড়তেন। সময়ান্তরে কোনো কারণে তাঁরা ওই কাজ ছেড়ে দারুশিল্পকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। রাজ-অনুগ্রহ পেয়েছিলেন বলে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাঁরা ‘রাজা-রানী’ পুতুল বানাতেন। ভাদ্র ও পৌষ মাসে সেখানে ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজো হয় বলে ‘লক্ষ্মীপেঁচা’ গড়তেন। বৈষ্ণব প্রভাবিত অগ্রদ্বীপ গ্রামের সন্নিহিত হওয়ায় এবং শ্রীচৈতন্যের জন্মস্থান নবদ্বীপ-ও বেশি দূরবর্তী না-হওয়ায় গৌর-নিতাই ও রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তিও যুক্ত হয়েছিল তাঁদের তৈরি পুতুলের তালিকায়। কাঠের যোগান পেতে অসুবিধা হত না। কেননা তখন এই অঞ্চলে ছিল গভীর জঙ্গল। সেখান থেকেই তাঁর পূর্বজরা কাঠ কেটে আনতেন। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। পরবর্তীকালে প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া বাবা নামে একজন সন্ন্যাসী জঙ্গল হাসিল করে গ্রাম পত্তন করে এখানকার শিল্পকলাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হন। স্বকীয়তায় ও সূক্ষ্মতার সুষমায় দারুশিল্পে এক অনন্য ও নতুন ঘরানার জন্মদাতা নতুনগ্রামের শিল্পীদের তৈরি কাঠের পুতুলের কদর এখন দেশের গন্ডী পেরিয়ে বিদেশেও পৌঁছে গেছে। আগের তুলনায় শিল্পীরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন। মাধব ভাস্করের মতো অনেকেই রাজ্যস্তরে পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মানিক সূত্রধর। শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ কাজের সূত্রে বিদেশ ভ্রমণ-ও করেছেন। ভক্ত ভাস্কর নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে আমেরিকা গিয়েছিলেন। দিলীপ সূত্রধর ফ্রান্স ঘুরে এসেছেন। এই সবকিছুর জন্য সমস্ত গ্রামবাসী প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়াবাবার অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তাঁরা সবাই কাঠিয়া বাবার শিষ্য এবং ‘রাধা কৃষ্ণ’ মন্ত্রে দীক্ষিত। কাঠিয়া বাবার দান করা জমিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদি ও গ্রামীন শিল্প পর্ষদের উদ্যোগে নতুনগ্রামে দ্বিতল বিশিষ্ট একটি বাড়িতে ‘ফোক আর্ট সেন্টার’ তৈরি হয়েছে। সেখানে রয়েছে শিল্পপ্রদর্শনশালা এবং গ্রামে বেড়াতে আসা অতিথিদের জন্য থাকা-খাওয়ার সুলভ ব্যবস্থা। শিষ্যরাই ‘সেন্টার’-টি চালান। গ্রামে কাঠিয়া বাবার বিশাল আশ্রমও রয়েছে। শ্রী শ্রী ১০৮ স্বামী জানকীদাস কাঠিয়া বাবা তপোবন আশ্রম। আমি যেদিন যাই সেদিন ‘ফোক আর্ট সেন্টার’ বন্ধ ছিল। সময়াভাবে আশ্রমেও আমার যাওয়া হয়নি।
হাওড়া-কাটোয়া লোকাল ট্রেনে চেপে অগ্রদ্বীপ স্টেশনে পৌঁছে একটা টোটো ভাড়া করে রওনা হয়েছিলাম নতুনগ্রামের উদ্দেশে। গ্রাম থেকে স্টেশনে ফেরার কোনো যানবাহন সেভাবে মেলে না বলে টোটো ‘বুক’ করে নিয়েছিলাম। শরতের সকালে পল্লীপ্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে পৌঁছলাম গন্তব্যে। জায়গাটার নাম মিস্ত্রিপাড়া। আশেপাশের আবাদী জমি দেখে এখন আর বোঝার উপায় নেই এককালে এখানে জঙ্গল ছিল। টোটো যেখানে দাঁড়াল সেখান থেকে গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া সরু ঢালাই রাস্তার পাশে একের পর এক শিল্পীদের ঘরবাড়ি। এখানে বসবাসকারী ৪২ টি পরিবারের প্রায় সব সদস্য কাঠের পুতুল তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি উদ্যোগ এবং বস্ত্র উদ্যোগ’ (MSME and Textiles) দপ্তর ও UNESCO-র যৌথ প্রচেষ্টায় নতুনগ্রামকে রাজ্যের অন্যতম ‘Rural Craft Hub’ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দান ও পুতুল বিপণনের জন্য রয়েছে ‘Swami Janakidas Natungram Wood Carving Artisans Industrial Co-operative Society Limited’। শম্ভুনাথ সূত্রধর-ও অনেককে কাজ শিখিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কার্তিক সূত্রধর অন্যতম। যিনি সিঙ্গি থেকে এসে শম্ভুনাথের কাছে কাজ শিখে পাকাপাকিভাবে নতুনগ্রামের বাসিন্দা হয়ে যান। গ্রামের পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল শিল্পীদের কর্মব্যস্ততার ছবি। ঘরে ঘরে কাঠ খোদাই ও রঙের কাজ চলছিল। কর্মরত কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম এখানকার ছেলেমেয়েরা পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই কাজ শিখতে শুরু করে। পড়াশোনার তেমন চল নেই। বিশেষত মেয়েরা শুধুমাত্র স্কুলের শিক্ষাটুকুই নেয়। গ্রামে স্কুল আছে। বহড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বামী জানকীদাস মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র। বিদেশিদের সাথে শিল্পীদের ইংরাজিতে কথা বলার সমস্যা থাকায় প্রজ্ঞাদাস কাঠিয়া বাবা গ্রামে ‘স্বামী জানকীদাস বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি ইংরাজি মাধ্যম স্কুল-ও স্থাপন করে দিয়েছিলেন। কলেজ আছে কাটোয়ায় ও নবদ্বীপে। কিন্তু স্কুলের গন্ডী পেরোনোর পর উচ্চ শিক্ষা নিতে কেউই বাইরে বিশেষ যায় না। দু’একজন অন্য চাকরিবাকরি করলেও এখনও প্রায় সবাই বংশগত পেশাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চাইছেন। যদিও অসীম ধৈর্য ও শ্রমসাধ্য এই কাজ করতে গিয়ে সকাল থেকে রাত ‘আট থেকে আশি’ কারোরই দম ফেলার সময় থাকে না। পুরুষেরা কাঠ কাটা ও ছাঁটার কাজ করেন। পুতুলে মাটি লাগানো ও রং চাপানোর কাজ করেন মহিলারা। সুদেব ভাস্কর তাঁর স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে লাবনী ভাস্করের হাতের কাজ গর্বভরে দেখালেন।
লাবনীর ছবিসহ তার কাজের প্রশংসা খবরের কাগজে ছেপে বেরিয়েছে জানালেন। তবে অনেক বাড়িতে নেহাৎই পেটের তাগিদে এমন ছোটো ছোটো মেয়েরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে বলে মনে হয়েছে। অন্য পেশার মানুষের সাথে বিয়ে হয়ে অন্য গ্রামে চলে যাওয়ার পর সেখানকার পরিবেশে এই শিল্পগ্রামের মেয়েরা মানিয়ে নিতে পারে কিনা প্রশ্ন করায় মাধব ভাস্কর বলেছিলেন,”পারে। আসলে এই পরিশ্রমের কাজ থেকে তো তখন তারা মুক্তি পায়।”
তাঁর স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে প্রীতি ভাস্কর বলেছিল বিয়ের পর পুতুল রং করার কাজ ছাড়তে হলে তার মনে তেমন কোনো কষ্ট হবেনা। নতুনগ্রামে বউ হয়ে আসা মেয়েদেরও রুটি-রুজির জন্যই কাজ শিখে নিতে হয়। রান্না ও ঘরের অন্যান্য কাজ করার পাশাপাশি সুনিপুণ দক্ষতায় বাড়ির বউরা পুতুল রং করছেন বা খদ্দের সামলাচ্ছেন নজরে পড়েছে। যদিও হাতে গোনা মাত্র দু-চারজন ক্রেতাই সেই দিন সেই মুহূর্তে গ্রামে হাজির ছিলেন। তাঁরা টুকিটাকি কেনাকাটাও করছিলেন। প্রত্যেক ঘরের সামনে বিক্রির জন্য সারি দিয়ে রাখা কাষ্ঠ-নির্মিত শিল্পসামগ্রী। সেগুলোর মধ্যে পুতুল ও দেবদেবীর মূর্তি ছাড়াও ছিল দেওয়ালে ঝোলাবার ঘর সাজানোর উপকরণ,চাবির রিং,আয়না,ফটো ফ্রেম,ঘড়ি,টেবিল ল্যাম্প,ট্রে,চেয়ার,টেবিল ইত্যাদি। কিন্তু এই প্রতিটি শিল্পকর্মেই হয় পেঁচা নাহয় বর-বউ বা রাজা-রানী পুতুল (ওঁদের ভাষায়,’রাশি পুতুল’) আঁকা বা আটকানো। একটা ঘরের সামনে দেখলাম বাবুই ঘাসের দড়ি দিয়ে তৈরি কয়েকটা টুল। পায়াগুলোকে বাটালি দিয়ে নিখুঁতভাবে কেটে পেঁচার অবয়ব দেওয়া হয়েছে। রং চাপানোর কাজ বাকি। ছোটো,বড়,মাঝারি ইত্যাদি বিভিন্ন রকম আকার ও কাঠের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে এইসবের দাম। মোটামুটিভাবে ২০-২৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০-১৫০০ টাকার মধ্যে উপহার সামগ্রী বা গৃহশয্যার উপকরণ পাওয়া যায়। স্মারক হিসাবে কয়েকটা রাশি পুতুল কিনলাম। সাধারণত খুব সস্তা ও নরম কাঠে রাশি পুতুলগুলো তৈরি হয়। মাধব ভাস্কর জানালেন তিনি রাশি পুতুল বানান পিটুলি কাঠ দিয়ে। কেউ কেউ শিমুল ও ছাতিমের কাঠেও বানান। লম্বু, নিম বা আম কাঠ দিয়ে তৈরি হয় পেঁচা, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি। তবে ভালো কাজের জন্য গামার ও মেহগনি কাঠ প্রয়োজন হয়। অর্ডার মাফিক বড় দুর্গা মূর্তি গড়তে বা আসবাবপত্র বানাতে তাঁরা এই ধরনের কাঠ ব্যবহার করে থাকেন। যে কাঠই হোক, বাইরে থেকে কিনে আনার পর দিন কয়েক ফেলে রেখে রোদ-জল খাইয়ে পোক্ত করে তবেই তাঁরা কাজে হাত দেন। সরকার থেকে গ্রামে করাত কলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখান থেকে কাঠ চেরাই করে আনার পর তা ছোটো ছোটো টুকরো করে কাটা হয়। প্রতিটা টুকরোকে বাটালি দিয়ে কুঁদে চাহিদামতো আকার দেওয়া হয়। তারপর সেগুলোর ওপর বেলে মাটি ও গোবরের প্রলেপ লাগিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নেওয়ার পর শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে মসৃন করা হয়। সবশেষে খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিয়ে রং করার পালা। আগে বেল বা তেঁতুলের বীজ থেকে তৈরি আঠায় প্রাকৃতিক রং মিশিয়ে তা দিয়ে আঁকা হত। এখন ফ্যাব্রিক রং ব্যবহার করা হয়। তবে উন্নত মানের কাঠ দিয়ে তৈরি অনেক পুতুল ও মূর্তি রং ছাড়াও হয়। সেগুলোকে বার্নিশ ও পালিশ করা হয়। ঠিক এমনই একটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ মূর্তি আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন মাধব ভাস্কর। সেটা তিনি ‘অর্ডার’ নিয়ে বানিয়েছেন। নতুনগ্রামের শিল্পীরা এখন অনেকেই অনলাইনের মাধ্যমে ‘অর্ডার’ নিয়ে যথাসময়ে ক্রেতার বাড়িতে বিক্রয়পণ্য পৌঁছে দেন। এমনিতে গ্রামের বাইরে নবদ্বীপে তাঁদের ভালো বাজার আছে। পুজোর সময় বিভিন্ন বারোয়ারিতে তাঁরা কাজ পান। কলকাতা সহ রাজ্যের অন্যান্য জেলায় দুর্গাপুজোয় নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল ও প্রতিমার খুব চাহিদা। মন্ডপসজ্জায় সেগুলো বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া রাজ্যে এবং রাঁচি, পুরী, দিল্লি, মুম্বাই, গোয়া ইত্যাদি দেশের নানা জায়গায় সরকারিভাবে আয়োজিত হস্তশিল্প মেলা ও অন্যান্য মেলাপার্বণে তাঁরা অংশ নেন। সরাসরি শিল্পীদের সঙ্গে ক্রেতাদের যোগসূত্র তৈরি করতে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে নতুনগ্রামেও তিন দিনের একটি বর্ণময় মেলার আয়োজন করা হয়। মূলত শহর থেকে আসা লোকজন এই মেলার প্রধান ক্রেতা। বিদেশী পর্যটকেরাও আসেন। মেলা উপলক্ষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাউল, ঝুমুর, ছৌ, রায়বেঁশে সহ নানা লোকগান ও লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়। UNESCO-র সহযোগিতায় বাংলা নাটক ডট কম সংস্থা,স্বামী জানকীদাস নতুনগ্রাম কাষ্ঠ খোদাই শিল্প সমবায় সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদি ও গ্রামীন শিল্পপর্ষদ এবং ক্ষুদ্র, ছোটো, মাঝারি উদ্যোগ ও বস্ত্র উদ্যোগ দপ্তরের উদ্যোগে এই মেলা হয়।
কিন্তু বর্তমানে এখানে এখন বিক্রির হার তেমন ভালো নয়। মাটির উনুনে রান্না করতে করতে সেই দুঃখের কথাই শোনালেন মাধব ভাস্করের স্ত্রী সান্ত্বনা ভাস্কর। একই কথা বললেন প্রবীণ শিল্পী বুদ্ধদেব ভাস্কর।
করোনাজনিত কারণে লকডাউনের ফলে শিল্পীদের অনেক লোকসান হয়েছে। পর্যটক আসা কমে গেছে। অনেক মেলাই বন্ধ। নতুনগ্রামের মেলাতেও মানুষের উপস্থিতি আগের চেয়ে অনেক কম। অন্যদিকে কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাজারে তাঁরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। সকলকেই ধারদেনা করে অনেক কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে। এখনও তাঁরা জি আই শংসাপত্র (Geographical Indication Tag) পাননি। তাঁরা মনে করেন, জি আই শংসাপত্র পেলে তাঁদের কাঠের পুতুল ও আসবাবপত্রের বিক্রিবাটা আরও বাড়বে। দেশ-বিদেশে আরও খ্যাতি ছড়াবে। একইসাথে তাঁরা তাঁদের আর্থিক ও শিল্পের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আরও বেশি সরকারি সহায়তার প্রত্যাশী।
তথ্যসূত্রঃ
(১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খন্ড) – বিনয় ঘোষ
তথ্য প্রদানের জন্য বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাধব ভাস্কর, সান্ত্বনা ভাস্কর, সুদেব ভাস্কর ও বুদ্ধদেব ভাস্করের কাছে।
ছবি : সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়
**************************************************
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন’-এ স্নাতকোত্তর সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত একজন লেখিকা,সংগীতশিল্পী এবং বিজ্ঞান ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। ‘কালান্তর’,‘সুস্বাস্থ্য’ ‘উৎস মানুষ’,‘টপ কোয়ার্ক’,‘যুক্তিবাদী’, ‘এখন বিসংবাদ’,‘মানব জমিন’,‘আবাদভূমি’,‘সাহিত্য সমাজ’,‘সারথি’,‘অভিক্ষেপ’ ইত্যাদি বেশ কিছু পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। একসময় তিনি ছিলেন ‘আজকাল’ পত্রিকার নিয়মিত পত্রলেখিকা। ২০০৩-এ ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’-র উদ্যোগে তাঁর সম্পাদনায় ‘র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন’ প্রকাশন থেকে ড. পবিত্র সরকারের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয়েছে ‘ছোটোদের কুসংস্কার বিরোধী গল্প’-র দুটি খন্ড। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে মরণোত্তর দেহদান–আন্দোলন ও উত্তরণ’ বইটি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। দূরদর্শনে ‘মরণোত্তর দেহদান’ নিয়ে সম্প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন। সম্প্রতি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী কানন দেবীর জীবন নিয়ে তাঁর একটি গবেষণামূলক কাজ ‘ফেসবুক’-এ তাঁর টাইমলাইনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে তিনি ‘সংগীত প্রভাকর’ ও ‘সংগীত বিভাকর’। দীর্ঘদিন শাস্ত্রীয় সংগীতেও তালিম নিয়েছেন। শৈশব ও কৈশোরে বেতারে ‘শিশুমহল’,‘গল্পদাদুর আসর’ ও ‘কিশলয়’-এর অনুষ্ঠানে বহুবার গান গেয়েছেন। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলায় ও এই রাজ্যের বাইরেও মঞ্চানুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত,পল্লীগীতি ও গণসংগীত ছাড়াও তাঁর ভাই রাজেশ দত্তর কথায়-সুরে ‘মানবতার গান’ পরিবেশন করেছেন। ২০০৬-এ রাজেশের কথায়-সুরে তাঁর গাওয়া ‘পাল্টা স্রোতের গান’ অডিও ক্যাসেট ও সিডি আকারে প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রজীবনে বেশ কয়েকটি নাটক ও শ্রুতিনাটকে অভিনয় করেছেন। পরবর্তীতে চন্দননগরের ‘কোরক’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নাট্যাভিনয় করেছেন। আবৃত্তি,সংগীত ও কয়েকটি ‘রিয়্যালিটি শো’-এ বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্রতচারী নাচের প্রশিক্ষণ শেষে শংসাপত্র-ও অর্জন করেছেন। এখন গৃহকর্মের ফাঁকে ও অবসরে লেখালেখি ও গানের চর্চা ছাড়াও আঁকতে ও ছবি তুলতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ’ভ্রমণ’।