Shadow

মোমরঙের সংসার – ব্রততী চক্রবর্ত্তী

PC: Minnesota Good Age

মোমরঙের সংসার 

ব্রততী চক্রবর্ত্তী

 

ঠাম্মা পয়সা দিবা? কাঠি আসকিরিম খাবো এট্টা
নারকোলের আচায় এক খাবলা ছাইমাটি মিশিয়ে ছোবড়া আনতে গেছিল বিন্দে সকড়ি বাসনগুলো কলপাড়ে পড়ে রয়েছে সকাল থেকে হাজারটা কাজ সেরে তবে তো ফুরসত তারমধ্যে এই এক নাতি তার ঘাড়ে কলতলায় থেবড়ে বসে নাতিকে ধমকাল বিন্দে,
পয়সা কি গাছ থেকে টপকায় নাকি রে? এই তো সকালেই এক পেট পান্তা গিললি! আবার এখন খাবার পয়সা চাস তুই?
তো পান্তা! আমি কাঠি আসকিরিম খাবো হারুরা সব  খেয়েছে জিভে কী সুন্দর রঙ হয়ে যায়,জানো? আমিও খাবো, দাওনা পয়সা ঠাম্মা
এমন রাক্ষস তো আমি জম্মে দেখিনি ঠাকুর! বলি বাপের কি জমিদারি আছে যে আসকিরিম কিনে খাবি? পয়সা নেই আমার কাছে যা এখান থেকে
আট বছরের নুরু মাটিতে শুয়ে হাতপা ছুঁড়ে কান্না জোড়ে এবার বিন্দে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে বাসনগুলো রগড়াতে থাকে কিছুক্ষণ বাদে আর সহ্য করতে না পেরে ছাইমাটি মাখা হাতেই দুম করে এক ঘা বসিয়ে দেয় নাতির পিঠে একেতেই ঘরে অসুস্থ স্বামী নিয়ে সংসার কীসের যে রোগে ধরল লোকটাকে! দিন দিন জ্বর আসছে আর পেট মোচড়ানি ডাক্তারবদ্যি তো আর কম করা হল না! সেরে ওঠার কোনো লক্ষণই নেই কালুমুদির দোকানে খাতা লেখার কাজটাও এই করেই গেছে লোকটার, তা সেও আজ বছর চারেক হল রোগে ভুগে ভুগে হাড়মাস কালি করল বিন্দের ভাগ্যিস ওপাড়ার নিতাই মন্ডলের ছেলেটা একটা উপায় করে দিল! গতবছর বিন্দের ছেলে আর বউকেও তার সঙ্গে করে বোম্বে নিয়ে গিয়ে,কাজে জুটিয়ে দিয়েছে মার্বেল টাইলসের কাজ নাকি খুব ভালো আর অভাবের সংসারে ভালোমন্দর কীই বা বাছবিচার সেই থেকে মাসে মাসে কিছু খরচা পাঠায় ছেলে,আর বিন্দের কয়েক জায়গায় ব্লাউজের হেম,হুক সেলাইয়ের কাজ ধরা আছে;তা সেও বা আর কত! ভালো মালের কাজ হলে তাও ডজনে চুয়ান্নপঞ্চান্ন টাকা বড়জোর গেরস্থ ঘরের বউ বিন্দে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঝিয়ের কাজ তো আর করতে পারবে না! ঘরে বসেই তাই যা হোক কিছু করে তারমধ্যে রুগীর চিকিৎসার খরচ সব যে কীকরে সামলায় সে বিন্দেই জানে যা মাগগিগন্ডার বাজার পড়েছে! নাতিটা তাও ইশকুলে একবেলা খেয়ে নেয় যাকগে, এসব ভাবতে বসলে বিন্দের দিন চলবে না দুপুর গড়িয়ে গেল রুগীর ভাত তরকারি টাইমে না দিলে তার আবার ওষুধের টাইম সরে যাবে নুরুটা কান্না থামিয়ে কতগুলো মাটির গুলি,শুকনো ডালপাতা জোগাড় করে দাওয়ার ধাপে খেলতে বসে গেছে কখন রাতের বেলায় গরম ভাত আর আলুর চোখা বেড়ে নুরুকে ধরে নিয়ে এল বিন্দে সন্ধে হলেই এই এক তাল হয়েছে পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে যাবেই নুরু কত মুখ করে ওরা,বিন্দে মারধোর করে কিন্তু নির্লজ্জ ছেলের কোনো হুঁশই নেই যাবেই ডেকে ডেকে সাড়া পাওয়া যায় না খেতে বসে নুরু আবার বকবক শুরু করল,
রোজ আলুভাতে ধুর! একটা মাছ ভাজা আনোনা ঠাম্মা ওদের বাড়িতে মাছ ভাজা হয়েছে জানো আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম টিভির ঘর থেকে আমাকে বলছিলও খেতে জানো তুমি ধরে আনলে কেন আমাকে?
আবার! ওরা খেতে বলছিল তোরে? ফের যদি মিথ্যে কথা বলিস তুই
না তো কী! ওরা বলছিল তো
গলা নরম হয়ে আসে বিন্দের ওইটুকু বাচ্চাকে কীই বা বোঝায় নুরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় বিন্দে,
লোকেদের বাড়ি কিছু খাবি না,নিবি না কেউ কিছু দিলেও হাতপেতে নিতে নেই সঙ্গে সঙ্গে এগুলো তোরে শিখিয়েছি না?
হ্যাঁ কিন্তু
কিন্তু কিছু না ওরকম লোকেদের জিনিসে নজর করে না যাদু তোর বাবা বলেছে না , এইবারে আসলে তোর জন্য অনেক জিনিস নিয়ে আসবে বোম্বে থেকে?
তখন কি বাবা আসকিরিম খেতে পয়সা দেবে ঠাম্মা?
হ্যাঁ, দেবে তো আরো কত্ত জিনিস আনবে! দেখিস না তখন তোর মা কত ভালো ভালো জিনিস রান্না শিকে আসবে সেসব খাবি
তালে একটা নতুন মোমরঙ এর বাসকো নেব তখন আর লম্বু,পেটি চাটনি এইসব খাবার খাওয়ার পয়সাও দেবে বাবা? আর তুমি গাছের কাঁঠালের তরকারি করবে বাবার জন্য?
হ্যাঁ হ্যাঁ সওব এখন তুমি ভাতটা খেয়ে নাও তো দেখি শিগগির করে
খুশিমনে খেতে শুরু করল এবার নাতি ঠাকুমা মিলে বিন্দে মনে মনে ঠিক করে রেখেছে ছেলেবৌমা সামনের বার বাড়ি এলে ঘটা করে সত্যনারায়ণ পুজো দেবে একটা আর কলকাতায় বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ভালো করে চিকিৎসে করাবে অসুস্থ লোকটার বিন্দে জানে ভগবান ঠিক একদিন মুখ তুলে চাইবেনই খাওয়া শেষে এঁটো লেপে নুরুকে নিয়ে শুতে যায় বিন্দে
ঠাম্মা এট্টা রাজারাণীর গল্প বলো না শুনেই ঠিক ঘুমিয়ে পড়ব
বিন্দে তালপাতার পাখাটা নাড়তে নাড়তে গল্প বলতে লাগে নুরুকে এই একরত্তি ছেলে বুকে করেই তো সারাদিনের দুঃখ কষ্ট ভুলে শান্তির ঘুম নেমে আসে বিন্দের চোখে এভাবেই দিন কাটে পরদিন সকালে হঠাৎ ঢিঢি পড়ে গেল কী নাকি এক রোগ এসেছে,নাম নাকিকরোনা‘! সব নাকি বন্দ হয়ে যাচ্ছে চারদিকে সব লোকেরা নাকি বাইরে বেরোচ্ছে না বিকেলের দিকে নিতাই মন্ডলের বাড়ি যেতে হবে তো একবার মনে হচ্ছে বাবু আর বউটার খবর নিতে হবে নিতাই মন্ডলের ফোনেই বাবুর সঙ্গে কথা বলে বিন্দে তা নিতাই মন্ডল মানুষ ভালো পরের উপকার করে তার ছেলেটিও ওমনি নইলে এখনকার দিনে কেউ কি আর যেচে উপকার করে মানুষের! কেমন সুন্দর বন্ধুর কাজের জোগাড় করে দিল একটা অচেনা জায়গায়! নিতাই মন্ডল যা বলল, তাতে যা বুঝল বিন্দে তাতে তেমন ভয়ের কিছু নেই তবে শহরে নাকি দোকানপাট,গাড়িঘোড়া,ইশকুলপাঠশালা সব বন্ধ করে দিয়েছে অনেকদিনই হল সব ঘরবন্দী তবে গ্রামের দিকে ওসব রোগভোগের অত ভয় নেই তেমন বোম্বে থেকে নিতাই মন্ডলের ছেলে খবর দিয়েছে,ওরা সব এমনি ভালো আছে আর এই একটা মাস দেখে,সামনের মাসে ওরা সবাই নাকি এখনের মতো বাড়ি ফিরে আসবে এই নুরুরই জুড়িদার,জেলে পাড়ার সুরিলের বাবা; সেও নাকি আজ কদিন হল বাড়ি চলে এসেছেওখানেও নাকি সব কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে কোনো জিনিসের দরকার পড়লে নিতাই মন্ডলের কাছে ধার নিতে বলেছে বিন্দের ছেলেএর প্রায় মাসখানেক পর বিন্দে উনুন লেপে রান্নার জোগাড় করছিল হারুর জ্যেঠি এসে খবর দিলে,
এক্ষুণি নিতাইদার বাড়ি যাও বিন্দে কাকি
এই সক্কাল সক্কাল সংসারের কাজ ফেলে কী ইয়ার্কি করিস বল তো! আয়,তুই বস একটু দুটো গিমের বড়া খেয়ে যাসখুনি গরম গরম
আরে এখন রাখো এসব কাকি নিতাই মন্ডল সাইকেলে চড়ে মনোহরপুর গিয়েছিল খবর আনতে আসার পথে হারুর জ্যাঠারে বলে দিয়েছে তোমারে তাড়াতাড়ি খবর দিতে
কিন্তু নুরু ইশকুলে গেছে,তোর কাকার খাবার হয়নি এখনো,এরমধ্যে
বিন্দে দোনামনা করছে দেখে তাড়া লাগালো হারুর জ্যেঠি শেষ পর্যন্ত কোনোমতে শাড়িটা ঝেড়েঝুড়ে বিন্দে নিতাই মন্ডলের বাড়ি যেয়ে উঠল কিন্তু এত লোক কেন নিতাইয়ের বাড়ির উঠোনে! বিন্দে যেতেই নিতাই মন্ডলের বউ আছাড়িপিছাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়ল
দিদি গো আমার ব্যাটারে ফেরৎ এনে দাও গো দিদি গো
এক সপ্তাহ আগে লকডাউনের জন্য বোম্বে থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল একটা দল সেই দলে বিন্দের ছেলে,ছেলের বউ,নিতাইয়ের ছেলে,মনোহরপুরের আরো দুটো ছেলে সবাই একসঙ্গে আসছিল পথে এক জায়গায় রাতে রেললাইনের ওপরে সবাই যখন ঘুমাচ্ছিল অজান্তে একটা ট্রেন এসে চলে গিয়েছে ওদের ওপর দিয়ে কেউ কোনো খোঁজ পায়নি প্রথমে পরে সব জানাজানি হয়েছে বিন্দের পা কাঁপতে লাগল নিতাইয়ের বউকে ধরে;চোখেমুখে অন্ধকার দিয়ে উঠল নিকষ অন্ধকারে শুধু ঝাপসা দেখা যাচ্ছে নুরুর মুখ।।
ঠাম্মা বাবা আসলে আসকিরিম খাওয়ার পয়সা দেবে বলো? ঠাম্মা বলো?
******************************************************

                   

ব্রততী চক্রবর্ত্তী পরিচিতি
ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করেছেন এবং বর্তমানে পেশায় শিক্ষিকা।দীর্ঘদিন লেখালিখি ছাড়াও, শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ মূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। বিশেষত অ্যাসিড অ্যাটাক সার্ভাইভারদের নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন তিনি। 

1 Comment

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!