Shadow

রাতের মেলট্রেন – ব্রততী সেন দাস

PC: Pinterest

রাতের মেলট্রেন

ব্রততী সেন দাস

নিশুত রাত,কামরা ঘুমে অচেতন।তেপান্তরের মাঠের ওপর দিয়ে মেল ট্রেন ছুটে চলেছে দিকশূন্যপুরের দিকে। নিশছিদ্র বগি থালার মত মস্ত কষ্টিপাথরের রঙা আকাশ উপুড় হয়ে আছে আর সেখানে ছিট ছিট কুচি কুচি নক্ষত্র ছড়িয়ে আছে আদিগন্ত।অমাবস্যার রাত,এক কিশোরী কন্যা মাঝ রাতে ঘুম ভাঙা চোখ মেলে চেয়ে আছে বাইরে।জানলার শার্সি তোলা,মন্দ মেদুর বাতাসে কপালের ওপর চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ।লোহার ঠান্ডা রডে গাল চেপে এক অবাক বিস্ময়ে দেখছে রাতের প্রকৃতিকে।ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৃষ্টি সরে সরে যাচ্ছে আবছা মাঠ,ঘাট,পুকুর, খেত,খামার, ঘর- বাড়ি পেরিয়ে দূরের দিকে।  যেখানে ঘুমন্ত মাতঙ্গসম পাহাড় আর টিলা নিশ্চুপে আছে পশ্চিমদিকে।তার উঁচু নিচু রূপরেখার বাইরে কালো কালির কাঁচের বোয়ামের মত ঝকঝকে আসমান আর উড়ো উড়ো মেঘ সরে সরে যাচ্ছে।
কিশোরী কামরার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখল অন্ধকার চারদিক,প্যাসেজের শেষে একটা টিমটিমে বালব জ্বলছে আর রেল কম্পানির ছোট ছোট ফ্যানগুলো বাতাসের থেকে বেশি শব্দ দিয়ে জানান দিচ্ছে যে তারা তাদের কাজ করছে,ঘুরছে মাথার ওপর!
হঠাৎ ট্রেনের গতি কমে এলো,ধীরে ধীরে কোন এক নাম না জানা গাঁয়ের ধারে থেমেও গেল।কিশোরী জানলা দিয়ে আরো নিবিষ্ট চিত্তে সেই গ্রামটিকে খুঁজতে লাগল। নিস্তব্ধ গভীর রাতে এমন একটা গ্রামের মধ্যে গাড়ি থেমেছে তো শুধুমাত্র ওর জন্য! আর কেউ জানুক আর না জানুক এই কিশোরীর সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য তো ট্রেনের থেমে যাওয়া! কারণ এই গ্রামে যাওয়ার টিকিট তো কেউ কাটেনি,তাহলে থামবে কেন। সমস্ত যাত্রীরা গভীর ঘুমে অচেতন আর সে দেখছে দূরে একটা বাড়ির বারান্দা। বারান্দাটায় ঘরের থেকে হলদে ম্লান আলো তেরছা হয়ে পড়েছে। আর একটা পর্দা হাওয়ায় থিরথির করে কাঁপছে বা কখনো হাওয়ায় লুটোপুটি খাচ্ছে। কিশোরী পর্দার দিকে চেয়ে ভাবছে- কারা বাস করে এই বাসায়? তারা কি জাগা,এত রাতে? কেন….যখন সমস্ত ভূমন্ডল ঘুমে অচেতন তখন এ বাড়িতে আলো জ্বলে কেন? খোলা দরজায় নেতানো পর্দার ঘর আর বাহিরের আন্দোলন ওকে কেমন মোহাবিষ্ট করে তোলে। মনে হয় কী যেন একটা হবে,এক্ষুণি কেউ ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসে দাঁড়াবে।কিংবা ঘরের আলোটা নিভে যাবে বা কেউ এসে দরজাটা বন্ধ করে দেবে। কিশোরী রুদ্ধশ্বাসে যে কোন কিছুর একটা প্রতীক্ষায় ছিল। চোখ স্থির  ছিল ওই বারান্দাটায়। এক একটি মুহূর্ত জল কেটে বেরিয়ে গেল কিন্তু পর্দা একই ভাবে দুলে যেতে লাগল। অক্লান্তভাবে! অপেক্ষার নিরসন ঘটল যখন ট্রেনটি আবার দুলে উঠল,যাত্রা শুরু হল।ট্রেন এগিয়ে যেতে লাগল আর কিশোরীটি যতদূর পারল ঘাড় বেঁকিয়ে চেয়ে রইল ওই দুলন্ত পর্দাটির দিকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সজল চোখ জবাব খুঁজেই গেল।
আজও ওই দুলন্ত পর্দা ওর ঘুমের মধ্যে তিরতির করে কাঁপে।আজও  ঘুম আর না-ঘুমে মাঝে উত্তরের প্রতীক্ষা করে!! স্বপ্ন দেখে ঘরের আলো আড়াল করে এক অতিকায় ছায়া বারান্দা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ হতে হতে সে মেল ট্রেনকে স্পর্শ করতে পারে হয়ত বা কিশোরীর গালও।
****************************************************

ব্রততী সেন দাসের পরিচিতিঃ
ব্রততী সেন দাসের জন্ম দক্ষিণ দিনাজপুরে কিন্তু পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা মহানগরে।রবীন্দ্রনাথের আদর্শে দীক্ষিত। পাঠভবনে স্কুলে পড়তেন,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন।পরিণত বয়সে লেখালেখি শুরু করেন যখন ছেলে মেয়েরা অনেকটাই বড়।প্রথমে শুরু করেন অনুবাদ দিয়ে।পরে স্বকীয় লেখায় নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন। বাংলার প্রখ্যাত পত্র-পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে। দেশ,আনন্দ বাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়, যুগশঙখ,উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্র, ফেমিনা ইত্যাদি অন্যতম।এছাড়া ওঁর অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,প্রতিভাস,পারুল প্রকাশনী, ভাষাবন্ধন ইত্যাদি প্রকাশনালয় থেকে। 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!