হোয়াইট হাউসে রক্তের দাগ
দেবপ্রিয়া সরকার
কুয়াশা ঢাকা আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে কমলা রঙের চাঁদ। বিকেলের পর থেকেই শিরশিরে উত্তুরে হাওয়া কাঁপন ধরাচ্ছে। আজ ডিসেম্বরের চব্বিশ। রাত পোহালেই বড়দিন। চারদিকে উৎসবের আবহ। আলোর মালায় সেজেছে চার্চ,দোকানপাট;হোয়াইট হাউসও।
অ্যালবার্ট ডিসুজা নামজাদা মানুষ। বংশপরম্পরায় ধনী। তাঁর পূর্বপুরুষরা ইংরেজ আমলে কাঠের ব্যবসা করতে এসেছিলেন ডুয়ার্সে। তারপর এখানেই রয়ে গেলেন পাকাপাকিভাবে। ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতেও অ্যালবার্ট হাত পাকিয়েছেন ভালরকম। খুব বড়সড় গণ্ডগোল না হলে এবছর তাঁর বিধানসভায় টিকিট পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। ডিসুজাদের বাড়িটা ছিল অনেক পুরনো। অ্যালবার্ট তাকে ভেঙে তৈরি করেছেন হাল ফ্যাশানের দালান। দামী মার্বেল পাথর বসানো বাড়ির বাইরের রঙ ধবধবে সাদা। স্থানীয় মানুষরা বলে হোয়াইট হাউস।
হোয়াইট হাউসে আজ চলছে খ্রিস্টমাস ইভ সেলিব্রেশন। আত্মীয়-বন্ধু,পার্টির নেতা-কর্মী নিয়ে হলঘর সরগরম। অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত অ্যালবার্ট আর তাঁর স্ত্রী মিজোরা, ছোট ছেলে রজার আর বড় পুত্রবধূ অ্যালিস। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় রাখা হয়েছে একটা এক্সমাস ট্রি আর জাম্বো সাইজের কেক। মিউজিকের তালে তালে চলছে খানাপিনা। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতেই চনমনিয়ে উঠল সকলে। পরিবারের সদস্যরা জড়ো হল কেক কাটার জন্যে আর তখনই ঘটল অঘটনটা।
হাতে রিভলভার নিয়ে ঘরে ঢুকেছে রেমো। নেশার ঝোঁকে পা দুটো টলছে। কষ্ট করে দাঁড়াল কেক সাজানো টেবিলটার সামনে। একটা দুর্বোধ্য হাসি ছড়িয়ে আছে সারা মুখে। কেউ কিছু বোঝার আগেই গুলি চালাল একে একে অ্যালবার্ট,মিজোরা আর রজারের বুকে। একবার মুখ তুলে দেখে নিল পার্টিতে উপস্থিত মানুষগুলোকে। তারপর নিজের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে চাপ দিল ট্রিগারে,শেষবারের মতো।
******
বড় লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে রণজয়। ভাল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে জরিপ করছে বাড়িটাকে। আলোর মালা এখনও জ্বলছে। সকাল হয়ে গেলেও সেগুলো নেভানোর কথা মনে নেই কারও। রংবেরঙের কাগজ হাওয়ায় উড়ছে। গতরাতের উৎসবমুখর বাড়ি আজ শ্মশানের মতো শান্ত! বারান্দায় পা রাখতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল সাব-ইন্সপেক্টর প্রসূন। বলল,
-কেস একদম জলের মতো সহজ স্যার। অ্যালবার্ট ডিসুজার বড় ছেলে রেমো কাল নেশার ঝোঁকে খুন করেছে বাবা, মা, ভাই আর নিজেকে। পার্টিতে উপস্থিত প্রায় সকলের স্টেটমেন্ট আমি নিয়েছি। প্রত্যেকের মুখে একই কথা। মাঝখান থেকে লাকিলি বেঁচে গিয়েছে রেমোর স্ত্রী অ্যালিস।
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল রণজয়।
-লাকিলি! সেটা কীভাবে?
-অ্যালিস তখন রান্নাঘরের দিকে গিয়েছিলেন,কেক কাটার ছুড়ি আনতে। সেইসময়ই ঘরে ঢোকে রেমো।
-ও। পোস্ট মর্টেম আর ফরেনসিক রিপোর্টগুলো নিয়ে বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করবে। তার আগে একবার বাড়ির ভেতরটা দেখতে চাই আমি।
প্রসূন সঙ্গে করে নিয়ে গেল অন্দরে। ঘুরে দেখাল পার্টির জায়গা। বেবি পিঙ্ক রঙের আইসিং দেওয়া কেকটা এখনও পড়ে আছে টেবিলে। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছেন মূর্তিমান সান্তাক্লজ!
-বাড়ির চাকরবাকর,অ্যালিস এরা সব কোথায়?
-স্যার দু’জন মেইড,একজন মালি আর ড্রাইভার আছে এই বাড়িতে। আমি ওদের ওপরে থাকতে বলেছি। অ্যালিসও আছে নিজের ঘরে। খুব ভেঙে পড়েছে বেচারি। একেই মাতাল স্বামীর অত্যাচারে কুঁকড়ে থাকত। তার ওপর এমন ঘটনায় একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে সে।
-ঠিক আছে, আজকের দিনটা বাদ দাও। কাল এসে ইন্টারোগেট করব।
******
-তাহলে বলছেন দলের ভেতরেই শত্রু ছিল অ্যালবার্টের?
-একদম সহি বাত। আমি আপনাকে ভিতরের খবর দিচ্ছি। ওই অর্জুন সিং আর ওয়াসিম কুজুরের সঙ্গে ক্ল্যাশ ছিল অ্যালবার্টের। অর্জুনের টার্গেট ছিল এসেম্বলির টিকিট আর ওয়াসিম চাইছিল কাঠের ব্যবসার বেতাজ বাদশা হতে। ওদের দুইজনেরই পথের কাঁটা ছিল অ্যালবার্ট। ওরাই রেমোকে দিয়ে খুন করিয়েছে নিজের পিতাজিকে।
-কিন্তু ওরা রেমোকে দিয়ে খুন করাতে যাবে কেন? তেমন হলে যেকোনো ভাড়াটে খুনিকে দিয়েও কাজটা করাতে পারত?
-টুইস্টটা তো এখানেই স্যারজি। অন্য কাউকে দিয়ে খুন করালে সহজেই ওদের ওপর উঙ্গলি উঠবে। কিন্তু রেমোকে দিয়ে করালে নয়। কারণ রেমো আর তার বাপের দুশমনির কথা সব্বার জানা। তাই সাপ ভি মরবে,লাঠিও ভাঙবে না।
-দুশমনি! সেটা কেন?
-আরে রেমো তো একটা বদমেজাজি,নেশাখোর ছেলে। দিনভর দারু খেয়ে পড়ে থাকে রেড লাইট এরিয়ায়। পয়সার জন্য বাবা ছেলের ঝামেলা এই শহরের খুব পপুলার ইস্টোরি।
-বুঝলাম। কিন্তু আপনি এতো খবর পেলেন কীভাবে?
-আরে সাব আমরা পার্টির ইমানদার মেম্বার আছি, অপজিশনের হাঁড়ির খবর তো আমাদের রাখতেই হয়।
লাজুক হেসে বিশ্বনাথ কথা শেষ করতেই ঘরে এসে ঢুকল প্রসূন। বিশ্বনাথকে বিদায় দিয়ে প্রসূনকে বসতে বলল রণজয়।
-স্যার পোস্ট মর্টেমে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। কলেজ লেভেলে শুটিং চাম্পিয়ান রেমো নেশাগ্রস্ত অবস্থাতেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি একচুলও। প্রত্যেকটা গুলি বেরিয়েছে হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে। লাশগুলো পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছি।
-বাড়িতে তো তেমন কেউ নেই। কবর দিতে আমাদের হেল্প লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলে?
-হ্যাঁ স্যার। অ্যালিস বলেছে সাহায্য দরকার হবেনা। অ্যালবারটের ভাই অ্যালান আর তার ছেলে সানি খবর পেয়ে চলে এসেছে দুপুরেই।
******
-আর বলবেন না স্যার রেমোদাদার অত্যাচারে ঝামেলা লেগেই থাকত। সাহেব, মেমসাহেবকে জ্বালিয়ে খেয়েছে। বিয়ে করে বউ ঘরে আনায় আমরা ভেবেছিলাম এবার হয়তো অশান্তি কিছুটা কমবে। কিন্তু কোথায় কী? আর আজ দেখুন বাড়ির সকলকে মেরে নিজেও মরল। বহুবিটিয়ার চোখের দিকে তাকাতেই পারছিনা।
সকাল থেকে ডিসুজা হাউসে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। বাড়ির কাজের লোকেদের একে একে জেরা করছে রণজয়রা। আর সকলে আড়ষ্টভাব বজায় রাখলেও বাড়ির সব থেকে পুরনো সহায়িকা সবিতা মুখ খুলেছে ভালরকম। একটু দম নিয়ে সবিতা বলল,
-এই তো ক’দিন আগে রাতের বেলা সাহেবের সঙ্গে রেমোদাদার খুব ঝামেলা হল। বন্দুক হাতে নিয়ে বলেছিল টাকা না দিলে খুন করবে সব্বাইকে।
-সেকি! কবেকার ঘটনা এটা?
-এক-দু হপ্তা আগের হবে।
-বন্দুকটা কার?
-রেমোদাদার। ও তো খুব ভাল বন্দুকবাজ ছিল একসময়।
সবিতার পর ডাক পড়ল অ্যালেন আর তার ছেলে সানির। জানা গেল প্রায় বারো বছর আগে পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ দাদার কাছে বিক্রি করে দার্জিলিং চলে গিয়েছিলেন অ্যালেন। শুরু করেছিলেন হোটেলের ব্যবসা। রেমো প্রায়ই যেত সেখানে। ওদের জবানবন্দি রেকর্ড করে রণজয়রা এল অ্যালিসের ঘরে। চোখ রক্তবর্ণ। সারা মুখে ক্লান্তির ছাপ।
-সারাজীবন অনেক কষ্ট সয়েছি, জানেন? আমি খুব গরিব পরিবারের মেয়ে। লেখাপড়াও করিনি বেশি দূর। একটু বড় হবার পর নিজে কাজ করে সংসার চালিয়েছি। রেমোকে পেয়ে ভেবেছিলাম এবার হয়তো কপাল ফিরবে। কিন্তু দেখুন আমার ভাগ্য!
–আগে কোথায় থাকতেন আপনি?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মৃদু স্বরে অ্যালিস বলল,
-দার্জিলিঙয়ে।
ডিসুজাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রণজয় জিজ্ঞেস করল,
–কখনও গ্লেনারিজের জানালা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছ,প্রসূন?
******
-আমরা অলমোস্ট গুটিয়ে এনেছি কেসটা। ফিনিশিং পয়েন্টে যাবার আগে একটা লাভ স্টোরি শোনা জরুরি।
থমথমে হলঘরে বসে আছে ডিসুজা পরিবারের আত্মীয় পরিজনরা। নীরবতা ভেঙে শুরু হয়েছে ফিসফাস। মুচকি হেসে রণজয় বলল,
-নিজেদের হোটেলের এক সুন্দরী স্টাফের প্রেমে পড়ে মালিকের ছেলে। কিন্তু বাবার আপত্তির জন্য সেটা বিয়ে অব্দি গড়াতে পারছিলনা। এর মধ্যে সেখানে হাজির হয় তার রইস কাজিন। যথারীতি সেও মুগ্ধ হয় মেয়েটির সৌন্দর্যে। পয়সার জোরে ইমপ্রেস করে ফেলে ওই স্টাফকে। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা মেয়েটি সহজেই রাজি হয়ে যায় বড়লোকের লম্পট ছেলেকে বিয়ে করতে।
একটু থেমে রণজয় আবার বলে,
-ক’দিনের জন্যে দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম প্রসূন আর আমি। সেখান থেকেই শুনে এলাম গল্পটা। কি, ঠিক বললাম তো মিসেস অ্যালিস ডিসুজা?
মাথা নিচু করে বসে আছে অ্যালিস।
–চিন্তা করবেন না সব এভিডেন্স আমাদের কাছে আছে। খুনের মোটিভও পরিষ্কার। নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেওয়াটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।
-বিশ্বাস করুণ ইন্সপেক্টর আমি এসব খুনখুনি কখনওই চাইনি। সানিই জোর করেছে আমাকে।
-মানছি খুনের আইডিয়াটা আমার ছিল। বন্দুক নিয়ে রেমোর হুমকি দেবার কথা শুনে আমিই ভেবেছিলাম ওকে দিয়ে মার্ডার করালে সন্দেহটা আমাদের দিকে আসবেনা। কিন্তু রেমোকে ফ্যামিলির বিরুদ্ধে ভড়কে এত সুন্দরভাবে প্ল্যানটাকে এগজিকিউট কে করেছে? আমি? ইউ ব্লাডি…
ফুঁসে ওঠে সানি।
-কাম ডাউন। বাকিটা আমিই বলছি।
রণজয় আবার বলতে শুরু করে,
-পরিকল্পনাটা একদম নিখুঁত ছিল। রেমো প্রায়ই নিজেকে আর বাড়ির সকলকে মেরে ফেলার হুমকি দিত। পার্টির দিন সেই অস্ত্রটাই কাজে লাগাল অ্যালিস। মাতাল রেমোর ব্রেনওয়াশ করে মাথায় ঢুকিয়ে দিল খুনের নেশা। নিজে সেখান থেকে কেটে পড়ল যথা সময়ে। যাতে মনে হয় গোটা ঘটনাটা নেশাখোর রেমোর হঠকারিতা। আমরাও হয়তো তাই ভাবতাম,যদি না বিশ্বনাথ যাদব আমার ভেতর সন্দেহটা জাগিয়ে তুলতো। তারপর অ্যালিস আর সানির দার্জিলিং কানেকশন সেটা আরও বাড়িয়ে দিল। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম সানির নামে বাজারে প্রচুর দেনা। হোটেলের ব্যবসাও ধুঁকছে। একদিকে জেঠুর সম্পত্তির লোভ অন্যদিকে পুরনো প্রেমিকাকে ফিরে পাওয়ার আশা দুয়ে মিলে জমে উঠল মার্ডারের প্ল্যান। এদিকে অ্যালিসও মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিল রেমোর হাত থেকে মুক্তি আর শ্বশুরের সম্পত্তি দুটোই পাওয়া যাবে এক তিরের নিশানায়। কী? তাই তো?
সকলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে অ্যালিস আর সানির দিকে। পুরো হোয়াইট হাউস জুড়ে এখন পিন পতনের স্তব্ধতা।
***************************************************
দেবপ্রিয়া সরকার:
উত্তরবঙ্গের জেলা শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। টুকটাক কবিতা এবং অনুগল্প দিয়ে লেখালিখির হাতেখড়ি হলেও ছোটগল্প লিখিয়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ ২০১৮ সালে। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘উজান’,উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায়। এরপর যথাক্রমে সানন্দা, তথ্যকেন্দ্র,শারদাঞ্জলি,উত্তরবঙ্গ সংবাদ,উত্তরের সারাদিন,এখন ডুয়ার্স,আজকাল(উত্তরণ) সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকা,লিটল ম্যাগাজিন এবং ওয়েবজিনে ছোটগল্প,বড়গল্প,অণু উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে একে একে।