উজানস্রোত
ব্রততী সেন দাস
দেবপ্রিয় বলল- আমি যেখানে থাকি তিয়াসা তোমার ভাল লাগবে না, তুমি থাকতে পারবে না। বরং আমি ফিরে আসি….
– কেন?
– খুব নির্জন জায়গা গো, একা তোমার ভয় করবে।
-তুমি তো আছো।
– আরে: আমি সেই সকালে বেরোব, ফিরব সন্ধে বেলা। মস্ত একটা দিন তুমি কী করে কাটাবে?
– সে আমি জানি না, কিন্তু তুমি যদি আমায় ফেলে চলে যাও ফিরে এসে আমায় আর নাও পেতে পারো। মা আর মামা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, আমি জানি। যেদিন আমায় জানাবে ধরে নাও সেদিন থেকে আমি বাধ্য এই বিয়ে করতে। আমার মায়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। মামাও তো মায়ের দিকে। আমি তো এখানেই বরং একা দেব।
– হুম, চিন্তায় ফেললে! তোমায় নিয়ে যে কী করি।
তিয়াসা চোখের জল মুছে মুচকি হেসে বলল-চল, বিয়ে করে নিই।
পুরনো আমলের পরিত্যক্ত বাড়ি, সার দিয়ে কাচের জানলা। মেঝে সিমেন্টের, দেওয়াল কাঠের। কোথাও ফেটে গেছে, কোথাও চলটা উঠে গেছে। উঠোনের এক পাশে কয়েকটা পাইন আর স্প্রুস গাছ। সটান উঠে গেছে মস্ত গুঁড়ি আর ডালপাল নিয়ে। একপাশে কয়েকটা লতানে গোলাপ আর আইভি লতা জড়াজড়ি করে একটা বীথিকা রচনা করেছে। বড় বড় ঘাস আর বুনো ফুলে ভরা। ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ডানার প্রজাপতি সারাদিন ঘাসের বনে উড়ে বেড়ায়। বড্ড শান্ত আর নির্জন জায়গা। নিজের চলার শব্দও কানে আসে। দুপুরবেলা আরো নিঝুম হয়ে যায়। নৈ:শব্দ বিন বিন করে কানের মধ্যে। কাজ সেরে দুপুরবেলা উঠোনের কোণে ভেতরে ঢোকার তিন ধাপ সিঁড়িতে বসে রোদ পোহায় তিয়াসা। হাতে কখনো থাকে বই, দু পাতা পড়ার পর চোখ চলে যায় পাইনগাছের দিকে। ঝির ঝির করে সবুজ কাঠির মত পাতা ঝরে পড়ছে, মাথায়,বইতে। পাইন ফলও লুটোপুটি খায় এখানে ওখানে। প্রতিদিন ঝাড়ুদারনি এসে ঝাঁট দিয়ে যায় তবুও উঠানময় পাইনপাতা। কাগজ কলম নিয়ে সুদূর কলকাতায় চিঠি লিখতে বসে…প্রিয় বন্ধু শ্রাবস্তী অবধি লিখেই হাঁ করে তাকিয়ে দেখে একটা সাদা প্রজাপতি কেমন হলুদ প্রজাপতিকে তাড়া করেছে। দুটিতে ফুলের বনে গিয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। যেমনটি ও আর দেবপ্রিয় খায়, গতরাতের কোন একটা কিছু মনে হওয়ায় তিয়াসা নিজের মনেই লজ্জায় লাল হয়ে যায়!
মেঘ তিয়াসার বন্ধু, খোলা জানলা বা দরজা দিয়ে মেঘ মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে খোকা – খুকু দুজন কেমন সংসার পেতেছে। মাঝে মাঝে ওর আর দেবপ্রিয়ার মাঝে এক টুকরো মেঘ কেন এক ঝাপসা আড়াল তৈরি করে? বড় ভয় করে তিয়াসার!
সারাদিন এই দেখেই দিন কেটে যায়। মা ছোটবেলায় ঠিকই বলত – বড্ড হাঁ করা মেয়ে! এখন দেবও বলে – তোমার কি বিশ্বের সবেতেই বিস্ময় খুকুমণি? তিয়াসা সত্যিই মনে মনে এক অবুঝ আনন্দে মেতে থাকে! নবীন বিস্ময়ে যখন যা কিছু দেখে অজানা সুখে ও রোমাঞ্চিত হয়।
শুধু যখন মামাবাড়ির কথা মনে হয় একটা দম চাপা ভয় বুকের মধ্যে বাসা বাঁধে।
বিডন স্ট্রীটের মস্ত তিনতলা বাড়িটা ছবির মত ভাসে তিয়াসার চোখের সামনে, এটাই ওর মামাবাড়ি। মা যখন ওকে নিয়ে মামারবাড়ি ফিরে আসে তখন ওর বয়স ছিল চার বছর। কেন মা বাবাকে ছেড়ে আসে ও জানে না। কিন্তু বাবার সেই ছবিটা ওর চোখের সামনে আজও ভাসে। বাইরের ঘরে একটা কাঠের চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে থাকা এক শীর্ণকায়, বিবর্ণ মানুষ। হাতের শিরগুলো কেমন ফুটে ওঠা। পরনে আকাশী বুশশার্ট আর খয়েরি পাতলুন, রঙ ওঠা। হাতের একটা ঠোঙায় থাকত ওর প্রিয় কোন ফল – পেয়ারা,কুল বা আপেল অথবা নাশপাতি। তিয়াসা বাবার কোলে বসে বুকের কাছে মাথা রেখে বাবার গায়ের গন্ধ পেত। ঘাম আর সিগারেটের সাথে একটা বাবা বাবা গন্ধ। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকার অনুমতি ছিল না। কান্তাপিসি এসে দাঁড়ালেই বাবার কোল থেকে নেমে যেতে হত। যাওয়ার আগে বাবা মাথায় একটা আলতো চুমো খেত। ভিষণ নি:স্ব লাগত বাবাকে তখন।
বিকেল যখন সন্ধ্যার বুকে মাথা গোঁজে তখন ও দিকের পাহাড়ে টিপটিপ করে জোনাক বাতির মত আলো জ্বলে ওঠে। তিয়াসার দেবপ্রিয়র জন্য পথের দিকে চেয়ে প্রতীক্ষায় থাকে। রাতের দিকে সারা পাহাড় আলোয় সেজে ওঠে। তখন বড্ড কলকাতার জন্য মন কেমন করে, বিডন স্ট্রীটের পার্কের কোণে ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে এখন খুব ভিড়। রাস্তার কোণায় রাজুদার দোকানের এগ চিকেন রোল দেবপ্রিয়র বড় প্রিয়। আর মনে পড়ে জিনির কথা, আদুরে বেড়ালটা সারাক্ষণ তিয়াসার পায়ে পায়ে ঘোরে। আর এই গরমে দোতলায় দিম্মার ঘরে জানালার চওড়া পাটাতনের ওপর থাবা পেতে আরামে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চয়ই। ওকে যদি চিঠি লিখতে পারত তাহলে তিয়াসা লিখত ও এখন গায়ে সোয়েটার, পায়ে মোজা পড়ে বরের বুকের কাছে শুয়ে সোহাগ খাচ্ছে হি হি হি।
– মা আসতে চাইছেন, কাল অফিসে টেলিফোন করেছিলেন। কী বলব?
তিয়াসার বুকের মধ্যে আচমকা দুড়দুড় করে উঠল। কোন কথা না বলে দেবপ্রিয়কে আঁকড়ে ধরল।
মহাশ্বেতাকে এয়ারপোর্টে নিতে দুজনে মিলে তিন ঘন্টার রাস্তা উজান পেরিয়ে এল। মা মেয়ের দেখা হতে চোখ সরিয়ে নিল না কেউ। মেয়ের দৃষ্টিটা পড়ে নিতে মহাশ্বেতার দু সেকেন্ড সময় লাগল। খেলনাবাটির সংসার তিয়াসা বড় যত্নে সাজিয়েছে। ছোট হাঁড়ি, কড়াই, থালা, গ্লাস, চামচ, হাতা ঝকঝকে করে মাজা আর সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। জামাকাপড়ও পাট পাট করে রাখা। মা আসবে শুনে দেবপ্রিয় পর্দা আর কার্পেট পালটে নতুন কিনতে চেয়েছিল, তিয়াসা রাজি হয়নি। মা যা দেখতে চায় তা নয়, ও যা, মা তাই দেখুক! যে কয়দিন ছিল মহাশ্বেতাকে খুব যত্ন করল তিয়াসা আর দেবপ্রিয়। এত যত্ন আর সম্মান নিজের বাপের বাড়িতেও কখনও পেয়েছে কিনা মনে পড়ে না মহাশ্বেতার। যাবার আগে আড়ালে ডেকে মেয়েকে বললে – দেবপ্রিয় ছেলে মন্দ নয় রে, ভারি আপন করতে পারে কিন্তু সংসার মানে তো পুতুলখেলা নয় রে তুয়া, ওকে অনেকদূর উঠতে হবে। অনেক পরিশ্রম করতে হবে তবেই না সংসারের গাড়ি গড়গড়িয়ে চলবে।
– চলছে তো মা, কিসের অসুবিধে?
– বোকা মেয়ে, এটুকুতেই কি সুখ?
– আর কী চাই?
– এখন নতুন নতুন সংসার তো বুঝবি না, আরো কিছুদিন যাক…..তোর বাবাকে বিয়ে করে আমি খুব ঠকা ঠকেছি। জীবন আমায় খুব শিক্ষা দিয়েছে।
– তার জন্য আমি আছি তো মা, যতটুকু আর প্রয়োজন আমি যোগাড় করব। চাকরির পরীক্ষাগুলো সব দিতে শুরু করব চিন্তা করো না।
– আর সারাজীবন কি এই বন জঙ্গলের মধ্যে কাটাবি নাকি, মা গো!
– কেন, আমার তো বেশ লাগে। সকাল হলে এই পাইন গাছটায় একটা দাঁড়কাক ডাকে ক্ব ক্ব করে- ভোর হল দোর খোল, খুকুমণি জাগো রে। আর বিকেল হলে ওই পাহাড়টা বলে তিয়াস সাজুগুজু কর তোমার বর এখনই ফিরবে যে, বলে তিয়াসা হেসে লুটিয়ে পড়ল। মহাশ্বেতা মেয়ের দিকে চেয়ে বলল – একদম বাবার মত কাব্যি করতে শিখেছিস। কলকাতা ছেড়ে কীভাবে যে এখানে পড়ে আছিস? যত সাপখোপ পোকামাকড়ের রাজত্ব!
– তাও ভাল। মা গো, সাপখোপ, পোকামাকড় দেখে তো আগে থেকে সাবধান হওয়া যায়!
– উফফ, খুব কথা শিখেছিস তুয়া এখানে এসে। কলকাতাকে মিস করিস না?
– করি কিন্তু এখানে যা পাই তা কলকাতা বা তোমার বিডন স্ট্রীট কোনদিন দিতে পারবে না। তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না মা, আমি ভাল আছি!
মহাশ্বেতা ভাবে মেয়েটা এই ক’দিনেই কেমন অচেনা হয়ে গেছে!
উড়ান মহাশ্বেতাকে নিয়ে দূর আকাশে মিলিয়ে গেলে দেবপ্রিয় তিয়াসার অশ্রুসিক্ত ঝাপসা চোখের দিকে চেয়ে বলল – চলো, যাওয়া যাক।
তিয়াসা কিছু না বলে চোখ মুছে আলতো করে হাসল।
-শোন, তোমার বাবাকে একবার নিয়ে এসো এখানে, তোমার কাছে থাকলে উনি খুব আনন্দ পাবেন, শান্তি পাবেন।
তিয়াসা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে চাইল-দেবপ্রিয় কী করে জানল শৈশব থেকেই বাবার সাথে বাস করার, বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমোনোর কী তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল ওর, ও তো কখনও বলেনি, তাহলে? ভালবাসা কি অন্তরযামী করে দেয়?
তিয়াসা দেবপ্রিয়র আঙুলে আঙুল ঢুকিয়ে ঘন হয়ে দাঁড়াল। পাহাড় থেকে নেমে আসা হিমেল বাতাসে ওর শীত করে না যখন দেবপ্রিয় ওর কাছে থাকে, ওর হাত ধরে থাকে। বিডন স্ট্রীটের ঐ মস্ত বাড়িটার ভয় ওকে আর ছোঁয় না যখন ও পাহাড়গুলোয় পিঠ দিয়ে দেখে সোনাঝরা ভোর হচ্ছে। তিয়াসা এতদিন ঘন কুয়াশায় জীবনযাপন করেছে, সাদা মেঘ আর রামধনু এখানে এসেই দেখল।
**********************************************
ব্রততী সেন দাসের পরিচিতি
ব্রততী সেন দাসের জন্ম দক্ষিণ দিনাজপুরে কিন্তু পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা মহানগরে। রবীন্দ্রনাথে আদর্শে দীক্ষিত পাঠভবনে স্কুলে পড়তেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন। পরিণত বয়সে লেখালেখি শুরু করেন যখন ছেলে মেয়েরা অনেকটাই বড়। প্রথমে শুরু করেন অনুবাদ দিয়ে। পরে স্বকীয় লেখায় নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন। বাংলার প্রখ্যাত পত্র – পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দ বাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়, যুগশঙখ, উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্র, ফেমিনা ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া ওঁর অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, প্রতিভাস, পারুল প্রকাশনী, ভাষাবন্ধন ইত্যাদি প্রকাশনালয় থেকে।
কি অপূর্ব !! কি বর্ণনা!!খুব ভালো লাগলো!!
ভালো.. খুব ভালো লাগলো।।