এবং অলকানন্দা
দেবপ্রিয়া সরকার
এক
দরজাটা খুলতেই হিমেল হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগলো চোখে মুখে। হুড়মুড়িয়ে ঠান্ডা উওুরে বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকছে আগলে রাখা উষ্ণতাটুকু গিলে খাবার মতলবে। প্রাথমিক ঝটকা সামলে গায়ের চাদরটা ভাল করে কানে মাথায় জড়িয়ে নিল নন্দা। সন্তর্পণে সদর দরজা বন্ধ করে পা বাড়াল ঘরের বাইরে।
এবার পৌষের শুরু থেকেই জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। উওরবঙ্গের শীতের রকমসকম নন্দার ভালই জানা। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসা ইস্তক এর দামালপনা দেখে আসছে। আজ কুয়াশাও পড়েছে জব্বর! দু’হাত দূরের জিনিসকেও ঠাহর করা যাচ্ছে না ঠিকঠাক। রাস্তাঘাট শুনশান। সঙ্গের ঢাউস ব্যাগটাকে আঁকড়ে দ্রুত পা চালালো নন্দা। ঘন কুয়াশার পর্দা ডিঙিয়ে নজরে আসছে হলদে রঙের স্কুল বাড়িটা। একটা আবছা মানুষের ছবি চোখে পড়ছে ঝুপসি ছায়া ঘেরা চন্দনগাছের নীচে। নন্দা একটু থমকালো। অজান্তেই বুকের গহীন কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এল একটা স্বস্তির শ্বাস।
টুপি-মাফলারে মাথা গলা ঢেকে রাখা মানুষটা এবার তাকাল নন্দার দিকে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল দু’জনেই। টুপটাপ হিম পড়ার শব্দ আর শুকনো পাতার খসখস ছাড়া কানে আসছে না কিছুই। শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে দুটো নির্বাক মূর্তিকে। নীরবতা ভেঙে কানে এল একটা জোড়ালো পুরুষকন্ঠ,
-তুমি তৈরি তো? এবার তাহলে এগোনো যাক? অনেকটা পথ যেতে হবে আমাদের।
গভীর কোনও ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল নন্দা। সামনের দিকে পা বাড়িয়েও কিসের টানে যেন আবারও ফিরে তাকাল পেছনে। নিজের শহর, পরিবার, বাবা-মা, ভাইবোন সকলকে ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা এক জগতের উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে। নিজের মনের সঙ্গে কঠিন লড়াই করেছে সে। অবশেষে শক্তি জুটিয়েছে এমন দুঃসাহসিক একটা সিদ্ধান্ত নেবার। সমস্ত পিছুটানকে অগ্রাহ্য করে আজ পালিয়ে যাচ্ছে নন্দা। সম্বল বলতে দু’ চারটে জামাকাপড়, একজোড়া সোনারদুল, একটু একটু করে জমিয়া রাখা কিছু টাকা আর বুক ভরা স্বপ্ন, যেগুলো তাকে দেখিয়েছে সীমান্ত চাকলাদার নামের এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
দুই
-অলকানন্দা !
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে উঠল সীমান্ত।
-মানে জানো শব্দটার?
-হ্যাঁ, কেন জানবনা? এটা তো উত্তরাখণ্ডের একটা নদীর নাম। দেবপ্রয়াগের কাছে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে, তারপর গঙ্গা নাম নিয়ে এগিয়েছে সামনের দিকে। ভূগোল বইতে পড়িনি বুঝি?
স্বতঃস্ফূর্তভাবে সীমান্তর প্রশ্নের উত্তর দিল নন্দা। একটু গর্ব বোধও হল সদ্য বিয়ে করা স্বামীর সামনে নিজের বিদ্যে বুদ্ধি জাহির করতে পেরে।
সীমান্ত অপ্রসন্ন গলায় বলল,
-আরে ধুর ওসব তো কেতাবি কথা! অলকানন্দা শুধু নদী নয়, সে এক বিশ্বাস। হিন্দু পুরাণ মতে স্বর্গের নদী হল অলকানন্দা। তার মতো স্বচ্ছ, পবিত্র জলধারা আর দুটো নেই। এর তীরেই গড়ে উঠেছে একের পর এক তীর্থক্ষেত্র। স্বয়ং ব্যসদেব এই অলকানন্দার ধারেই খুঁজে পেয়েছিলেন অপার শান্তি। সেখানে বসে রচনা করেছিলেন মহাভারত। আর দেখো, আমার মতো অধমও কিনা আজ পেয়ে গেল সেই পুণ্যতোয়া অলকানন্দার সান্নিধ্য!
লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া মুখ স্বামীর রোমশ খোলা বুকে গুঁজে দিল নন্দা। অজান্তেই দু’চোখ ছাপিয়ে নেমে এসেছে জলের ধারা। মুখে কিছু না বললেও নন্দার মন জানে কী অপরিসীম আনন্দের সাগরে ডুব দিয়েছে সে! তার মতো রোগা, কালো, হনু বেরিয়ে থাকা, তিরিশ পেরোনো মেয়ে এতকাল বাপ মায়ের গলার কাঁটা হয়ে পড়েছিল ঘরে। বাড়ির লোকেরা চেষ্টা কম করেনি নন্দাকে পাত্রস্থ করার। কিন্তু সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে বারবার। মুখচোরা নন্দা দিন দিন কেমন যেন গুটিয়ে যাচ্ছিল নিজের মধ্যে। যত দিন গড়িয়েছে তত সিটিয়ে গিয়েছে মনের মধ্যে গড়ে ওঠা চৌখুপির ভেতর। একদিন আচমকাই তার জীবনে এল সীমান্ত। ঝলমলে রাজপুত্রের মতো এক পুরুষ! নন্দা বিশ্বাস করতে পারেনি নিজের ভাগ্যকে। অন্ধের মতো ভেসে গিয়েছে সীমান্তর ডাকে। আজ সেই সুপুরুষের বক্ষলগ্না হয়ে অপার মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়ে আছে সে। সীমান্ত দু’ হাতে সজোরে আলিঙ্গন করল নন্দাকে। তারপর ঈষৎ মৃদুকন্ঠে উচ্চারণ করল,
“অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে”।
বড় বড় চোখ মেলে সীমান্তর দিকে তাকিয়ে নন্দা অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল,
-জয় গোস্বামী?
তিন
সীমান্ত চাকলাদার বাংলা সাহিত্যের উঠতি কবিদের মধ্যে অল্পবিস্তর পরিচিত নাম। বাঁকুড়ার প্রান্তিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা সীমান্ত কলকাতায় এসেছিল পড়াশুনা করতে। কবিতার প্রতি তার টান সেই কিশোর বয়স থেকেই। কলকাতায় এসে সে টান পরিণত হয়েছে ভালবাসায়। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সামিল হয়ে ছুটেছে বাংলার এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। সম্প্রতি একটা কবি সম্মেলনে যোগ দিতে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে উত্তরবঙ্গ গিয়েছিল সীমান্ত। সেখানে গিয়েই ঘটে যায় অঘটনটা। কীসের থেকে কী হল ঠিক মতো বোঝার আগেই সীমান্তর গায়ে সেঁটে গেল বিবাহিত পুরুষের তকমা। তার বোহেমিয়ান জীবনে চিরকালের মতো এসে পড়ল একটা পূর্ণচ্ছেদ। এতদিন দু’ চারটে টিউশনি আর কবিতা নিয়ে মেতে থেকেই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। কিন্তু এবার রোজগারের চিন্তা এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সীমান্তকে।
যাদবপুরের এক কলোনির ভেতর দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘরে সংসার পেতেছে সীমান্ত আর নন্দা। আরও তিন ঘর ভাড়াটের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় স্নানঘর, কলতলা। ঘরের এক কোণে রান্নার ব্যবস্থা। নন্দার বাবা অমৃতলাল সরকার বনেদী ব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই পাকা দালান বাড়ি, সামনে ফুল বাগান, রোদ ঝলমলে পরিবেশে মানুষ। আচমকা এমন পরিবেশে এসে প্রথমে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে নন্দা। কিন্তু ধীরে ধীরে মেনে নেয় স্বনির্বাচিত জীবনকে।
সীমান্ত শৌখিন মানুষ। পড়া লেখা নিয়েই মেতে থাকতে ভালবাসে। সংসারের প্রয়োজনে তাকে কাজ করতে হয় ইদানীং। কিন্তু কোনও কাজেই তার মন টেকে না। দু’ চারদিন যাবার পরই তার ওই চাকরি বড্ড একঘেয়ে মনে হয়। খুঁজতে থাকে নতুন কোনও কাজ। প্রথমটা বুঝতে না পারলেও নন্দা এখন আন্দাজ করতে পারছে তার স্বামীর রকমসকম। অভাব থাকলেও হাসিমুখে সবটা সামলে নিয়েছে নন্দা। আসন্ন মাতৃত্বের আনন্দে ভরে আছে তার মন।
পরিবারের কাউকে না জানিয়ে সীমান্তর হাত ধরে ঘর ছেড়ে ছিল নন্দা। কিন্তু তার মা হওয়ার খবর আপনজনদের না জানিয়ে থাকতে পারেনি। বাড়ির সকলেও মান অভিমান ভুলে ঘরে তুলেছে নন্দা এবং তার ছেলেকে। ব্রাত্য কেবল সীমান্ত। অমৃতলাল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর বাড়ির দরজা সীমান্তর জন্যে চিরকালের মতো বন্ধ। বাবার এই সিদ্ধান্ত আহত করেছে নন্দাকে। ফিরে এসেছে ছেলেকে নিয়ে। বাড়িতেই জুটিয়ে নিয়েছে ক’টা টিউশনি। ছেলেকে পাশের ভাড়াটে অসীমাদির কাছে রেখে ছ’ মাসের একটা বিউটিশিয়ান কোর্সও করেছে। এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে সাজিয়ে আসছে মেয়েদের। রোজগার মন্দ হচ্ছে না।
এক শুক্রবার বিকেলে নিজের ছ’নম্বর চাকরিতে জবাব দিয়ে ঘরে ফিরে সীমান্ত বলল,
-আমি ভেবে দেখলাম নন্দা, পরের গোলামি করা আমার ধাতে নেই। তার থেকে বরং ভাবছি একটা ব্যবসা শুরু করি।
-সেকি? ব্যবসা করবে তুমি!
-হ্যাঁ, কেন পারব না? শুধু একটু টাকার জোগাড় করতে হবে, এই যা।
-তা কীসের ব্যবসা করবে শুনি?
-এখনও তেমন কিছু ভাবিনি। নরেন মিত্তিরের একটা দোকান খালি পড়ে আছে। ভাবছি ওটাই নেব সেলামী দিয়ে। টাকা পয়সা বেশি জোগাড় হলে বড়সড় মুদিখানা করা যায়। না হলে পান-বিড়ি, সিগারেট, চকলেট দিয়ে শুরু করি।
-সেলামী? সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! এতো টাকা পাব কোত্থেকে?
-বন্ধুবান্ধবদের বলে দেখেছি, তারা কেউই একলপ্তে এতগুলো টাকা ধার দিতে চাইছে না। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়াও বিস্তর ঝকমারির ব্যাপার।
-তাহলে কোথায় পাব আমরা এত টাকা?
একটু ইতস্ততঃ করে সীমান্ত বলল,
-তোমার মাকে একবার বলে দেখবে? আমার নাম করে তোমার বাবার কাছে চাইলে কখনওই দেবেন না। কিন্তু মা…
কথাটা শেষ না করে সীমান্ত তাকাল নন্দার দিকে। তার বাবা একেবারেই পছন্দ করেন না সীমান্তকে। এখন ব্যবসা করার জন্যে টাকা চাইতে গেলে বাবা কী মনে করবেন ভেবে কেঁপে উঠল নন্দার বুক। আত্মসম্মানবোধকে এক পাশে সরিয়ে রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় মাকে ফোনে নন্দা জানিয়েছিল সমস্যাটা। না জানি কোন কথার জালে বাবাকে ফাঁসিয়ে মা বন্দবস্ত করে দিল এক লক্ষ টাকার। দারুণ উৎসাহে গিফট আইটেম, কাগজ-খাতা-পেনের দোকান খুলে বসল সীমান্ত। প্রথম প্রথম ব্যবসা নিয়ে দারুণ উদ্দম দেখা গেলেও ধীরে ধীরে তা ঝিমিয়ে এল। দোকানে বসতে শুরু করল আড্ডা। ভিড় বাড়ল কবি সাহিত্যিকদের। নন্দা খেয়াল করল আয়ের থেকে ব্যয়ই হচ্ছে বেশি। দোকান বন্ধ করে সীমান্ত ছুটে যায় সাহিত্যসভায়। দোকানে বসে ডুবে যায় কবিতায়, মগ্ন থাকে সাহিত্য সৃষ্টিতে।
সীমান্তকে দেখে করুণা হয় নন্দার। মনে হয় একটা মুক্তমনা মানুষকে সে যেন জোর করে আটকে রেখেছে খাঁচায়। তাই সীমান্তকে একদিন ছুটি দিয়ে দিল সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে আর যাবতীয় ভার তুলে নিল নিজের কাঁধে। দোকান উঠে তৈরি হল বিউটি পার্লার। পায়ের নীচে শক্ত মাটি পেয়ে মাথা তুলে দাঁড়াল নন্দা।
খাতার পর খাতা ভরে এখন কবিতা লেখে সীমান্ত। বই হয়ে বেরিয়েওছে দু’ একটা। প্রায় সব কবিতাই পড়ে দেখে নন্দা। ছুঁয়ে দেখতে চায় সীমান্তর কবিতায় জমে থাকা বিষণ্ণতাকে। কোনও এক অপ্রাপনীয়াকে উদ্দেশ্য করে নিরন্তর ছুটে চলে কথার স্রোত, অক্ষরমালা। সীমান্তর বুকের ভেতর হতে থাকা রক্তক্ষরণ অনুভব করে নন্দা। একেক সময় জানতে ইচ্ছে করে কে এই নারী? যাকে না পাওয়ার কষ্ট তাড়া করে বেড়ায় সীমান্তকে প্রতি নিয়ত! সময় এগিয়ে চলে আপন ছন্দে। মনের ভেতর জন্ম নেওয়া প্রশ্নরা অব্যক্তই থেকে যায় বছরের পর বছর।
চার
বড় কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নন্দা। স্থির চোখে দেখছে সীমান্তকে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। হাতে স্যালাইনের নল। বুকে বোতামের মতো কতগুলো জিনিস লাগানো। পাশে রাখা মনিটারে চলমান উঁচুনিচু রেখা। গতকাল আচমকাই ঘরের ভেতর মাথা ঘুরে পড়ে যায় বছর পঞ্চাশের সীমান্ত। সেরিব্রাল অ্যাটাক। নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছেন অবস্থা সংকটজনক। স্বজন, বন্ধুরা একে একে এসেছেন দেখতে। সারাদিন দৌড়ঝাঁপের পর কাল রাতে সীমান্তর লেখার টেবিলের কাছে অনেকক্ষণ বসেছিল নন্দা। মনের ভেতর আঁকিবুঁকি কাটছিল অজস্র স্মৃতি। সীমান্তর লেখার খাতা, বই উল্টে পাল্টে দেখছিল আনমনে। তখনই নজরে এসেছিল ডায়েরিটা আর সন্ধান পেয়েছিল সেই নারীর, যার পরিচয় এতকাল ধরে খুঁজছে নন্দা। আজ অনেকটা নির্ভার লাগছে নিজেকে।
হঠাৎই পায়ের শব্দ পেয়ে নন্দা ফিরে তাকাল। একটা ছাই রঙা তাঁতের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে জাহ্নবী। নন্দার আদরের জিয়া। কাঁধে ঝোলা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ।
-এতদিনে মনে পড়ল দিদির কথা?
মুখে একটা আলতো হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল নন্দা। নন্দা আর জিয়া পাক্কা দু’বছরের ছোট বড়। রূপে গুণে বরাবরই নন্দার থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল জিয়া। এর কারণেই হয়তো কিছুটা হীনমন্যতা গ্রাস করেছিল নন্দাকে। তৈরি হয়েছিল দূরত্ব। জিয়ার অচেনা কোনও এক যুবকের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করা নিয়ে বাড়িতে অশান্তি, দুম করে তার দার্জিলিং কলেজে পড়তে চলে যাওয়া এসবের জন্যে তাদের সম্পর্কের সুতোটা আলগা হয়ে গিয়েছিল ক্রমশ। এমনকি তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাটাও নন্দা জানায়নি জিয়াকে। এরপর কেটে গিয়েছে প্রায় পনেরটা বছর। ফোনে কথাবার্তা হলেও কখনও একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি দুই সহোদরা।
জাহ্নবী অধ্যাপনা করছে শিলিগুড়ি কলেজে। তার স্বামী শহরের নাম করা ডাক্তার। বাবা-মা সম্বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছে জিয়ার। তার সুখী সুখী জীবন বরাবর দূর থেকেই দেখেছে নন্দা। ভেতরে প্রবেশ করার সাহস হয়নি। অপরদিকে জিয়াও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে দূরত্ব বজায় রাখত দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে।
-জ্ঞান ফেরেনি না?
নন্দার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল জিয়া। আলতো করে মাথা নাড়ল নন্দা। বলল,
-ফিরবে সে ভরসাও দিতে পারছেন না ডাক্তারবাবুরা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাহ্নবী তাকাল কাঁচের জানালাটার দিকে। বিহ্বল চোখে দেখছে সীমান্তকে। চারদিক স্তব্ধ। শুধু কানে আসছে চলতে থাকা মনিটরের আওয়াজ। মৃদু কণ্ঠে নন্দা বলে উঠল,
-এতো বছর ধরে কেন সত্যিটা আমার কাছে গোপন করে রেখেছিলি জিয়া? কেন? আমি কী দোষ করেছিলাম বলতে পারিস?
ফুঁপিয়ে ওঠে নন্দা। জিয়া হতভম্ব হয়ে তাকায় দিদির দিকে। তার হাত ধরে এনে বসায় পাশের বেঞ্চে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে গুছিয়ে নেয় একটু। তারপর বলে,
-আমি জানতাম দিদি একদিন না একদিন এই প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে হতে হবে। কিন্তু আজ এখানে এই অবস্থায়, সেটা ভাবিনি। তুই কার কাছ থেকে কী শুনেছিস আমি জানি না। তবে এটা সত্যি, একদিন আমি আর সীমান্ত পরস্পরকে ভালবেসেছিলাম। বাড়িতে কাউকে কিছু বলার আগেই বাবা জানতে পেরে যায় সবটা। আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয় দার্জিলিঙে, ছোট পিসির জিম্মায়। শুনেছিলাম সীমান্তকেও নাকি চরম অপমান করেছিল বাবা। বিশ্বাস কর সীমান্ত কীভাবে নিজেকে তোর সঙ্গে জড়াল সে বিষয়ে আমার কিচ্ছু জানা ছিল না। যখন খবরটা পেলাম ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। তুই চলে গিয়েছিস বাড়ি ছেড়ে। সীমান্তকে নিয়ে সামান্য আলোচনাটুকু করার ফুরসৎও আমি পাইনি তোর সঙ্গে।
নন্দার কোলের ওপর রাখা হাতটায় আলতো করে চাপ দেয় জিয়া। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
-আমাকে ভুল বুঝিস না দিদি। যেদিন জানতে পারলাম সীমান্ত আর তুই সুখে সংসার করছিস সেদিন থেকে গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে। মনে মনে শপথ করেছি এ জন্মে আর কখনও মুখোমুখি হব না সীমান্তর। কিন্তু কাল তোর ফোন পেয়ে থাকতে পারিনি, বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট থেকে সকালের ফ্লাইট ধরে চলে এসেছি কলকাতায়।
ভেজা চোখে জাহ্নবীর দিকে তাকাল নন্দা। একটা শ্লেষের হাসি হেসে বলল,
-সুখের সংসার! এটা ভাল বলেছিস। ওই মানুষটার শুধু শরীরটা আমি পেয়েছিলাম রে জিয়া। মন তো এতকাল পড়েছিল তোরই কাছে। সারাজীবন ধরে লেখা অজস্র কবিতা, গল্পে সীমান্ত বাঁচিয়ে রেখেছে তোদের ভালবাসাকে। আমার সঙ্গে তো সে শুধু ঘরটাই বেঁধেছিল, ওর আসল সংসার ছিল তোকে নিয়ে।
চোখের জল বাঁধ মানছিল না নন্দার। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে চলল,
-পনের বছর ধরে একসঙ্গে থেকেও আমি ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারিনি সীমান্তর মনের ভেতর বহমান ভালবাসায় আসলে কোনও অধিকার নেই আমার। সবিতার মায়ের হাত দিয়ে চিঠি পাঠাত আমাকে। জানি না কী মোহের জালে বাঁধা পড়েছিলাম। মাত্র ক’দিনের পরিচয়ে ঘর ছেড়েছিলাম ওর ডাকে। একবারের জন্যেও জানতে দেয়নি কেবল জেদের বশে, বাবার করা অপমানের বদলা নিতে আমাকে বিয়ে করছে সীমান্ত। ছোট মেয়েকে না পাওয়ার ঝাল মিটিয়েছে বড় মেয়েকে বিয়ে করে। অথচ দেখ এতো বছর ধরে এই মানুষটাকে আঁকড়েই বেঁচে রয়েছি আমি। তার সুখ দুঃখের ভাগীদার ভেবে এসেছি নিজেকে চিরটাকাল। আর আজ যখন জীবনের এত বড় সত্যিটা সামনে এল তখন কৈফিয়ত চাইবার সুযোগটুকুও আমাকে দিল না সীমান্ত। পালিয়ে যাচ্ছে ফাঁকি দিয়ে।
কেবিনের ভেতরটা হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ছটফট করছে সীমান্ত। ডাক্তার, নার্সরা ছুটে এল একে একে। আকস্মিক উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল জাহ্নবী। একরাশ অস্থিরতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে সীমান্তর দিকে। ধীর পায়ে হেঁটে এসে বোনের হাতটা ধরল নন্দা। দু’চোখে তার অদ্ভুত প্রশান্তি। মনিটরের উঁচু নিচু দাগগুলো ক্রমশ পরিণত হচ্ছে সরলরেখায়। স্বচ্ছ কাঁচের ওপারে থাকা সীমান্তর দিকে অপলকে চেয়ে আছে দুটো নারী, জাহ্নবী এবং অলকানন্দা।
********************************************
দেবপ্রিয়া সরকার পরিচিতি:
উত্তরবঙ্গের জেলা শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। টুকটাক কবিতা এবং অনুগল্প দিয়ে লেখালিখির হাতেখড়ি হলেও ছোটগল্প লিখিয়ে হিসেবে আত্মপ্রকাশ ২০১৮ সালে। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘উজান’, উত্তরবঙ্গ সংবাদ পত্রিকায়। এরপর যথাক্রমে সানন্দা, তথ্যকেন্দ্র, শারদাঞ্জলি, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, উত্তরের সারাদিন, এখন ডুয়ার্স, আজকাল(উত্তরণ) সহ বেশ কিছু পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন এবং ওয়েবজিনে ছোটগল্প, বড়গল্প, অণু উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে একে একে।