গন্ধপুরাণ
হিমাশিস ভট্টাচার্য্য
শেষ সময়ে বাবা মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করতেন। শরীর খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। থাকতেন আধো ঘুমে, আধো চেতনে। কখনো অতি সক্রিয় হয়ে বলতে শুরু করতেন – ঘরের সোফা চেয়ার গুলো খালি করে দাও। দেখছ না কারা এসেছেন? তাঁদের বসতে দাও। বাবার কথা শুনে মা আশেপাশে তাকিয়ে দেখতেন কেউ তো নেই। বাবা রেগে যেতেন। বলতেন – বাবা, মা, কাকা, ঠাকুরদা, জ্যাঠামশাই সবাই এসেছেন একসঙ্গে। তাঁদের বসতে দাও। মা হয়তো ধোওয়া কাপড়গুলো ছাদ থেকে এনে সোফায় রেখেছেন, পরে গুছিয়ে রাখবেন। বাবার কথা শুনে তাড়াতাড়ি সব সরিয়ে ফেলতেন। তখন বাবা ঠাণ্ডা হয়ে একা একা যেন কার সঙ্গে কথা বলতেন।
মা ভয় পেয়ে আমাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে আসতেন। আমরা গিয়ে দেখতাম বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ, মুখে মৃদু মৃদু হাসির রেশ। বাবা তখন দিনরাত তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েই থাকতেন। বয়স নব্বুই পেরিয়ে গিয়েছিল বাবার। ফুসফুসে ভয়ানক সংক্রমণ। বাবার ছোট বেলার বন্ধু আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ভৌমিক কাকু বলেই দিয়েছিলেন এযাত্রা আর আশা করে লাভ নেই। আমরা দেখছিলাম বাবা যেন প্রতিদিন একটু একটু করে মিইয়ে যাচ্ছিলেন। বিশাল, দশাসই বাবার চেহারা হয়ে পড়েছিল টিং টিঙে লম্বাটে ধরণের। তিল তিল করে তিনি বিছানার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলেন। মায়ের সঙ্গে আমরা পালা করে বাবার পাশে বসে রাত জাগতাম। দেখলাম হঠাৎ কয়েকদিন সন্ধ্যার পর থেকেই বাবা যেন চনমনে হয়ে উঠছেন। ঘরের কড়ি কাঠের দিকে তাকিয়ে একা একা বিড়বিড় করতেন। কথা বোঝা যেত না, কিন্তু মনে হত বাবা যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন। কোনদিন আবার মা কে বকতে শুরু করে দিতেন। তাঁর সব মৃত পূর্ব পুরুষদের নাম করে করে বলতেন এতদিন পরে তারা এই ঘরে এসেছেন, অথচ মা তাদের ওয়েলকাম করছেন না। বলতেন তাঁরা বাবাকে তাঁদের সঙ্গে চলে যেতে বলছেন। ভয়ে, আতঙ্কে মা চিৎকার শুরু করে দিতেন। আমরা সবাই ছুটে যেতাম। কিন্তু বাবার মধ্যে কোন ভাবান্তর হতো না। মায়ের মত তিনি আমাদের সামনেও একেই রকম কথা বলে যেতেন। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ঘরে তো আর কেউ নেই। যারা আসতেন সবাই বাবার মৃত পূর্বপুরুষ, অনেককে বাবা নিজে কোনদিন দেখেননি। কিন্তু বাবার এরকম অবস্থায় মা খুব ভয় পেয়ে যেতেন। আমাদের ছাড়তে চাইতেন না ।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ছোট কাকা। বলত – প্রত্যেকে নিজের শেষ সময়ে নাকি ওরকম মৃত পূর্বপুরুষদের চোখের সামনে দেখতে পায়। তাঁরা তাঁদের উত্তরসূরীকে পরলোকে স্বাগত জানাতে আসেন। আমরা হাসতাম ছোট কাকাকে নিয়ে। এ আবার কি রকম কথা? বাবার শরীর যতই খারাপ হয়ে পড়ুক না কেন ছোট কাকাকে কোনদিন ব্যস্ত হতে দেখিনি। আমাদের বলত সব ঠিক হয়ে যাবে একটু পরেই। তার এই ভরসা দেখে আমরা আরও অবাক হয়ে যেতাম। বাবা সত্যি কিছুক্ষণ পরে আবার নর্মাল হয়ে যেতেন ।
এরকম একদিন ভোরবেলায় আমরা পড়িমরি বিছানা থেকে নামলাম ছোট কাকার চিৎকারে। ছোট কাকা সবাইকে বাবার ঘরে ডাকছেন। বাবার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে। শ্বাসটুকুও নিতে পারছেন না। দেখেই বুঝলাম খুব কষ্ট হচ্ছে বাবার। পরিবেশটাই যেন কিরকম হয়ে গেছে। বাবার কষ্ট চোখের সামনে দেখছি, কিন্তু কিছু করার নেই। সমগ্র ঘর জুড়ে একটা তীব্র কটু গন্ধ। এতটাই তীব্র যে শ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। ভৌমিক কাকুকে ফোন করতে গেলাম। ছোট কাকু আটকে দিল – এত সকালে বুড়ো লোকটাকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ ? দাদা আর থাকবে না। আজই দাদার শেষ দিন। ছোট কাকুর কথায় মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ছোট কাকু মা কে বলল – সকাল থেকে গন্ধটা পাচ্ছ না? তুমি জান না বৌদি ? মাথাটা ধপ করে জ্বলে উঠল। ছোট কাকার কথায় মনে পড়ে গেল। আমাদের পরিবারের এক কাহিনী। “গন্ধপুরাণ”। আমি তখন অনেক ছোট। বারো বছরের। ছোট পিসির বিয়ের দিন পুরো বাড়িটা ছোড়জোড় গিয়েছিল একটা তীব্র কটু গন্ধে। বিয়ের পর বাবা কুঞ্জতে দান করতে বসার তোড়জোড় করছিলেন। আমরা ছোটরা গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে গন্ধের উৎসটা বের করতে পারলাম না। গন্ধ পেয়ে বাবা খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। সেজো কাকুকে ডেকে কানে কানে কিসব বলেছিলেন। একটু পরে দেখলাম সেজো কাকু ধুতি পরে এসে ছোট পিসীকে দান করতে কুঞ্জে বসে গেলেন। বাবাকে আর দেখা গেল না। সব শেষ হয়ে গেলে গভীর রাতে বাবাকে আবিস্কার করলাম ঠাকুর ঘরে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন। কয়েক ঘণ্টা পরে শেষ রাতে বাসর ঘরে হঠাৎ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল ছোটপিসী। বাড়িতে চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে শুনলাম পিসীর মৃত্যুর ভয়ঙ্কর সংবাদটি। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বিয়ের রাতেই কনের মৃত্যু হয়েছে এরকম আশ্চর্যজনক ঘটনা এর আগে কোনদিন শুনিনি। সেদিনের ছবিটা এখনও মাঝে মাঝে মনে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সিঁদুরে লেপটানো ছোট পিসীকে কোলে নিয়ে বসে আছেন ছোট পিসু। কয়েক ঘণ্টা আগে যার সঙ্গে পরিচয় মাত্র হয়েছিল।
বড় হয়ে শুনেছিলাম গন্ধপুরাণ। আমাদের ঠাকুমা একটি বিশেষ তেল মাথায় দিতেন। বাজারের দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে কেনা কড়াপাকের তিল তেলের সঙ্গে আরও অনেকগুলো লতাপাতার রস মিলিয়ে ঠাকুমা নিজের হাতে তৈরি করতেন এই বিশেষ তেলটি। তেলের গন্ধ এতটাই তীব্র ছিল যে যারা আশেপাশে থাকতেন তারা বুঝতেন। ওটা নাকি ছিল আমাদের পারিবারিক তেল। ঠাকুমা পেয়েছিলেন তাঁর ঠাকুমার কাছ থেকে। কত প্রজন্ম ধরে এই তেল আমাদের বাড়িতে চলছে এর সঠিক হিসেব কেউ জানেন না। শেষ সময়ে ঠাকুমার আর এই তেল মাখার শক্তি ছিল না। তেল আর তৈরিও হত না। আমরা সবাই প্রায় এর গন্ধটা ভুলেই গেছিলাম। আমরা ভুলে গেলে কি হবে, গন্ধটা কিন্তু আমাদের ভোলেনি। কখনও আমাদের ছেড়েও যায়নি। আমাদের বাড়িতে কারও মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে নাকি এই গন্ধটা আগেভাগেই কোথা থেকে ভেসে এসে বাড়ি ছেয়ে যেত। বাবা বলেছিলেন তাঁর ঠাকুমা, জ্যেঠামশাই সবার মৃত্যুর দিনে গন্ধটা বাড়িতে ম ম করেছিল। ছোটপিসীর বিয়ের দিন সাতপাক হওয়ার পরেই গন্ধটা বাড়িতে ছেয়ে গিয়েছিল। বিয়েবাড়ির ফুল আর তীব্র পারফিউমের গন্ধ ছাপিয়ে, ওটা ঠিক বাবা কাকাদের নাকে ঢুকে গিয়েছিল। বাবা বুঝে নিয়েছিলেন কোন একটা অঘটন নিশ্চিত। তাই তড়িঘড়ি করে সেজো কাকুকে কণ্যাদান করতে বসিয়ে বাবা ঠাকুর ঘরে ঢুকে গিয়েছিলেন। মা পরে আমাদের বলেন বাবা সেদিন ঠাকুর ঘরে তাঁর মৃত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করেছিলেন। কিছুতেই কিছু হল না। শেষরাতে চলে গেল ছোটপিসী। হার্টফেল। ভৌমিক কাকু এসে পৌঁছাতে পারেননি। তার আগেই সব শেষ। খুব খারাপ লেগেছিল ছোটপিসেমশাইর দিকে চেয়ে। সদ্য পরিণীতা বৌয়ের মাথাটা দুহাতে কোলে নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে বসে রয়েছেন। বিয়ে হয়েছে কয়েক ঘণ্টাও হয়নি। হয়তো ভাল করে পরিচয়টাই হয়নি।
মা কিন্তু বংশ পরম্পরায় প্রচলিত এই ধারাকে বজায় রাখেননি। বাবা নিজেই নাকি মা কে মানা করেছিলেন। এ নিয়ে ঠাকুমার মনে ক্ষোভের অন্ত ছিল না। বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছেন। ঠাকুমা মৃত্যুর আগে দুমাস কোমায় ছিলেন। মাথায় ঐ তেল লাগানোর অবস্থা ছিল না। সুতরাং বেশ কিছুদিন গন্ধ ছিল না। কিন্তু একদিন খুব সকাল থেকে হঠাৎ করে গন্ধটা কোথা থেকে এসে বাড়িময় ব্যপ্ত হয়ে গেল। বাবা সেজো কাকুকে অফিস যেতে দিলেন না। অন্য সবাইকে বাড়িতে আটকে রাখলেন। দুপুর একটায় মৃত্যু হল ঠাকুমার। শবদাহ করার সময় বাবা ঠাকুমার তেলের বোতলটি আগুনে দিয়ে দিয়েছিলেন।
বাবা চেয়েছিলেন ঠাকুমার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আমাদের পরিবারের গন্ধপুরাণের ইতি হোক। কিন্তু বাবা চাইলেও ওটা কিন্তু বন্ধ হয়নি। বাড়িতে কোথাও তেলের অস্তিত্ব না থাকলেও বাবার মৃত্যুর দিন ভোর থেকেই সর্বনাশের আগাম সংকেত হয়ে গন্ধটি আবার তার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিল। আমরা কখনও তেলটিকে দেখিনি কিন্তু কটু একটা গন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম। গন্ধটি চিরচেনা হয়ে আমাদের নাকে স্থায়ী হয়ে বসে রয়েছে।
জানিনা, এর পরে আবার কবে এই গন্ধ বাড়িতে ম ম করে নতুন কোন সর্বনাশের প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে !!
———————————————————————-
হিমাশিস ভট্টাচার্য্যের পরিচিতিঃ
হিমাশিস ভট্টাচার্য্যের জন্ম শিলচরে। শিক্ষা শিলচর পাবলিক উচ্চতর মাধ্যামিক বিদ্যালয়ে, গুরু চরণ কলেজ ,আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নতুন দিল্লির এম এস পি আই। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ, পি এইচ ডি। নতুন দিল্লির এম এস পি আই থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা। মুম্বাইয়ের আই আই বি থেকে ব্যাঙ্কিং সি এ আই আই বি (পার্ট ওয়ান )। জীবিকা স্টেট বাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চাকুরী।
স্কুলের দিনগুলোতেই সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি। গুরুচরন কলেজ মুখপত্র “পূর্বশ্রী” ও দেওয়াল পত্রিকা “কুন্দকলি” র সম্পাদক। ২০০২ সালে “দেশ” পত্রিকায় “বন্যা উপত্যকা” এবং “সাপ্তাহিক বর্তমান” পত্রিকায় “লাশ” গল্পের মাধ্যমে বৃহত্তর আত্মপ্রকাশ। দীর্ঘ দিন থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। শিলচর, গুয়াহাটি এবং কলকাতার বিভিন্ন কাগজে কাজ করেছেন। বর্তমানে সংবাদ সংস্থা PTI র শিলচরের প্রতিনিধি। আকাশবাণী শিলচরের সংবাদ বিভাগে অস্থায়ী অনুবাদক তথা সংবাদ পাঠক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন সংবাদ প্রচারের সূচনা লগ্ন থেকে। আকাশবাণী থেকে বেশ কয়েকটি নাটক ছাড়াও আকাশবাণী ও দূরদর্শন কেন্দ্র থেকে অনেকগুলো আলেখ্য সম্প্রচারিত হয়েছে।
সাংবাদিকতায় শ্রেষ্ঠ গ্রামীন প্রতিবেদনের জন্য উত্তর পূর্বাঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মান “সেন্টিনেল” গোষ্ঠীর “আজির অসম এম এল কাঠবরুয়া” পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছেন ১৯৯৪ সালে।
“যুগশঙ্খ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯” এ সম্মানিত।
গন্ধপুরাণ – হিমাশিস ভট্টাচার্য্য
1 Comment
Comments are closed.
খুব সুন্দর গল্পের ধারাপ্রবাহ…এমন ধরনের ঘটনা সত্যি ই ঘটে,যদিও এর কোন ও যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় না, তবুও ঘটে এমন…