Shadow

দাশু তোর সঙ্গে – ইন্দ্রাণী ঘোষ

দাশু তোর সঙ্গে

ইন্দ্রাণী ঘোষ

দাশু সেদিন দুপুরবেলা পাড়ার মোড়ে বসে সেই মার্কামারা হিনডেলিয়ামের টিফিন কৌটো খুলে কি যেন খাচ্ছিল। আমারও চনচন করে  ক্ষিদে পেয়েছে, ইশকুল থেকে ফিরছি। একটু উঁকি মারতে গেছি, ব্যাটা বলে ‘বাড়ী গিয়ে খা না, হ্যাংলামি এ বয়েসেও গেল না। আমি বললাম, ‘তোরই বা খাবার জায়গা এরম কেন? খেটেখুটে ফিরছি  ক্ষিদে পেয়েছে, আর গাছতলায় বসে তুই লুচি, তরকারি খাচ্ছিস। চাইওনি, শুধু তাকিয়েছি, তাতেই এত কথা।’ বলে হাঁটা লাগিয়েছিলাম। দাশু বললে ‘খেয়ে কি করবি, রক্ত দিতে তো পারবি না, তোর তো লো প্রেসার। ইশকুলে রক্তদান শিবির আছে।’
রোববার সকাল থেকেই মনটা কেমন ইশকুলের দিকে টানছিল। ভাবছিলাম দাশু যা চ্যাটাং, চ্যাটাং কথা বলল সেদিন ভরদুপুরে, ব্যাটাকে জবাব না দিলেই নয়। রক্ত দেব না তো কি হল। দাশুর বন্ধুদের পাশে তো থাকতে পারি। সত্যিই দাশুদের বন্ধুরা যে একসাথে হয়, হৈচৈ করে, বন্যা  দুর্গতদের জন্য কোন প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে ত্রান পৌঁছয়, রক্তদান শিবির করে, ফুটবল খেলে, শিবির শেষে ফুটবলের কুইজ হয়, এসব কেন হয়? তাদের ডাক্তার বন্ধুরা তো টানা ২৪ ঘণ্টা কাজ করে, কর্পোরেটের বন্ধুরা ঊনকোটি ঝকমারি সামলে এসবে আসে। কেনই বা আসে? এসব ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বৈতো নয়। এসব ভাবতে ভাবতে ইশকুলের পথ দুপুরবেলা ধরেই ফেললাম গুটিগুটি। প্রতিবারের মত এবারও বিশাল আয়োজন। দাশুদের বন্ধুরা তাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে রক্ত দান করতে শিবিরে এসেছে, অরগ্যান ডোনেট করতেও। ভাগ্যিস এসেছিলাম না হলে নিজের কাছে কৈফিয়ত দিতে পারতাম না। অন্তত যারা রক্ত দিতে পারছে তাদের পাশে তো থাকতে পারলাম। শিবিরের শেষে ফুটবল নিয়ে অসামান্য কুইজ হল, কত পুরনো খেলা দেখা গেল, দাশুদের বন্ধুদের ফুটবলের ইতিহাসের অসামান্য পড়াশোনা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম, মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। সবকিছু মিটতে মিটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের রোদের আলিস্যি মাখল এ শহর।
ফেরার পথে দেখলাম দাশু ইশকুলের নতুন ঝাঁ চকচকে অর্ধেক তৈরি হওয়া বাড়ীটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো কেমন উদাস। আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম “কি রে এরম করে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? ‘দাশু বললে, “আমাদের এসবেটাসের ছাদ, তুমুল বর্ষায় হু হু করে জল ঢোকা ইশকুল বাড়িটা কতগুলো হৃদয় তৈরি করেছে দেখেছিস?, এই বাড়িটা পারবে তো এমন হৃদয় তৈরি করতে? “বলে আর কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে, দাশু হাঁটা দিলে। মনে মনে বললাম “যতদিন তুই বেঁচে আছিস খ্যাপামি নিয়ে, হৃদয় আপনি তৈরি হবে”। দাশু আমার মনের কথা শুনতে পায়, তাই মোড়ের মাথায় গিয়ে পিছন ফিরে হাসল। সেই বিশ্রী ফ্যাচফ্যাচে হাসিটা নয় কিন্তু। মেঘ ভাঙা রোদ্দুরের মত হাসি। আমিও দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ালাম।
***************************************************

ইন্দ্রাণী ঘোষ পরিচিতি:
জন্ম মহারাষ্ট্রের পুনা শহরে। নব নালন্দা হাই স্কুল থেকে ১৯৯১ সালে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ। বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ।
পেশায় : শিক্ষিকা, লেখালিখি নেশা ও ভালবাসা।

2 Comments

  • Madhumita Mitra

    বাহ্ গল্পের মেসেজ‌ও খুব সুন্দর আর গল্প বলার ঢং ও❤️

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!