Shadow

দশাবতার তাসঃ এক লুপ্তপ্রায় শিল্প ও খেলার উৎস সন্ধানে – সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

দশাবতার তাসঃ এক লুপ্তপ্রায় শিল্প ও খেলার উৎস সন্ধানে

সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘সর্বনাশা’ তকমা জুটলেও ‘রঙ্গে ভরা’ বঙ্গদেশে তাসখেলার জনপ্রিয়তায় কোনোদিনই ভাঁটা পড়েনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতা ও মন্দাকিনীর মতো অন্তঃপুরে নারীরা এখন আর বিশেষ তাস খেলেনা সত্য। কিন্তু শহর-মফস্বলে ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেনের এক চিলতে বসার আসনে বা গ্রামের বুড়ো বটতলায় কি ভাঙা মন্দির-চত্বরে ছেলে-বুড়োর দল জমিয়ে বসে তাস খেলছে, এ ছবি দুর্লভ নয়। যদিও ইউরোপীয়রা এদেশে নোঙর ফেলার আগে সাহেব-বিবি-গোলামের বাহান্ন তাসের সঙ্গে ভারতীয়দের পরিচয় ছিলনা। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মানীতে জোহানেস গুটেনবার্গের আবিষ্কৃত যন্ত্র মুদ্রণ ব্যবস্থায় বিপ্লব আনলে ইউরোপে বিপুল পরিমানে কাগজের তাস তৈরি হতে থাকে। ফলে সেখানকার বিভিন্ন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাসখেলা ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে আমাদের দেশের বাজারেও আসতে শুরু করে সস্তা ও সহজলভ্য ইউরোপীয় তাস। বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সমাজতাত্ত্বিক ও লোকসংস্কৃতির গবেষক বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বেশ বোঝা যায়, বৃটিশের কাছে আমাদের গোলামির ইতিহাসের কলঙ্ককথা এই সাহেব-বিবি-গোলামের তাসখেলার মধ্যে খেলার ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে রয়েছে।” ইউরোপীয় তাসের দাপটেই একসময় পিছু হঠতে বাধ্য হয় হস্তশিল্পকলার অনন্য নিদর্শন মুঘল ‘গঞ্জিফা’ বা এই ধরনের অন্য অনেক দেশীয় তাস। দাক্ষিণাত্যের ‘চাঙ্গরানি’, মহারাষ্ট্রের ‘চাঙ্গকাঞ্চন’, ওড়িশার ‘গঞ্জাপা’, উত্তরভারতের ‘তাজ’ বা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের ‘দশাবতার তাস’-এর মতো আঞ্চলিক তাস ও তাসখেলা ক্রমে লুপ্ত হতে থাকে।
ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে ‘গঞ্জিফা’ শব্দটি ফারসি। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুঘলদের হাত ধরে পারস্য থেকে ভারতে গঞ্জিফার আগমন ঘটে। পারস্য সংস্কৃতির অনুরক্ত তৈমুর লঙের দরবারে এই খেলা প্রচলিত ছিল। কিন্তু পারস্যে এই খেলার জন্ম কীভাবে হল তা সঠিক বলা যায়না। তবে নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে  চীনে তাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭) শাসনকালেই প্রথম তাস খেলার প্রচলন ঘটেছিল বলে জানা যায়। সেখানে তখন অন্তঃপুরবাসী রানীরা তাস খেলে সময় কাটাতেন। খেলার কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হত পয়সা ও প্লেট। এই তাসখেলাই চীন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের রেশম পথ ( Silk Route) ধরে পারস্যে পৌঁছে গঞ্জিফার রূপ নিয়েছিল এমন অনুমান করা যেতেই পারে। ভারতে আসার পর মুঘল সম্রাটের দরবারেও এই খেলা চালু হয়ে যায়। বাবরকন্যা গুলবদন বেগমের লেখা ‘হুমায়ুন নামা’-য় গঞ্জিফার উল্লেখ আছে। আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’-তে গঞ্জিফার কথা লিখেছেন। সম্রাট আকবরের প্রিয় খেলা ছিল গঞ্জিফা। হাতির দাঁত, কচ্ছপের খোলা, চন্দন কাঠ, সোনা, রূপা, কাগজের মন্ড, কাপড়, চামড়া, পামগাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত হত সেসব তাস। সেগুলোতে চিত্রিত থাকত বিভিন্ন মুঘল মোটিফ, যার ওপর নির্ভর করত তাসের মান। ৯৬ টি তাস নিয়ে তৈরি হত গঞ্জিফার একটি সেট। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের রাজকীয় সংগ্রহশালা ‘Royal Danish Kunstkammer’-এ এ ধরনের গঞ্জিফা সংগৃহীত আছে। ভারতের রাজস্থানের জয়পুরে ‘সিটি প্যালেস মিউজিয়াম’-এও আছে। মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারতে সামন্তরাজাদের দরবার থেকে শুরু করে আম আদমির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গঞ্জিফা। তারপর স্থান-কাল ভেদে তা বিভিন্ন রূপ ও নাম নেয়। খেলার নিয়মও বদলায়।
বাংলার বিষ্ণুপুর বা মল্লভূমে প্রাচীন ‘ওরক’ তাসের আদিপুরুষ-ও গঞ্জিফা। ‘ওরক’ শব্দের অর্থ পাতা বা পত্র। এই ওরক তাসই কালক্রমে ‘দশাবতার তাস’ নামে পরিচিত হয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত মতানুযায়ী, মল্লরাজাদের সমৃদ্ধিকালে দশাবতার তাসখেলার প্রবর্তন হয়েছিল। ৯৯৭ খৃষ্টাব্দে মল্লরাজ জগৎমল্ল (৯৯৪ – ১০০৭) বিষ্ণুপুরকে ঢেলে সাজাতে রাজস্থান থেকে ‘সূত্রধর’ পদবিধারী বেশ কয়েকজন দক্ষ ভাস্কর, মৃৎশিল্পী, কাষ্ঠশিল্পী ও চিত্রশিল্পীকে নিয়ে আসেন। বর্তমান বিষ্ণুপুর মহকুমার কোতুলপুর থানার লাউগ্রাম অঞ্চলে প্রচুর জমিজমা দিয়ে তাঁদের বসতি গড়ে দেন। পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে যাঁরা রাজার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, তাঁরা ‘ফৌজদার’ উপাধি পান।  মল্লবংশের ৪৯ তম রাজা হাম্বীর মল্লদেব বা বীর হাম্বীর (১৫৬৫-১৬২০) ছিলেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। পটচিত্র অঙ্কনে পারদর্শী তাঁর সেনাপতি কার্তিক ফৌজদারকে দিয়ে তিনিই প্রথম দশাবতার তাস তৈরি করান। সম্রাট আকবরের কাছ থেকে পেশকাশি জমিদারি লাভ করার সুবাদে মুঘল দরবারে প্রচলিত ‘গঞ্জিফা’ তাসের সঙ্গে বীর হাম্বীরের পরিচয় হয়েছিল। একইসাথে তিনি তাঁর বৈষ্ণব দীক্ষাগুরু চৈতন্যভক্ত শ্রীনিবাস আচার্যের মাধ্যমে ওড়িশার ‘গঞ্জাপা’ তাস-ও হাতে পান। মুঘল ও ওড়িশা শিল্পকলার সংমিশ্রণেই দশাবতার তাস তৈরি হয়েছিল। তাতে মুঘল মোটিফের স্থান নিয়েছিল ওড়িশা ‘গঞ্জাপা’-য় চিত্রিত বিষ্ণুর দশ অবতার। যদিও ‘গঞ্জাপা’-র একটি সেটে ১৪৪ টি তাস থাকে। সেখানে বিষ্ণুর দশ অবতার ছাড়াও গণেশ ও কার্তিক-ও স্থান পেয়েছে। বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাসের একটি সেট ১২০ টি তাস নিয়ে। গণেশ-কার্তিক থাকে না। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, জগন্নাথ (বুদ্ধ) এবং কল্কি – বিষ্ণুর এই দশ অবতারের মূর্তিই শুধু আঁকা থাকে তাসে। প্রত্যেক অবতার তাসের অধীনে থাকে ১১ টি তাস। এইভাবে দশজন অবতারকে ধরে সব মিলিয়ে ১২০ টি তাস। অবতার তাসটিকে বলা হয় ‘রাজা’ তাস। এই তাসে অবতার, মন্ডপের ভিতর আঁকা থাকে। ১১ টি তাসের মধ্যে একটি ‘উজির’ বা ‘মন্ত্রী’ তাস। মন্ত্রীর মন্ডপ থাকেনা। বাকি ১০ টি তাসে (দশ, নয়, আটি, সাতি, ছক্কা, পঞ্জা, চৌকা, তিরি, দুরি ও টেক্কা) আঁকা থাকে অবতারের প্রতীক চিহ্ন। যেমন মৎস্য অবতারের মাছ, কূর্মের কচ্ছপ, বরাহের শঙ্খ, নৃসিংহের চক্র, বামনের কমন্ডলু, পরশুরামের টাঙ্গি, রামের তীর, বলরামের গদা, জগন্নাথ বা বুদ্ধের পদ্ম এবং কল্কির তরবারি। বীর হাম্বীরের উত্তরসূরী রঘুনাথ সিংহ দেব (১৬২৬-১৬৫৬) ও বীর সিংহ দেবের (১৬৫৬-১৬৮২) আমলেও এই তাসখেলা বাংলায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। তখন বাজি রেখেও খেলা হত।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অবশ্য ১৮৯৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে লেখা তাঁর ‘Notes On Vishnupur Circular Cards’-এ মল্লভূমে দশাবতার তাসের আবির্ভাবকাল সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী নির্ধারণ করেন।  তিনি বলেছিলেন, “I fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred years before the present date.” তাঁর  মতানুযায়ী খেলাটির উদ্ভব হয় বাংলাদেশে মহাযান বৌদ্ধধর্মের আধিপত্যের যুগে, পাল-রাজাদের রাজত্বকালে অথবা তার কিছুকাল আগে। যে সময় বুদ্ধকে পঞ্চম অবতার (পদ্মপাণি) এবং পদ্মফুলকে তাঁর প্রতীক বলে গণ্য করা হত। বিনয় ঘোষ-ও বলেছেন, “দশাবতার তাস পালযুগে উদ্ভাবিত হওয়া আদৌ আশ্চর্য নয়। মল্লরাজারা তখন মল্লভূমের অধীশ্বর হয়েছেন। বিশেষ করে, দশাবতার তাসের চিত্র এবং চিত্রাঙ্কনের পদ্ধতি দেখলে মনে হয়, পাল যুগের সমৃদ্ধিকালেই এই খেলা, এই শিল্প ও শিল্পীদের বিকাশ হয়েছিল।” এই মতকে যথার্থ বলে মানলে চীনের পরিবর্তে ভারতবর্ষই তাসখেলার উদ্ভাবক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
কিন্তু ইতিহাস গবেষক মানিকলাল সিংহ তাঁর ‘পশ্চিম রাঢ় সংস্কৃতি’ গ্রন্থে এই মত খন্ডন করেছেন। তাঁর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হল, পুরীতে জগন্নাথের মন্দির নির্মাণের কাজ দশম শতকে রাজা জয়তী কিশোরীর আমলে শুরু হয়ে শেষ হয় দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাজা অনন্তচোর গঙ্গের আমলে। তারপর থেকেই জগন্নাথের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু দশাবতার তাসে নবম অবতার হিসেবে জগন্নাথের মূর্তি অর্থাৎ তাঁর মাথা ও হাতসহ দেহকান্ডের ছবি চিত্রিত হয়, সেহেতু এই তাসের উৎপত্তিকাল দশম শতাব্দীর আগে নয়।
তবে এটা লক্ষ্য করার বিষয় বিষ্ণুপুরে দশাবতার তাস নির্মাণের শিল্পীরা এখনও জগন্নাথ অবতারের তাসটিকে ‘বুদ্ধের তাস’ বলে উল্লেখ করেন এবং তার প্রতীক চিহ্ন হিসেবে ‘পদ্মফুল’ আঁকেন।

দশাবতার তাসের শিল্পী শীতল ফৌজদার

২০০৬ সালের জুলাই মাসে সপরিবারে বিষ্ণুপুর ভ্রমণকালে এই অতুলনীয় শিল্পকীর্তি ও তার স্রষ্টাদের সাথে পরিচয়ের সুযোগ আমার হয়। বিষ্ণুপুরে মদনমোহন মন্দিরের কাছে শাঁখারিবাজারের বাসিন্দা ফৌজদার পরিবারের লোকজন বীর হাম্বীরের সেনাপতি কার্তিক ফৌজদারের বংশধর। কার্তিকের পর থেকে শুধুমাত্র তাঁরাই পুরুষানুক্রমে দশাবতার তাস তৈরি করে আসছেন। ৮৭ তম উত্তরপুরুষ শিল্পী শীতল ফৌজদার এক সকালে তাঁর বাড়িতে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান। ঘরে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। ভিতর-দরজা দিয়ে ঢোকা স্বল্প আলোর সামনে বসে তাঁর কাকা ভাস্কর ফৌজদার নিবিষ্ট মনে তখন দশাবতার তাস আঁকছেন। পাশে সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ মিলিয়ে ছড়ানো কিছু তাস, নারকেল মালার বাটিতে গোলা রঙ, আর অনেকগুলো তুলি। কোনোরকমে পরিচয়-পর্বটুকু সেরেই বৃদ্ধ আবার মগ্ন হলেন তাঁর হাতের কাজে। দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কারে সম্মানিত এই চিত্রকরের তুলির টান দেখতে দেখতেই কথা হতে থাকল শীতলের সঙ্গে। কাকার কাছেই শীতল তাস তৈরির কাজ শিখেছেন, পেয়েছেন অনেক পুরস্কার-ও। তিনি আমাদের জানালেন তাস তৈরির কৌশল।
প্রথমে তেঁতুল বীজ, শিরীষ ও বেলের আঠা দিয়ে তিন, চার বা ছয় পরতে আঁটা সুতির কাপড় চৈত্র-বৈশাখের খররোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। তারপর তার এপিঠে-ওপিঠে ওই আঠা ও খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে দিয়ে সেটিকে আরও পুরু করে আবার রোদে দিতে হয়। শুকিয়ে গেলে তার থেকে ৮-১০ সেন্টিমিটারের ব্যাসের বৃত্তাকার প্লেট কেটে তার এক পিঠ ঝামাপাথর বা নোড়া দিয়ে ঘষে মসৃন করা হয়। এ অংশকে বলে ‘জমিন’। আগে চাপানো হয় জমিনের রঙ। অবতার ভেদে জমিনে রঙের ব্যবহার ভিন্ন হয়। মৎস্যে কালো, কূর্মে বাদামী, বরাহে ঘন সবুজ,  নৃসিংহে ধূসর, বামনে নীল, পরশুরামে সাদা, , বলরামে হালকা সবুজ, জগন্নাথ বা বুদ্ধে হলুদ এবং রাম ও কল্কি অবতারের জমিনে দেওয়া হয় লাল রঙ। এই প্রাথমিক রঙ চাপানোর পর জমিনের ওপর রাজা, মন্ত্রী ও প্রতীক চিহ্নসহ দশ থেকে টেক্কা পর্যন্ত সব ছবি আঁকা হয়। নানা রঙ ও ছাগলের ল্যাজের লোমে তৈরি তুলি দিয়ে আঁকা হয়। আঁকার জন্য ভুষোকালি থেকে কালো, শিম পাতা থেকে সবুজ, কাঁচা হলুদ থেকে হলুদ এবং বিশেষ ধরনের পাথর থেকে লাল ও সাদা রঙ তাঁরা সংগ্রহ করেন। তারপর সেই রঙগুলোকে মিলিয়েমিশিয়ে অন্য আরও রঙ তৈরি করে নেন। আগে প্রাকৃতিক রঙ দিয়েই পুরো আঁকার কাজটা হত। কিন্তু এখন দু’একটা রঙ বাজার থেকে কিনতে হয়। যেমন আগে যখন নীল চাষ হত, সেই নীলের রঙই তাঁরা ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন সেই রঙ পেতে বাজারের কেমিক্যাল রঙ তাঁদের জোগাড় করতে হয়। ছবি আঁকা শেষ হলে অন্য পিঠে মেটে সিঁদুর ও গালার প্রলেপ দেওয়া হয়। সবশেষে হয় পালিশের কাজ। ১২০ টি তাসের একটি সেট তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় এক মাস।
খেলার নিয়ম জানতে চাইলে শীতল বললেন দশাবতার তাসখেলার পদ্ধতি বেশ জটিল। পাঁচজন খেলোয়াড় নিয়ে খেলা চলে। খেলোয়াড়রা কেউ কারও পার্টনার নয়। মল্লরাজাদের আমলে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্রে খেলোয়াড়দের খেলতে বসতে হত। তাদের বসার পাঁচটা আসন ছাড়াও একটা আসন রাখা হত বিষ্ণুর নামে। তাস বন্টনের কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। বাম থেকে ডানে বা ডান থেকে বামে যেভাবে ইচ্ছে তাস বাটা যেতে পারে। ১২০ টি তাস বাটার পর প্রত্যেকের ভাগে ২৪ টি করে তাস পড়ে। মানের বিচারে রাজা বা অবতারদের তাসগুলোই হল সর্বোচ্চ তাস। তারপর তাদের মন্ত্রীদের স্থান। রাম, বলরাম, পরশুরাম, জগন্নাথ (বুদ্ধ) ও কল্কির ক্ষেত্রে তাদের মন্ত্রীদের তাসের পরে টেক্কার স্থান সর্বোচ্চ। তারপর যথাক্রমে দুরি, তিরি, চৌকা ইত্যাদির স্থান। দশের স্থান সর্বনিম্ন। বাকি পাঁচ অবতারের (মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ ও বামন) ক্ষেত্রে তাদের মন্ত্রীদের পর দশ সর্বোচ্চ এবং ক্রমানুযায়ী  টেক্কার স্থান সকলের নিচে। তবে সময় ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাসের মানেরও পরিবর্তন ঘটে। যেমন, দিনের বেলা খেলা হলে স্টার্টার তাস হল রাম। তার মান তখন সবচেয়ে বেশি। রাতে মৎস্য।  আর খেলা চলার সময় বৃষ্টি নামলে কূর্ম।
খেলার শেষোক্ত এই  নিয়ম প্রসঙ্গে পরে একটি মজার গল্প পড়েছি। সেটি এবার বলি। ৫৭ জন মল্লরাজা প্রায় ১১০০ বছর ধরে রাজত্ব করার পর বৃটিশ আমলে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মল্লভূমের দখল নেন বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র। তারও অনেক অনেক বছর পর শতধারায় বিভক্ত ক্ষয়িষ্ণু মল্ল রাজপরিবারের এক সদস্য এক দিন এক দুপুরে দশাবতার তাস খেলতে বসেছেন সে খেলায় পটু এক ইংরাজ সাহেবের সঙ্গে। বাজি ধরে খেলা শুরু হয়েছিল। বাজিতে সর্বস্ব হারিয়ে শেষে তাঁর কাছে থাকা রাজবংশের শেষ চিহ্ন রুপোর গড়গড়াটাও হারাতে বসলেন মল্লরাজাদের ওই বংশধর। কেননা খেলা যখন প্রায় শেষ তখন সাহেবের হাতে ছিল সবচেয়ে বড় মানের তাস ‘রাম অবতার’। আর তাঁর হাতে ছিল ‘কূর্ম অবতার’। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি নামায় তিনি জিতে গেলেন। যেহেতু তখন সবচেয়ে বড় মানের তাস হয়ে গেল ‘কূর্ম অবতার’। ফলে রুপোর গড়গড়ার মালিক তো তিনি থাকলেনই, বাজির শর্তানুযায়ী হারানো অন্য সব সম্পত্তি সাহেবের কাছ থেকে ফেরতও পেলেন।
তবে শীতল জানিয়েছিলেন মল্লরাজারা ও তাঁদের বংশধরেরা চিত্তবিনোদনের জন্য অবসরে এ তাস খেললেও এখন আগ্রহী খেলোয়াড় ও খেলা শেখানোর উপযুক্ত লোকের অভাবে খেলাটি অবলুপ্তির পথে এগোচ্ছে। বিষ্ণুপুরের শেষ রাজা কালিপদ সিংহ ঠাকুরের (১৯৩০-১৯৮৩) দশাবতার তাসখেলার সঙ্গী ছিলেন রাজবাড়ি সংলগ্ন কবিরাজপাড়ার রামেশ্বর দাশগুপ্ত, গোপালচন্দ্র দাশগুপ্ত, বাদল দাশ ও গুঁইরাম গিরির মতো প্রাচীনরা। খেলাটিকে টিঁকিয়ে রাখতে ১৯৮৫ সালে কবিরাজপাড়ায় ‘দশাবতার কার্ড প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন’ তৈরি হয়েছে। তবু বিষ্ণুপুর ও তার আশেপাশে তালডাংড়া, সিমলাপাল, রাইপুর, ইঁদপুর, লক্ষীসাগর, খাতড়া ইত্যাদি কিছু গ্রামে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজনই বর্তমানে এই খেলা খেলতে জানেন। ফলে তাসের খরিদ্দারের সংখ্যাও কমেছে। ১২০ টি দশাবতার তাসের বর্তমান মূল্য ১৫০০০ থেকে ২৫০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। হাতের কাজের সূক্ষ্ণতার ওপর মূল্য নির্ভর করে। কায়িক শ্রম, শিল্পকলা ও ঐতিহ্যের নিরিখে এই মূল্য যথাযথ হলেও বছরে এই সেট দু-তিনটির বেশি বিক্রি হয়না।  আর সেগুলো সাধারণত কেনেন বিষ্ণুপুর ভ্রমণে আসা বিদেশি পর্যটকেরা। তাই সংসারের অভাব-অনটনকে সামাল দিতে শীতল ১৯৮৩ সাল থেকে দশ অবতার অঙ্কিত মাত্র দশটি তাসের সেট বানাতে শুরু করেন। ঘর সাজানোর উপকরণ ‘ওয়াল হ্যাঙ্গিং’ হিসেবে সেগুলো বিক্রি হয়। আমরাও তাঁর কাছ থেকে তাঁর আঁকা দশাবতার তাসের এমন একটি সেট কিনেছিলাম। তার দাম পড়েছিল ৫০০ টাকা। এখন এই সেটের দাম ১৫০০-২৫০০ টাকা।
পেট চালাতে দশাবতার তাসের শিল্পীরা এখন কেউ মাটির ঠাকুর গড়েন, কেউবা পটচিত্র আঁকেন। রাজ্যের মেলাগুলোতে মাঝেমধ্যে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ছাড়া সরকারি তরফে আর্থিক সহায়তা তেমন দেওয়া হয়না বলে শীতলের মতো অনেক শিল্পীই  ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শীতকালে বিষ্ণুপুরে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় বেশি হয়। তখন তাস বিক্রি কিছুটা বাড়ে। এছাড়া প্রাচীন এই শিল্পকলা এখন নিদর্শন হিসেবে বিভিন্ন পুজোমন্ডপের অলঙ্করণে ব্যবহৃত হওয়ায় পুজো উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বরাত পান তাঁরা। তখন বাড়ির মহিলারাও তাঁদের কাজে হাত লাগান। সম্প্রতি বিষ্ণুপুরী লন্ঠনে শিল্পীরা দশাবতারের ছবি আঁকছেন। দশাবতার তাসের মোটিফ উঠে আসছে গহনাতেও। কিন্তু এককালে বর্ণবৈচিত্র্যে উজ্জ্বল দশাবতার তাস  সামনে রেখে বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত তাঁতশিল্পীরা  বালুচরী শাড়ির আঁচল ও পাড় বুনতেন। হারিয়ে যাচ্ছে সেই ঐতিহ্য। অভাবের তাড়নায় ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ হচ্ছে অনেক শিল্পীর জীবন। এই ঐতিহ্য, শিল্প ও শিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সরকারি তরফে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে এর গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার দায় নিতে হবে সংস্কৃতিমনস্ক শিল্পরসিকদেরকেই।
 তথ্যসূত্রঃ
(১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খন্ড) – বিনয় ঘোষ
(২) দশাবতার তাস – একদিন (নবপত্রিকা), ২৯ এপ্রিল ২০১২
(৩) ৯ জুলাই ২০০৬ সালে বর্তমান লেখিকার নেওয়া বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাসের শিল্পী শীতল ফৌজদারের সাক্ষাৎকার।
ছবি সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা ও শ্রীতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়
****************************************************

সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন’-এ স্নাতকোত্তর সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত একজন লেখিকা, সংগীতশিল্পী এবং বিজ্ঞান ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। ‘কালান্তর’, ‘সুস্বাস্থ্য’ ‘উৎস মানুষ’, ‘টপ কোয়ার্ক’, ‘যুক্তিবাদী’, ‘এখন বিসংবাদ’, ‘মানব জমিন’, ‘আবাদভূমি’, ‘সাহিত্য সমাজ’, ‘সারথি’, ‘অভিক্ষেপ’ ইত্যাদি পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘আজকাল’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’, ‘ভ্রমণ’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর চিঠিপত্র ছাপা হয়েছে। ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’-র উদ্যোগে তাঁর সম্পাদনায় ‘র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন’ প্রকাশন থেকে ড. পবিত্র সরকারের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয়েছে ‘ছোটোদের কুসংস্কার বিরোধী গল্প’ গ্রন্থের দুটি খন্ড। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে মরণোত্তর দেহদান-আন্দোলন ও উত্তরণ’ বইটি উচ্চ-প্রশংসিত। দূরদর্শনে ‘মরণোত্তর দেহদান’ নিয়ে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন। রবীন্দ্রসংগীতে তিনি ‘সংগীত প্রভাকর’ ও ‘সংগীত বিভাকর’। তালিম নিয়েছেন শাস্ত্রীয় সংগীতেও। স্কুলজীবনে বেতারে ‘শিশুমহল’, ‘গল্পদাদুর আসর’ ও ‘কিশলয়’-এ নিয়মিত গান গেয়েছেন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে ও এই রাজ্যের বাইরে রবীন্দ্রসংগীত, পল্লীগীতি ও গণসংগীত ছাড়াও তাঁর ভাই রাজেশ দত্তর কথায়-সুরে ‘মানবতার গান’ মঞ্চস্থ করেছেন। কয়েকটি নাটক ও শ্রুতিনাটকে তিনি অভিনয় করেছেন, পুরস্কৃতও হয়েছেন। আবৃত্তি, সংগীত ও কয়েকটি ‘রিয়্যালিটি শো’ প্রতিযোগিতায় বিচারকের পদ পেয়ে সম্মানিত হয়েছেন। খেলাধূলার ক্ষেত্রে ‘কবাডি’-তে কৈশোরে স্কুলে নিজের ক্লাসের দলে অধিনায়কত্ব করেছেন, ‘জিমনাস্টিকস্‌’-বিশেষত ‘তারের খেলা’ শিখেছেন, ব্রতচারী নাচে শংসাপত্র পেয়েছেন। আঁকা, ছবি তোলা, রন্ধন ও ভ্রমণ-ও তাঁর শখের বিষয়।

7 Comments

  • dola basu

    সুতপা, ধন্যবাদ তোমাকে।এই সব মূল্যবান লেখা লিংক এ পেয়ে।কত যে আনন্দ পেলাম।শেয়ার করবো দু একজনের সাথে।ভালো থেকো।

    • Sutapa Bandyopadhyay

      তোমার ভালো লাগায় আমিও খুব আনন্দ পেলাম। অবশ্যই শেয়ার করো। আন্তরিক শুভেচ্ছা।

  • Sreetosh Banerjee

    আমি ধন্য হলাম। আমার লেখার চেয়েও অনেক তথ্য বহুল এ লেখা। আসলে অনেক ছোটবেলায় শুকতারা পত্রিকায় পড়েছিলাম এই তাসের কথা। তারপর যখন বিষ্ণু পুর ঘুরতে গেলাম, অবাক লেগেছিল সেখানকার অনেক সাধারণ মানুষ এই তাসের কথা জানেন না। দলমাদল (দলমর্দন) কামানের সামনে দাঁড়িয়ে জনে জনে জিজ্ঞাসা করছিলাম এই তাসের শিল্পীর কথা। এক প্রাচীন মানুষ সন্ধান দেন শীতল ফৌজদারের। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম তাঁর সাথে। ফেসবুকে আমি আছি bandyopadhyay Sreetosh নামে। সাথী হতে পারলে ভালো লাগবে

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!