প্রকৃতির সন্তান (ওলট চন্ডাল- gloriosa superba)
সোমনাথ দাস অধিকারী
মনে হয় মানব শিশু মাতৃস্তন্য পান করেছিল বলে পানীয়কে এত ভালবাসে ,শরীরের ৭৫% ভাগ জলীয় অংশ মাত্র ২৫% শক্ত বস্তু। হ্যাঁ কথা হচ্ছিল পানীয় নিয়ে, আমরা মানুষ নানান রকম পানীয় ব্যবহার করি, নানা জাতের স্বাদে-গন্ধে ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে।
সপ্তসতী চন্ডীকে দেবী দুর্গা বলেছেন, –“গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়”। “মধু যাবৎ পীবামহ্যৎ” এই বাক্য দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার আগে, শক্তি সঞ্চয় পূর্বক দেবী মধু রূপে সুরা পান করেছিলেন। এই ঘটনা অনেক প্রাচীন।
অতীতে শক্তির উৎস হিসেবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আদিম জাতির ভিন্ন ভিন্ন পানীয় ছিল। আজকে খুব প্রাচীন সাঁওতাল জাতির প্রিয় পানীয় “হেঁড়্য/হাড্ডি” সম্বন্ধে বলছি। ওদের সমাজে বিবাহ সবচেয়ে বড় আনন্দদায়ক উৎসব। মেয়ের বাড়িতে ছেলেরা তাদের পরিবারের সমস্ত সদস্য/ সদস্যা, প্রতিবেশী সহ দলবেঁধে ধামসা, মাদল, সেরেং (তার যন্ত্র) বাঁশের বাঁশি বাজাতে বাজাতে আসে আর সেখানে ভাঁড়ে ভাঁড়ে হাঁড়ি শুদ্ধ “হেঁড়্য/হাড্ডি” যার গন্ধে আকাশ বাতাস সুবাসিত এবং আন্দোলিত হয়। মেয়ের বাড়িতে থাকবে সেই অপর্যাপ্ত “হেঁড়্য/হাড্ডি”। বিয়ের দিন, তারপরে তিন-চারদিন সঙ্গে মুরগি ও শূকরের মাংস, কিছু সাঁওতালের বাড়িতে থাকে মহুল ফুলের মদ। ঐ গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম “মধু ইন্ডিকা”।
এর প্রস্তুতি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে আদিবাসীদের একটু ভিন্ন “বটি / বাখর বটি”- তৈরি হয়। আতপ চালের গুঁড়ো এক কিলো সঙ্গে বুনো জঙ্গলের লতা ঝোপ গাছের ছাল শেকড় ইত্যাদি, দুশো পঞ্চাশ গ্রাম, —
১) তেলাকুচা- coccima grandis
২) সহদেবী /ছোট কুকসিমা- Veronica cimeria
৩) ভেঁটু- clerodendrum viscosum
৪) চিত্রক- plumbago zelamica
৫) নিমুয়া- Stephanie gaponica
৬) আরালু/ বনহাতা – oroxylum indicum
৭) মুসুন্ডা ফুলের গাছ – mussauda roxburghii
৮) বন ধনে -scoparia dulcis
৯) সর্পগন্ধা- rauvolfia serpentine
১০) চাঁদড়- rauvolfia teraphyua
১১) মুসাকানি – hemigraphis hirta
সবকিছু শুকনো করে গুঁড়ো করে অল্প জল দিয়ে মিশিয়ে ছোট ছোট – ১০/১২ মিমি আকৃতির বল বানিয়ে প্রথম পর্ব শেষ হয়।
দ্বিতীয় পর্বে, এক কিলোগ্রাম চাল সেদ্ধ/ আতপ – নিয়ে পোড়া মাটির হাঁড়িতে রান্না করে, ভাতে ফ্যান থাকবে না একটু কম সিদ্ধ ভাত হবে, খেজুর পাতার চাটাইতে ঠান্ডা ভাত মিলে দিয়ে ঝরঝরে করবে। পরে ঐ ভাতে ৫/৬ টি বাখর বটি গুঁড়ো করে শুকনো ভাতে ভালো করে মেশাবে। পরে একটি নতুন হাঁড়ি শুকনো কাপড়ে ঝেড়ে ঝুড়ে একটু আগুনে পুড়িয়ে ঠান্ডা করে, বাখর মিশানো ভাত ও হাঁড়ির মধ্যে দিয়ে হাত দিয়ে চেপে দিতে হবে। এরপর হাঁড়ির ওপরে মাটির পাত্র চাপা দিয়ে অন্ধকার ঘরের মধ্যে রাখতে হবে। প্রথম দিন বসানো, দ্বিতীয় দিন চাপা থাকবে, তৃতীয় দিনেও চাপা থাকবে। চতুর্থ দিনের সকাল ৯ টা নাগাদ পরিষ্কার পুকুরের জলে অথবা নলকূপের জল ১ লিটার, হাঁড়ির চাপা খুলে ঢালা হবে। দুপুর ১২টা নাগাদ হাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়ে নেড়ে দেবে। ৩০ মিনিট পরে শুধু জল পাত্রে বের করলে চক্ চকে পরিশ্রুত জল সেটা পান করা যাবে। কিন্তু ওরা (আদিবাসীরা) সব চটকে ভাত শুদ্ধ বিশেষ মাটির পাত্রে ছেঁকে ঐ হাঁড়ি থেকে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ দিনে খাওয়া হয় অথবা বাজারে বিক্রি করে, সঙ্গে ছাতু কিংবা বুনো শাকের ভাজা, কচড়ার তেল/ মহুল বীজের তেলে, প্রায় ৮%-১২% অ্যালকোহল থাকে এই হেঁড়্যাতে।
অত্যন্ত বলকারক – চাল থেকে তৈরি তাই আদিবাসীগন এই পানীয় খেয়ে, আর কিছু না খেয়ে, প্রায় ৪/৫ দিন কাটাতে পারে এবং সুস্থ থাকে।
আমি দীর্ঘ ৩০/৪০ বছর আদিবাসীদের সঙ্গে মিশেছি, ওদের কাছে বছরের পর বছর দিন কাটিয়েছি ওদের খাবার খেয়ে ওদের সঙ্গে মাঠে কাজ করেছি। আদিবাসী জনজাতি মূল অংশ যারা গরীব তারা কখনও বিলেতি বা দেশীমদ খায় না। ওদের সমস্ত রকম উৎসবে হেঁড়্যা থাকবে, মহুলের মদ কম। সপ্তাহান্তে নিকটবর্তী বাজারে স্বামী-স্ত্রী যাবেই, পয়সা থাকলে মাছের শুটকি কিনবে, একটু শুকনো লঙ্কা, গায়ে মাথায় মাখার জন্য নারকেলের তেল, পেটভর্তি হেঁড়্যা খাবেই।
দেখা গেছে, বেশিরভাগ সাঁওতাল কোনো অসুখে ভোগে না, বার্ধক্য ও দারিদ্র্য ওদের হার মানাতে পারেনি।
কোন সাঁওতাল চোখে দেখতে পায় না তার জন্য চশমা ব্যবহার করেছে, আমার চোখে পড়েনি। দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়েছি প্রায় – ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এইসব জায়গায় দাঁতের ডাক্তার বলেছে – আদিবাসী রোগী/রোগিনী নেই। ব্লাড সুগার, হার্ট ফেলিওর, স্ট্রোক, প্রোস্টেট, কিডনির ক্যান্সার জঙ্গলের অধিবাসীদের নেই। যারা শহরে এসে ভদ্র হয়েছে তাদের কথা বলছি না। আমি বললাম প্রকৃতির সন্তানদের কথা যারা জন্মেছে খোলা আকাশের নিচে, পান করেছে মাটিতে বয়ে যাওয়া আকাশে জল, খেয়েছে জঙ্গলের মাটিতে জন্মানো শাক, মূল, ফল, ধান, গাছের বীজ, মকাই, জোয়ার, গম, অল্পকিছু জঙ্গলের পশু পাখি আর মাছের শুটকি। ওরা সুখী, দীর্ঘায়ু – তেজবান।
আগেই হেঁড়্যা তৈরীর গাছগাছালির নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম দিয়েছি, যেকোনো একটি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম GOOGLE খোঁজ করবেন, কী অশেষ গুণ সম্পন্ন লতাগুল্ম দিয়ে ওরা ঔষধি গুণসম্পন্ন হেঁড়্যা নামক অমৃতসুধা তৈরি করে। হাজার হাজার বছর ধরে ওরা এভাবেই সুস্থ থেকেছে।
সেখানে আমরা ক্যান্সার ইত্যাদি ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত।
— প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখুন–
*******************************************
সোমনাথ দাস অধিকারী পরিচিতিঃ
সোমনাথ দাস অধিকারী মহাশয়ের নিবাসঃ গ্রাম ও ডাকঘর – অমরপুর, থানা – পটাশপুর, জেলা – পূর্ব মেদিনীপুর। প্রেসিডেন্সি কলেজ হইতে জীববিদ্যায় স্নাতক, বর্তমানে জীববৈচিত্র পর্ষদের সঙ্গে কর্মে লিপ্ত।