Shadow

সন্ত সুরদাস – মণি ফকির

সন্ত সুরদাস 

মণি ফকির

পূর্বাঙ্গ 🙏
—————-
১৪৭৮ খ্রীষ্টাব্দে,দিল্লীর কাছে সিহি গ্রামে এক দরিদ্র সারস্বত ব্রাহ্মণের ঘরে সুরদাসের জন্ম হয়।
জন্মের পরেই গ্রামের দাই মা আবিষ্কার করেন শিশুটি অন্ধ। বছর তিনেক বয়স হতে না হতেই তাঁর আসল নাম ভুলে সবাই ‘সুর’ বলে ডাকতে লাগল। যার মানে জন্মান্ধ।
শৈশব থেকেই বঞ্চনার শিকার। তদুপরি ভাই,বন্ধুদের  উপহাস ও অত্যাচার ছিল উপরি পাওনা। প্রথাগত ও পারিবারিক শিক্ষা লাভের অধিকার তিনি পাননি। মা বাবার মমতা থেকেও বঞ্চিত থাকলেন। অথচ তাঁর দৃষ্টিহীনতার ওপর তাঁর কোনো দায় ছিলনা। আর জন্মগত অন্ধ হওয়া কোনো অপরাধ নয়। তবু তাঁর কপালে নিঠুর শাস্তিই বরাদ্দ হল। আগামী দিনে যিনি কৃষ্ণ প্রেম অকাতরে দান করবেন,তার শৈশব ছিল বড়ই প্রেমহীন।
একদিন সজল নয়নে,বালক সুর বসেছিলেন বারান্দায়। ঠিক সেই সময় কানে এল ভজনের কথা ও সুর। একদল গায়ক সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের গান শুনে তাঁর আর্ত মন শান্ত হল। সেই ছিল সূচনা।
এর কয়েকদিন পর আবার সেই গায়কদল ওঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সন্মোহিত সুর নীরবে তাদের পিছু নিলেন। গৃহত্যাগী হলেন বালক। রাত কাটানোর জন্য,গ্রামের বাইরে হ্রদের ধারে সেই দল তাঁবু ফেলার সময় সুর কে দেখতে পায়। বালক তাঁদের কাছে গান শিখতে চাইলেন। সারা রাত তাদের গান শুনলেন।
এক অজ্ঞাত অন্ধ বালকের দায়িত্ব এড়াতে,ভোরের আলো ফোটার আগেই সেই যাযাবর গায়কদল ঘুমন্ত সুর কে ফেলে পালিয়ে যায়। হায় রে মানুষ,তুমি যদি অদৃষ্ট দেখতে পেতে। যাঁর ভরণপোষণের ভার জগন্নাথ নিয়ে রেখেছেন,তাকে বর্জন করে কার সাধ্য।
সুর সেই হ্রদের ধারে এক গাছতলায় থেকে গেলেন। গান গেয়ে তাঁর দিন কাটতে লাগল। সরল গ্রামবাসীরা তাকে যা এনে দিত সে তাই খেত। মথুরা বৃন্দাবন যাওয়ার পথে কত সাধু, তীর্থযাত্রী সেই হ্রদের ধারে বিশ্রাম নিতে আসত। তাদের গান ও কথা শুনে সুর অনেক কিছু জানল ও শিখল।
পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের একটি তাঁর নেই,অথচ বিধাতার কৃপায় তাঁর এক ষষ্ঠেন্দ্রিয় ছিল। কিছু দিনের মধ্যেই গণক বলে তার খ্যাতি হল। আশে পাশের গ্রাম থেকে বহু মানুষ তাঁর পরামর্শ নিতে আসত। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রেখে যেত ফল মূলাদি উপহার।
একবার ‘হারিয়ে যাওয়া’ ছেলের সঠিক সন্ধান দেওয়ায়,গ্রামের জমিদার তাঁর ভক্ত হয়ে উঠলেন। একখণ্ড জমিতে গড়িয়ে দিলেন তাঁর পর্ণকুটীর। তাঁর সুমধুর গান শুনতে দূর দূরান্ত থেকে লোক আসত। কয়েকজন সেবক ওখানেই থেকে গিয়ে,ওঁর সেবা করতে লাগলেন। গড়ে উঠল এক গৃহী সন্ন্যাসীর অনাড়ম্বর সংসার। এই ভাবে দিন কাটছিল। এক রাতে সুরদাস শ্রীকৃষ্ণ কে স্বপ্নে দেখলেন। আর দেখলেন, অনেক লোক কীর্তন গাইতে গাইতে চলেছে। গানের সুরে,তালে তাদের শরীর দুলছে। ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। অনুভব করলেন যে উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে এসেছেন,তার জন্য তাঁর আবার গৃহত্যাগ প্রয়োজন। নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে,ঊষা লগ্নে শুধু একতারাটি সাথে নিয়ে একবস্ত্রে বেরিয়ে পড়লেন আবার।
“জয় জয় মুরারি,
তব রূপ নেহারি,
অজানার ডাকে
আমি পথচারী”
কৃষ্ণের গুণগান করতে করতে বিভোর সুরদাস “জয় গোপাল,জয় জয় গোপাল” ধ্বনি সঞ্চারে বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন যখন রুণকত জনপদে পৌঁছলেন,আশ্রয় নিলেন এক পিপুল গাছের তলায়,বহু মানুষ তাঁর মেদুর গান শুনল। মনে পরম প্রশান্তি নিয়ে ফিরে গেল। কিছুদিন রুণকতেই ডেরা বেঁধেছিলেন। ফের পথে নামলেন সুরদাস। সাংসারিক বন্ধন যে তাঁর মোক্ষ নয়। কৃষ্ণ প্রেম পিপাসার্ত সুরদাস ব্যাকুল চিত্তে কৃষ্ণ নাম গান গেয়ে পথে পথে ঘুরতে লাগলেন।
এক রাত্রে,এক পরিত্যক্ত কুয়োর ধারে বিশ্রাম করতে গিয়ে তার মধ্যে পড়ে গেলেন। এক সপ্তাহ কেটে গেল। ক্ষুধার্ত,পিপাসার্ত,আহত অন্ধ গায়ক গেয়ে চললেন কৃষ্ণ প্রেম গান। তারপর একদিন এক বালক এসে তাঁকে উদ্ধার করল। পর মূহুর্তে উনি বুঝলেন,স্বয়ং মধুসূদন বালক রূপ ধরে ভক্তের বিপদ তারণ করেছেন। অবশেষে ঈষ্টদেবের দর্শন,পরশ,ও কৃপা জুটল জনম দুখী ভক্তের কপালে। সজল নয়নে,ভক্তি প্লাবনে গান বাঁধলেন “আঁখিয়া হরি দর্শন কি পিয়াসী”। গোপাল কে খুঁজতে খুঁজতে সুরদাস মথুরার কাছে গৌ-ঘাটে গিয়ে পৌঁছলেন। এখানে তিনি অনেক বছর ছিলেন। কৃষ্ণের গুণ গেয়ে শত শত গান রচনা করেছিলেন। গায়ক মহাত্মা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। এমন সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। বিখ্যাত কৃষ্ণ ভক্তি প্রচারক,পণ্ডিত বল্লভাচার্য বৃন্দাবন যাওয়ার পথে সেখানে এলেন।  নিজে এলেন সুরদাসের আশ্রমে। অভিভূত সুরদাস তাঁর অনুরোধে গাইলেন,
“প্রভু আমি সব পতিতের পুরোভাগি,
বাকি সকলেই ক্ষণিকের,
শুধু আমি আজন্ম থাকি ”
আপ্লুত মহাজ্ঞানী বল্লভাচার্য তাঁকে দীক্ষা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন,”তোমার গানের মাধ্যমে তুমি কৃষ্ণ মহিমা প্রচার করবে।”
গুরুর সঙ্গে বৃন্দাবন গেলেন সুরদাস। গুরু বল্লভাচার্য গোবর্ধনের শ্রীনাথজির মন্দিরে তাঁকে প্রধান গায়ক নিযুক্ত করলেন।
কথিত আছে কৃষ্ণ লীলা গীত গাইবার সময়,ভক্তরা গানে বর্ণিত দৃশ্য গুলি দেখতে পেত। অনুভব করত।
একবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সুরদাস জী আকুল হয়ে ভজন গাইছেন। সমবেত ভক্তবৃন্দের হৃদয় ভেসে যাচ্ছে সুললিত প্রেমে। ঘটনাচক্রে সেদিন ভক্তদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুরদাসের দুই অগ্রজ সহোদর। তাঁরা ভাইকে চিনতে পারলেন। গান শেষে দেখা করে ক্ষমা চাইলেন পা ধরে। উদার সুরদাস তাদের বুকে টেনে নিলেন। আসলে যাঁর মন প্রাণ নিবেদিত বংশীধারীর শ্রী চরণে,যাঁর শিরায় উপশিরায় শুধু কৃষ্ণ প্রেম,তার কাছে কে বা আপন কেই বা পর।
————————————————–
।। বিস্তার ।।
——————-

সন্ত সুরদাস এর আসর

সমস্ত বিশ্বই ছিল তাঁর আপন। তাঁর গান সবার মুখে মুখে ফিরত।
আকবরের নবরত্ন সভার প্রধান গায়ক তানসেন পর্যন্ত সুরদাসের গান গাইতে শুরু করেন। একবার তানসেন গাইলেন ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিত না ধারো ‘ । গান শেষে সজল নয়নে সম্রাট বললেন “সুভান আল্লাহ তানসেন,তোমার গান শুনে আমার  চোখে জল এসে গেল,এখানে এমন কেউ নেই যার মন টলেনি।”
তানসেন বললেন,”জাহাঁপনা,আমি এ প্রশংসার যোগ্য নই। ও গানের রচয়িতা সুরদাস।”
অভিভূত আকবর সুরদাসের দর্শন করতে চাইলেন। দূত গেল তাঁকে আমণ্ত্রণ জানাতে। বিনীত সুরদাস বললেন,”দুঃখের সঙ্গে জানাই বন্ধু,আমি শুধু দেবকীনন্দন এর সভায় গাই। ব্রজ ছেড়ে কোথাও যাব না।
সব শুনে সম্রাট নিজে এলেন সুরদাসের কাছে,সঙ্গে তানসেন। অনুরোধ করলেন গান শোনাতে। সন্ত সুরদাস গাইলেন,”নিশদিন বরসত নয়ন হামারে”। মহা পরাক্রমশালী সম্রাটের হৃদয় বিগলিত। অনুরোধ করলেন তাঁর সভা অলংকৃত করতে। সুরদাস জী নম্র নমস্কারে প্রত্যাখ্যান করলেন। তখন আকবর তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ আশে পাশের গ্রামগুলি দিতে চাইলেন। সুরদাস জী উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন:
‘জগতের নাথ,ত্রিভুবন পতি
বিপুলা ধরণী তাঁর,
এক ফালি এই ভূখণ্ডে মোর
কিবা আছে অধিকার?’
আকবর নিজের ভুল বুঝলেন। অনুভব করলেন ইনি একজন সত্যিকারের ফকির। ক্ষমা চেয়ে বললেন ‘প্রভু,আপনার জন্য কি আমি কিছুই করতে পারি না?’
উত্তরে সন্ত বললেন একটাই অনুরোধ। ব্রজ ত্যাগ করতে বলবেন না। প্রত্যাখ্যাত বাদশাহ এক নির্মল প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এলেন।
—————————————
।। উত্তরাঙ্গ ।।
………………
অনেক উদীয়মান কবি,গায়ক সুরদাস এর আশীর্বাদ নিতে আসতেন। একবার মথুরায়,তাঁর কাছে তরুণ কবি তুলসীদাস এলেন আশীষ নিতে। ইনিই পরবর্তী কালে রামচরিতমানস রচনা করেন। বিদায় কালে সুরদাস জী তাঁর হাত ধরে বললেন “তুলসী,কথা দাও তুমি কৃষ্ণের নাম গাইবে।” তুলসীদাস বললেন,”অবশ্যই প্রভু,যদি আপনি কথা দেন রামের নাম গাইবেন।”
দুজনে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পরে সুরদাস জী তাঁর এক পদে এই সাক্ষাৎ এর উল্লেখ করেন
“প্রভু,চন্দন তুলসী তব চরণে লাগি,
বংশীধারী বাঁশির টানে সব বিবাগী।
মুরলী ছাড়ি,তাপস বসনে,বনে বনে ফিরি,
ধনুর্ধারণে সমর ভূমিতে,সংহার অরি।”
সুরদাস যতদিন মথুরায় ছিলেন,কৃষ্ণের নামে রোজ একটি গীত রচনা করতেন আর প্রত্যেকটি গানে তিনি বিগ্রহের বর্ণনা দিতেন। একদিন গান বাঁধলেন:
“নীল বসন পরি,ললাটে সিন্দুর ধরি,কি অপরূপ রূপ নেহারি”
কিছু সন্দিগ্ধ ভক্ত নিছক কৌতূহল বশতঃ একদিন পুরোহিত কে নির্দেশ দিলেন বিগ্রহ না সাজাতে। সেদিন সুরদাস গাইলেন “আজ দেখি প্রভুর আমার দেহে নেই বসন!”
যিনি জন্মসূত্রে দৃষ্টি হীন,তিনি ঈশ্বরের মূর্ত রূপ দেখতে পেতেন। উপলব্ধি করতেন তাঁর প্রকৃত স্বরূপ। জ্ঞান চক্ষু যাঁর খোলা,ভক্তি যাঁর নিখাদ,তাঁর কোনো প্রথাগত শিক্ষার দরকার নেই।ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্ব নিয়ে অনেক তর্ক হতে পারে। দ্বৈত ও অদ্বৈত বাদ নিয়েও বহু কথা হয়। মূর্তি পূজা বা ধর্মান্ধতা নিয়ে মানুষে মানুষে বিবাদ হয়। এমনকি একথাও অনেকেই মানবেন যে ধর্ম বিভেদ সৃষ্টি করে।
সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভক্তিবাদ ও সমর্পণ। সেখানে কোনো ধর্ম নেই,ভাষা নেই।
সুরদাস তা প্রমাণ করেছেন।
জীবনের অধিকাংশ সময় শ্রীনাথের মন্দিরে কাটালেও, ব্রজবুলি ভাষায় রচিত তাঁর পদ ও গান গুলি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে তা ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সীমানা অগ্রাহ্য করে পাঞ্জাব,রাজস্থান,মহারাষ্ট্র,বাংলা,আসাম এবং দক্ষিণ ভারতেও লোকের মুখে মুখে ফেরে।
…………..…………………………
মনি ফকির
মণি ফকিরের জন্ম শিল্পনগরী বার্ণপুরে। সাহিত্য চর্চার অভ্যাস ছাত্র জীবন থেকেই। অনুপ্রেরণা মা ও মামার কাছ থেকে। প্রথম কবিতার বই *মণি ফকিরের পদাবলী* প্রকাশিত হয় ২০১৮ পূজোয়। গল্পকারের মূল বৈশিষ্ট্য তার গল্প বোনার ও বলার সাবলীল ধরন। গল্পের শেষে কিছু না বলা কথার প্রচ্ছন্ন ঈঙ্গিত মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে।।

 

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!