স্বাধীনতা সংগ্রামে হুগলী জেলা
সুলগ্না চক্রবর্তী
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া সব দেশেরই নিজস্ব স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আছে। কখনো তা সহিংস কখনো অহিংস। কখনো আবার তার নিজের শিকড় চেনানোর জন্য আদর্শের লড়াই। কিন্তু আমাদের দেশের হুগলী জেলাতে এই লড়াই ছিলো ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে সহিংস,অহিংস,আধ্যাত্মিক,প্রতিরোধ কৌশলযুক্ত,আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক লড়াই ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ধারার সংগ্রাম একসাথে মিলিত হয়েছে। শুনলে অবাক লাগবে যে স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ইতিহাস হুগলী জেলাতে শুরু হয়েছিল সিপাহী বিদ্রোহের সময় মানে ১৮৫৭ থেকে। কানপুর থেকে লড়াই করা নানা সাহেব চন্দননগরে আশ্রয় চেয়েছিলেন এবং ব্রিটিশ ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে “নেপোলিয়ন বাহাদুর”কে চিঠি লিখেছিলেন যা চন্দননগর থেকে ফ্রান্সে যায়। ফ্রান্সের উত্তর কী ছিলো তা সময়ের স্রোতে বিলীন। শ্রীরামপুরের ইউরোপিয়ানরা রথের সময় বাজে ঘটনার আশঙ্কা করে সাদা পুলিশ চেয়েছিলো দেশীদের থেকে সুরক্ষা পেতে–এই তথ্য এটা বুঝিয়ে দেয় যে সিপাহী বিদ্রোহের আঁচ এই অঞ্চলে ভালোই পড়েছিলো।
তাই হুগলী জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস যেমন বর্ণময় তেমন গভীর প্রকৃতির। ১৮৮৫ এ বোম্বাইতে যখন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস স্থাপিত হয় তখন হুগলী জেলা থেকে বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত ব্যক্তি যোগদান করেছিলেন হুগলী,হরিপাল,গোঘাট থেকে। তবে এই পালে হাওয়া লাগে বঙ্গভঙ্গের সময় তা বলাই বাহুল্য।
১৯০৫ থেকে ১৯১১ অবধি গোটা হুগলী জুড়ে চলেছিলো বিদেশী বস্তু বর্জন ও স্বদেশী বস্তু আপন করার আবহাওয়া। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও আনন্দমোহন বসুর সভাতে যোগদান করবে বলে হাজার হাজার লোক পায়ে হেঁটে তারকেশ্বরে গিয়েছিলো। এই সময় গোটা হুগলী জুড়ে অনেক স্বদেশী ঘরানার স্কুল ও বয়ন শিল্পের কেন্দ্র খোলা হয়। জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ,সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়,উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,মতিলাল রায়ের নাম এক ডাকে গোটা হুগলী জেলা চিনতো। গোটা হুগলী জেলা জুড়ে অসংখ্য স্থানীয় কাগজ বেরোতো যা দেশের কথা তুলে ধরতো সাধারণ মানুষের কাছে সহজ-সরল ভাষাতে। সন্ধ্যা,প্রজাবন্ধু,বঙ্গবাণী,হৃতবাদী,প্রভাতী,ইন্ডিয়ান মিরর ইত্যাদির নাম লোকেরা জানতো এবং যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলো।
দেবব্রত বসু,মতিলাল রায় প্রথমদিকে অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করলেও পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিক দিকে চলে যান। অরবিন্দ ঘোষ চন্দননগরে মতিলাল রায়ের আশ্রমে থাকাকালীন মতিলাল রায়ের স্ত্রীকে দেখে মাতৃভাবে আকৃষ্ট হন। এরপর চন্দননগর থেকে চিরদিনের জন্য বাংলা ছেড়ে পন্ডিচেরীতে চলে যান। অসংখ্য নারী গোটা জেলা জুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো নীরবে। বোমা পেটে বেঁধে পুকুরে স্নানের অভিনয় করা পুলিশের সার্চের সময়,পিস্তল চালানো,বোমা বাঁধার মাল মশলার আয়োজন করা,অস্ত্র ও চিঠি আদান-প্রদান করা ইত্যাদি কাজের উদাহরণ অনেক আছে। এমনকি বউ সেজে বিপ্লবীদের আত্মীয় করে নকল স্বামী নিয়ে সংসার করেছেন সুহাসিনী দেবী যতক্ষণ না পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষে আশালতা চট্টোপাধ্যায় ও বীণা দাস ছিলেন মা অন্নপূর্ণার সমান গোটা হুগলী জুড়ে।
বিপ্লবী ভাবধারায় বিশ্বাস করতো অনেকেই। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাওয়া শহীদ কানাইলাল দত্ত ছিলো চন্দননগরের ছেলে। দীনেশ মজুমদার ১৯৩৩ সালে চন্দননগরে এসে মঁশিয়ে কাঁকে হত্যা করেন এবং ১৯৩৪শে তার ফাঁসি হয়। চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের অন্যতম নায়ক জীবন ওরফে মাখনলাল ঘোষালের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ১৯৩৫ এ। শহীদ গোপীনাথ সাহা ছিলো এই জেলার ভূমিপুত্র। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯০৭ সালে ভদ্রেশ্বরের কাছে ট্রেন উড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা সাফল্য পায়নি কিন্তু চেষ্টা চলেছিলো। নজরুল ইসলাম চিনসুরাতে থাকাকালীন অনেক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছিলেন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় কলকাতা হাইকোর্টের জজের পদ প্রত্যাখ্যান করেন দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল। মতিলাল রায়ের প্রবর্তক আশ্রমে গান্ধী,নেতাজি,নেহরু,প্রফুল্ল রায়,শ্যামাচরণ মুখার্জি,সরোজিনী নাইডু ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার লোকেদের চরণধূলি পড়েছে। এছাড়া রাসবিহারী বসুর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন যারা বিদেশী সহায়তায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। জিতেন লাহিড়ীর নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বাঘাযতীন নিয়মিতভাবে গোপনে চিনসুরাতে আসতেন এবং এখানে বসেই জার্মানী থেকে অস্ত্র আমদানীর পরিকল্পনা হয়। মোহন সাঁপুই সরাসরি ফ্রান্স থেকে রিভলবার এনে বিপ্লবীদের দিতেন। চন্দননগরে এসেছেন ভগিনী নিবেদিতা,আসতেন মিসেস দাস নামে এক মেমসাহেব যিনি বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন।
এমন অনেক ধারায় পুষ্ঠ হয়েছে হুগলী জেলার স্বাধীনতা সংগ্রাম। চন্দননগর যেহেতু ফরাসি নগরী ছিলো তাই ইংরেজি আইন এখানে বলবৎ ছিলোনা। এই কারণে বহু বিপ্লবী এখানে আশ্রয় নিয়েছে। এই জেলা কানাইলাল-মাখনলাল-গোপীনাথের মত বিপ্লবীদের কর্মক্ষেত্র,নগেন্দ্রনাথ-গৌরহরি-দেবেন্দ্রনাথ এর মত গান্ধীবাদীদের গর্ভধারিণী,দেবব্রত-অরবিন্দ-মতিলালের মতো মানুষের আধ্যাত্মিক বোধের সাক্ষী,রাসবিহারী-জিতেন-বাঘাযতীনের স্বপ্নের দোসর এবং মহিলাদের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের সঙ্গী। তাই হুগলী জেলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কী করেছে তা যুক্তি-তর্কের বেড়াজালে না বেঁধে,পথিক হয়ে বেরিয়ে পরতে হবে এই অঞ্চলের স্হানীয় ইতিহাস আবিস্কার করতে। তাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুই প্রজন্মই লাভবান হবে।
=======
এই প্রবন্ধ লিখতে বিভিন্ন গবেষণা পত্র,ম্যাগাজিন,প্রবন্ধ সংকলনের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
====
১। হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ। সুধীর কুমার মিত্র। দেজ।
২। কর্মবীর রাসবিহারী। বিজনবিহারী বসু। রাডিক্যাল প্রকাশনী।
৩।বাংলা রচনা। শ্রীঅরবিন্দ।শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পন্ডিচেরী।
৪। বৈতালিক। কলাবীথিকা হুগলী। জুন ও নভেম্বর সংখ্যা। ২০১৯.
৫। স্বাধীনতা সংগ্রামে চন্দননগর।ডঃ বিশ্বনাথ বন্ধোপাধ্যায়।
৬। Europe and the hooghly by Suranjan Das and Basudeb Chattapadhya , KP Bagchi.
**************************************
সুলগ্না চক্রবর্তী পরিচিতিঃ সুলগ্না চক্রবর্তী বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে মাষ্টার করলেও ভালোবাসার জায়গা হলো সাহিত্য ও ইতিহাস।বিভিন্ন পত্রপত্রিকা,রেডিওতে সুলগ্না চক্রবর্তীর প্রবন্ধ,গল্প,কবিতা এসেছে। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের প্রজেক্টেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে।