ফিরে চাওয়া ফিরে দেখা
মধুমিতা মিত্র
কুলায় ফেরা এই শব্দ বন্ধটি নিজের মনে নাড়াচাড়া করতে করতে বিচিত্র এক অনুভূতির উন্মেষ হল।
আমাদের চিন্তা প্রকাশের এক নতুন ঠিকানা কুলায় ফেরা। ভোরের আলো ফোটার সাথে পাখি তার নীড় ছেড়ে বেরোয় জীবনের সন্ধানে। জীবন মানে শারিরীক ক্ষুধা, মানসিক চাহিদা, তৃপ্তি সবকিছু জড়িয়ে আবার সবকিছু ছাপিয়েও।সারা দিনমানের পরিশ্রম অভিজ্ঞতায় জারিত হয় তার এক-একটি দিন।দিন শেষে আবার নীড়ে ফেরা বা কুলায় ফেরা পরের দিনের শক্তি বুদ্ধির উজ্জীবনে বা সঞ্জীবনেও। আমাদের কুলায় ফেরা প্রতিদিনের নয়-জীবন সায়াহ্নের কুলায় ফেরা। জীবন যখন শুরু হয়েছিল তখন ছিল নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া,বহুল মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে শুধু সঞ্চয়নের খেলা। সেই সঞ্চয়নে ছিল না লাভ ক্ষতির হিসেব।
কিন্তু তাৎক্ষণিক ক্ষতি দেখালেও আখেরে লাভের পাল্লা হয়েছে ভারী।ঠোক্কর খাওয়া অভিজ্ঞতা বলছে ভালো-মন্দের কথা।মন্দের হাত ধরে এসেছে ভালোর বাণী।‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’-সেই না ফেলা ধন বাঁচাতে বসে দেখা গেছে উত্তরণ ঘটেছে মননের,বুদ্ধির।তাই কুলায় ফেরা আমরা এখন অনেক পরিণত,যদিও পরিণতির শেষ ঠিকানা শেষ দিন পর্যন্ত অধরাই থেকে যাবে যদি অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমাদের বুদ্ধি মনন স্হির থাকে,অবিকৃত থাকে।
দিনের শেষে কুলায় ফিরে দেখি আমার অবিকৃত নেই। বাইরের ঝড় ঝাপটায় কুলার বিন্যাস যাচ্ছে নষ্ট হয়ে।গার্হস্হ্য আশ্রমের পুরোটাই প্রবাসে কাটিয়ে এসে বঙ্গদেশ দেখি কেমন পাল্টে গেছে। বাঙালিরা যেন সেরকম বাঙালি আর নেই। মিশ্রণে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত সংকর এক জাতি,তার প্রভাব পড়েছে ভাষায়,শিল্পে,সাহিত্যে,চেতনায় মননে।এ কি সময়ের প্রভাব?জানি না তবে ভালোও লাগে না আগের বাঙালি চরিত্ররা কেমন আটপৌরে ছিল,এখন পাল্টে গেছে সেই সহজ সরলতা। বাঙালি এখন অনেক স্মার্ট।তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্ৰস্ত বোধহয় আমাদের অতি সুন্দর এই ভাষাটি। হিন্দির প্রভাবে বাঙলা ভাষা তার বাঙালীয়ানা হারাচ্ছে।সময়ের সাথে সব কিছুরই বিবর্তন অতি স্বাভাবিক।সেই স্বাভাবিকতা বজায় থাকে যদি অন্য ভাষার প্রভাব সেই ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করে তবেই।যেমন আরবী,ফার্সী,উর্দু, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা বাংলা ভাষার সাথে মিশে আমাদের ভাষাকে আরও ধনী করেছিল কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হিন্দির সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা বিপর্যস্ত,বিধ্বস্ত।জানিনা এ অবক্ষয় রোধ করা যাবে কিনা তবে কুলায় ফেরা আমরা কিন্তু হতাশাগ্ৰস্ত এই ক্ষণের এই বিবর্তনে।ভাষাই সংস্কৃতির মূল সঞ্চালক,ধারক,বাহক-সেই ভাষার সৌন্দর্য সৌষ্ঠব যদি বজায় না থাকে তবে আগামী দিনে আমাদের প্রিয় এ মাতৃভাষা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?-কুলায় ফেরা আমরা আসুন না সিন্ধুতে বিন্দু হয়েও চেষ্টা করি বাংলা ভাষা সংস্কৃতির এই মৌলিকত্ব বজায় রাখতে। প্রচেষ্টা চতুর্দিকেই অবশ্য চলছে। সেই প্রচেষ্টায় হই আমরাও শরিক ।।
মধুমিতা মিত্র
পেশা—স্বপ্ন দর্শন,স্বপ্ন গুলো ই বাঁচিয়ে রাখে,
নেশা—আনন্দ চয়ন,জীবন পথের সমস্ত জঞ্জাল,বোঝা,দুঃখ সব দূর করে ফেলে দিয়ে আনন্দ কুড়িয়ে বেড়ানো,
প্রেম–রবীন্দ্রনাথ,উদয়শঙ্কর, উত্তমকুমার।সাম্প্রতিকতম প্রেম শ্রীকৃষ্ণ ..
আমার মতো এমন অ–জ্ঞানী, অবাস্তব মানুষ কে কুলায় ফেরার সম্পাদকমন্ডলী লিখতে সুযোগ দিয়েছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁদের।
লেখার সাবলীলতা প্রশংসার দাবি রাখে। ভালো লেগেছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, খুব উৎসাহিত বোধ করছি।
লেখার সাবলীলতা প্রশংসার দাবি রাখে।
লেখিকা শ্রীমতী মিত্রের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সংকটের সমস্যার সঙ্গে সম্পুর্ন সহমত। আজ বাঙ্গালির বিয়েতে গায়েহলুদ ইত্যাদি ব্রাত্য। এখন মেহেন্দি, স্যাঙ্গীত ইত্যাদি একান্ত আবশ্যক। আর ভাষা? অমুক লোকটার প্রচন্ড ” অ্যাটিচ্যুড” বা ভীষণ ” ঘ্যাম “! বাঙ্গালি তরুণ / তরুণীদের শব্দভান্ডার থেকে দাম্ভিক বা অহংকারী শব্দগুলো এখন বাতিল !!… ভাষা সর্বত্রই বহতা নদীর মত। কিন্তু সেই নদী থেকে শুধু জঞ্জালগুলোই তুলে আনলে তো সমস্যা !!
সংকর ভাষা প্রসঙ্গে অনেক দিন আগে এক রসিক বন্ধু বর্নিত কথোপকথনটুকু লিখতে লোভ হচ্ছে।
এক শিক্ষিতা তরুণী দূরভাষে বান্ধবীকে বলছেনঃ
“you know, other day I had been to Sujata’s place. They had a পূজা there. It was sooo crowded, we had to sit হাঁটুগেড়ে। During the যজ্ঞ the place was full of ধোঁয়া! আমার চোখ, you know, was বিচ্ছিরি ভাবে watering!! Anyways(!), we then had some প্রসাদ। I really enjoyed that fruit! কি যেন নামটা? ওই যে, you know, that লাল লাল thing, with কালো কালো বিচি! It was sooo delicious, sooo juicy, it was খেতে খুব ভাল you know ” ……
ওপরের কথাগুলো ঠিক ঠিক আধা ফিরিঙ্গি উচ্চারণে শুনলে হয়তো মজা পেতেন, যেমন আমি পেয়েছিলাম!!
প্রতি দিনের ক্ষোভ এই স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দেওয়ায়।ভেবে দিশাহারা।বাঙালী বলে ভবিষ্যতে কোনও জাতি থাকবে না? খুব মনোমতো কথা বলেছেন-ভাষা সত্যিই বহতা নদীর মতোই কিন্তু সেই নদীই তুলে আনছে জঞ্জাল,হয়ে যাচ্ছে দূষিত,আমরা নিরুপায় দর্শক।
অনেক অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর এবং মূল্যবান মন্তব্যের জন্য, লেখার এবং ভাবনা চিন্তা করার উৎসাহ বেড়ে গেল অনেক গুণ…
বাঙালির বাঙালিয়ানার বিজয়যাত্রা স্তব্ধ হয়েছে অনেক আগেই। আর এখন পাড়ার কাকু বা দাদা শাসন করার সাহস দেখাতে পারেননা। গুরুজন শব্দটা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে আজ আইসিসিইউ তে। সবচেয়ে দুর্দশা আমাদের সাধের ভাষাটির। আপাতত বোম্বাই মার্কা বাংলা ভাষা আর বলিউডিয় ধড়াচুড়োতে বাঙালিয়ানা ভেন্টিলেশনে। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন সুতোয় ঝুলছে তার ভাষার গৌরব, শিল্পের অহমিকা, সেই সময়ে বন্ধু মধুমিতার লেখাটি বড় বেশিই প্রাসঙ্গিক আজ। সুন্দর শব্দমালায় মহামূল্যবান রত্নটি হলো সাবলীলতা, যা বন্ধু মধুমিতার সিগনেচার স্টাইল। নিটোল একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য মধুমিতার অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য। কুলায়ফেরার পাতায় আপনার আরও অনেক অনেক লেখার প্রত্যাশায় প্রতীক্ষিত রইলাম।