মানুষ যখন পরিযায়ী
বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত
আমরা পরিযায়ী বাবু।
দিনে দিনে ,মানুষ থেকে ,
পশুপাখির দলে ভিড়িয়ে দিল আমাদের।
দুমুঠো অন্নের সন্ধানে একদিন ছেড়েছিলাম ঘর। আমাদেরও আছে পরিবার ।
তোমাদের মত আমার মাও ,
রোজ রাতে তার খোকার কথা ভেবে ,
লুকিয়ে চোখের জল ফেলে।
রাজনীতির পরিযায়ীরা ,
আসে পাঁচবছর ছাড়া–ছাড়া।
প্রতিশ্রুতি আর প্রতিশ্রুতি ।
হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা।
বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়।
নিজেদের আখের গুছাতে ,
কার্পণ্য করে না কখনও।
না শিল্পের ভাবনা না কর্মসংস্থান।
হীরক রাজার দেশে সকলেই পরিযায়ী ।
লম্বা লম্বা ভাষণে পেট ভরে না।
চাই আধপেটা ভাত।
বেঁচে থাকার তাগিদে ,
কাজের সন্ধানে কোথাও গেলেই ,
আমরা পরিযায়ী ।
দেশের দুঃসময়ে ,এ তকমা এঁটে বসে ,
আমাদের গায়ে।
তোমরা যখন গৃহবন্দি হয়ে ,
বাঁচার লড়াই কর ,
আমরা তখন খোলা আকাশের তলে বাসা বাঁধি। আমরা তো মানুষ নই ,
আমরা যে পরিযায়ী ।
সন্তান স্ত্রীর সান্নিধ্য পাওয়ার ,
সাহস দেখাতে নেই আমাদের।
বুড়ো বাবা মার মুখে ,
জল টুকু দিতে অক্ষম শেষ দিনটিতে।
লকডাউনে তোমরা যখন ঘরে বসে ,
বিরিয়ানি বানাও,
আমরা তখন লড়াই করি ,
কুকুরের সাথে এক টুকরো রুটির মালিকানায়।
আমরা তো মানুষ নই ,আমরা পরিযায়ী ।
সব পাখি ঘরে ফেরে।
এই পাখিদের ঘরে ফিরতে নেই।
স্তুতি বাক্য শুনেশুনে কান ঝালাপালা হয়।
বাসের আয়োজনে দাঁড়ি পরে অচিরেই।
সকলেই অস্বীকার করে আমাদের দায় নিতে।
শুরু হয় ভয়ডরহীন অভিযান ।
কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটেই চলেছি।
গন্তব্য সুখের দুচালা কুঁড়েঘর।
যেখানে দরজায় অপেক্ষা করে আছে,
অন্ধ পিতা ,পুত্রের শেষ ছোঁয়া পাবার আশায় ।
ক্লান্ত শরীরে কখনও ঘুমিয়ে পড়েছি ,
রাস্তার উপরে ,
কখনো বা রেললাইনের মাঝে।
ক্ষুধা নিবারণ সম্বল দু টুকরো শুকনো রুটি। রাতের অন্ধকারে ছুটে আসে রেলগাড়ি ,
আসে দূরন্ত বেগে রাতজাগা ট্রাক।
অভিশপ্ত রাতে ,
অকালে ঝরে যায় অগণিত প্রাণ ।
পাশে পড়ে থাকে বাসি রুটির টুকরো।
অচেনা দেশে লাশ গুলো পড়ে থাকে ,
হায়নার খাদ্য হয়ে।
কোনো প্রতিবাদ নয়।
আমরা যে পরিযায়ী ।
জানিনা পৌঁছাবো কবে?
হয়তবা কোনদিনই নয়।
তবু হেঁটে চলি অনেক আশা নিয়ে।
বাড়ির দুয়ারে অপেক্ষায় অভুক্ত পরিবার। আমাদের কথা বলা বার্ণ ।
আমরা সেই পরিযায়ী ।।
বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত:…… জন্ম ,ঝাড়গ্রাম শহরে। বর্তমানে একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন । ছোটবেলা থেকেই এক সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা। পেশাগত জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝে সাহিত্যচর্চা ,তাঁর কাছে গ্রীষ্মের বিকালে মলয় বাতাস।
বিশ্বজিৎ,
খুব ভালো। তোর লেখা কবিতা তো পড়েছি বেশ কিছু। এটাও অনবদ্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
আরো আরো কবিতা এই ‘কুলায়-ফেরা’ তে চাই। আমরা এবং ‘কুলায়-ফেরা’ আরো সমৃদ্ধ হোক।