লাস্ট বেঞ্চার
রাজু সেনগুপ্ত
মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ। অমলেন্দু স্যার সবাইকে কি ভাবে ফর্ম ফিলাপ করতে হবে সেটা বলার পরে আমরা সবাই ফর্ম ফিলাপ করবো। স্যার বল্লেন প্রথম লাইনে সবাই নিজের নাম লেখো। ফর্ম ফিলাপটা একটা পরীক্ষার মতই আমার কাছে। আমি সোমনাথ কে গুঁতো মেরে বলি,” দেখা না কি লিখলি“! সোমনাথ রেগে যায়। বলে,নিজের নামটা লিখবি সেটাও নিজে লিখতে পারছিসনা। সেটাও দেখাতে হবে!স্যার এবার সব বেঞ্চে গিয়ে দেখে নিলেন সবাই নিজের নামটা সঠিক ভাবে লিখেছে কিনা। ততক্ষণে আমার বুদ্ধি খুলে গেছে , আমি সঠিক জায়গায় আমার নাম লিখে বসে আছি। এক্কেবারে ১০ এ ১০!
দ্বিতীয় লাইনে বাবার নাম। স্যার এবার সব্বাইকে সতর্ক করে দিলেন বাবার নাম লেখার সময়, বাবার নামের আগে কেউ যেনো “শ্রী”,”শ্রীযুক্ত” না লেখে। শুধু বাবার নাম। আমার তখন ফ্লো এসে গেছে! সোমনাথ কে আর বিরক্ত করছি না।
হঠাৎ একটা গুড়ুম করে কিলের আওয়াজ, আর সোমনাথের গগনভেদী চিৎকার। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে, ” স্যার আপনি আমায় মারলেন কেনো?”
হারামজাদা তোদের যে আমি পই পই করে বারণ করলুম বাবার নামের আগে কেউ ” শ্রী বা “শ্রীযুক্ত” লিখবি না
তা তুই এর মধ্যেই বাবার নামের আগে “শ্রী” লিখে ফেলেছিস?
পিঠ ডলতে ডলতে সোমনাথ বলে কি করবো স্যার? বাবার নাম তো ” শ্রীপতি‘!
স্যার একটু সামলে নিয়ে বলেন, সেটা আমায় আগে বলবিতো!
কিছু স্যার আবার “টার্গেট” ছাত্রদের “টোপ” দিয়ে পেটাতেন।
ক্লাসের ফার্স্ট বয় জয়ন্তকে প্রশ্ন জিগ্গেস করলেন ” উত্তর প্রদেশ ভারতের কোন দিকে?
উত্তর দিকে।
ঠিক আছে, বসে পড়।
মধ্যপ্রদেশ ভারতের কোন দিকে রে দেবাশীষ?
দেবা উত্তর দিলো মধ্যেখানে স্যার।
বসে পড়।
স্যার এবার হাঁটা শুরু করেছেন শেষ বেঞ্চের দিকে।
আমি যথা সম্ভব স্যারের সাথে আই কন্ট্যাক্ট না রাখার চেস্টা করছি। স্যার শেষমেষ আমার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-এবার তুই বল। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের কোন দিকে?
আমি উত্তর দেবার আগেই স্যার পেটাতে শুরু করলেন। আমি কি উত্তর দেবো স্যার জানেন। তাই আগে থেকেই পিটিয়ে নিলেন।
এতটাই কনফিডেন্ট থাকতেন কিছু ছাত্রদের ওপর।
শুধু স্যাররা পেটাতেন এমন নয়। অশোকের বাবা যেমন রেজাল্ট বেরনোর দিন যদি না থাকতে পারতেন, তাই আগের দিন রাতে পিটিয়ে রাখতেন। রেজাল্ট কি হবে ওঁনার জানা।
আমাদের ছোটোবেলায় এমনি কারনে, অকারণে আমরা বহু মার খেয়েছি স্যার, বাবা,কাকা, দাদাদের কাছথেকে।
মা‘ রা খুব সচারাচর উগ্রপন্থা নিতেন না খুব বাধ্য না হলে। তবে যেটা নিতেন তার চেয়ে অনেক সস্তায় প্রোটিন ছিলো দু/চারটে চড় বা কিল।প্রতি পাড়ায় বা ফ্যামিলিতে দুর সম্পর্কের দু এক পিস ভালো ছেলে/মেয়ে থাকতো, তাদের জন্ম হয়েছিলো শুধুমাত্র আমাদের অপদস্থ করার জন্যই বোধহয়। কথায় বার্তায় তাদের সাথে আমাদের তুলনা করে আমাদের প্রেস্টিজের “ওয়াট” লাগালেও , “হাম নেহি শুধরেঙ্গে” মনোভাবের জোরে সব রকম প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতাম।আমার এক দুর সম্পর্কীয় মাসীর ছেলে, সে শুধু পরীক্ষায় প্রথম হতো তা নয়, সে আবার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তো। ইংরাজীতে ভূগোল, ইতিহাস পড়া ছাড়াও ইংরাজীতে কথা বলতে এমনকি ইংরাজীতে গালাগালিও দিতে পারতো। আপদে বিপদে তারা না থাকলেও, পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর পরে আমাদের বাড়ীতে মাসী তার ছেলের বহুমুখী প্রতিভা, আর আমার বহুমুখী ব্যথর্তা নিয়ে আলোচনা করে যৎপরনাস্তি প্রীত হতেন।আমি সেই সময় লজ্জায়, ভয়ে বাথরুমে থাকাই শ্রেয় মনে করতাম। তখন কিন্তবাঙালী বাথরুমে “কমোড” প্রবেশ করেনি।বাথরুমে এই দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার কষ্ট শুধু মাত্র আমার মতো বহুমুখী ব্যর্থ পড়ুয়ারাই অনুধাবন করতে পারবে।
মাকে বহুবার বলে ছিলাম, ” মা, যে সমস্ত আত্মীয়রা জন্মদিনে, বা দূর্গা পুজোতে কোনো রকম গিফ্ট দেয়্না, তাদের কোনো রকম সাংবিধানিক অধিকার নেই পরীক্ষার পরে তাদের রেজাল্ট জানার“।
আমাদের দেশে কোন মা, বাবা তাদের সন্তানদের কথার প্রাধান্য দিয়েছে! সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা।আমার সব লাস্ট বেঞ্চের বন্ধুদের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার ভয়, কেবলমাত্র প্রদীপ ছাড়া। আমরা যখন গাতিয়ে মুখস্থ করে চলেছি ভুগোল, বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইতিহাস তখন প্রদীপ, “চেগুয়ে ভারা” পড়ছে। সব দিক থেকে প্রদীপ আমাদের চাইতে আলাদা। ওর কাছেই প্রথম শুনি, “ বুর্জোয়া, শাসক শ্রেনী, শোষক শ্রেনী, সাম্রাজ্যবাদ, কমরেড ইত্যাদি শব্দ গুলো।আঁকিয়ে বলতে যখন শুধু পাড়ার গনুদা আর ছানুদাকে জানতাম, তখন প্রদীপের মুখে শুনি প্রথম পিকাসো, ভ্যান গখ এদের নাম। ছানুদা, গনুদানারা নাকি যা চোখ দিয়ে দেখে, সেটাই আঁকে। আর ওঁনারা চোখ দিয়ে দেখে আর মাথা খাটিয়ে আঁকে।
আমি বলি, তুই পরীক্ষার সময় এখন এই সমস্ত পড়ছিস? পরীক্ষায় ফেল করলে?
পরীক্ষা তো আর অলিম্পিক নয়, যে প্রতি চার বছরে এক বার আসবে! সামনের বছর আবার পরীক্ষা দেবো!
আমরা সবাই জানি, প্রাদীপ অন্য ধরনের ছেলে। লাস্ট বেঞ্চে বসার ছেলে নয়। সব বন্ধুরা মিলে বলি, তুই মন দিয়ে পড়লে কিন্তু অভীকদার চেয়েও বেশী নম্বর নিয়ে পাশ করবি?
প্রদীপ বলে, তারপরে অভীকদার মতো IIT থেকে পাশ করে আঙুলে গোমেদ, পোখরাজ, বাড়ীতে কোনো “বাবার” ছবিতে মালা দিয়ে পুজো আর রাত্রে ইসাব্গুল খেয়ে ঘুমোতে যাবো? ধুর ধুর আমার জন্য ঐ জীবন নয়।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট বেরোবে কিছুদিনের মধ্যে। এর মধ্যে প্রদীপ একদিন আমায় বলে চল!
-কোথায় গড়িয়াহাট?
-ধুর, হিমালয়! কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাই চল।
এমনই সব অবাস্তব প্রস্তাব ওর মনেই দানা বাঁধতো। কি করে বোঝাই ঐ বয়সে অতো দুর যেতে পারি কখনো? আমি হিমালয়ের কথা চিন্তা করে মনে মনে ঠান্ডায় কেঁপে উঠি। কৌপীন পরে’ মাধুকরী! না না অসম্ভব। নানান অজুহাত দেখাই।
মনে মনে চিন্তা করে নিয়েছি, পাশ করলে কলকাতা আর ফেল করলে পার্মানেন্টলি হিমালয়!
হিমালয় যাতে দুষিত না হয়, তার জন্য কিনা জানিনা, তবে আমি এক বারে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে গেলাম। আর আমার পাশ করার খবর শুনে আমার সেই মাসী বলে, “ মাধ্যমিক পরীক্ষার যা স্ট্যান্ডার্ড, তাতে নাকি এবার থেকে সব গরু, গাধা গুলো পাশ করে যাবে।
এই সমস্ত ঘটনা বহু বছর আগে। এখন আমরা সবাই সমঝদার আর সেয়ানা। সবাই বদলে গেছি। কোথায় যেন এক চোরাগোপ্তা কম্পিটিশান। চা খাবার পরে, সবাই পকেট থেকে আগে ভাগে টাকা দিয়ে দেয়।এখন আর কেউ বলেনা, “ আগের বারে আমি চায়ের দাম দিয়েছিলাম, এইবার তুই দে! “ কোনো নতুন জামা পরলে, কেউ ধার করে জামা পরতে চায় না। এখন আর কোনো বন্ধু হঠাৎ এসে হারিয়ে যাবার প্রস্তাব আনে না।
তখন মাত্র দু এক জনের ঘড়ি ছিলো, কিন্তু সময় ছিলো সবার কাছে। এখন সবার কাছে ঘড়ি, কিন্তু সময় নেই কারোর কাছে। তাই ভাবি যদি কোনো ভাবে ভাগ্য ফিরে পাই…জীবনের ঐ সব দুর্লভ সময় ফিরে পাই…
-চল, আবার বসি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে
যদি ঐ সব পুরনো বন্ধু আবার নতুন করে ফিরে পাই….!!
সুনীল গাঙ্গুলী শক্তি চট্টোপাধ্যায়,সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়া, কিশোর ,মান্না ,সন্ধ্যা, হেমন্তর লংপ্লে রেকর্ডে গান শুনে ও টুকে পাস করে দিব্য আছি।করোনাতে যদি ২০২০ সালে বেঁচে যাই, তবে ইচ্ছা মৃত্যু……কলির কেষ্ট হবার ইচ্ছে ছিলো, সময়ান্তরে কলির ভীষ্ম হয়ে বাঁচবো ……।।
খুব ভালো লাগল । হাস্যরসের আড়ালে আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো সত্যিই খুব সুন্দর ভাবে ফিরে এসেছে।