নিভৃত লোকে এক অনন্য প্রতিবাদী কলম
অমৃতা লাহিড়ী
“আমি কেবল দেখেছি চোখ চেয়ে
হারিয়ে গেল স্বপ্নে দিশাহারা
শ্রাবণময় আকাশ ভাঙা চোখ
বিপ্লবে সে দীর্ঘজীবি হোক ৷”
আকাশ ভাঙা অশ্রু জলে আমাদের ভাসিয়ে চির অমৃতলোকবাসী হলেন দশকের পর দশক ধরে আমাদের হৃদয় আর বাঙলা সাহিত্য জগৎ জুড়ে নিরন্তরভাবে উপস্থিত প্রতিবাদী কবি শঙ্খ ঘোষ।বয়স জনিত কারণে কবি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন না। আমাদের প্রিয় ‘কুন্তক’,অশীতিপর কবিকে শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে গেল অভিশপ্ত করোনা ভাইরাস।
গত দশকের পর দশক ধরে বাঙালীর জীবনে আর বাংলা সাহিত্যে নিরন্তর তাঁর উপস্থিতি চোখে পড়েছে। শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবি যিনি শুধু কবিতায় নয়,গদ্যে,ভাষণে,নিয়ত জীবন যাপনেও প্রাতিষ্ঠানিকতাকে ভেঙেছেন,গড়েছেন ৷
শিক্ষক শঙ্খ ঘোষ ছিলেন যেন নদীর মতো। নদী যেমন তার আপন স্রোতে বয়ে চলেছে,তিনিও ঠিক তেমনি ছিলেন। তাঁর পড়ানো বয়ে চলত নদীর স্রোতের মতো ৷ বর্তমান যুগের স্মার্টফোন এর ব্যবহার তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। তিনি পড়াতেন মসৃণ ভাবে ৷
তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। মাতা অমলাবালা,পিতা সুশিক্ষক। বাংলা ভাষার সম্মানিত বিশেষজ্ঞ মনীন্দ্রকুমার ঘোষ। কবির জন্ম বর্তমান বাংলা দেশের চাঁদপুর জেলায় ৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ সালে।বংশানুক্রমিক ভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারীপাড়া গ্রামে।৷ শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায় ৷ পিতার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েকবছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।৷ ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলাবিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ৷
জরুরী অবস্থার সময়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিলেন কবি ৷ যখনই শৃঙ্খলার নামে বাক্ স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে তখনই লিখেছিলেন “আপাতত শান্তি কল্যাণ”,”পেটের কাছে উঁচিয়ে আছে ছুরি/কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি,এখন সবই শান্ত,সবই ভালো ৷”
তাঁর সাহিত্য সাধনা এবং জীবন যাপনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বা ৷ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে বারবার তাঁকে কলম ধরতে দেখা গেছে ৷ তিনি নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন । “মাটি” নামের একটি কবিতায় নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি ৷
ভালবাসা পাতা জুড়ে থাকে ৷ সে পাতা যদি ছিঁড়েও যায়,তারপর অদৃশ্য কোন টানে,তা এক হতে বেশী সময় নেয় না ৷ ভালবাসার মতোই ভাষা ও এমন যে,যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেন,কি পূর্ব কি পশ্চিম তার অপূর্ব যোগসূত্র ঘটে হৃদয় মন্দিরে ৷ ভাষা,সাহিত্য,অর্থনীতি,বিজ্ঞান সব বিষয়েই আমরা বিদেশ তোলপাড় করে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব খুঁজি | বোধকরি তাতে কোন অসুবিধা নেই ৷ কিন্তু তাতে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না ৷
বাংলা কবিতার জগতে শঙ্খ ঘোষের অবদান অপরিসীম। ‘দিনগুলি রাতগুলি’,’বাবরের প্রার্থনা’,’মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’,“গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ” তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ হিসাবে ও তাঁর নামডাক ছিল। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ।।
দেশ ভাগের লাঞ্ছনাময় ক্ষত নিয়ে স্বাধীনতা আসার পর,ও-বাংলা থেকে যখন কবি এলেন এ-বাংলায়। শুরু হল তাঁর আপসহীন রুখে দাঁড়ানো,পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই খাদ্য আন্দোলনে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মৃত্যু হয় এক কিশোরীর ৷ ক্ষোভে,লজ্জায় তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে এল প্রতিবাদী সুর ৷ লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা-‘যমুনাবতী’ ৷
“নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আর একটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে
যমুনাবতী সরস্বতী
কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে
বারুদ বুকে দিয়ে”
মৃত্যু মুহূর্তের শূন্যতা-ই স্থির হতে দেয়নি ছদ্মনামে পরিচিত ‘কুন্তক’ কে। তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টির জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ৷ দুবার তিনি সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। পুরষ্কৃতও হয়েছেন-জ্ঞানপীঠ,দেশিকোত্তম,রবীন্দ্র এবং পদ্মভূষণে ৷ কিন্তু কোন স্বীকৃতি বা সম্মানের প্রাচুর্য তাঁকে সত্যের বিপ্লব থেকে সরাতে পারেনি ৷ যখন চারপাশে মৃত্যুর রাক্ষস মুখ খোলা,শঙ্খ ঘোষের কবিতা যেন জীবন পাথরের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে ৷
‘পদ্ম তোর মনে পড়ে খাল যমুনার
এপার ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায়
নিয়ে গিয়েছিল ?’
মারণব্যাধির প্রকোপ কবিকে নিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে ৷ বিষাদ রয়ে গেল আমাদের।
“আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয়”
বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ভুবনে। সেই শ্রেষ্ঠ কবি ভুবন থেকে বিদায় নিলেন৷ অমর হয়ে রইলেন আপামর বাঙালীর হৃদয়ে।।
*************************************
অমৃতা লাহিড়ী পরিচিতি:
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম.এ.। আধ্যাত্মিক পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা। প্রমথনাথ তর্কতীর্থ (ঠাকুরদা)র সঙ্গ সংস্কৃত শিখতে প্রেরণা জাগায়।
বাহ্ ভারী চমৎকার শ্রদ্ধার্ঘ্য