নীলকন্ঠ ফেরিওয়ালা – আলোকপাত
পর্ণশবরী ভট্টাচার্য্য
নীলকন্ঠ ফেরিওয়ালা বইটির লেখক: চিন্ময় চক্রবর্তী
(প্রকাশক:গাঙচিল)
“নীল” শব্দটির মধ্যে আছে অতলান্ত গভীরতার দ্যোতনা,স্বপ্নিল ছায়াবৃত রহস্যময়তা,নিঃসীম অপার ব্যাপ্তি যা কখনও গগনচুম্বী,কখনও অতলস্পর্শী,যার আভাস পাওয়া যায় নাগাল পাওয়া যায় না৷
“নীলকন্ঠ ফেরিওয়ালা” আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘নীল’ বাল্যকাল থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত জীবনের গতিময়তাকে বর্ণিল করে তোলে বস্তুজগতের ঘটন অঘটনের রূপ ও রূপহীনতাকে ছান্দসিকের দৃষ্টিতে দেখে৷ তাই কোন পারিপার্শ্বিক বিরূপতাই তার অন্তর্লীন শিল্পীসত্ত্বাকে নিঃশেষে বিক্ষত করতে পারে না৷ জীবনের মাধুরীকে সে পান করে আর গরলকে ধারণ করে ‘নীলকন্ঠ’ হয়৷
কাহিনীকার চিন্ময় চক্রবর্তী “নীলকে” নির্মাণ করেছেন তার আবাল্য কৈশোর-যৌবন ও মধ্যবয়সের পরিসীমায়৷ এটি নীলের আত্মকথন| তার জন্ম গঙ্গার পশ্চিমকূলের একটি মফঃস্বল শহরে, সেখানকার মানুষজনের জীবনযাপনের অনাড়ম্বর সারল্য,নিকটজনের আন্তরিকতা,বন্ধুদের সান্নিধ্য ও ছোট সুখী পরিবারের ছায়ায় যাপিত নীলের শৈশব৷ সাধারণ পরিবারের সাধারণ ছেলে নীল নিজ স্বীকৃতমতে ভাই বোনের তুলনায় মধ্যমেধার| ছাত্রজীবনে সে চোখ ধাঁধানো সাফল্য পায়নি,পেতে পারতো কিনা তাও অপরীক্ষিতই থেকে গেছে কারণ শিক্ষায়তন নির্ভর মেধা বিচারকে সে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি ৷ তার ছিল এক নিজস্ব কল্পজগৎ যেখানে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ| শহরতলীর অমলিন পরিপার্শ্ব নীলকে স্বপ্নালু করে তোলে৷ ইচ্ছেডানায় ভর করে তার পিয়াসী মন আশ্রয় খুঁজে নেয় আদিগন্ত শ্যামলিমার মধ্যে ৷ তখন থেকেই অ-রূপের মধ্যে রূপের সন্ধান সে পেতে শুরু করে ৷ কলেজ জীবনে রসায়নে রস না পেলেও নীলের জীবন রসাস্বাদিত হয় বন্ধু-সঙ্গে৷ স্বভাব মিশুক নীল সহজ পরিচিতি লাভ করে সহাধ্যায়ীদের মধ্যে,জনপ্রিয় ও হয় ৷ খুঁজে পায় মিলিকে,যে শুধু তার পরম সুহৃদই নয়,একজন মরমী মানুষ,যে তার সংবেদনশীল মনকে ছুঁতে পারে ৷ নীলের বর্ণনায় মিলি যেন ‘এক টুকরো স্নিগ্ধ বাতাস’ যা উড়িয়ে নিয়ে যায় না,জ্বালা ধরায় না,বরং জুড়িয়ে দেয়,শমিত করে ৷ তখন থেকেই মিলি নীলের জীবনের তারগুলোকে সুরে বাঁধতে শুরু করে যার তাল,লয়,ছন্দ আর কখনই কাটেনি৷ এরপর থেকেই নীলের যাত্রা শুরু জীবনের উচ্চাবচ পথে৷
জ্যেষ্ঠ পুত্রের কৃত্যপালনের জন্য স্নাতক স্তরের পরেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে ৷ প্যাশনের সঙ্গে পেশার মেলবন্ধন ঘটেনি৷ নিয়তি-তাড়িত ফেরিওয়ালার বৃত্তি (ওষুধ কোম্পানীর) তাকে র্দীঘদিন ছুটিয়ে নিয়ে গেছে প্রান্ত থেকে প্রান্তে৷ আয়ত্ত করতে হয়েছে আপাদমস্তক পেশাদারিত্ব,পণ্য বিপণনের কূট কৌশল,কথোপকথনের বাণিজ্যিক আবেগবর্জিত প্রয়োগ| সবই সে করেছে অবলীলায়,কিন্তু অক্লেশে নয় ৷ তার স্পর্শকাতর মন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে নামী বহুজাতিক সংস্থাগুলির অন্তর্জগতের মালিন্যে, ক্লেদাক্ত হয়েছে কিছু চিকিৎসকের আগ্রাসী লোলুপ মানসিকতায় ৷ নীল কোন অসততার সঙ্গে আপস না করে নিজের শ্রম ও একাগ্রতা দিয়ে কাজ করে গেছে,নিজের মানসলোককেও দীর্ণ হতে দেয় নি ৷ বহু অভিজ্ঞতায় সে জানে পেশায় টিঁকে থাকতে গেলে কতটা গ্রহণীয় আর কতটা বর্জনীয়৷ পেশার সঙ্গে ভ্রামণিকের চরিত্রকে মিলিয়ে সে নিত্য নতুন মানুষ,জীবন,প্রকৃতি দেখেছে ৷ চলার পথে মিলেছে আরও কত বন্ধু আত্মজন৷
ততদিনে পরম বন্ধু মিলি তার জীবনের দোসর হয়ে তার আলো দিয়ে,ছায়া দিয়ে,প্রলেপ দিয়ে শুশ্রূষা করেছে নীলের মনের ক্ষতস্থান ৷ পত্নীর কর্তব্যের সঙ্গে বন্ধুর সহমর্মিতার এক যুগলবন্দী ওদের জীবন ৷ এসে গেছে তিস্তা ও রোদ্দুর৷ স্রোতস্বিনী তিস্তা আর আলোকিত রোদ্দুরকে নিয়ে খুশিমাখা সংসার নীলের৷
নীল এই পর্যায়ে একজন আপাত সফল মানুষ ৷ তার নিজের কথায় ‘উন্নতির অর্থ উত্তরণ’| সাধারণত: উন্নতির মাপকাঠি আর্থিক সাফল্যের নিরিখে দেখা হলেও উত্তরণ বড় কঠিন| নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিযোগীতা| ভেতরের ‘আমিকে’ প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করা৷ ঘোরতর বৃত্তিনির্ভর জীবনে নিজেকে আদ্যন্ত নিষ্কলুষ রেখে,সরসতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে,মানবিক,বৌদ্ধিক জগৎকে সমৃদ্ধ রেখে নিজেকেই ছাপিয়ে যাওয়া ৷ নীল তা করে গেছে সাবলীল ভাবে,কিন্তু গ্লানিমুক্ত হতে পারে নি৷ কর্পোরেট দুনিয়ার ইঁদুর দৌড়,বাজার গ্রাস করার অস্বাস্থ্যকর লড়াই,ঊর্ধতনকে খুশি করার মরিয়া প্রয়াস~তার অন্তরের কবিকে রক্তাক্ত করেছে ৷ সে চাকরি ছাড়ে-ব্যর্থ অবসাদগ্রস্ত হয়ে নয়,সার্থকতার সঙ্গে জীবিকার প্রতিটি ধাপে অবদান রেখে ৷ নীলের নিজের কথায়-‘নীল হারতে জানে না’|
নীল এখন মানসিক দোলাচলে৷ পারিবারিক,দায়িত্বশীল মানুষ হিসাবে যখন তার স্থিত হবার কথা তখন সে নতুন কিছু করার কথা ভাবছে৷ পরিবার বা পরিচিত গন্ডীর মধ্যে এক্ষেত্রে এক ধরনের সংশয়,সংকোচ এবং তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাই স্বাভাবিক~যাতে নীল আলোড়িত হয়৷ সে এক বন্ধুর সঙ্গে ডিস্ট্রিবিউটরশিপের ব্যবসায়ে নামে এবং অচিরেই বোঝে,সে দিকভ্রষ্ট৷ সে আবার ফেরে তার পরিচিত বৃত্তে যেখানে সে অভিজ্ঞতাঋদ্ধ৷ তার প্রশ্নাতীত দক্ষতার কারণে নামী বহুজাতিক কোম্পানী গুলি তাকে সাদরে গ্রহণ করে৷ এবার সে অনেকটা আত্মস্থ৷ বহুবারের বিদেশ ভ্রমণে সে জীবনের অদর্শিত,অজানিত সারণীগুলোতে পা রেখেছে৷ দীর্ঘ চাকরি জীবনে স্বক্ষেত্রে সে একজন বিশেষজ্ঞ| এই জগতের গোলকধাঁধা,আলো আঁধারি সবই তার নখদর্পণে৷ কলকাতায় নতুন আবাসন,সখাসম্মিত গৃহিণী,সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় সাফল্য,বন্ধু সান্নিধ্য,অর্থ কৌলিন্য-নীল এখন লব্ধপ্রতিষ্ঠ,স্থিতপ্রজ্ঞ|
নীলের মাতৃজগৎ কিছুটা অস্পষ্ট,ধোঁয়াটে৷ মা শিক্ষিতা ছিলেন। তারপরেই তিনি আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেন৷ একজন সংসারী মানুষ কি কারণে সংসারের প্রতি এতটা নিরাবেগ,নিস্পৃহ হন~তা প্রচ্ছন্ন-কিন্তু তার অভিঘাত নীলের জীবনে বড় মর্মান্তিক৷ সন্তানের সাফল্য মা সর্বাগ্রে আবেগবিহ্বল ও অংশভাক হন৷ নীল,মাকে তার সাফল্যের ভাগীদার করা তো দূরের,কণামাত্র ছোঁয়াতেও পারে নি৷
তবু ‘সুখ যারে কয় সকল জনে’ তা নীলের অধিগত৷ কিন্তু কিসের আর্তি তার জীবনে? কিসের হাহাকার? কেন সে ভাবে জীবনের মাইলস্টোন গুলো ঠিক কী কী? লেখক নীলের চরিত্রচিত্রণ করতে গিয়ে ঠিক এই প্রশ্নগুলিতেই তাকে গড়পড়তা মানুষের থেকে পৃথক করে এঁকেছেন৷ সর্বার্থে সার্থক কেউই নয়,যা কাম্য তার অনেকটাই মানুষের অধরা কিন্তু জীবনের সোপানগুলোকে মসৃণ করতে গেলে যা লাগে নীল তা অর্জন করেছে নিজ আয়াসে,অধ্যবসায়ে৷ ফেরিওয়ালার বৃত্তিতে সে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে কিন্তু নিজের মানসক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য তেমন কিছুই করে ওঠবার অবকাশ পায় নি৷ সে মনফকিরা৷ অবশেষে লেখক সুবিচার করেছেন তার ওপর৷ যে বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতাগুলোকে সে লালন করেছে,জারিত করেছে,দিনের পর দিন যে স্বপ্ন সে দেখে এসেছে,যে আবেগকে নিরুদ্ধ রেখেছে-এবার তাদের মুক্তির সময়৷
নীল কলম ধরে৷ শৃঙ্খলিত ছন্দের স্রোতকে খুলে দেয়৷ মরুখাত শ্যামলিম হয়,পুষ্পল হয়৷ জীবনে নীল দিশা পায়৷ ফেরিওয়ালার জীবিকায় সে প্রত্যুপহার পেয়েছে স্ট্রেস ডিসঅর্ডার যা তার শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ওপর যথেষ্ট কুপ্রভাব ফেলেছে৷ যা আদৌ চিকিৎসা সিদ্ধ নয়৷ নীলকন্ঠ ফেরিওয়ালা তাকেও গ্রহণ করেছে পরম ঔদাসীন্যে ৷ সে জানে,’সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে’|
পরিশেষে নামী প্রকাশনা সংস্থা গাঙচিল থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদচিত্র চোখকে আরাম দেয়৷ মলাট,বাঁধাই ও মুদ্রণ ত্রুটিহীন | মুদ্রণ প্রমাদ প্রায় নেই বললেই চলে৷ লেখকের এটি প্রথম গদ্য রচনা। বেশ অনাড়ষ্ট ঝরঝরে লেখন৷ দু একটি বাক্য পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট৷ কালানুক্রমের অভাব চোখে পড়ে৷ নীলের চরিত্র হয়তো লেখকের নিজেরই জীবন ছায়া কারণ পূঃ ৫৮ ও পূঃ ১১৪ তে হঠাৎ উত্তম পুরুষের ব্যবহারে মনে হয় লেখক তার আবেগকে সংযত করতে পারেনি,সেক্ষেত্রে পুরোটাই উত্তমপুরুষে লেখা হলে গদ্যটি বৃহত্তর মাত্রা পেতে পারতো৷ বইটি উৎসর্গীকৃত বিক্রয় প্রতিনিধি ভাইবোনেদের উদ্দেশ্যে৷
নীলেরই মতো অসংখ্য ফেরিওয়ালা যারা স্বপ্নদর্শী কিন্তু পেশার নিষ্পেষণে যাদের স্বপ্নগুলো হারিয়ে যাচ্ছে,তলিয়ে যাচ্ছে,নীলের মধ্য দিয়ে লেখক তাদের বার্তা দিতে চেয়েছেন-‘যে পারে সে আপনি পারে,পারে সে ফুল ফোটাতে’।।
*******************************************************
ডঃ পর্ণশবরী ভট্টাচার্য্য পরিচিতিঃ
এসোসিয়েট প্রফেসর, ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন (কলেজ),কলকাতা