শ্রদ্ধার্ঘ্য
মুনমুন রায়
কিছু অজানা কথা
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি “বন্দেমাতরম “। শ্রদ্ধার্ঘ্য …………. (জন্ম :২৭ শে জুন ১৮৩৮ তিরোধান: ৮ই এপ্রিল ১৮৯৪ )।
“বন্দেমাতরম” সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা শুধু একটি সঙ্গীত নয়, এটি ভারত আত্মার কথা।এই সঙ্গীত ভারতবাসীর পঞ্চকোষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পর্কিত। এই পঞ্চকোষের প্রথম কোষ “বন্দেমাতরম” সঙ্গীতের প্রথম দুই লাইনে পাই “অন্নময় কোষ”। তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ লাইনে পাই “আনন্দময় কোষ”।,”সপ্তম থেকে একাদশ লাইনে পাই “প্রাণময় কোষ”। দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ লাইনে পাই “মনোময় কোষ” এবং বাকি শেষ অংশে পাই “বিজ্ঞানময় কোষ”। এই কারনে “বন্দেমাতরম” ভারতবাসীর অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৯৪ সালে ৮ই এপ্রিল মৃত্যু শয্যায় উপস্থিত তার মেয়েকে “বন্দেমাতরম” সম্পর্কে বলেছিলেন “দেখবি এই সঙ্গীত একদিন ভারতবাসীর অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে।” সাহিত্য সম্রাটের সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভবিষৎবাণী পরবর্তীকালে মিলে গিয়ে ছিল। “বন্দেমাতরম” এর ইতিহাস আজকের প্রজন্মের কাছে অজানা। কারণ তাদের জানতে দেওয়া হয়নি ইচ্ছাকৃত ভাবে ও উদ্দ্যেশ্য প্রণোদিত ভাবে। এবার দেখে নেওয়া যাক “বন্দেমাতরম” সঙ্গীতের ইতিহাস।
(বন্দেমাতরম ভবন জোড়াঘাট, চুঁচুড়া। এই ঘরে বসেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দেমাতরম’ রচনা করেন।)
সাহিত্য সম্রাট ১৮৭৬ সালে “বন্দেমাতরম” নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেও ১৮৮২ সালে উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অবলম্বনে তার “আনন্দমঠ” উপন্যাসে “বন্দেমাতরম” কে অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম সুরারোপিত করেন “যদু ভট্ট”। বিংশ শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত বন্দেমাতরম এর উপর ১০৭ বার সুরারোপিত হয়েছে । প্রথম যদু ভট্ট এবং শেষ এ.আর.রহমান। এর মাঝে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর সুর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “বন্দেমাতরম” আজও প্রত্যেক ভারতবাসীর রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ২০০২ সালে বি বি সি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০টি সঙ্গীতের মধ্যে এ আর রহমানের গাওয়া “বন্দেমাতরম” দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হয়।
(ছবি সৌজন্যে দেবলীনা সরকার)
(বন্দেমাতরম ভবনের ঘরের ভিতর থেকে নেওয়া ছবি, জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রবহমান গঙ্গা। এই ঘরের ভিতরেই সাহিত্য সম্রাট রচনা করেছিলেন “বন্দেমাতরম”।)
১৮৯৬ সালে কলকাতার বিডন স্কোয়ারে জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম রাজনৈতিক মঞ্চে “বন্দেমাতরম” সংগীতটি পরিবেশন করেন। ১৯০১ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে দক্ষিণাচরণ সেন “বন্দেমাতরম” পরিবেশন করেন। ১৯০৫ সালে কংগ্রেসের বারাণসী অধিবেশনে সরলা দেবীচৌধুরানী “বন্দেমাতরম” পরিবেশন করেন। এই সময় পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। সমস্যা শুরু হলো এর পরেই। একাধিক মুসলিম সংগঠন “বন্দেমাতরম” গাওয়ার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করলেন এই বলে যে, ভারতমাতার বন্দনাগীতি এই গানটির মূলভাবনা ইসলাম-নিষিদ্ধ পৌত্তলিকতার অনুসরণ করে। তাই তারা “বন্দেমাতরম” গাওয়ার বিরোধিতা করলেন। কারণ এই গানে দেশ মাতৃকাকে দেবী দুর্গার রূপে বন্দনা করা হয়েছে। তদানীন্তন রাষ্ট্র নায়কেরা মুসলিম সংগঠন দের এই দাবিকে মেনে নিয়ে দেশ ভাগের আগে “বন্দেমাতরম” কে প্রথম খণ্ডিত করেছিলেন। “বন্দেমাতরম” সঙ্গীতটি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে সমাপ্তি সঙ্গীত হিসেবে ব্যাবহ্রিত হয়। শ্রী অরবিন্দ “বন্দেমাতরম” গানটির ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন এবং উনি “বন্দেমাতরম” গানটিকে “National Anthem of Bengal” নামে অভিহিত করেছিলেন। “বন্দেমাতরম” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জাতীয় ধ্বনিতে পরিণত হয়ে ছিল। বৃটিশ সরকার বিরক্ত হয়ে জনসমক্ষে “বন্দেমাতরম” ধ্বনি নিষিদ্ধ করেছিল। মাতঙ্গিনী হাজরা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার সময় “বন্দেমাতরম” উচ্চারন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার (ডাক্তারজী) স্কুল থেকে বিতাড়িত হন শুধু মাত্র ব্রিটিশ স্কুল ইন্সপেক্টরের সামনে “বন্দেমাতরম” ধ্বনি দেওয়ার জন্য। “বন্দেমাতরম”, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সংমিশ্রণে লিখেছিলেন। এটি ছিল ভারত মায়ের বন্দনা গীতি। ১৯০৭ সালে ভিখাজী কামা ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার যে রূপ দান করেছিলেন সেই পতাকার মাঝখানে দেবনাগরী হরফে “বন্দেমাতরম” শব্দটি লেখা ছিলো। ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে” ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা লাভ করলে “বন্দেমাতরম” সঙ্গীতটিকে সমমর্যাদায় ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় স্তোত্রের সম্মান দেওয়া হয়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি “বন্দেমাতরম” কে আমরা বার বার স্মরন করি এবং তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম। ******************************************
মুনমুন রায় পরিচিতি – অধ্যাপিকা, সঙ্গীতজ্ঞা,
সঙ্গীতশিল্পী এবং লেখিকা।
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা,ভালো লাগলো
সমৃদ্ধ হলাম
অসাধারণ ব্যাখ্যা।