দ্বীপভূমি ময়নাগড়
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য
সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে। আরো বেশী করে ভাগ্যবান কারণ এই দেশের মধ্যে আবার বাংলায় জন্মগ্রহণ করার জন্য। বাংলাকে আমরা মা বলে ডাকি। নদীর ধার, সবুজ ধানের ক্ষেত, বাউলের গান, পাহাড়ের ডাক, বার মাসের তেরোপার্বণ নিয়ে আনন্দে মেতে থাকি আমরা। তাই বাংলায় ঘুরে বেড়িয়ে সবচেয়ে বেশী মজা পাই।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বেড়ানোর মজাই আলাদা। আর সে বেড়ানো যদি হয় জল, জঙ্গল, পরিখা, আর দ্বীপের মধ্যে তাহলে তো কেয়া বাত। না না আন্দামান নয়, আমাদের রাজ্যেই রয়েছে এক চমৎকার দ্বীপভূমি যার সন্ধান অনেকেরই অজানা। আমাদের খেয়ালই থাকে না যে আমাদের রাজ্য কত সুন্দর কেবল একটু খুঁজে ঘুরে বেড়ানো।
তাই খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে পৌঁছালাম পূর্ব মেদিনীপুরের এক সুপ্রাচীন পুণ্যভূমি ময়নাগড়ে। গড় বা কেল্লা বলতে বিরাট বিরাট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা অঞ্চল বোঝালেও এই ময়নাগড় তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক। কারণ এই ময়নাগড় ঘেরা রয়েছে বিরাট বিরাট পরিখা দিয়ে যে পরিখায় একসময় ছাড়া থাকত বড় বড় কুমীর।
না কোন রূপকথা নয়, কোন বানানো গল্পও নয়। ময়নাগড়ের একদম কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি দ্বীপ। এই দ্বীপই ভিতরগড় যেখানে বাস করতেন রাজা। সেই কারণে এখানে প্রাসাদ, মন্দির প্রভৃতি তৈরি হয়েছিল।
দীর্ঘ ইতিহাসে প্রবেশ করার আগে চোখ আটকে গেল তোরণ দ্বারে যেখানে লেখা রয়েছে ময়নাগড়, বৈষ্ণব,শাক্ত,শৈব মূল ভূখন্ড।
তোরণদ্বার পেরিয়ে লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে। পাশ দিয়ে কালিদহ ও মাকড়দহ নামক দুটি পরিখা। খানিকটা এগুতেই একটি ছোট ডিঙি বাঁধা রয়েছে দেখলাম। ইতি উতি চাইছি হঠাৎ খেটো ধুতি পড়া এক বয়স্ক মাঝি এসে উপস্থিত। আমাদের বলল পরিখা ঘুরিয়ে, রাজার বাড়ি ঘুরিয়ে এইখানে এনে নামিয়ে দেবে তার জন্য লাগবে একশ টাকা। অগত্যা টাল খেতে খেতে ডিঙিতে উঠে বসা গেল। মাঝি দাদার নাম রূপিন। ডিঙি চলল লগি ঠেলে ঠেলে আর দাদা বলতে লাগল এই দ্বীপভূমির কথা। ডিঙির মাথায় কোন আচ্ছাদন নেই, থাকার কথাও নয় অথচ আকাশের মুখ ভার, আজ বেশ গুমোট, যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি এসে যেতে পারে। ও সব আশঙ্কা এক লহমায় কোথায় চলে গেল যখন গল্পের ঠাস বুনোটের মধ্যে ঢুকে গেলাম। বর্তমান এই দ্বীপটির আয়তন ১২.৯১ একর। দ্বীপটিকে ঘিরে রয়েছে দেড়শো ফুট চওড়া ও প্রায় ৩০০০ ফুট পরিধি বেষ্টিত একটি পরিখা। আগে এই পরিখায় ছাড়া থাকত অসংখ্য কুমীর আর পরিখার ধার ধরে ভিতরগড়ে ছিল বাঁশবন। যার ফলে দূর থেকে ছোঁড়া তীর বা গোলাগুলি সবই আটকে যেত বাঁশের জঙ্গলে। এক দুর্ভেদ্য গড় ছিল ময়নাগড়।
এই পরিখার ধার থেকে দুশো মিটার দূরে আর একটি দেড়শো ফুট চওড়া ও ৬০০০ ফুট পরিধি বিস্তৃত একটি পরিখা ছিল। মাঝের এই ভূমিটিকে বলা হত বাহিরগড়। এখানে রাজার সেনাবাহিনীর লোকজন, অন্যান্য কর্মচারী ও পাত্রমিত্রদের বাসস্থান ছিল। দ্বিতীয় পরিখাকে ঘিরে আর একটি তৃতীয় পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল এই গড়। পরিখা কাটার মাটি দিয়ে ভিতরগড় ও বাহিরগড়ের স্থলভূমি তৈরি হয়েছিল। অগ্নিকোণে ছিল বাহিরগড় প্রবেশের মূল দ্বার যা এখনও আছে। তৃতীয় পরিখার অস্তিত্ব এখন আর নেই, নেই পরিখাতে ছাড়া কুমীর। আছে কালিদহ ও মাকড়দহ নামে দুটি পরিখা। এই ময়না দ্বীপভূমিকে উত্তর ও পূর্বে ঘিরে রেখেছে কাঁসাই নদী। দক্ষিণে কেলেঘাই ও পশ্চিমে চন্ডীয়া নদী। বর্তমানে পুরো ময়না দ্বীপটাই হল ময়না ব্লক। আর ময়নাগড় বর্তমানে হয়েছে গড়ময়না, স্থানীয়রা বলেন গড় সাফাত। গড়ময়না এখন স্কুল, কলেজ, অফিস নিয়ে বেশ বড়সড় গঞ্জ।
অতীতের দিকে ফিরলে জানা যায়, বৌদ্ধ নরপতি মহাবীর লাউসেনের রাজধানী ছিল এই ময়নাগড়। তার আগে নবম শতাব্দীতে ময়নাগড়ের রাজা ছিলেন কর্ণসেন। তাঁর সময়ে বীরভূম জেলার অজয় নদের ধারে ঢেঁকুর রাজ্যের সামন্ত গোপ রাজা ছিলেন ইছাই ঘোষ।
মহাশক্তিশালী ইছাই ঘোষ ছিলেন দেবী ভবানীর বরপুত্র। তিনি কর্ণসেনকে পরাজিত করে ময়নগড় দখল করে নেন। যুদ্ধে কর্ণসেনের ছয় পুত্র মারা গেলে শোকে তাঁর স্ত্রীও মারা যান। কর্ণসেন এই সময় আশ্রয় নেন গৌড়ের রাজা মতান্তরে দন্ডভুক্তির রাজা ধর্মপালের কাছে। কথিত যে, রাজা ধর্মপাল তার শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে কর্ণসেনের বিয়ে দেন। ধর্মদেবের উপাসিকা রঞ্জাবতী একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন ধর্মঠাকুরের দয়ায়। এই ধর্মের বরপুত্র লাউসেন বড় হয়ে ইছাই ঘোষকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করেন। লাউসেন পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করে ময়নাগড়েই আবার রাজধানী স্থাপন করেন। লাউসেনের বীরত্বের কাহিনী “ধর্মমঙ্গল কাব্যে” বর্ণিত আছে। ময়নাগড় ধর্মপূজার পীঠস্থান হিসাবে চিহ্নিত ছিল কারণ মানুষের বিশ্বাস, ময়নার কাছে বৃন্দাবনচকে যে প্রাচীন ধর্মঠাকুর আছেন তা লাউসেনের প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া, ময়নাগড়ের মধ্যে যে “রঙ্কিণী কালী” ও “লোকেশ্বর শিব” লাউসেনের প্রতিষ্ঠিত বলে অনেকের ধারণা।
বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে মাঝি দাদা দূরে ডানদিকে আঙ্গুল তুলে বলে,ওই দ্যাখেন,নয়নানন্দ দেব গোস্বামী মহন্তর সমাধি মন্দির,উড়িষ্যা থেকে এসেছিলেন বৈষ্ণব রাজবাড়ীর কুলোপুরোহিত। সমাধি মন্দিরটি বেশ সুন্দর, দ্বীপভূমির বুকে যেন এক টুকরো স্থির ছবি। আর একটু এগিয়ে রয়েছে পীর হায়দারের দরগা, রাজা জগদানন্দের আহ্বানে তিনি এখানে এসে ডেরা বেঁধেছিলেন। বাঁদিকে গভীর ঘন জঙ্গল, জঙ্গলের মাঝে চাপা পড়ে গেছে নানা ঘাট যেমন আয়নামহল, সওয়ারী মহল, পুজোর ঘাট, রাজ ঘাট ইত্যাদি। আবার গল্প বলা শুরু হল।
মধ্য যুগে উৎকল সাম্রাজ্যের জলৌতি দন্ডপাটের অন্যতম ছিল “ময়না”। ময়নায় গোবর্ধনানন্দ ১৫৬২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। গোবর্ধনানন্দর সংগীত প্রতিভা ও ক্ষিপ্ত পাঠহস্তীকে বশীভূত করার জন্য উৎকল নৃপতি তাঁকে রাজা,আনন্দ,বাহুবলীন্দ্র উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বাহুবলীন্দ্র বংশের প্রথম পুরুষ কালিন্দীরাম সামন্ত বালিসীতা গড়ে ১৪৩৪ খ্রীষ্টাব্দে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই বংশের জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্র স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন অগ্রগণ্য সেনানী ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের লেফটেন্যান্ট “বেইল” কেল্লা ময়নাচৌরার দখল নিয়েছিলেন ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দের ২০শে ফ্রেবুয়ারি। জগদানন্দ সেইসময় রাজ্যচ্যুত হন কিন্তু ব্রিটিশরা কখনও তাঁকে বন্দি করতে পারে নি। সেই থেকে আজ অবধি বাহুবলীন্দ্র বংশধররা এই ভূখন্ডের ভিতরগড়ে রয়েছেন।
আস্তে আস্তে ডিঙ্গি ঘাটে এসে থামে। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে ভিতরগড়ে ঢুকলাম। মাঝিদাদার মুখে শুনলাম জগন্নাথ মন্দির, খাস দরবার, কামানপোতা, ভূগর্ভস্থ হর্ম্যরাজি, গুপ্ত সুড়ঙ্গপথ সবই চলে গেছে কালের গর্ভে। রয়ে গেছে বাহুবলীন্দ্রদের ঘর বাড়ি, প্রাচীন ধবংসস্তুপ আর রাজপরিবারের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জীউর মন্দির। আমরা এখন সেই দক্ষিণমুখী পঞ্চরত্ন মন্দিরের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি। বর্তমানে শ্যামসুন্দরের কপালেই রাজতিলক আঁকা হয়। প্রায় ২৩ ফুট উচ্চতার মন্দিরের ভিতরে শ্যামসুন্দর জীউ। অনিন্দ্যসুন্দর মূর্তি, চোখ ফেরানো যায় না। সঙ্গে রয়েছেন গৌড় নিতাই, শালগ্রাম শিলা ও রাজরাজেশ্বর। অবাক হয়ে অতীতের কথা ভাবছিলাম। রাজপরিবারের কুলদেবতা যদিও স্বমহিমায় বিরাজিত তবুও কি এক বিশাল শূন্যতা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। এই শূন্যতা অবশ্য পূর্ণ হয়ে ওঠে রাসপূর্ণিমার সময়। প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমায় রাসযাত্রা উপলক্ষে ময়নাগড়ে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। বাহিরগড়ের পরে গড়সাফাতে রয়েছে সুন্দর রাসমঞ্চ। পূর্ণিমা ও তারপরেও কদিন নৌকায় করে ব্যান্ড বাদ্যি বাজিয়ে শোভাযাত্রা সহকারে রাসমঞ্চে আসেন শ্যামসুন্দর জীউ। নৌকাগুলো আলোর রোশনাইয়ে ভরে যায়। সুসজ্জিত নৌকার আলোয় পরিখার জল রঙিন হয়ে ওঠে। আকাশে ওঠে রঙিন ফানুস। সারা ভারতে আর কোথাও কৃষ্ণ ভগবান এরকম নৌকায় করে রাসমঞ্চে যান না। এটি একটি বিরল অভিজ্ঞতা। পুরো এলাকাটি শ্যামসুন্দরের জয়ধ্বনি ও বাজনার আওয়াজে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছায়।
এক কল্পলোকে চলে গেছিলাম। গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা আর রূপিন দাদার ডাকে সম্বিত ফিরল। সে তাড়া দিয়ে বলে- চলেন চলেন, ওই দিকে রয়েছে লোকেশ্বর শিবের মন্দির। ২৬ ফুট উচ্চতার মন্দিরটির আটচালা বেশ অভিনব। লোকেশ্বর শিব অবস্থান করছেন একটি গর্তের মধ্যে। গর্তটি জলে ভরা। এটি কেবল সম্ভব হয় বর্ষাকালে। গুপ্তপথে নদী থেকে জল এসে শিবকে ডুবিয়ে রাখে। মন্দিরে বেশকিছু টেরাকোটার কাজ রয়েছে যেমন বিদেশীদের শিকারযাত্রা, নৌবহর ইত্যাদি।
রাসের সময় এখানে যে মেলাটি হয় সেটি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অন্যতম মেলা। এই মেলার অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে যেটি বিখ্যাত সেটি হল কদমা। ছোট থেকে ফুটবলের মাপের কদমাও তৈরি হয় যার স্বাদ জগতবিখ্যাত। রূপিন দাদা বারবার অনুরোধ জানালেন রাস পূর্ণিমায় যাবার জন্য। তাঁকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বাড়ির পথ ধরলাম।
হাওড়া থেকে খড়গপুর লাইনে “মেচেদা” রেলস্টেশন আর সেখান থেকে বাসে ময়নাগড় যাওয়া যায়।।
শক্তিপদ ভট্টাচার্য
ইতিহাসের শিক্ষক, প্রিয় বিষয় ভ্রমণ, পঞ্চাশটিরও বেশী পত্র পত্রিকায় লেখালিখি করেছেন , মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যা বারো, ভ্রমণ আড্ডা পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য।