আলোকের এই ঝর্ণাধারায়
অনসূয়া সরকার বিশ্বাস
(১)
সকাল থেকেই মাথাটা ভার হয়ে আছে শ্রীলেখার। কেমন যেন একটা গুমোট লাগছে। জানালার পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বাগানে গন্ধরাজ গাছটার দিকে। ফুলে ফুলে ভরে গেছে গাছটা। সন্ধ্যে হলেই সুন্দর গন্ধে চারদিকটা ভরে যায়। এই গাছটা টিডো আর শ্রীলেখা একসঙ্গে লাগিয়েছিল। মাঝে মাঝে বড্ড নিঃসঙ্গ মনে হয়। কে আছে তার টিডো ছাড়া? দেবাশীষ চলে যাবার পর ওই তো তার শিবরাত্রির সলতে। অদ্ভুত শীতল সম্পর্ক তাদের মা ছেলের। অথচ ছোটবেলায় কি ন্যাওটাই না ছিল টিডো ! আর আজ ! হাজার চেষ্টা করেও দশ বছর ধরে এই দুর্লঙ্ঘ্য্ সীমারেখা অতিক্রম করতে পারেনি শ্রীলেখা। ক্লাস নাইন থেকেই বাইরে পড়া শুরু করলো। কাছ ছাড়া করতে মন চাইতো না। কিন্তু ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মৌন থেকেছে। ছুটিছাটায় যা একটু বাড়ি আসে তাও একটা অদৃশ্য প্রাচীর বজায় রেখে। ফোনে কথা বলতে গেলেও তীব্র শীতলতা অনুভূত হয় কণ্ঠস্বরে। খুব অভিমান হয় শ্রীলেখার। টিডো মুম্বাই আই. আই .টি থেকে এম. টেক কমপ্লিট করে, নামী বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে আসীন।
সম্প্রতি কোভিড 19 এর মারণ থাবা আর লক ডাউনের জেরে টিডো মুম্বাই থেকে বাড়ি ফিরে, “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” কর্মসংস্কৃতি তে ব্যস্ত। তাতেই বা কী! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে এই যা! আজই তো, মনের মত কয়েক পদ রেঁধে, সাজিয়ে দুপুরে দিয়েছিল… এক দুটো পদ নাড়াচাড়া করে উঠে গেলো। হঠাৎ মোবাইলের স্ক্রীনে ভেসে ওঠে মিমির নম্বর। স্মিত হাসিতে ভরে যায় শ্রীলেখার মুখ। সেই ছোট্ট থেকে টিডো আর মিমি বন্ধু। দুটিতে যেমন ভাব তেমনি খুনসুটি। এ পাড়াতেই থাকে মিমি। দত্ত বাড়ির মেয়ে। সুমতি এসে জিজ্ঞেস করে, “দিদি সন্ধ্যে দেবেনা, চা বসিয়েছি যে!” “তুই ময়দাটা মাখ। আমি আসছি।” চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে।
(২)
চুপ করে শুয়ে আছে শ্রীলেখা। সুমতি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সামনের সোফায় টিডো মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সুমতি আপন মনে বক্তৃতা দিয়ে যায়। তার কথার জেরে বুঝতে পারে প্রেসার বাড়িয়ে সে এক মহা বিপত্তি ঘটিয়ে ছিল, টিডো না থাকলে এ যাত্রা রক্ষা পেতোনা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রীলেখা। বড়-ই হয়ে গেলো ছেলেটা। একদম দেবাশীষের আদল। হঠাৎই টিডো মৌনতা ভেঙে একটা ওষুধের স্ট্রিপ এগিয়ে দিয়ে বলে, “এখনি খেয়ে নাও”। সামনের টেবিল থেকে জলের বোতলটা নেবার জন্য একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে শ্রীলেখা, মাথাটা আবার ঝিমঝিম করে ওঠে। ধপ্ করে ধরে নিয়ে জোরসে ধমক লাগায় টিডো “একটা মাইল্ড অ্যাটাক হতে যাচ্ছিল। কি হতো বলতো? তোমার কি কোন কান্ডজ্ঞান নেই মা?” কোনো কথা কানে ঢোকেনা শ্রীলেখার। হা ঈশ্বর এই ডাকটা শোনার জন্য এতগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করছিল সে। হু হু করে কেঁদে ফেলে শ্রীলেখা।
(৩)
ছুটে এসে হাতটা ধরে টিডো বলে “কেঁদোনা মা। কত বলতে চেয়েছি আই অ্যাম সরি। পারিনি মা। মুম্বাইতে খুব কষ্ট হতো। তোমাকে খুব মিস করতাম মা”। জড়িয়ে ধরে ছেলেকে শ্রীলেখা বলে, “সরি কি রে মায়ের কাছে?” টিডো কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে “সেদিন অমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করা আমার উচিত হয়নি। আসলে তোমার মোবাইলে বিকাশ আঙ্কেলের এসএমএস গুলো আমি পড়ে ফেলেছিলাম”।
“জানি তো।” “তাই উনি যেদিন বাড়িতে এলেন আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে উল্টো পাল্টা বলে ফেলেছিলাম। আসলে তখন বাবার জায়গায় কাউকে বসানোর কথা ভাবতে পারিনি”।
“তুই কি রে! আমাকে খুলে বললিনা কেনো? এই জন্য এত অভিমান?”
“না মা সেদিনকার পর খালি মনে হতো আমি একটু উদার হলে, তুমি ভালো থাকতে। ওই লজ্জাতেই অস্বস্তি হতো”।
“তাছাড়া….”
“তাছাড়া কী? বল?”
দাদুন একদিন দিম্মা কে বলেছিল “ছেলেটার জন্যই শ্রী নতুন করে বিকাশের সাথে জীবন শুরু করতে পারলনা।”
“হ্যাঁরে, তোর বন্ধুরা এখনও বলে, সাদা শাড়ী পরে মাথায় পলাশ ফুল গুঁজে কবিতা-কবিতা ন্যাকামি করি! খারাপ লাগে তোর খুব!”
“না মা তুমি আবার লেখালিখি শুরু করো। আমার খুব গর্ব হয়। ট্রাস্ট মি। বিকাশ আঙ্কেলও খুব ভালো মা। তুমি নতুন করে ভাব মা, প্লিজ।”
“ধুর। তোর মাথাটা না গেছে পুরো।”
“সত্যি কি তোমার বিকাশ আঙ্কেলের প্রতি কিছু ছিলনা ?”
“প্রত্যেকটা মেয়েই, সে যতই স্বাধীনচেতা হোক, কারো প্রতি নির্ভর করতে চায়। আমিও ওর কাছে খুব শান্তি আর নির্ভরতা পেতাম। বন্ধুত্বও ছিল। ওর মনের কথা আমাকে জানিয়েও ছিল। সে তো কত বছর আগের কথা। এখন আর জলপাইগুড়িতেও নেই। মিষ্টি একটা বউ আছে। গুছিয়ে সংসার করছে। বুঝলি? কিন্তু এটা ঠিক, ও আমাকে খুব বুঝতো। সম্মানও করতো।”
“জানি মা। যেটা তুমি বাবার কাছে পাওনি।”
“আমার মনে আছে মা, বাবা তোমার লেখার ডায়রিটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। দু একবার গায়েও হাত ….”
“এসব ছাড় তো!”
“আমার একটাই আফসোস, আমার জন্য তুমি লেখালিখি ছেড়ে দিলে?”
“ওরে লেখাটা আমার বড্ড স্পর্শ কাতর জায়গা, ফার্স্ট প্রায়োরিটি কখনো তো দিইনি।”
“না মা, আমার স্পষ্ট মনে আছে বাবার রোড অ্যাকসিডেন্টে এক্সপায়ার হবার পর, আমরা দিনহাটার ঠাম্মার বাড়ি ছেড়ে দাদুর বাড়ি এলাম। তুমি এখানেই ট্রান্সফার নিয়ে জয়েন করলে, সব দিক সামলেও অল্প কদিনে তুমি খুব নাম করেছিলে। মাঝে মাঝেই বিভিন্ন সাহিত্যসভা, বৈঠকী আড্ডা, বইমেলার আমন্ত্রণ আসতো। তুমি একটু লাজুক ছিলে, যেতে চাইতেনা খুব একটা। রূপে, খ্যাতিতে এই শহরের মহিলামহলে ঈর্ষণীয় হয়ে উঠলে, ওই আর কী পারিপার্শ্বিক কুটকাচালি, কাছের মানুষদের ইন্ধন আমাকে প্রভাবিত করেছিল।
তুমিও টিন এজ ছেলের স্পর্শকাতর মনে যাতে কোনো আঘাত না আসে, তাই সবকিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিলে। “অভিমানেই তুমি আর লেখালিখি করোনা। আমি জানি। তুমি এখন এগুলো থেকে পুরোপুরি ডিটাচড।”
“হ্যাঁরে মিমির সাথে সেটেল কবে হবি বলতো? দত্তদার সাথে কথা বলি?”
“কথা ঘুরিও না মা।”
“তুই কি আজই যাচ্ছিস?”
“রাতের ফ্লাইটে। লক ডাউন উঠে, ফ্লাইট চালু হয়ে গেছে। যেতে ত হবেই।”
(৪)
ভোর হয়ে এসেছে। ঘুমটা অনেকক্ষন ভেঙে গেছে। পাশের সোফা কাম-বেডটাতে সুমতি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওকে আর ডাকতে ইচ্ছে করলোনা শ্রীলেখার। টেবিলের ঢাকা গ্লাসটা থেকে জল নিতে গিয়ে দেখে, ঝলমলে মোড়কে মোড়া একটা বই। মা, বাপি চলে যাবার পর এই দিনটি জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কবেই। আজ সকালে কে তাকে প্রিয় উপহার দিয়ে শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল? তা দেখার লোভ সামলাতে পারলনা শ্রীলেখা। যদিও আন্দাজ করতে পারছে….
গিফ্ট প্যাক করা বইটা বুকের কাছে নিয়ে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে আসে শ্রীলেখা। মোড়াটা টেনে বসে, ঝলমলে কাগজের মোড়ক সরাতেই আগ্নেয়গিরির বিদার অগ্ন্যুদগম বহুদিনের জমে থাকা কান্না অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে একমুঠো রোদ। কবি শ্রীলেখা সেনগুপ্ত বইটা খুলে একবার ঘ্রাণ নেয়। একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা –
শ্রীচরণেষু মা,
তুমি যখন এটা পাবে আমি তখন তোমার থেকে হাজার মাইল দূরে। তোমার জন্মদিনের উপহার। ডায়রিতে লুকিয়ে রাখা যে স্বপ্নগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলে, আলোর সামনে নিয়ে এলাম। অনেকবছর থেকেই ছুটিতে এসে তোমার অলক্ষ্যে এগুলোকে সংগ্রহ করাই ছিল আমার একমাত্র স্বপ্ন। ভেবেছিলাম বইমেলায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো। সরি মা, ফর এভরিথিং। প্রতি জন্মে যেনো তোমাকেই মা হিসেবে পাই।।
ইতি তোমার টিডো।
চোখ টা মুছে ফেলে শ্রীলেখা।
পুবের জানালা দিয়ে একটা মিঠে রোদ আসছে। জানালার ফাঁক দিয়ে একফালি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। অনেকদিনের পুরোনো ডায়রিটা কাছে টেনে নিয়ে অনেকদিন পর শ্রীলেখা লিখলো …
“আমরা প্রত্যেকেই একটা বন্ধু চাই, যে না-বলা কথা বুঝতে পারে, কোনো ভুল করে যাকে অকপটে সব বলা যায়…. যে আমাকে বোঝে আমার মত করে। এমন বন্ধু কেউ পাই, কেউ পাইনা কিন্তু খোঁজ চলে নিরন্তর। সেই বন্ধু যে স্বামী, প্রেমিক, স্ত্রী বা প্রেমিকার মধ্যে পেতে হবে এমন কে বলেছে? আমি খুব ভাগ্যবতী যে নিজের ছেলের মধ্যে সেই “বন্ধু” কে খুঁজে পেয়েছি।।
***********************************************
অনসূয়া সরকার বিশ্বাস পরিচিতি :
পেশায় সরকারী স্কুলের শিক্ষিকা। লেখালেখি করে মনের সুখ খুঁজে পান। যখনি সুযোগ পান, ডুব দেন রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, সুনীল থেকে শুরু করে সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, স্মরণজিতের অপূর্ব সৃষ্টিতে।।
চমৎকার ভাবে আলোকধারা তার ঝর্ণা ছড়িয়েছে…
Thank you.
Chomotkar
Thank you..
গল্পের বাঁধুনিটা বেশ ভালো লাগলো।
গল্পের বাঁধুনিটা বেশ । ভালো লাগলো।
Thank you
Thank you
Thank you
Thank you..
Thank you..
Thank you..