Shadow

ভালোবাসা – ননীগোপাল মহারাজ

                                                                                         
ভালোবাসা

   ননীগোপাল মহারাজ

বেলুড়মঠে স্বামীজীর নির্দেশে রাত চারটের সময় ঘন্টা বাজিয়ে সবাইকে জাগিয়ে দেওয়া হতো। সাধু ব্রহ্মচারীরা সবাই ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে এসে ঠাকুরঘরে ধ্যান জপ করতেন। তাঁর প্রখর শাসনে এই নিয়মের কোন নড়চড় হওয়ার উপায় ছিল না। স্বামীজী কঠোর নিয়ম করেছিলেন, যে সাধু বা ব্রহ্মচারী নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর ঘরে আসতে পারবে না, তাকে সেদিন বাইরে থেকে ভিক্ষা করে এনে খেতে হবে। সেদিন সে মঠে খেতে পাবে না। একদিন মহাপুরুষ মহারাজ স্বামী শিবানন্দ কোন কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর ঘরে আসতে পারলেন না। স্বামীজী তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “তারকদা (স্বামী শিবানন্দ, পূর্বাশ্রমের নাম ছিল তারক) আমরা একটা নিয়ম করেছি যে, নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর ঘরে এসে সাধন-ভজন না করতে পারলে তাকে সেদিন বাইরে ভিক্ষা করে খেতে হবে। শিবানন্দজী ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। স্বামীজী নীরবে সেই চলে যাওয়া দেখলেন। তারপর খাওয়ার সময় দেখা গেল স্বামীজী খাবার ঘরে আসেননি। অনেক সাধ্যসাধনা করেও তাঁকে খাওয়ানো গেলো না। সারাদিন তিনি অভুক্ত রইলেন। দিনের শেষে ভিক্ষা করে ফিরে এলেন স্বামী শিবানন্দজী। স্বামীজী ছুটে এসে তাঁকে ধরলেন। সাগ্রহে বললেন, “দেখি তারকদা, ভিক্ষা করে কি কি এনেছেন। আসুন আমরা দুই ভাই একসাথে এই ভিক্ষান্ন খাই। কতদিন মাধুকরীর অন্ন খাইনি”।  স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী বিবেকানন্দ একসাথে সেদিন ভিক্ষান্ন গ্রহণ করলেন।
আরেকদিন স্বামীজী নতুন সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীদের নিয়ে বেদান্ত পাঠ ও ব্যাখ্যা করছেন। বেদান্তের আলোচনায় স্বামীজী মগ্ন হয়ে গেছেন। এর মধ্যে স্বামী প্রেমানন্দ হইহই করে এসে বললেন, “সবাই চলো, ঠাকুরের আরতি করতে হবে।” বেদান্তের আলোচনায় এভাবে ব্যাঘাত ঘটায় স্বামীজীর বিশাল নয়ন প্রান্তে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল। তিনি তীব্রভাবে স্বামী প্রেমানন্দজীকে বললেন, “তুই কি ভেবেছিস? একটি ছবির সামনে সলতে পোড়া নাড়লেই শুধু তাঁর পূজো হয়? আর এখানে যেটা হচ্ছে সেটা তাঁর পূজো নয়?” স্বামীজি এরপর আরো কঠোর ভাষায় প্রেমানন্দজী কে তিরস্কার করতে লাগলেন। অবশেষে সান্ধ্যপূজার পর প্রেমানন্দজী কে কোথাও দেখা গেলোনা। যে স্বামীজী এতক্ষণ প্রেমানন্দজীকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন, তিনি শিশুর মত ব্যাকুল হয়ে উঠলেন প্রেমানন্দজী কে দেখার জন্য। ব্যাকুল হয়ে অবুঝের মত বিলাপ করতে লাগলেন, “ওরে বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল বাবুরাম) কোথায় গেল? সে কি আমার গালাগাল খেয়ে গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যা করল? একদিকে বাবুরাম মহারাজকে পাওয়া যাচ্ছে না, তার উপর স্বামীজী তাঁকে দেখার জন্য এরকম ছটফট করছেন। মঠের সাধু-ব্রহ্মচারীদের দিশাহারা অবস্থা। অবশেষে একজন দেখেন বাবুরাম মহারাজ ছাদের উপরে অন্ধকারের মধ্যে একা একা বসে আছেন। তাঁকে ধরে আনা হলো স্বামীজীর কাছে। স্বামীজী বাবুরাম মহারাজকে দেখতে পেয়েই ব্যাকুল হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবুরাম মহারাজ এভাবে স্বামীজীর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে কেঁদে ফেললেন। স্বামীজীরও চোখে জল। দুই গুরুভাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
একদিন লাটু মহারাজ (স্বামী অদ্ভুতানন্দজী) স্বামীজী কে বললেন, “তুমি এখন বিলেত থেকে এসেছো, মঠে কতো রকম নতুন নতুন নিয়ম করেছো, আমি ওসব মানতে পারব না। আমার মন এখনো ওরকম ঘড়ি ধরা হয়নি যে তুমি ঘন্টা বাজালেই আমি ধ্যানে বসে পড়বো। সুতরাং, আমি এখানে আর থাকবো না, আমি চললাম।“ স্বামীজী তখন তাঁর চলে যাবার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন। কিন্তু লাটু মহারাজ সত্যিই চলে যাচ্ছেন দেখে স্বামীজি ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দেখ লাটু, কতো নতুন ছেলেরা এখন মঠে যোগ দিচ্ছে। একটা নিয়মের মধ্যে না রাখলে এরা সব বিগড়ে যাবে। এসব নিয়ম-কানুন তোর জন্য নয়।” লাটু মহারাজ নিশ্চিন্ত হয়ে মঠে থেকে গেলেন।
বাঘা নামে একটি নেড়ি কুকুর মঠে থাকতো। স্বামীজীর সাথে তার ছিল ভালোবাসার সম্পর্ক। এক দিন কুকুরটি ঠাকুরের ভোগে মুখ দিয়ে ফেলায় মঠের সন্ন্যাসীরা তাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। স্বামীজী তখন মঠে ছিলেন না। তিনি সন্ধ্যায় মঠে ফিরে শুনলেন, সবাই মিলে বাঘাকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে গঙ্গার ওপারে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। এদিকে মঠ বাঘাকে ছাড়লেও বাঘা কিন্তু মঠকে ছাড়বার পাত্র নয়। সাধুরা তাকে গঙ্গা পার করে দিয়ে ফিরে গেলে বাঘাও কিছুক্ষণ বাদে আর একটি ফিরতি নৌকায় উঠে বসল। মাঝিরা তাকে নামাতে গেলে সে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে। অবশেষে নৌকার অন্য যাত্রীরা মাঝিদেরকে বলল, “কুকুরটা যখন কোন ক্ষতি করছেনা, চুপ করেই বসে আছে, তখন নিয়েই চলো ওকে।“ বাঘা এভাবে ফিরে এসে সারারাত বেলুড় মঠের আশেপাশেই লুকিয়ে লুকিয়ে রইল। বাঘা জানতো স্বামীজী ভোর হবার আগেই স্নানঘরে আসেন। সে সেখানে লুকিয়ে স্বামীজীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। স্বামীজি এলে বাঘা তাঁর পায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে কুঁইকুঁই করে কাঁদতে লাগলো। স্বামীজী বাঘাকে নিয়ে বেরিয়ে এসে মঠের সকলকে ডেকে বললেন, বাঘাকে আর এভাবে যেন কেউ তাড়িয়ে না দেয়। ও চিরদিন মঠেই থাকবে।“ তখন বাঘার আনন্দ দেখে কে। লেজ নাড়তে নাড়তে গর্বের সঙ্গে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাঘা ভৌ ভৌ করে আনন্দ করতে লাগল। বাঘার মৃত্যুর পর তার মৃতদেহটাকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হলো। পরের দিন দেখা গেল ভাটার টানে বাঘার নশ্বর দেহটি আবার মঠ-ভূমিতে ফিরে এসেছে। তখন বাঘার দেহ সসম্মানে মঠের জমিতেই সমাহিত করা হয়েছিল।।
রামকৃষ্ণ সংঘ নামক যে সংগঠনটি স্বামীজী তৈরি করেছিলেন সেই সংগঠনের ভিত্তি ছিল এই অকৃত্রিম ভালবাসা, পরস্পরের প্রতি নিখাদ টান। আর এই ভালোবাসার কারণ হলেন ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ। মঠের সবাই, সবকিছুই ঠাকুরের — এই বোধের সঞ্চার ঘটিয়ে স্বামীজী সকলকে দুর্নিবার ভালোবাসায় আবদ্ধ রেখেছিলেন। মঠের সাধুদেরকে তিনি বলতেন, “ঠাকুর যেমন আমাকে ভালোবাসতেন, আমি যেমন তোদেরকে ভালোবাসি, তোরাও তেমনি জগৎটাকে ভালবাস দেখি!“ স্বামীজি যেন ছিলেন এই ভালোবাসার মূর্তিমান বিগ্রহ। তিনি ভালোবাসা দিয়ে সংগঠন তৈরি করেছিলেন, ভালোবাসা দিয়ে সংগঠনকে শাসন করতেন, ভালোবাসা দিয়ে সংগঠন কে বেঁধে রেখেছিলেন।
**************************************************
ননীগোপাল মহারাজ (স্বামী দেবতত্ত্বানন্দ) – 
স্বামী দেবতত্ত্বানন্দ ১৯৯৯ সালের ১২-ই সেপ্টেম্বর স্বামী গহনানন্দজী মহারাজের উদ্যোগে রামকৃষ্ণ মিশনে যোগদান করেন। ঠিক দশ বছর পরে ২০০৯ সালে বেলুুড় মঠে স্বামী আত্মস্থানন্দজী মহারাজের শিষ্যত্ব ও সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথানুযায়ী বিভিন্ন সেবামূলক কাজ ছাড়াও ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোনে দীর্ঘ আঠারো মাস ত্রাণসেবা ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!