সমুদ্র জীবন
অরূপ কুমার সেনগুপ্ত
আমার সমুদ্র জীবনের ৩৫ বছরে যেমন অনেক সুন্দর মুহূর্ত্ত আছে, তেমনি কিছু কিছু ঘটনা আছে, যেগুলো সারাজীবনেও ভোলা যায় না। আমার জীবনের স্মরণীয় একটা রাত। সেই রাতে আমি তাকে খুব নিবিড় ভাবে কাছে পেয়েছি। তার বুকে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম। তার গন্ধ বুক ভরে নিয়েছি। তার স্বাদ আস্বাদন করেছি, তাকে পুরোপুরি ভাবে উপলব্ধি করেছি। সারাটা রাত তার বুকেই হাবুডুবু খেয়েছি। আশা করি বুঝতে পেরেছো, কে সে, যে আমাদের তার বুকের মধ্যে রেখেছিলো। হ্যাঁ সে হচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত মহাসমুদ্র।
দিনটা ছিল ২০ মার্চ ১৯৭৯ সাল। আমাদের জাহাজ M V Mandadevi গুজরাটের জামনগর বন্দর থেকে সিমেন্ট লোড করে দুবাই এর দিকে রওনা দিয়েছে। শান্ত সমুদ্র, জাহাজ খুব স্বাভাবিক ভাবেই সমুদ্রের বুক চিড়ে জল কেটে এগিয়ে চলেছে। জাহাজে খুবই স্বাভাবিক পরিস্থিতি। যে যার নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। একুশে মার্চ দুপুর বারোটার সময় জাহাজের ক্যাপ্টেন সেদিনের Mid day position chart এ plot করে জানালেন যে ETA (Expected time of Arrival) Pilotage Point হলো ২৩শে মার্চ, দুপুর ১২.৩০টায়। সেই সময় এত বিভিন্ন রকমের Modern Navigational Equipment ছিলো না। এখন যেমন আমরা সমুদ্রের মাঝখানে জাহাজ ঠিক কোন্ জায়গায় আছে প্রতিটি মুহূর্ত্তে তার অবস্থান পেয়ে যাই। কিন্তু ঐ সময়ে শুধু সেই অবস্থানটাই খালি পাওয়া যেত। দুপুর বারোটায় ও সন্ধ্যাবেলা সাতটা নাগাদ আমরা Sextant দিয়ে সূর্য ও তারার sight নিয়ে জাহাজের position বের করতাম, অবশ্যই যদি আকাশ মেঘে না ঢেকে থাকতো। যাইহোক এগুলো সব different types of navigation। এটা আমাদের আজকের গল্পের বিষয়বস্তু নয়। ২৩শে মার্চ বিকেল পাঁচটা নাগাদ হঠাৎ আমি Chief officer এর টেলিফোনে কল পেলাম কেবিনে। আমি তখন 3rd officer ছিলাম। Chief officer আমাকে জাহাজের Bridge (যেখান থেকে Ship Navigate করা হয়) এ আসতে বললেন। আমি তখন off duty ছিলাম, কিন্তু আমি সঙ্গে সঙ্গে Bridge-এ চলে এলাম। Bridge-এ এসেই মনে হল যেন জাহাজ একটু বেশি পরিমাণ ডান দিকে কাত হয়ে চলছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তৎপরতা শুরু হয়ে গেলো। ক্যাপ্টেন ও চলে এলেন Bridge-এ। জাহাজের এইরকম abnormal হয়ে যাওয়ার কারণ খোঁজা শুরু হয়ে গেলো। জাহাজে অনেক রকমের water ও oil tank থাকে। সবকয়টা tank এর measurement করা হল। কিন্তু কোথাও কোন রকম abnormality ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু জাহাজ ক্রমশ Starlord side এ list হতে থাকলো। প্রসঙ্গত বলে রাখি, জাহাজের ডান দিক ও বামদিককে বলা হয় যথাক্রমে Starlord & Port side। যাইহোক সব রকম প্রচেষ্টা চলতে থাকল। সঙ্গে জাহাজেরও Starlord এ list হওয়া অব্যাহত থাকলো। ইতিমধ্যে জাহাজ প্রায় Starlord side 8 Degree List নিয়ে ফেলেছে। যেহেতু সমুদ্র খুব একটা অশান্ত ছিল না, তাই জাহাজ খুব একটা দুলছিলো না। সেই কারণে জাহাজ যে একদিকে কাত হয়ে যাচ্ছে, সেটা খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছে। জাহাজ দুলতে থাকলে ততটা বুঝতে পারা যায় না। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা প্রায় সন্ধ্যা সাতটা ছুঁই ছুঁই। জাহাজের সব লোকজনকে আগে রাত্রের খাবার খেয়ে নিতে বলা হলো। জাহাজের ডিনার টাইম সন্ধ্যা ছটায় হয়ে যায়। বেশিরভাগ লোকই এই কাজে ব্যস্ত থাকায় কেউই তাদের নির্ধারিত সময় ডিনার করতে পারেনি।
ইতিমধ্যে আমরা ঠিক করি cargo hold এ check করতে হবে এবং cargo hold যেহেতু পুরো সিমেন্টে ভরা আছে তাই কাজটা খুব সহজ নয়, বিশেষ করে মাঝ সমুদ্রে। যাই হোক অবশেষে দেখা গেল যে 2nd cargo hold এর ভিতর যেকোনো ভাবে crack হয়েছে এবং hold এর ভিতর জল ঢুকেছে এবং সেই কারণে জাহাজ এক দিকে কাত হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে জল ঢুকে ছিল সেটা বিস্তারিত ভাবে এখানে লেখা সম্ভব হলো না বিশেষ কিছু কারণবশতঃ। প্রথমে চেষ্টা করা হল পাম্প বসিয়ে জল বের করবার কিন্তু দেখা গেল যে পরিমাণ জল বের করা যাচ্ছে তার থেকে বেশি পরিমাণ জল ঢুকছে আর জাহাজ ক্রমশ বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাহাজে Emergency situation declare করা হলো। জাহাজের গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া হল পাকিস্তানের করাচি বন্দরের দিকে। সেই মুহূর্তে করাচি বন্দর ছিল আমাদের নিকটবর্তী বন্দর। SOS বার্তা পাঠিয়ে দেওয়া হলো করাচি বন্দরে। রেডিও বার্তা পাঠানো হলো কোম্পানির কলকাতা অফিসে। আগেই বলেছি যে বর্তমানে যে সমস্ত navigation instrument ও communication system সেসব তখন থাকলে সেদিনের পরিস্থিতিটা অন্যভাবে সামলানো যেত। কিন্তু সেই সময়কার সামগ্রিক ব্যবস্থার জন্য পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয়ে যায়। করাচি বন্দর থেকে আমাদের জানানো হয় যে আমরা করাচি বন্দরের Anchorage এরিয়াতে এসে জাহাজ বন্দর করতে পারি। অবশেষে রাত ন’টা নাগাদ জাহাজ এসে করাচি বন্দর থেকে প্রায় ১২ নটিক্যাল মাইল দূরে anchor করলো। ততক্ষণে জাহাজ প্রায় ১৫ ডিগ্রী কাত হয়ে গিয়েছে একদিকে। জাহাজের ক্যাপ্টেন বারবার করে করাচি বন্দর কর্তৃপক্ষকে আমাদের সাহায্যের জন্য মেসেজ পাঠাচ্ছে কিন্তু কোন সাহায্য এসে পৌঁছায়নি। এই অবস্থায় জাহাজ ক্রমশ একদিকে List হতে থাকে। অবশেষে ক্যাপ্টেন ডিসিশন নেয় যে লাইফবোট নামিয়ে আমরা জাহাজের কুড়ি জন লোক লাইফবোটে আশ্রয় নেবো কারণ জাহাজে থাকা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে লাইফবোট নামাবার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম ও জাহাজের কাগজপত্র এবং নিজেদের পাসপোর্ট ও সি-ডি-সি সমস্ত একটি বাক্সে ভরে নিলাম।
কিন্তু বিপদের উপর বিপদ। লাইফবোট নামাতে গিয়ে দেখা গেল যে জাহাজ যেভাবে একদিকে কাত হয়ে গিয়েছে সেই অবস্থায় কোনো দিকেই লাইফবোট নামানো যাচ্ছে না। জাহাজের উপর সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারা যাচ্ছে না। তখন চেষ্টা হলো Life Raft নামাবার। Life Raft হল Rubberised craft যা লাইফ বোট এর পরিবর্তে জীবন বাঁচাবার জন্য সমুদ্রে ব্যবহার করা হয়। যাইহোক একটা Life Raft নামানো হলো এবং জাহাজের দুজন ওই Life Raft এ উঠলো কাগজপত্রের বাক্সটি নিয়ে এবং ঠিক হলো যে সবাই এক এক করে লাইফ জ্যাকেট পরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে Life Raft এ উঠবে। কেউ নিজের অন্য কোন জিনিস সঙ্গে নিতে পারবে না এসব ক্ষেত্রে। রাত তখন প্রায় দশটা। জলে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছে, জাহাজও বিপজ্জনকভাবে Starlord side এ List নিয়ে নিচ্ছে। সবাই চূড়ান্ত মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে। এমন সময়ে জাহাজের একজন লোকের মাথায় যে কি হলো, কেউ কিছু বুঝবার আগেই সে নিজের কেবিন থেকে একটা লোহার মাঝারি সাইজের ট্রাঙ্ক নিয়ে এসে Life Raft এর দিকে ছুঁড়ে মারলো। আর আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ট্রাঙ্কটা সোজা গিয়ে Raft এর ওপর পড়ল এবং Raft টা কে ফুটো করে দিল, Raft টা ডুবতে শুরু করলো। Life Raft এর ভিতর যে দুজন ছিল তারা হাঁকপাঁক করে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রাণ বাঁচালো। আর যে লোকটি ট্রাংকটি ছুঁড়েছিল সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে এক পলকে ওই দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর সবাই একে একে জলে ঝাঁপ দিতে শুরু করলো। Captain, Chief officer ও আমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা তদারকি করছি। জাহাজ ছেড়ে যেতে মন খারাপ লাগছে। কিছুটা ভয়ও লাগছে। মনে আছে রাতটা ছিল অমাবস্যার রাত। নিকষ কালো একটা আবরণ যেন সমুদ্রকে গ্রাস করে রেখেছে। সমুদ্রের মাঝে অনেকরকম বিপদ যে কোন সময়ে আসতে পারে। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার ছিল যে সমুদ্রের ওই জায়গায় হাঙ্গরের ভীষণ প্রাদুর্ভাব থাকে, যদিও একই জায়গায় ডলফিন এর ঝাঁকও দেখেছি। যাই হোক সবাই একে একে জলে ঝাঁপ দিয়েছে। খালি আমরা তিনজন বাকি আছি। হঠাৎ captain বলে বসলো যে, “He will wait on board the ship till last moment or else he will go down with the ship”। এই feeling টা সব captain এরই হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে এটা খুবই উপলব্ধি করেছি যে জাহাজ captain এর কাছে নিজের সন্তানের মত হয়। যাই হোক captain কে কোন মতে রাজি করিয়ে তাঁকে নিয়ে আমরা জলে ঝাঁপ দিলাম। অথৈ সমুদ্রের বুকে নিজেকে সঁপে দিলাম। প্রথম ঝাঁপ দিয়ে পড়লে পরে আগে একটু ডুবুনি খেতেই হয় তারপর life jacket মানুষকে উপরে ভাসিয়ে আনে। তখন আর সাঁতার কাটার দরকার হয় না। Life jacket এর সাহায্যে মানুষের মাথাটা খালি জলের উপরে থাকে আর সমস্ত শরীর জলের নিচে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকে। এই অবস্থায় শরীর ঢেউএর তালে তালে দুলতে থাকে। প্রথমে ঝাঁপ দেওয়ার পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশ কিছুটা নোনা জল পেটে চলে গেলো। তারপর এই অবস্থায় Thumb Rule হল পরে আর সমুদ্রের জল কোনমতেই খাওয়া যাবেনা। যদি তেষ্টায় বুক ফেটেও যায় তাও সমুদ্রের জল কোনমতেই খাওয়া যাবেনা। এটা এখন আমি আমার Marine student দের সব সময় survival at sea ক্লাসে বলে দিই।
সকলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে একে অপরের হাত ধরাধরি করে circle তৈরি করে সমুদ্রে ভাসতে থাকলাম। সবরকম প্রচেষ্টা যাতে কেউ আলাদা না হয়ে যাই। সবাই একসঙ্গে এক জায়গায় থাকতেই হবে। দেখলাম যে আমরা সকলে জাহাজের খুব কাছাকাছি আছি। তাই আমরা আমাদের circle টাকে জাহাজ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিলাম কেননা জাহাজ যখন ডুববে তখন যাতে কাউকে suck করে নিজের সঙ্গে না নিয়ে যেতে পারে। জাহাজ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে সবাই গোল হয়ে ভাসছি। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় হাত ধরাধরি করে গোল করে খেলা করার কথা কিন্তু ছোটবেলায় গোল করে খেলা ও আজকের এই রাত্রে অথৈ সমুদ্রে কুড়িটা মানুষ হাত ধরাধরি করে গোল করে একে অপরকে নিয়ে বাঁচবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা, দুটো পরিস্থিতির কত পার্থক্য! হঠাৎ মনে পড়ল, যে জায়গায় আমরা সমুদ্রে পড়ে আছি সেই জায়গাটায় খুব হাঙ্গরের আনাগোনা এবং তারা কখন এসে তাদের ব্লেডের চেয়েও ধারালো দাঁত দিয়ে আমাদের শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেবে তা কেউ জানে না। জলের মধ্যে রক্তের স্বাদ পেয়ে সেখানে আরও হাঙ্গর এসে জড়ো হবে। সাধারনতঃ Life Boat ও Life Raft এ Shark Repellent oil থাকে। এইরকম পরিস্থিতিতে জলের মধ্যে ঐ তেল ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে করে হাঙ্গর কাছাকাছি না আসতে পারে। কিন্তু আমরা তো জলে পড়ে আছি আর সেই তেলও আমাদের কাছে নেই, তাই হাঙ্গর যদি আসে, আমাদের কিছুই করার নেই। মাঝে মাঝে কিছু সামুদ্রিক মাছ (জানিনা কি মাছ ওগুলো) আমাদের খুব কাছাকাছি চলে আসছে। কেউ কেউ আবার পায়ে, পিঠে ঠুকরে দিয়ে যাচ্ছে। রাত তখন কটা বুঝতে পারছিনা। আমারা বুঝতে পারলাম সমুদ্রের জলে স্রোতের টান খুব বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের সকলকে জাহাজ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। তবে তখনও জাহাজ আমরা দেখতে পাচ্ছি। জাহাজ একদিকে পুরোপুরি কাত হয়ে গিয়ে জাহাজের মাস্তুল প্রায় জল ছুঁয়ে গেছে। বুঝলাম, এইবার যেকোনো মুহুর্তে জাহাজ সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। হঠাৎ মনে হল আমাদের চারিপাশে কোন সানুদ্রিক প্রানী খুব লাফালাফি করছে। জল থেকে ওপরে লাফিয়ে উঠে আবার জলে ডুব দিচ্ছে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছিনা ঠিক কি প্রাণী। কিছুক্ষন পরে বুঝতে পারলাম যে এক ঝাঁক ডলফিন আমাদের ঘিরে ফেলেছে। মনে একটা অদ্ভুত সাহস পেলাম। মনে হল আমরা নিরাপদ। সামুদ্রিক ডলফিন হল নাবিকের বিপদের বন্ধু। ডলফিনের যে সব কীর্তি কাহিনী নাবিকদের ঘিরে রয়েছে, সে সব অনেক গল্প কাহিনী। যাইহোক আমরা সবাই অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। ডলফিনগুলো আমাদের ঘিরে রইল। অত্যুৎসাহী দু-একটি ডলফিন এসে আমাদের পিঠে তাদের ছুঁচলো ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিলো। যেন বলতে চাইছিলো “ভয় নেই আমরা আছি”। ডলফিনদের সম্বন্ধে একটা কথা বলে রাখি। যেখানে ডলফিন থাকে তার কাছাকাছি হাঙ্গর আসেনা। আর ডলফিন মাঝে মাঝে চেষ্টা করে মানুষ যদি জলে পড়ে যায়, তাকে নিজের পিঠে উঠিয়ে নেওয়ার। বিপত্তি টা তখনই হয়। ডলফিনের পিঠে খুব শক্ত একটা ধারালো কাঁটা থাকে। সেই কাঁটার খোঁচায় মানুষ আহত হয়। আমরা তাই মনে মনে ভাবছিলাম, বাবা আমাদের তোমরা পিঠে তোলার চেষ্টা কোরো না, ঘিরে রাখো, আমরা তাতেই খুশি।
এইভাবে আস্তে আস্তে ভোর হয়ে এলো। কোনো জাহাজ বা মাছের নৌকো কিছুই আমাদের নজরে পড়ছে না। বুঝতে পারলাম যে জলের প্রচন্ড স্রোত আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে shipping track থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছে। আমরা ভাসছি। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু সমুদ্রের জল তো খাওয়া যাবেনা। তখন কটা বাজে, ঠিক বুঝতে পারছিনা। তবে সূর্য্যের অবস্থান দেখে আন্দাজ করছিলাম হয়ত ৭-৮টা বাজে। হঠাৎ অনেক দূরে একটা জাহাজ দেখতে পেলাম। মনে আশার সঞ্চার হল, যদি জাহাজ থেকে আমাদের দেখতে পায় ! না হলনা, আশা বিফল গেলো।
আমরা কোথায় আছি কিছুই বুঝতে পারছিনা। হঠাৎ অনেক দূরে কিছু কিছু বিন্দু দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম ওগুলো মাছ ধরার নৌকো, একসঙ্গে অনেকগুলো। আমরা ভাবলাম এরা নিশ্চয়ই আমাদের দেখতে পাবে। কিছুক্ষন পরে দেখলাম যে নৌকো গুলো আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম Fishing net lay করছে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিছুক্ষন এইভাবে চলার পর দেখলাম দুটো নৌকো আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই নৌকো দুটো আমাদের দেখতে পেলো। ওগুলো Pakistani Fishing Boat ছিলো এবং ওরা আমাদের ঘিরে ফেললো। ডলফিনের ঝাঁক কিন্তু সেখানে রইলো। এরপর একে একে আমাদের সকলকে দুটো নৌকোয় উঠিয়ে নিলো। আমরা বললাম আমরা Indian Sailor। ওরা আমাদের খাওয়ার জল, কড়া করে চা আর বিস্কুট খেতে দিলো। আমরা সবাই নৌকোর মধ্যে শুয়ে রইলাম। Fishing Boat আমাদের নিয়ে করাচী পোর্টের দিকে চলল। এইভাবেই আমাদের এক ভীষণ সামুদ্রিক রাতের অভিজ্ঞতার কাহিনী শেষ হল।
***********************************************
অরূপ কুমার সেনগুপ্ত পরিচিতিঃ
জন্ম ১৯৫৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর। ১৯৭৮ সালে কলেজ পাঠ শেষ করে জাহাজে ক্যাডেট (শিক্ষানবিশ অফিসার) হয়ে যোগদান ও সমুদ্র জীবন শুরু। ৩ বছরের শিক্ষানবিশ শেষ করে, ভারত সরকারের জাহাজ মন্ত্রক পরিচালিত পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে, ভারত সরকার স্বীকৃত “মার্চেন্ট নেভি অফিসার” হয়ে উচ্চপদস্থ সামুদ্রিক জীবন শুরু। ১৯৮৪ – ১৯৮৯ সাল ভারত সরকারের সংস্থা “সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্টে” ম্যানেজার (অপারেশন) হয়ে যোগদান, ১৯৮৯ সালে আবার সমুদ্রের আকর্ষনে সামুদ্রিক জীবনে প্রত্যাবর্তন। ১৯৯২ সালে জাহাজের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব গ্রহন, ২০১৫ সালে সমুদ্র জীবন থেকে স্বেচ্ছাবসর, ও বর্তমানে মেরিন ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত। ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংস্থার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। এ ছাড়া ওঁনাকে পূজো পাগল বললেও ভুল বলা হবেনা, নিজের পাড়ার দূর্গাপূজা নিয়ে মাতামাতির শেষ ছিলোনা। ২০১৫ সাল থেকে কলকাতার শারদ(দূর্গা) ও দীপাবলী (শ্যামা) পূজার প্রতিযোগিতায়, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা পরিচালন কমিটি তে বিচারক হিসাবে যুক্ত আছেন।
লেখকের অপূর্ব কলমে এই অসাধারণ ভয়াল অথচ রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনী পড়তে পড়তে, একেবারেই ডাঙ্গার মানুষ হিসেবে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল ! লেখকের দীর্ঘ সমুদ্র-জীবনের আরও বিচিত্র কিছু কাহিনী শোনার অপেক্ষায় রইলাম !!
মনে হলো যেন ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলাম।খুব।ভালো লাগল। আরো কাহিনী শোনার ইচ্ছে রইলো।
আচ্ছা,সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই শোনাব
রোমহর্ষক ঘটনা পড়লাম অরূপদা, আমাদের অজানা জগৎকে জানিয়ে দিলেন,আরো উপুড় করা এমন গল্পের ঝুলি চাই।