স্বাধীনতা দিবস আর রূপান্তীর গপ্পো
শ্রুতি দত্ত রায়
(১)
সকাল থেকেই আজ বাড়িতে ব্যস্ততার শেষ নেই। সেই কোন কাকভোরে উঠে কাকিমণি স্নান-টান সেরে পুজো দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে।আর কাকিমণির সাথে রূপান্তীকেও ঘুম ঘুম চোখে বিছানা ছাড়তে হয়েছে। ওকে ছাড়া কাকিমণির এক সেকেন্ডও চলে না যে। “রূপান্তী শিগগির বাসি ঘর ঝাড়ু দে”… “বাথরুমে গিজার অন কর”…”কাকুর জুতো জোড়া পালিশ করলি?”…”ময়দাটা তাড়াতাড়ি মেখে, লুচি কটা একটু বেলে দে তো”….সকাল থেকে একটার পর একটা ফরমায়েশ চলছে তো চলছেই, দম ফেলার সময় নেই আজ। আর হবে নাই বা কেন? কাকু, কাকিমণি আর তিতলিকে যে সকাল আটটার মধ্যেই তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। তার আগে কাকিমণির বাড়তি কাজ হলো তিতলিকে সাজিয়ে গুজিয়ে নাচের অনুষ্ঠানের জন্য তৈরী করা। আজ “ইনডিপিনডিন”..না কি যেন একটা বিশেষ দিন। কদিন ধরেই আলোচনা চলছে এ বাড়িতে। তিতলিসোনা নাচবে ঐদিন একটা বড়ো অনুষ্ঠানে। খুব তোড়জোড় চলছিল দিনটার জন্য। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে তিতলিকে নাচ প্র্যাকটিস করতে দেখেছে রূপান্তী। গানের কথার মানে না বুঝলেও সুরটা ভারী ভালো লেগেছিল ওর। আর তার চাইতেও ভালো লেগেছিল ছোট্ট তিতলির ঘুরে ঘুরে নাচের ভঙ্গিমা দেখতে। মাঝে মাঝে ওরও অমন নাচতে ইচ্ছে করে…তিতলির সঙ্গে, তিতলির মতো করে। কিন্তু ভয়ে নাচতে পারে না, কাকিমণি যা রাগী, যদি বকে দেয়?
তিতলিকে নিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে যাবার আগে রূপান্তীকে বাকি কাজগুলো সব বুঝিয়ে দিয়ে গেল কাকিমণি,….
-“শোন্ রূপান্তী, রান্না সবটুকু শেষ করে যেতে পারলাম না। মাছের ঝোলটা কালো জিরা ফোড়ন দিয়ে করে নিস, বুঝলি? আর তিতলির ঠাম্মা উঠলে টিফিনটা দিস। সঙ্গে একটু চা।” কাকিমণির শাড়ির কুঁচি ধরে দিতে দিতে সব মন দিয়ে শুনছিল রূপান্তী। টবের গাছগুলোতে জল দিতে হবে, বেলা বাড়লে ঠাকুমার স্নানের সময় সব গুছিয়ে দিতে হবে, ঠিকামাসী আসলে ঠিক মতো সব কাজ বুঝে নিতে হবে,….বাসনে যেন এঁটো না লেগে থাকে…কাপড় ধোয়ার সময় জল যেন বেশ ক’বার পাল্টায়….কোনোটা করতেই যেন ওর ভুল না হয়।
(২)
কাকু, কাকিমণি, তিতলি বের হয়ে গেলে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে ঘরে এল রূপান্তী।ভিজে তোয়ালেগুলো বিছানার ওপর পড়ে আছে। ব্যালকনির তারে মেলতে হবে ওগুলো। ঝুল বারান্দায় এসে এতক্ষণে একটু বাইরের আলো বাতাস গায়ে লাগলো। ঠাকুমা ওঠেনি এখনও। কাকিমণিরাও সবে বের হলো। আসতে ঢের দেরী। একটুক্ষণ রাস্তার লোক দেখলে কি আর এমন ক্ষতি? এমনিতে তো সারা দিন-রাতে এতটুকু বিশ্রাম নেবার জো নেই। সকালে চোখ খোলার পর থেকে ফ্ল্যাটের একঘর থেকে আর এক ঘরে… ছুটেই চলতে হয় ওকে। কখন যে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধে নামে…..ফাই ফরমাশ খাটতে খাটতে খেয়াল থাকে না।
ব্যালকনি থেকে বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত রাস্তা দেখা যায়। হঠাৎই চোখে পড়ল নীচের রাস্তা ধরে টগরমাসী আসছে। টগরমাসী এ পাড়ারই অন্য ফ্ল্যাটে রান্না করে। হন্ হন্ করে হাঁটছে মাসী। খুব তাড়ায় আছে মনে হচ্ছে। এ বাড়িটার রান্না সেরেই নিশ্চয়ই আরও যে দুটো বাড়িতে ঠিকা করে, সেদিকে দৌড়বে।ব্যালকনির কাছাকাছি আসতেই রূপান্তী ওপর থেকে চীৎকার করল,
“ও টগরমাসী, কই যাও?”
টগরমাসী মুখ উপরে তুলে রূপান্তীকে দেখে হাসল। বলল, “কিরে ওখানে কি করিস? কাজ নাই? ঠিক মতো করিস তো?”
“হ্যাঁ…” জবাব দিল রূপান্তী।
” দেখিস, আবার আমার নাম ডুবাইস না। বাড়ি গেছিস এরমধ্যে? বাবা আসছিল?”
“নাহ্। বাবা তো মাসে খালি একদিন আসে, টাকা নিতে,…. কেন গো? ”
“তোর মায়ের তো অসুখ। কেউ খবর দ্যায় নাই তোকে? ”
“না তো। কি হইছে মায়ের? ”
“কি জানি রে। পেটে খুব ব্যথা-বিষ। সেদিন গেলাম তোদের বাড়ি। তোর মা জানতে চাইছে তুই কেমন আছিস।”
মুখ ভার হয়ে গেল রূপান্তীর। টগরমাসী যেন পড়তে পারল ওর মন। চলে যেতে যেতে তাই বলে গেল, “বাবা এ মাসে আসলে ঘর থেকে ঘুরে আসিস একবার। যাচ্ছি রে, আর সময় নাই কথা বলার…ছিষ্টির কাজ বাকি আছে।”
টগরমাসী চোখের বাইরে চলে যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে থাকল রূপান্তী। এটা ও কি শুনল! মায়ের এত অসুখ, অথচ কেউ একটু খবর দিল না ওকে? ভাগ্যিস আজ টগরমাসীর সাথে আচমকা দেখা হল, না হলে যে জানতেই পারতো না।
টগরমাসীর প্রতি একটা ভালো লাগা আছে রূপান্তীর। এই মাসীর দৌলতেই তো চাকরিটা জুটেছে। তা না হলে রূপান্তীদের পরিবারটা শেষ হয়ে যেত। বাবা, মা, চার-চারটে বোন আর একটা ভাই নিয়ে ওদের সংসার। রূপান্তী যখন খুব ছোট, মা আর বাবা করত চা বাগানের পাতা তোলার কাজ। থাকত বাগানের লেবার বস্তিতে। দিন চলে যেত একরকম। তারপর হঠাৎ একদিন বাগান বন্ধ হয়ে গেল। গরীব থেকে আরো গরীব হল মদেশিয়া পরিবারটা। ঘরে খাবার থাকত না। পরার জামা জুটত না। খিদের জ্বালায় কোলের ভাইটা দিন রাত কাঁদত।বাপটা হয়ে গেল অমানুষ। হাড়িয়া গিলে রাতদিন পড়ে থাকত এখানে সেখানে। মা-ই বাবুদের বাড়ি থেকে চেয়ে চিন্তে কিছু আনতো। কোনদিন জুটত, কোনদিন না। এরই মধ্যে ওর সবচেয়ে বড়ো দিদিটা একরাতে কোন এক মরদ জোয়ানের সাথে ভেগে গেল। একটা পেট কমলেও বাকি পেটগুলোর খিদে মেটানো একা মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমনসময় ভগবানের মতো ওদের জীবনে এল টগরমাসী, মায়ের দেশোয়ালী বান্ধবী। টগরমাসীই মাকে বুদ্ধি দিয়েছিল….শহরের বাবুদের বাসা বাড়িতে ওর মাস মাইনের কাজটাজ জুটে গেলে অন্ততঃ আরও একটা পেটের দায় তো কমবে। মাস গেলে কয়টা টাকাও আসবে। মা শুরুতে রাজী হচ্ছিলো না কিছুতেই। রূপান্তীকে মা যে বড্ড ভালোবাসতো। টগরমাসীই মাকে ভরসা দিয়েছিল। দেখেশুনে ভালো বাড়িতেই কাজে ঢোকাবে ওকে। শেষমেষ অভাবের তাড়নায় মা রূপান্তীর ভার টগরমাসীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এগারো বছরের রূপান্তীও স্বপ্ন দেখেছিল শহরে গিয়ে পেটপুরে ভাত খাবার। সেই থেকে রূপান্তী কাকিমণিদের সংসারে। দুবেলা দুমুঠো ভাত আর মাস গেলে পনের শ’ টাকা। এর বিনিময়ে কাকিমণির সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ_সব দায়িত্বই আজ মুখ বুজে পালন করে রূপান্তী।
(৩)
খবরটা পেয়ে সক্কাল সক্কাল মনটা কেমন ভার হয়ে গেল রূপান্তীর। টবের গাছে জল দিতে দিতে বারবার মায়ের মুখটা মনে পড়ে চোখ দুটো জলে ভরে উঠছিল। কতদিন বাড়ি যায় না। ভাইবোনগুলো কত বড় হলো কে জানে? প্রতি মাসে বাপটা টাকা নিতে আসে। ওদের কথা জানতে চাইলে দায় সারা উত্তর দেয়।
“রূপু……”
বুড়িদিদার ডাকে নিজের ভাবনার জগত থেকে ঝটিতি সরে এলো রূপান্তী। তাড়াতাড়ি বালতি আর মগ বাথরুমে রেখে দিদার ঘরে এল। দিদাকে এবার সব কাজে সাহায্য করতে হবে। প্রথমে মশারি খুলে ভাঁজ করে রাখল। তারপর পাশের লাগোয়া বাথরুমে দিদাকে হাত ধরে নিয়ে গেল। এভাবেই নানান কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইল ছোট্টো রূপান্তী। মায়ের কাছে অতটুকু বয়সেই ও শিখেছিল যে কিভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে মনখারাপকে মনের গভীরে লুকিয়ে রাখতে হয়। তবে যতই লুকিয়ে রাখুক না কেন এই পৃথিবীতে দুইজন মানুষ আছে যাদের কাছ থেকে কোন গোপন কথা লুকোনো যায় না। একজন ওর মা, অন্যজন তিতলির ঠাম্মা_ যাকে রূপান্তী ডাকে “বুড়ি দিদা”। এবারেও ঠিক তাই হল। দিদা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-“রূপু আজ তোর মুখ এত ভার কেন রে? কাকিমণি বকেছে বুঝি? ”
-“না” ছোট্ট উত্তর দিল রূপান্তী।
-“উহুঁ, ঠিক করে বল আমাকে, কি হয়েছে? ” চুপ করে থাকে রূপান্তী।
-“কিরে বল?” নরম গলায় বলে ওঠে বুড়িদিদা। ডান হাতটা পিঠে রাখে। কোমল স্পর্শে ছোট মেয়েটির চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে ওর কালো টোপা গাল দুটো ভিজিয়ে দেয়।
-“জানিস তো, মনখারাপের কথা কাউকে বললে মন হাল্কা হয়। বাড়ির জন্য মন কেমন করছে বুঝি?”
-“মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মায়ের তো খুব শরীর খারাপ।”
-“কে এসেছিল খবর দিতে?”
-“কেউ না। টগরমাসীর সঙ্গে হঠাৎই দেখা হলো। মাসীই বলল।”
-“বুঝেছি। খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না রে?” মুখে কিছু বলে না রূপান্তী। শুধু মাথা নাড়ে।
-“ঠিক আছে । আমি বলব এখন বৌমাকে। যদি টগরের সাথে তোকে একটু বাড়ি পাঠানো যায়।”
কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে রূপান্তীর। এইজন্যই এ বাড়িতে বুড়িদিদাকেই ওর সবচেয়ে আপন লাগে। কতগুলো মাস যে হয়ে গেছে, রূপান্তী বাড়ি যায়নি। শহরের ফ্ল্যাট বাড়ির এই চারটে দেওয়ালে ওর দম আটকে আসে। এবার বাড়ি গেলে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেবে। আগে বাগানের টাটকা চা পাতার গন্ধে ওর শরীর ভারি তাজা হয়ে উঠত। হাল্কা ঢেউ খেলানো রাস্তা ধরে যখন রূপান্তী আর ওর বস্তির ছেলে মেয়েরা দৌড়ে বেড়াতো, মনে হতো যেন একপাল হরিণ ছুটে যাচ্ছে।
মনের আনন্দে ঝটপট হাতের সব কাজ সেরে ফেলল রূপান্তী। তারপর বুড়ি দিদার ঘরে এসে দেখল দিদা টিভি দেখছে। কাকিমণিরা যে কখন ফিরবে কে জানে। যতক্ষণ না ফেরে ততক্ষণ বিশ্রাম। টিভির দিকে তাকিয়ে দেখল কতগুলি লোক একরকম জামা পড়ে শুধু হেঁটেই যাচ্ছে। পিছনে বিয়ে বাড়ির ব্যান্ডের মতো বাজনা বাজিয়ে আরো একদল লোক যাচ্ছে। কতো লোক বসে দেখছে।
-“এটা কার বিয়ে হয় গো?” রূপান্তীর প্রশ্ন শুনে দিদা হেসে উঠল,
-“এটা বিয়ে না রে। আজ স্বাধীনতা দিবস…ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে। তাই দিল্লি বলে একটা জায়গায় এখন উৎসব হচ্ছে। সেটাই দেখাচ্ছে।”
-“ও…তিতলিবুনু ওখানেই নাচবে?”
-“না রে। ওটা দিল্লি। অ-নে-ক দূর। তিতলি তো এই শহরে নাচবে। আজ সারাদেশে সব জায়গায় এমন অনুষ্ঠান হচ্ছে।”
-“কেন হয়?”
-“ঐ যে বললাম আজ স্বাধীনতা দিবস। দাঁড়া, তোকে বুঝিয়ে বলি…”
এরপর দিদা খুব সহজ করে রূপান্তীকে বোঝাতে লাগল স্বাধীনতা দিবসের মানে। কিভাবে এই দেশকে, দেশের সাধারণ লোককে বিদেশীদের অত্যাচার থেকে বিপ্লবীরা মুক্ত করেছে, স্বাধীন করেছে। তাইতো এখন দেশের সব লোক নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারছে। কেউ কোনো অন্যায় অত্যাচার করতে পারছে না। আইন কানুন আছে। রূপান্তী চুপচাপ শুনছিল সব। ঠিক তখনই ডোরবেলটা ট্যাঁ ট্যাঁ করে বেজে উঠলো। তিতলিরা ফিরে এসেছে।
(৪)
-“উফ্! কি ভ্যাপসা গরম বাইরে। গা জ্বলে যাচ্ছে যেন। ” ধপ্ করে সোফায় বসে পড়ল কাকিমণি।”রূপান্তী, শিগগির ফ্যানটা অন কর। আর তিতলির জন্য একটু নুন চিনির সরবত করে আন তো চট করে। কি ঘেমে গেছে মেয়েটা।”
রান্না ঘরে ছুটল রূপান্তী। তাড়াতাড়ি হাত চালালো। এখুনি হয়তো কাকিমণি বলবে খাবার বাড়তে। সরবত তৈরি করে তিতলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে কাকুকে ভাত বেড়ে দিল। কাকুর পর কাকিমণি তিতলিকে নিয়ে খেতে বসল। সেই সময়ই রূপান্তীর কাঁধে ভর দিয়ে বুড়ি দিদা এসে খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়াল।
“কি ব্যাপার মা? আপনি আবার এখন উঠে এলেন? কিছু বলবেন? ” কাকিমণি জিজ্ঞাসা করল।
বুড়ি দিদা সবটুকু জানিয়ে বলল, “রূপুকে এই শনিবার টগরের সাথে একটু বাড়ি পাঠাবে বৌমা? রোববার বিকেলে না হয় ফিরে আসতো। তোমার খুব একটা তাহলে অসুবিধেও হবে না। ”
“বাহ্, আপনি নিজেই সব ঠিক করে ফেলেছেন? কি করে জানলেন যে আমার অসুবিধে হবে না?” ঝামটা দিয়ে উঠল কাকিমণি, “আগামী সোমবার তিতলির সামেটিভ এক্সাম। পড়ানো আছে। রবিবার সকালে ওর নাচের ক্লাস। আমি তিতলিকে সময় দেব, না রান্না ঘরে হাঁড়ি ঠেলব, বলুন তো? তাছাড়া সপ্তাহে ঐ একটাই তো ছুটির দিন। একটু দম ফেলার সময় পাই। বাকি দিনগুলো তো রুটিন মাফিক ছুটতেই চলে যায়। আপনার আর কি। বলেই খালাস। সংসারের সব ঝক্কি তো আমাকেই সামলাতে হয়। না না…ও সব ছুটি ফুটি হবে না এখন। তাছাড়া শরীর খারাপ হলে তুই গিয়ে কি এমন উদ্ধার করবি শুনি? তোর বাবাই তো আছে।”
রূপান্তীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আমার বাপ একটা হারামী। টাকা ছাড়া কিছু চেনে না। যদি হাসপাতালে না নিয়ে যায়? আমি নিয়ে যাব।”
একথা শুনে কাকিমণি সুর টেনে বলে উঠলো, “ইস্, কি আমার গার্জেন এলেন রে। উনি নিয়ে যাবেন! ওসব চালাকি ছাড়্। কোথাও যাওয়া হবে না।”
বুড়ি দিদা তবুও একবার বলতে চেষ্টা করল,
-“বাচ্চা মেয়ে বৌমা, মন খারাপ থাকলে কাজ করবে কি করে?”
কাকিমণির গলা আরো উঁচুতে উঠলো,”আপনি থামুন তো মা। সারাটা দিন তো হাতের কাছে সবকিছু গোছানো পাচ্ছেন, তাই গায়ে লাগে না। বুঝতাম সংসারে থেকে কিছু কাজে আসছেন। যত্তসব ইউসলেস এক্সিসটেন্স। যান, নিজের ঘরে যান…. আর ঝামেলা পাকাবেন না।”
কাকিমণির মুখের ঝড়ে বুড়ি দিদার মুখটাকে ভেঙে চুরে যেতে দেখল রূপান্তী। ঠিক যেমন মাঝে মধ্যে হঠাৎ ঝড়ে ওদের চা বাগানের লেবার বস্তির দুই একটা পুরনো ঘর ভেঙে যেতো, তেমন। বুড়ি দিদা আর কোন কথা বলল না। রূপান্তীর হাত ধরে নিজের ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। একটু যেন কাঁপছিল বুড়ি দিদার শরীরটা। ডাইনিং হল থেকে নিজের ঘর…. এটুকু আসতেই বুড়ি মানুষটার কষ্ট হয়েছে বোধহয়। রূপান্তী দিদার পায়ের কাছে রাখা হালকা চাদরটা খুলে যত্ন করে কোমর অবধি ঢেকে দিল। কিছু বলল না দিদা। অন্যদিন হলে কাছে ডেকে থুতনিটা ধরে বলত, “সোনা মেয়ে, সবদিকে নজর তোর।”
(৫)
খাওয়া দাওয়ার পাট মিটিয়ে কাকিমণি তিতলিকে নিয়ে ভাতঘুমে ঢলে পড়ার আগে রূপান্তীকে কটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে গেল। দুপুরের দিকটাতে ব্যালকনির মেঝেতে বেশ রোদ আসে। মশলার কৌটোগুলো থেকে মশলাগুলো বের করে থালায় সাজিয়ে রূপান্তী যেন রোদ খাওয়ায়।কেমন যেন ড্যাম্প মেরে গেছে। রাতের রান্নার সবজিগুলো কেটে ধুয়ে যেন ফ্রিজে তুলে দেয়। শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করে আলনায় তুলে রাখে, বিকেলের জলখাবারের জন্য একটু চাওমিন সেদ্ধ করে রাখে। ঘুমন্ত নিশ্চুপ ফ্ল্যাটে একটা একটা করে কাজ সারছিল রূপান্তী। আর ভাবছিল_মায়ের কথা, বুড়ি দিদার কথা। দিদা যে সকালে বলেছিল…এদেশের সবাই নাকি এখন স্বাধীন। সবাই নিজের ইচ্ছের মালিক। যার যা মন চায় করতে পারে। যেমন খুশি চলতে পারে। তাহলে বুড়ি দিদা, মা কিংবা রূপান্তীর ইচ্ছের মালিক কি ওরা নিজেরা নয়? উত্তর খুঁজে পায়না রূপান্তী। রোদ খাওয়ানো গোটা শুকনো লঙ্কাগুলোকে ছোট ছোট হাতে কৌটোয় ভরতে থাকে শুধু। চোখ দুটো জ্বালা করে ওঠে ওর। লঙ্কার ঝাঁঝে নাকি লুকোনো কান্নায়,…..কে জানে?
************************************************
শ্রুতি দত্ত রায় পরিচিতি:
সুন্দরী ডুয়ার্সের মফস্বল শহর জলপাইগুড়িতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পেশায় সরকারি বিদ্যালয়ের ভাষা সাহিত্যের শিক্ষিকা। ভালবাসেন গান শুনতে, বই পড়তে, ডুয়ার্সের প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে। আর গান গাইবার মধ্যে খুঁজে পান মুক্তির স্বাদ।
বেশ ভালো লাগলো। সহজ ও স্বচ্ছন্দ।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
পাকা হাতের টানে স্বাধীনতার (?) বাস্তব দিকটির উলঙ্গ চিত্রায়ণ পড়ে অভিভূত হ’লাম ! “কাকিমনির” নির্লজ্জ স্বার্থপরতা, আর পার্শ্বচরিত্র ” বুড়ি দিদার” প্রতি তার ব্যবহার (যা,নচিকেতার “বৃদ্ধাশ্রম” গানটিকে কিছুটা হ’লেও মনে পড়িয়ে দিল), আজ প্রায় ঘরে ঘরেই দেখা যায়। আর, চায়ের দোকান, গেঞ্জির কারখানা বা “ঘরের কাজে”( পরিভাষায় যার গালভরা নাম domestic help) যে সব রূপান্তি আর ক্ষুদেরা অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে ঘানি টেনে তেল বার করে বর্তমান সমাজকে সচল রেখেছে, তারই খানিকটা সাহিত্যরসে জারিত করে, যে ভাবে শ্রীমতী শ্রুতি পরিবেশন করেছেন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। অনেক দিন পরে এত সুন্দর , সংবেদনশীল একটি নিটোল ছোট গল্প পরলাম !
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
শ্রুতি, তুমি বলার আগেই আমি একবার গল্পটা পড়তে গিয়েও শেষ করতে পেরেছিলাম না। কিছু চলমান নৈমিত্তিক কারনে আমি আমার রিভিউ কমেন্ট বক্সে দিতে পারিনি। যাই হোক, আজ সন্ধ্যেবেলা শান্তমনে,সময় নিয়ে তোমার গল্পটা পড়ে ফেললাম।
এক নিঃশ্বাসে গল্পটা পড়ার পর কোথাও একটা ছোট ব্যথা মনের তন্ত্রীতে লেগে থাকল। আর রূপান্তীর কথা ভাবতে থাকলাম, সাহিত্যের করুন রসে ভিজে একটা ভাল লাগা ও হ’ল। ঐযে বলেনা, সিনেমা দেখতে গিয়ে গল্পের কারনে সারাক্ষন হাপুস-নয়নে কান্নাকাটি করে হল থেকে বেরিয়ে এসে বলে ‘কি ভালরে মুভিটা! ‘ সেই রকম ভাল আমার ও লাগল। আর এই ভাললাগানর মূল কারিগর গল্পের লেখিকা।
আমার ভাল লাগার জায়গাগুলো নিয়ে একটু বলি—
১। প্রচ্ছদ ভারি সুন্দর হয়েছে। চারিদিকে স্কাই-রাইজারের মাঝে একখন্ড পেঁজাতুলো মাখা উন্মুক্ত সুনীল আকাশ। গল্পের দ্যোতনার সাথে মিশে যায়।
২। আজন্ম সবুজ চা বাগান, অরন্য, খোলা আকাশের নীচে বেড়ে ওঠা ছোট্ট মেয়েটার বর্তমান আর্থসামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে সংসার বাঁচানর তাড়নায় যখন অনন্যোপায় হয়ে শহরের ইঁটকাঠের জঙ্গলে বন্দী হয়ে গেল এবং হৃদয় হীন এক গৃহকত্রীর(মালকিন) হাতে পড়ল এবং নিজেকে পিষতে থাকল –, বড় মর্মান্তিক। লেখিকার বর্ণনার মুন্সীয়ানা উল্লেখযোগ্য।
৩। ঐ ইঁটকাঠের জঙ্গলে একটুখানি দম নেবার জায়গা সেই বুড়িদিদার চরম অপমানে ‘ স্বাধীনতার ‘ এমনরূপ ঐ ছোট্ট মেয়েটির সামনে উলঙ্গ হয়ে গেলে পাঠকও গভীর ভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। গল্প লেখিকার এজন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য তার সংবেদনশীল ভাষা চয়নের দ্বারা এত সহজ করে এত নির্মমতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য।
আমি নিশ্চিত, যারা যারা গল্পটা পড়লেন এবং পড়বেন তারাও এরপর এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে মানবিকতার পক্ষেই হাত তুলবেন। এটাই যেন এই গল্পের প্রচ্ছন্ন আর্তি।
সমাজ পরিবর্তনে এজন্যই বোধকরি সাহিত্যের বড় অবদান অনস্বীকার্য।
“স্বাধীনতাদিবস আর রূপান্তির গপ্পো” র ওপরে
আপনার চমৎকার, সুলিখিত বিশ্লেষণ পড়ে মুগ্ধ হ’লাম !
আমার মত যে সব পাঠকরা তাদের মনের কথা, তাদের অনুভূতিগুলো, সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারে না, আপনি তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে সে কাজ নিপুণ মুন্সিয়ানার সাথে করেছেন ! অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে !!!!
আপনার মতো পাঠক এবং সমঝদার যে কোন লেখকের কাছে এক দামী সম্পদ।অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। আপনার মতামতে ঋদ্ধ হলাম।আমার আপ্লুতি জানবেন। ভালো থাকবেন।
পাকা হাতের টানে স্বাধীনতার (?) বাস্তব দিকটির উলঙ্গ চিত্রায়ণ পড়ে অভিভূত হ’লাম ! “কাকিমনির” নির্লজ্জ স্বার্থপরতা, আর পার্শ্বচরিত্র ” বুড়ি দিদার” প্রতি তার ব্যবহার (যা,নচিকেতার “বৃদ্ধাশ্রম” গানটিকে কিছুটা হ’লেও মনে পড়িয়ে দিল), আজ প্রায় ঘরে ঘরেই দেখা যায়। আর, চায়ের দোকান, গেঞ্জির কারখানা বা “ঘরের কাজে”( পরিভাষায় যার গালভরা নাম domestic help) যে সব রূপান্তি আর ক্ষুদেরা অবিশ্রান্ত পরিশ্রমে ঘানি টেনে তেল বার করে বর্তমান সমাজকে সচল রেখেছে, তারই খানিকটা সাহিত্যরসে জারিত করে, যে ভাবে শ্রীমতী শ্রুতি পরিবেশন করেছেন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। অনেক দিন পরে এত সুন্দর , সংবেদনশীল একটি নিটোল ছোট গল্প পরলাম !
আমার মন্তব্যের শেষ শব্দটির বানান ভুলের জন্য দুঃখিত। ” পরলাম ” নয়, “পড়লাম” হবে !
আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন।
আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন।