ফ্লুরিজ – সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের একটি লেখা
বিজিত কুমার রায়
ফ্লুরিজ। বাইরে থেকে কাচের দরজা ঠেলে সোজা ভেতরে টেবিলে এসে বসুন। অনেকেই বসেছেন আপনার মতো কফি নিয়ে। ফ্লুরিজ আসলে ছোটহাজরি জীবন যাপনের তরিকার একটা অংশ। কী রকম?
জলখাবার খায় সকলেই। তবে যাঁরা ফ্লুরিজে সেরে বেরোন, তাঁরাই ঢাক ঢোল পিটিয়ে সে কথা আত্মীয় বন্ধুদের জানান। সে বড় সাহেবি আয়োজন। বরাবরই কলকাত্তাইয়া সাহেবিয়ানার যে ক’টি খাস প্রতিষ্ঠান, ফ্লুরিজ তার অন্যতম। একটু ওপরতলার সঙ্গেই তার গা মাখামাখি, ওতপ্রোত সম্পর্কই বলা যায়। খেয়াল করলে দেখতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে ছাদ থেকে মেঝে অবধি স্বচ্ছ কাচের জানালা থাকা সত্ত্বেও ভেতরে যাঁরা বসেন, তাঁরা বাইরের কলরোলের পানে তাকিয়ে, পরিচিতদের মুখ খোঁজার চেষ্টার ফাঁকে আলগোছে মুচমুচে সেঁকা পাঁউরুটির ওপর মাখনের পুরু আস্তরণে গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়ান না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান যাঁরা, তাঁদের মাঝে ফ্লুরিজে জলখাবার খানেওলাদের আত্মীয়-বন্ধু থাকবেন এমনটা কল্পনা করাও গোস্তাকিই হবে।
অতঃপর দেখা করতে হলে বাইরে থেকে কাচের দরজা ঠেলে সোজা ভেতরে এসে পূর্বনির্ধারিত টেবিলে এসে বসুন। সকালে অনেকেই বসেছেন আপনার মতো কফি নিয়ে। গোটা হল ঘরটাই ম ম করছে তার সুবাসে। তার সঙ্গে মিশেছে আর একটা কীসের মাত করে দেওয়া গন্ধ। ময়দা, খামারি, মাখন, নানা রকমের বাদাম, ভ্যানিলা এবং আমন্ড, এসেন্স, ক্রিমের সুবাস। সবটা একসঙ্গে কেবল এখানেই মেলে। হাতছানি দিয়ে ডাকে শোকেসের পানে, থুড়ি, বলা উচিত পেছন থেকে আলতো হাতে ঠেলে নিয়ে যায় থরে থরে সাজানো কেক পেস্ট্রির দিকে। কাছে গেলে তবেই চকোলেটের গন্ধ নাকে আসে। হাওয়ায় ভেসে থাকে সদ্য তৈরি করা কেকের ট্রে হাতে কর্মচারীরা মূল হলঘরে প্রবেশ করলে, তার পর মিশে যায় বাকি খুশবুর স্রোতে।
খিদে পায় হঠাৎই ভয়ানক। পেটের ভিতর একেবারে মোচড় দিয়ে ওঠে। টোস্টে কামড় বসালে ওপরের বাদামি স্তরটি দাঁতের চাপে কড়মড় শব্দে গুঁড়িয়ে ভেঙে যাওয়ার শব্দ মাথার ভিতর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে কানে বাজে স্পষ্ট। আশপাশে নিবিষ্ট চিত্তে সানি সাইড আপের গোলাপি কুসুমে চামচ ডুবিয়ে সহবতের তোয়াক্কা না করে গোটাটা আধ হাত জিভ বের করে চেটে নেওয়া খাদ্যরসিকদের দেখে হঠাৎই খিদেটা বেড়ে যায় আরও। মেনু কার্ডে লেখা আছে নানা রকমের কম্বো ব্রেকফাস্টের বর্ণনা। সে সব পড়তে পড়তে লালাসিক্ত মুখে রবিঠাকুরের যে লাইনখানা মনে পড়লে পথিক পথ না হারাইয়াই এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে যাবে তা হল ‘এমন করে কি মরণের পানে ছুটিয়া চলিতে আছে?’ অর্থাৎ, আগে বাপু ইংলিশ ব্রেকফাস্টের অর্ডারটি দিয়ে রাখো। দু পিস টোস্ট, মাখন, মার্মালেড, বেকন, সসেজ আর গোটা চারেক সানি সাইড আপ মারো, তার পর ধীরে সুস্থে এ দিক সে দিক ঢুঁ মারার কথা ভাববে। সকাল সকাল চিংড়ি পোনা খেতে ভালো লাগবে না বলছি না, তবে পোড়া মুখে আর যদি কিছু না রোচে, তা হলে দশটা এগারোটার এই ঝক্কি, অ্যাদ্দুর ঠেঙিয়ে আসা, সবটাই মাঠে মারা যাবে।
আসলে, পয়সার ব্যাপারটা বাদ দিলেও, ফ্লুরিজে ছোটহাজরি একটা জীবন যাপনের তরিকার অংশ। সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে স্নিকার্স গলিয়ে দৌড়ে এসে এক হাতে মোবাইল ফোন অন্য হাতে কফির কাপ ধরে মিটিং শুরু করতে হলে বাপু হেথায় না এলেই ভালো।
ফ্লুরিজের সামনে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়াবে, শোফার হাতে খোঁয়ারি কাটানোর বড়ি আর সোডাওয়াটার দেবে, ঘড়ির কাঁটা বেলা বারোটা ছুঁই ছুঁই। আগে তো বাবুরা যেতেনই না নিজেরা। খানসামার স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট র্যালে কোম্পানির সাইকেল চালিয়ে বড় বড় শক্ত কাগজের বাক্সে করে পাউরুটি কেক পেস্ট্রি নিয়ে আসত। বাবু বাগানে বসে খেতেন সপরিবারে। কখনও ময়দানের ওধারে, রেসকোর্সের গায়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বুট থেকে বের করা হত গার্ডেন চেয়ার, ফোল্ডিং টেবিল, টেবিল ক্লথ। শীতের সকাল। রোদ মেখে ওয়াজউড থেকে চা। সঙ্গে ফ্লুরিজের টোস্ট। চিজ স্যান্ডউইচ কভি নেহি। কেক থাকত, তবে পেস্ট্রি নয়। দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসত ব্যাট দিয়ে বল নক করার আওয়াজ।
সে সব দিন যে কোথায় হারিয়ে গেল! সেই কলকাতাটাও এখন স্রেফ অ্যালবামে। সকালবেলার পার্ক স্ট্রিটে খেলা করে স্মৃতিজড়ানো হাওয়া। রাস্তার দু’ধারে যে ক’টি সাবেক বাড়ি এখনও বেঁচে, তারা গুনগুন করে, গন উইথ দ্য উইন্ড! গন উইথ দ্য উইন্ড ।
********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি:
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে।
রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ – পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।
ফ্লুরিজের কেকের মতোই অনন্য স্বাদের আস্বাদ পেলাম আপনার লেখাতে।