ভূত ও অদ্ভুত কাহিনী
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রত্যেক লেখারই একটা গোড়ার কথা থাকে। আমার এই লেখায় গোড়ার কথাটা নিজের ভাষায় না লিখে উদ্ধৃত করে দিচ্ছি। তার কারণ এই উদ্ধৃতির মধ্যেই আমার ভূত সম্বন্ধে ধ্যানধারনা, অভিজ্ঞতা বা অনভিজ্ঞতা সবই লুকিয়ে আছে। পন্ডিতপ্রবর সুকুমার সেন মহাশয়ের লেখা একটা বই আছে যার নাম ‘কলিকাতার কাহিনী’। সেই বইয়ের ৫৪ পাতায় একটি প্রবন্ধ আছে ‘ভূত ও ভীতি’ নামে। এই প্রবন্ধের গোড়ায় সুকুমার বাবু লিখছেন, ডঃ শ্রীসুভদ্র কুমার সেন কিছুদিন আগে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “কলকাতার ভূত” নামে সেটি এখানে উদ্ধৃত করছি। “নানান চরিত্রের মানুষের নানান ধরনের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী এই শহর। অনাগত ভবিষ্যৎ একদিন বর্তমান হয়েছে এবং তারপর প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে সেই বর্তমান আবার এক সময়ে ভূত হয়েছে। আর ভূত কাল যখন নিজেকে বর্তমানে প্রক্ষেপ করে তখনই ভৌতিক সত্তা আত্মপ্রকাশ করে এবং ভীতির সঞ্চার করে। তবে অনেক কিছুর মতোই ভূতও বিশ্বাসের ব্যাপার। বিশ্বাস করলে আছে; না করলে নেই। গল্পের বাইরে ভূতের অস্তিত্ব প্রমান করা মুশকিল। ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে কতটা গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হবে? এ বিষয়ে দ্বিমত থাকবেই। চাক্ষুষ তথ্য দাখিল করে ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা দুরূহ। হয়তো বা অসম্ভবও”।
এই লেখার উদ্দেশ্য হল কয়েকটি নিজের অভিজ্ঞতা ও শোনা কাহিনীর পরিচয় দেওয়া।
আমার বাস দেশপ্রিয় পার্কের ধারে প্রিয়া সিনেমা হলের পেছনে। আমি যখন ৮/৯ ক্লাসে পড়ি তখন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নিজেদের সংগ্রহের বই দিয়ে একটা লাইব্রেরী করি। লাইব্রেরীটা করা হয় আমাদের এক বন্ধু দেবাশিস রায়ের বাড়ির তিনতলায়। এই বাড়িটি ছিল রাসবিহারী এভিনিউ-এর ওপর ও প্রিয়া সিনেমার উল্টোদিকে। বর্তমানে সেই বাড়ি ভেঙে বহুতল বাড়ি হয়েছে। সে বাড়ির তলায় আছে টাইমেক্স ঘড়ির দোকান। দেবাশিসদের এই তিন তলাটায় তখন কেউ থাকত না। অনেকটা পোড়ো বাড়ির মতন পড়েছিল। যাই হোক আমরা তিন তলার ঘরদোর সব পরিষ্কার করে আমাদের নিজস্ব সংগ্রহের বই রেখে লাইব্রেরী শুরু করলাম। লাইব্রেরী বেশ কিছুদিন নির্বিঘ্নে চলার পর কতকগুলো ঘটনা এমনই ঘটতে শুরু করল যে আমরা কিছুটা ভয় আর কিছুটা বিরক্ত হয়ে লাইব্রেরী তুলে দিলাম। যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল সেগুলো হল – এক, আলো পাখার সুইচ দেওয়া ও না দেওয়া সত্বেও যখন তখন আলো পাখা জ্বলে উঠতো আবার যখন তখন নিভেও যেত। ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রিকে দিয়ে পরীক্ষা করেও কোনো ফল হয়নি। দ্বিতীয় ঘটনা হল যে জানালা ও দরজা ঐ একইভাবে অর্থাৎ ছিটকিনি দেওয়া এবং না দেওয়া সত্বেও খুলে যেত এবং বন্ধ হয়ে যেত আপনা-আপনি। এখন মনে পড়ছে না যে অন্যান্য বন্ধুদের মনের অবস্থা কি হয়েছিল, তবে আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম এই কারণে যে আমি তখন সেন্ট লরেন্স স্কুলে পড়তাম এবং ছোটোবেলা থেকেই ‘our Father The Son of Holy Ghost’ কথাটার প্রভাব আমার ওপর পড়েছিল।
এরপর এবং এখনও অবধি যে ঘটনা আমার ঘটেছিল তাই আমার শেষ অভিজ্ঞতা ভূত বা অদ্ভুত সম্বন্ধে। আমি পেশায় সরোদবাদক। ১৯৮৫ সালে আমার বিশিষ্ট বন্ধু বিনোদ কৈলাসের আমন্ত্রনে হায়দ্রাবাদ শহরে যাই অনুষ্ঠান করতে। বিনোদের বাড়িটি পুরোনো হাভেলি ধরনের। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তিন তলার একটি বড় ঘরে এবং কেবল মাত্র একটি ঠাকুরের সিংহাসন এবং তাতে কয়েকটি ঠাকুরের ছবি ছাড়া ঘরে আসবাবপত্র প্রায় ছিলই না। আমি ওই শহরে চারদিন ছিলাম। অনুষ্ঠান ছিল তৃতীয় দিন সন্ধ্যেবেলা। পরদিন ভোরে ছিল কলকাতা ফেরার ট্রেন।
অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরে গল্পগুজব করে শুতে শুতে বেশ রাত হয়েছিল। যাইহোক ঘুমিয়েও পড়েছিলাম বেশ গভীরভাবে। খুব সম্ভবত ভোর রাত্রির ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল আমার চারপাশে নূপুরের আওয়াজে। প্রথমদিকে ঘুম থেকে উঠে কী হচ্ছে ব্যাপারটা জানার কৌতূহল হলেও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু নূপুরের আওয়াজ ক্রমশই বাড়তে থাকায় শেষমেষ উঠতে হল এবং আলো জ্বালার সঙ্গে সঙ্গে নূপুরের আওয়াজ থেমে গেল। এই ঘটনার বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তি ঘটায় অর্থাৎ আলো নিভে গেলে নূপুরের আওয়াজ আর আলো জ্বালালে আওয়াজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি ভয় না পেলেও কিছুটা সংশয় ও অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ভোর হয়ে আসায় এবং ট্রেন ধরার তাগিদে বাকি সময়টা আলো জ্বেলেই শুয়েছিলাম। যাইহোক পরের দিন সকালে বন্ধুবর বিনোদ ও বাড়ির অন্যান্যজনকে যখন এই ঘটনার কথা জানালাম তখন তারা প্রথমদিকে এটাকে দিবাস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বার বার চাপ দিয়ে, যে আসল ঘটনা জানতে পারলাম তা হল বিনোদেরই কোনো পূর্বপুরুষ অত্যন্ত শিশু বয়সে মারা যান ওই ঘরে আর নূপুরের আওয়াজ নাকি ওই শিশু পূর্বপুরুষটির, যিনি ভোর রাত্রে ওই ঘরে খেলে বা ঘুরে বেড়ান।
উপরিউক্ত ঘটনা দুটি আমার জীবনের দুটি অভিজ্ঞতা। এরপর যে কয়েকটি ঘটনার কথা লিখব, তা শোনা এবং পড়া। আমাদের সঙ্গীত জগতে বহু শিল্পী ছিলেন এবং এখনো আছেন যাঁরা ভূত, পীর/জীন এসবে খুবই বিশ্বাস করেন। প্রবাদপ্রতীম সঙ্গীত সাধক বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব তাঁর আত্মজীবনী “আমার কথায়” লিখেছেন, – একদিন চা টা খেয়ে ভৈরবী বাজাচ্ছি – ভৈরবী বড় ভালোবাসি আমি। দেখি এক কাবুলী এসে হাজির – এই পর্য্যন্ত দাড়ি। “আমি আসতে পারি”? আমি বাজিয়ে চললাম। এক দেড় ঘন্টা বাজানোর পর চোখ খুললাম। “অনেকদিন থেকেই ঘুরছি এখানে, তোমার বাজনা শুনি। চা খাওয়াতে পারবে?” চা তৈরি করলাম, তিনি তখন ঝোলা থেকে একটা কালো কটোরা বের করলেন। আগুনে দিয়ে কি টিপ দিলেন, সেটা সোনা হয়ে গেল। বললেন, “তুমি এটা ভাঙ্গিয়ে আনো, রোজ চা খাওয়াবে”।
আমি বললাম, “তা এই সোনার কি দরকার? চা আপনি এমনিই রোজ খেয়ে যাবেন”।
“আঃ যাও তো, আমার দরকার আছে”। রামপুরের সুন্দরলাল আমার কাছে তবলা শিখত। তার কাছেই প্রথমে গেলাম। কী জানি, পুলিসে ধরে যদি! সুন্দরলাল দেখে তো বলল, “আরে এতো আসলি সোনা – কোথা মিলল?”
“এক মহাত্মা ছিলেন। তিন তোলার টাকা দিলাম তাকে। রোজ তিনি চায়ের সরঞ্জাম আনতেন। ৭ দিন চা খেতেন, ৮ দিনের দিন একটা রুটি। এক মাস ছিলেন। যাবার আগে তমসা নদীর জলে ৭ দিন গলা জলে নেমে রইলেন। তারপর একটা মাদুলী তৈরী করে দিলেন আমাকে। আপনারা কি বিশ্বাস করবেন এ কথা? বললেন, “এটা তোমার কাছে রেখে দেবে। খুব উপকার হবে। আমি চলে গেলে শনিবার ধুনো দিয়ে হাতে বাঁধবে”। তাই করলাম। ঘুমের থেকে উঠে দেখি দুটো দৈত্যের মত লোক আমার দু-পাশে শুয়ে আছে। সর্বনাশ এটা কি? স্বপ্ন দেখছি নাকি? মাদুলিটা খুলে ফেললাম। দেখি দৈত্য দুটো আর নেই। কি ব্যাপার? আলাউদ্দিনের চেরাগ পাবো নাকি? ২য় দিনও তাই! চক্ষু মেলে দেখি আর ভয় নাই। এই বড়ো বড়ো লোম, নিজের চোখে দেখেছি। ৩য় দিন ফেলে দিলাম তমসার জলে, গুরুদেবকে (উস্তাদ ওয়াজির খানকে) বললাম। তিনি শুনে বললেন, আরে আরে করলে কি? তোমাকে দুজন জামিন দিয়ে গেছল, যা বলতে তাই করত ওরা। তুমি মহা বেয়াকুব আদমি। আমাকে দিয়ে দিতে”।
আমার গুরু আচার্য আলি আকবর খাঁ সাহেবের স্ত্রী শ্রীমতি জুবেদা খান – এঁর কাছে শুনেছি, সন্ধ্যেবেলা বাবা আলাউদ্দিন যখন নিজের ঘরে বসে সাধনা করতেন তখন নাকি প্রায়শই লালপাড় শাড়ী পরিহিতা এক রমনীকে ওনার ঘরে ঢুকতে দেখা যেত। প্রথমদিকে সন্দেহ হয় যে নিশ্চয় বৃদ্ধ বয়সে বাবার ভিমরতি হয়েছে তাই ঘরে অন্য স্ত্রীলোক নিয়ে আসতেন। কিন্তু গুরুমা বেশ কয়েকবার ওই স্ত্রীলোককে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখেছেন স্ত্রীলোকটি যেন হাওয়ায় উবে গেলেন।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। ১৯৯৪ সালে আমি তখন আমার গুরু আচার্য্য আলি আকবর খান সাহেবের কাছে শিক্ষা নিচ্ছি আমেরিকায়। আমার থাকাকালীন কোনো একটা সময় খান সাহেবের পরিবারের সকলে বেড়াতে গেলেন লস এঞ্জেলস শহরে। খান সাহেব বাড়িতে একা ছিলেন এবং আমার কাজ ছিলো ওনার দেখভাল করা। সারাদিন বাড়ীতে কাটাবার পর উনি আমাকে রাত্রে ওনার কলেজে যেখানে আমি থাকতাম সেখানে গিয়ে শুতে অনুরোধ করলেন। আমি ওনাকে অনেকবার অনুরোধ করি যাতে ঐ কয়েকটা দিন আমি রাত্রে ওনার বাড়িতে শুতে পারি কারণ উনি একা থাকবেন বলে। কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হলেন না এবং না থাকতে দেওয়ার কারণ হিসেবে বললেন যে, রাত্রে আমি ওনার কাছে থাকলে ভয় পাব, কারণ রাত্রে নাকি ওঁনার বাবা আচার্য্য আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব রাত্রে এসে ওনাকে তালিম দেন এবং বকাবকি করেন। সেই সঙ্গে নাকি সারা বাড়ি পীর/জীন এনারা ঘুরে বেড়ান। এবং এঁদের দেখলে আমি ভয় পাবো। তাই তিনি চান না যে রাত্রে আমি ওনার বাড়িতে থাকি।
আমার লেখা শেষ করব প্রখ্যাত সরোদবাদক শ্রীবুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাছে শোনা গল্প দিয়ে। যশোর জেলার গদখালি গ্রামের গল্প। বহু বছর আগে এই গদখালি গ্রামের বহু পুরুষ মানুষ চাকুরি করতেন কলকাতা শহরে এবং কেউ সপ্তাহের শেষে, কেউ মাসের শেষে গ্রামে ফিরতেন পরিবারের কাছে। একবার গদখালিতে প্রচন্ডভাবে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং মড়কের আকার ধারণ করে। ফলে বহু পরিবার নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়। এই সময়ে তিন ব্যাক্তি গ্রামে ফেরেন পরিবারের সাথে মিলিত হবার জন্য। প্রথম জন দেখেন যে তাঁর স্ত্রী একহাত ঘোমটা টেনে তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন। এই ঘটনায় বিস্মিত হয়ে তিনি স্ত্রীর ঘোমটা সরাতে গিয়ে দেখেন মানুষের পরিবর্তে একটি কঙ্কাল। দ্বিতীয় ভদ্রলোক খাওয়ার পাতে লেবু চাওয়ায় স্ত্রী নাকি বিশাল লম্বা এক হাত জানলা দিয়ে বার করে বাগানের লেবু গাছ থেকে লেবু পেড়ে আনেন। আর তৃতীয় ভদ্রলোক বাড়ি এসে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে, খোঁজাখুঁজির পর স্ত্রীকে আবিষ্কার করেন রান্নাঘরে। সেখানে উনুনে ভাত সিদ্ধ হচ্ছে এবং কাঠের বদলে স্ত্রী তাঁর দুটো হাত উনুনের আগুনে গুঁজে রেখেছেন। এই কাহিনী নাকি যশোরের সব ঘরে ঘরে লোকের মুখে ফিরত এবং সত্যি বলে বিশ্বাস করত।
**************************************************
অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচিতিঃ
বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গ কন্ঠ সংগীত শিল্পী আরাধনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, (জন্ম ১৯৫৮), সরোদবাদনে তালিম পেয়েছেন ধ্যানেশ খান, আশীষ খান, বাহাদুর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলি আকবর খাঁ এর কাছে। আলি আকবর খাঁ এর কাছে তিনি শিক্ষা পেয়েছেন ওস্তাদজির মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্ব পর্য্যন্ত। ইউরোপ, ব্রিটেন, কানাডা, আমেরিকার বহু শহরে উনি সংগীত পরিবেশন করেছেন। তাঁর সরোদ বাদনে তিনি যেমন রবাব, সুরশৃঙ্গার ও বীনার গুনলক্ষন অঙ্গীভুত করেছেন, তেমনই আবার অপ্রচলিত সুরশৃঙ্গার বাদনেও তাঁর দক্ষতা প্রতিষ্ঠা করেছেন। কলকাতার স্টেটসম্যান ও টেলিগ্রাফ দৈনিকে দীর্ঘকাল সংগীত সমালোচকের দায়িত্ব পালন করেছেন। একাধিক সংগীত বিষয়ক তথ্য চিত্রে তাঁর সংগীতজ্ঞানের পরিচয় আছে। দেশে বিদেশে সংগীত শিক্ষাদানেও তাঁর খ্যাতি প্রতিষ্ঠিত।