ঘুষ
মধুমিতা ভট্টাচার্য্য
মই মেধোলাল মাহাতো। জন্ম হইছিল একুনকার ঝাড়খন্ডে মানে তকুনকার বিহারে পেরায় দুকুড়ি-পাঁচ বচর আগে। দু-বচরের হতিই ঠাকুদ্দা তেনার পরিবার নে কলকেতায় চলি আসেছেল। পত্থমে হাওড়া-ইস্টেশনের পেলাটফরম, পরে ইদিক-সিদিক কত্তি কত্তি এখেনে। বড় হতিই বেবাক কাজকামের ধান্দায় নানান ঘাটের জল খেইয়ে মুর মুখের ভাষাটুকও জগাখেচুড়ি হই গিচে। আপাতক ঠিকনা খাস কলকেতায় না হলিও কলকেতাতেই বলতি পার। হুই-ই সোনারপুরের উদিকটায়। সেখেনেই ইস্টেশনের হাতায় আমার ছ’ট্ট চা-দ’কান। সক্কালে গেই তোলা উলুনটো ধরাই, ছচপ্যান-টচপ্যান ধোই চায়ের জল চাপাই। তার পিছে দুধ, চিনি ঢেলি চা বেনাই। দ’কানের সম্পত্তি বলতি কয়টা লড়বড়া বেঞ্চি আর এট্টা টুল, ব্যস। ভাঙ্গা কাঁচের পাল্লাওলা ছোটোমোটো লজঝড়ে বাস্কটোতে লেড়ো বিস্কুট, সস্তা চানাচুরের পাকিট আর গোটাকয় বিড়ির বাণ্ডিল রাকি। দ’কানের এক কোণে ঝুলাই দি আগুন মাথাওলা রসি। লোকজন সিটুর থিকে বিড়ি ধরাইঁ সুখটান দেয়। বাসি খবর-কাগজটু নে আনি পাশে সমর দাদাবাবুর মিগাজিন ইস্টল থিকে। পরের দিন আবার ঘুরায়ে দে আসি।
আমার ছুটোখাটো সোমসার। আমি, আমার বউ রেখা আর ছেইলে লম্বোদর। সবাই আদর কইরে ল্যামডা বুলে ডাকে। তা-বাবু ল্যামডা আমার ভাল ছিল্যে, কিন্তু বহুত চঞ্চল। উই পেরাণবন্দুক ইশকুলে কেলাশ ফাইভে পড়ে। দিদিমনিরা বুলে পড়াসুনা মোটে করেনাকো। অঙ্কেও এক্কেবারেই বুর্বক। হবেনে? তার মা-বাপ দুটাই অঙ্কে ফুস। যেমন কমজোরি বীজ তেমনি ল্যাগব্যাগে গাছ! সিদিন ইশকুল থিকে ডাক এল্যো। খোদ বদ্দিমনি ডেকিচে। সেই থিকে বড় চিন্তায় আচি। শুনিচি তিনি অঙ্ক কষেন মা-দুগ্গার মত আর অঙ্কগুলাকে মহিষাসুরের মত পটাপট মেরে পাট করি দেন। তাই ডর লাগতিচে। আমার মহিষাসুরের মত চ্যায়রা দেকে যদি রেগি যেয়ে মুকেও অঙ্ক কষতে বলেন? রাতিবেলার ঘুম পাইলেচে মুর। এই একন ঝ্যামন শুয়ে শুয়ে ঝিঁঝিঁপোকার গান শুনতেচি। ঘুমটা এস্যেও চটকে যাচ্চে ওই বদ্দিমনি আর অঙ্কের কতা ভেবি।
হাজিরার দিনটা ঝ্যানো জলদি এসি গেল! মুই দ’কানের ঝাঁপ ফেলি ইশকুলের গেটে গেই বল্লাম বদ্দিমনি ড্যাকিচে। শুনে চাপরাশি নি ঢুকায়ে দেল বদ্দিমনির আপিসঘরে। মিশিন চলতিচে, ঠান্ডা ঘর। ভয়ে মুর হাড়মাসেও হিম হিম। দেকনু বদ্দিমনি চশমা চ’কে দে গম্ভীর হইয়ে কি ঝ্যানো নিকতিচেন। লিচ্চয় অঙ্ক বানাইতিচেন আমারে দিবেন বলি। হেই গ’ মা-দুগ্গা, রক্কা কোরো মা গো, আগাম পুজোয় মন্দিরে পাঁচ-ফল চড়াবো।
আমার ঝন্যি অঙ্ক মানে বিশ-বাঁও জল। অঙ্কও আমায় দেকলে হুউ-ই দুত্থেকে খিক খিক কইরে হাসতি লাগে। জমা-খরচের হিসেপ লিখতি গেলি এক দ’রজন গলতি হয়। ত্যাখন সমরদা এসি বাঁচায়। এখন আমারে কে বাঁচাবে বাপ? ভেবিই গায়ের রক্ত জল হইয়ে গেল।
তা সে আপিসঘরে গে তো মুই অকুলে পল্লাম। দেকি চাদ্দিকে অঙ্ক-কেতাব আর অঙ্ক-কেতাব। মুর গুটা গা বেইয়ে ঘাম ঝরতি লাগলো। গলা শুখায়ে ফুটিফাটা পাত-কো। পা দুখানে ঠকঠক ভুঁইকম্পক। বদ্দিমনির টেবুলে ফাইলের বোঝা, কলমদানী, ড্যাস্টর (ম্যাস্টরের ড্যাস্টর থাকবেনে?), গাদাখানি কলম, চকখড়ি, পেলশিন, রবাট আরও ক্যাতো কিচু ছেল। সেসব দেকেই মুর বুক ধড়পড়। কুন দিক দে পালাই ভাবতে ভাবতে যেই না দু-পা পেচোনু, অমনি বদ্দিমনি উটে এক লাফে খপ্ করে আমার ঘেঁটি ধরি ফেলি বললেন, “পালাস কোতায় বাছা? তোর ছেলি অঙ্ক পারেনা তোর ঝন্যি। আজ যদি তুই জমা-খরচের ক্যালকুলুশন ঠিকমত না শিকেচিস তবে তোর একদিন কি মোর একদিন! শিগ্গির বোস এখেনে আসনপিঁড়ি পেতি। শেলেট নে, পেলশিন ধর। লেক…! দিনভর ফাঁকিবাজির ধান্দা ঘুচোচ্ছি তোর দাঁড়া। পাঁটা কোথাকার! বাপ না পারলি ছেলি নেকাপড়া পারবে? বাপ গাধা হলি ছেলে কি রামচন্দর হব্যে? উজবুক”!
মুই ঝ্যানো ত্যাকন সত্যি-সত্যিই আস্তো একখান বলির পাঁটা। মুর পেটের মধ্যি কালবোশেখি ঝড়-বাদলের জবড়জস্ত গুড়গুড়ুনি। কুন দিক দে পালাই ভাবতে নাগনু। শেষে উপায় না দেকি ধপাস কইরে বদ্দিমনির পাইয়ে আছাড় খেই হাউমাউ কেঁইন্দে বননু, “বদ্দিমনি গো, এবারকার মত ছেড়ি দ্যাও গো, লম্বোদর আর কুনোদিন অঙ্ক ভুল করবেনি আর আম্মো তুমার আপিসে আসবনি। নাক, কান, দাঁত সব মলচি। বিশ্বেস না হলি এ্যাই দ্যাকো, দ্যাকো…। ছেড়ি দ্যাও গো বদ্দিমনি, পিলিজ। অঙ্ক মুর মোট্টে হজম হয়নে। পেটের অসুক করে, চ’কে আঁধার দেকি, হাত পা কেমন এলু এলু হইয়ে যায়।
বদ্দিমনি মুকে বলিচে পাঁটা। মুই যদি পাঁটা হই তবে বদ্দিমনি রয়েল-বেঙ্গল বাঘিনী। সামনে জলজ্যান্তক পাঁটা পেলি বাঘিনী ছেড়ি দেয়? বইললেন, “উঠ্…উঠ্ শিগ্গির। খবদ্দার যদি জমা-খরচের অঙ্কগুলো না শিকে এই ঘর থিকে বেরোয়েচিস, দুটা ঠ্যাং ভেঙ্গি দিব”। বলেই ইস্কেল দে মুর পেচুনে ঠাঁই ঠাঁই করে চার-ঘা দেলেন। মুর পেটে ত্যাকন আরও বেশি গুড়গুড় পাকাতে নাগছেল। মাতা ঘুরছেল। মুই ঝ্যানো পড়ি যাব। মাগো দুগ্গা…কোতায় গো, বাঁচাও মাগো এট্টিবার!
“উঠ্…উঠ্ শিগ্গির…উঠ্…”! পেচুনে ইস্কেল মারে আর বদ্দিমনি চ্যাঁচায় “উঠ্…উঠ্…”। ত্যাকন হটাত চ’ক খুলে দেকি বদ্দিমনি লয়গোওও, মুর বউ মুকে ছেলের নেকাপরা করার ইস্কেল দে ঝাপটি মাচ্চে আর বলচে “উঠ্…উঠ্, শিগ্গির উঠ্! দিনভর সোমসারে খেটে মরি, আবার রেতেও ঘুমুতে দ্যায়নাকো। ঝ্যামন নাক ডাকুনি, ত্যামন পেট গুড়গুড়োনি। ঝ্যানো রাম-রাবনের যুদ্ধু! শিগ্গিরই পাশ ফেরে শোও বলচি, পাশ ফেরো। কতবার মানা কন্নু অতখানি মুলোঘন্ট রাতেরবেলা খেওনি, কতা শুনলে তো! একন মুর ঘুমের চোদ্দটা ব্যাজায়ে নিজে ঘড়ঘড়িয়ে ফড়ফড়িয়ে ঘুমুচ্ছে! কি আখাম্বা লোকের সাতে বে দিছিলে মাগোও-ও-ও…!”
তা বউয়ের উদুম গালি আর ইস্কেল পিটান খেয়ে এই পত্থমবার মুর ভারি আলন্দ হোল্যো। ঘরের কাজেকম্মে বউয়ের বিচুটিপাতার মতুন খসখসি হাত দুখান ধরি মুর নাগল ঝ্যানো পদ্মকলি ধরিচি। ফুত্তিতে বললাম, “বউ, তুই কি ঝানবি কি ফাঁড়া থিকে বাঁচালি তুই মুকে! আর এট্টু হইলে বদ্দিমনি কুলকুলুশন না কি ঝ্যানো অঙ্ক কত্তে দেচ্চিলো। তুই ইস্কেল ঝাপুটি মাল্লি বলিই না ঘুম ভেইঙ্গে বুইত্তে পাল্লাম বদ্দিমনির আপিসে লয়, এখেনে নিজির ঘরেই শুই আচি, এই ঠিক তুর পাশটিতেই। তুই যি এ্যাতো সোন্দর তা আগে ঝানা ছেলনা। আর কুনওদ্দিন তুকে কালা-কুষ্টি-মুটকি বলবনিকো। কস্সম সে। দে দিকিনি আরো দু-চার ঘা ইস্কেলের ঝাপুটি। কি যে মিঠে লাইগল কি বলি! কাল আরও এট্টা ইস্কেল এনি দিব, ঠিকাচে? ল্যামডার ইস্কেল ভেঙ্গি গেলি আবার বদ্দিমনি বকতি পারে। ত্যাকন আবার ডেকি পাঠালে বাপু আর ইশকুলের আপিসে যেতি পারবনিকো। হ্যাঁ!
অ’ বউ, এই দ্যাক তুর ইস্কেলের গুঁতোয় পেট গুড়গুড়ও পাইলেচে। তুই আমার সর্ব-রোগহারি ধন্বন্তরি। আন দেকি তোর ফুলকো-নুচি গালটা এপাশে। একটা চুমকুড়ি খাই”।
“আ মোলো যা”…! (অন্ধকারে টকাস করে একটা আওয়াজ উঠল, স্কেলের ঝাপটি না চুমকুড়ি বোঝা গেলনা।)
কাল ইশকুল থিকে সত্যিকারের ঘুরে এসিচি। বদ্দিমনির আপিসেও সেঁধোয়েচিলাম। তিনি এট্টুও বকেননিকো। উলটে বললেন ল্যামডাকে রোজ ছুটির পর একঘণ্টা ইশকুলে রেকে অঙ্ক শেকাবেন, মাগনা। মুই তো আল্লাদে আটখান। ঢিপ করি পণাম দিয়ে পাইলে এইচি।
দুদিন পর আজগি মুর চা-দ’কানে সকাল থিকে জোর আলোচনা চলচে। পাড়ার পাকড়াশীবাবু পেপার-কাগজের হেডলাইন পচ্চেন জোরে জোরে, “প্রাণবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের বড়দিমনি ছাত্রীদের ঘুষ দিতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পল্লেন”। সবার কান খাড়া। সুরেশবাবু আগ বাড়িয়ে জেজ্ঞেস করলেন “ঘুষ? কতটাকা ঘুষ”?
পাকড়াশী আরও দুচার লাইন পড়ি নে বললেন, “টাকা-পয়সা না। অঙ্ক ঘুষ। কোন মিডিয়া পার্টি নাকি স্টিং-অপারেশন করে ফাঁস করেছে যে ইশকুলে ছাত্রীদের অঙ্ক ঘুষ দেওয়া চলছিল, যাতে বোর্ডের পরীক্ষায় ভালভাবে পাশ করতে পারে। এমন ঘুষ উনি নাকি পতিবছর দ্যান এবং সুদে-আসলে উসুল করেন পরীক্ষার রেজাল্ট বেরলে ছেলেমেয়েগুলোর হাসি মুখগুলো দেখে। চুপি চুপি কেউ ফটো তুলে ছেপেছে বুঝলে? লোকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, হুঁউঃ!”
পাশের মিগাজিন ইস্টলের সমরদাদাবাবুও দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেল। হা হা করি হেসি বললেন, “বিনা পয়সায় অঙ্ক ঘুষ? ভাবা যায়? সেটা আবার পেপারে? বেনিয়ম কোথায় গিয়ে পৌঁচেছে! বড়দিমনিকে আমরা ভাল করেই চিনি, ওনার মত সৎ একজন শিক্ষিকা ঘুষ নিয়েছেন একথা উনি নিজে এসে বললেও আমি মানতে পারবনা। রামো… রামোঃ! যতোসব ফাজলামী কান্ড-কারখানা”!
পেপার-কাগজের ছবিটা দেকে সমরদা হেসি হেসি বললে, “স্কুলের স্টুডেন্টগুলো কিন্তু বেজায় সাহসী! বড়দির সামনে চেয়ারে বসে অঙ্ক করছে। আমি হলে তো ভয়েই আধমরা হয়ে যেতাম গো। কিন্তু ছবিটা তুললো কে? সেটাই ভাবছি”।
আমি বল্লাম, “ভাল আর সাচ্চা বদ্দিমনিরা পমাণ রেকে কাজ করেন। তাই নিঝিই নিঝির ইশটিং-অপ্রেশন করেচেন বুদয়!”
“হাঃহাঃহাঃ…। আর যে বাচ্চাগুলো বড়দিমনির মত বাঘিনীর সামনে বসে অঙ্ক কষছে, তারা সামনের বছর দিল্লিতে অসম-সাহসিকতার জন্য ছাব্বিশ জানুয়ারি হাতির পিঠে চেপে রাজপথ দিয়ে যাবে।”
মুই ব’ল্লাম, “সমরদাদা, মুই চিলাপাতা জঙ্গলের ফরেস-গাটকে চিনি। ছ’-বচর দুয়ার্সে ছেলাম কিনা! তেনাকে ফুন কল্লিই হাতি সাপ্লাই দিবে। তুমার চাই এট্টা”? শুনে সব্বাই হাসতে লাগল। আমি হিঁ হিঁ করে হেসি মাতা চুলকোলম।
“কিন্তু তোর জমা-খরচের হিসেব শেখার কি হবে?” পাকড়াশীবাবু ব’ল্লেন। এ বাবা উনি কতাটা ভুলেননি দেকচি!
“কাল থেকে আমিই তোকে অঙ্ক শেখাব। আজকালকার দিনে টাকা পয়সা জমা-খরচের ক্যালকুলেশন জানা খুবই জরুরী। তার জন্যে তোকে আমি রোজ পাঁচ টাকা হাতখরচও দেবখন”, সমরদাদা হেসি হেসি কইলেন।
“আবার অঙ্ক? তাও আবার ঘুষ খেইয়ে? ও বাবা গো…, আমায় ছেড়ি দ্যাওগো সমর দাদাবাবু, তুমি আমার ভাল দাদাবাবু। দুকানের হিসেপের ঝন্যি আমি আর কুনোদিন তুমায় ডিস্টাপ করবনি। এই কান ধচ্চি, নাক মুলছি!”
ভইয়ে ভাঙ্গা টুল থিকে মাথা ঘুরি ডিগবাজি খেয়ি ধড়াস করি মাটিতে পড়ি গ্যালাম। হায়-গ’, অঙ্কে আমি যি বিলকুল লবডঙ্ক। কিচুতেই কিচু মাতায় ঘুসে না। সমর দাদাবাবু রোজ পাঁচ ট্যাকা ঘুষ দিলিও না। কস্সম-সে!
**************************************************
মধুমিতা ভট্টাচার্য্য পরিচিতিঃ
জন্ম আসানসোলে, সেখানেই স্কুলবেলা শেষ হলে শান্তিনিকেতনে বাকি পড়াশুনো। লেখালিখির ভালোবাসা হাত ধরে লিখিয়ে নেয় কবিতা, ছোটগল্প বা প্রবন্ধ। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বে থাকায় ছোটদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ তাই খুব ভালোলাগা ছোটদের জন্যে ছড়া বা গল্প লেখা। গান শোনা ও দু-চার কলি কন্ঠে সাজাতে ভালো লাগে, ভালো লাগে কিছু আঁকিবুকির সময় কাটাতে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, যেন এমনিই শব্দশস্যে আর রং ও সুরের সম্ভারে জীবনক্ষুধার নিবৃত্তি হতে পারে শেষ দিনটিতেও। শুভেচ্ছা জানাই ‘কুলায় ফেরা’র সঙ্গে যুক্ত সব সদস্যকে।