Shadow

মুক্তির আকাশ – অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

মুক্তির আকাশ

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

দিব্য ঝকঝকে এক সোনালী সকাল। তবে এখানে রোদের তেজটা একটু যেন বেশীই। আর সেটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। কারণ রাজ্যটা হল মহারাষ্ট্রের একটা শহর পুনে। তবে আমার কিন্তু এখন তেমন গরম লাগছেনা। ঘামও হচ্ছে না। খুব ভোরেই আজ হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। আর তখন থেকেই নিজেকে বড় হালকা ফুরফুরে মনে হচ্ছে। সেই বহুদিন আগে হলং বেড়াতে গিয়ে ভোরবেলায় পাগলা হাওয়ার বুকে নিজেকে সমর্পণ করা শিমুল তুলোর উদ্দেশ্যবিহীন ওড়াউড়ি দেখেছিলাম। এখন নিজেকে ঠিক সেই নরম, তুলতুলে শিমুল তুলোর মতোই লাগছে।
আমি এখন বেশ জমিয়ে সোফার মাথায় চেপে দুই বন্ধুর বিচিত্র ঝগড়া উপভোগ করছি। দিনকয়েক আগে আমি বেড়াতে এসেছি পুনেতে, আমার বড়মেয়ের কাছে। দুই বন্ধু একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বেশ সুন্দর মিলেমিশে থাকে। তবে লড়াইটা হয় মূলতঃ খাওয়া নিয়ে। ক্রিসেন্ট দক্ষিণী খাবার পছন্দ করে, আর আমার মেয়ে অবশ্যই বাঙালি খাবার।
গত পাঁচদিন ধরে তাদের এই আপাত-মধুর-কলহ আমি দুই কানে বালিশচেপে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে এসেছি। কিন্তু আজ তো আমার ঘুম অনেক আগেই ভেঙে গিয়েছে। তাই সোফার মাথায় চেপে হাতে তালি মারতে মারতে অবিরাম বলে চলেছি নারদ-নারদ। ওরা এতই ঝগড়ায় মগ্ন হয়ে রয়েছে যে আমার উপস্থিতি তাদের নজরেই পড়ছে না। অবশেষে, ঝগড়ায় ক্লান্ত দুজনের মধ্যে একসময় সন্ধি হল, ঠিক হল তারা সকালের খাবারটা এরপর থেকে বাইরেই খেয়ে নেবে। এবং দুজনেই বলল, আমরা আর বেশীদিন একসঙ্গে, এক গৃহে বসবাস করতে পারব না। ঝগড়া থেমে গিয়েছে, দুজনেই তৈরি হচ্ছে কর্মস্থলে বেরোবার জন্য। আমিও বিরস বদনে ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী ঘরে। জমিয়ে উঠে বসলুম একটা চেয়ারে।
খাট নেই, ভূমিতেই শয্যা। গরম কাল, ফনফন করে পাখা চলছে। কিন্তু আমার কেমন যেন শীত-শীত লাগছে। কিন্তু এত আলিস্যি যে উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিডটা কমাতেও ইচ্ছা করছিল না।তাই চুপ করে বসেই রইলুম।
আর ঠিক তখনিই!
দুম করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল, আমার গুন্ডি মেয়ে দপদপিয়ে ঘরে ঢুকে এল, রাগ এখনও, একটুও কমেনি। কন্ঠস্বর যথেষ্ট ভারি, বলল, বাবাই এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ, খাবার টেবিলে রেখে গেলাম সময়মতো খেয়ে নিও। আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। আজ রাত্রে বাইরে খেতে যাব। আমরা তোমাকে ট্রিট দেব। কাল তোমার সকালের ফ্লাইট, চেন্নাই হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে! এটা মাথায় রেখে যা করার করবে কিন্তু! একটা একস্ট্রা চাবি টেবিলে রেখে গেলাম। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, আজকেও লেট!
আমি বললুম, বাপরে বাপ! এত রাগ যে চেয়ারে বসে থাকা আস্ত বাপটাকেই দেখতে পাচ্ছিস না!
আমার কথা কানে না তুলেই দুমদুমিয়েই সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
গুন্ডি বেরিয়ে যাবার পর এল ক্রেসেন্ট, বলল, আঙ্কেল গুডমর্নিং। বেরোচ্ছি।
বাড়ি এখন শান্ত। ঠিক কচি বয়েসের মতো দুটো ডিগবাজি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম নিজের বাড়ির দিকে। না, আজ ডিগবাজি খেতে কোনও কষ্ট হয়নি। ফিরে এলাম আমার সেই প্রিয় বাড়িতে। নিঃশব্দে প্রবেশ করলাম নিজ গৃহে।
আমার বউ, আমার বহুকালের বান্ধবী সোফায় বসে তখন তার বড় মেয়ের সঙ্গে ভিডও কলে ব্যস্ত। আমি গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়লাম আমার ছোট মেয়ের ঘরে।
সেই ঘরে ছোটাই ছাড়া আমার আরও দুই মেয়ে বসবাস করে। ঘুমে আচ্ছন্ন ছোটাইয়ের আগে মিঠাই ও জিনি আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। শুরু হল তাদের প্রবল চিৎকার। তাদের মাথায় শরীর বুলিয়ে উঠে এলাম দোতলায়, তারপর সোজা ছাদে। আমার সেই প্রিয় ছাদ! আর দেরি করলাম না, এবার নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম মহাশূন্যে।
পুনে যাওয়ার দিনকয়েক আগে আমাদের পাড়ার অনিলকাকু মারা গিয়েছিলেন। আজ বোধহয় তাঁর কাজ।মনে হচ্ছে কাজটা করছেন সন্তু জ্যাঠামশাই। কানে ভেসে এল তাঁর ভারী সুললিত কন্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ—‘মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ। মাধ্বীর্নঃ সন্ত্বোষধীঃ…..।’
ইতিমধ্যে আমি এখন আরও অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি। সেখান থেকেই একবার নীচের দিকে তাকালুম, দেখলুম পুনের সেই অস্থায়ী ঘরের ভূমি শয্যায় আমি এখনও পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছি। এবার হাওয়ার বুকে নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম। মুক্তির আকশে মুক্ত পাখির মতো নিজেকে ভাসিয়ে দিলাম।
********************************************

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় পরিচিতি
কলেজ জীবন শেষ করার পর ঘটনাচক্রে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ। সাংবাদিক জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা অভিনেত্রী ও গায়িকা কানন দেবীর সাক্ষাতকার। পরে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল দেশ পত্রিকায় ‘আমি পরিপূর্ণ জীবন যাপন করলাম’ শিরোনামে। তারপর সুযোগ হয়েছিল সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, মৃনাল সেন, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু ভট্টাচার্য, মুকুল দত্ত, নবেন্দু ঘোষ, রবিশঙ্কর, সুচিত্রা মিত্র সহ বহু বিশিষ্ট মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার। ২০১১ সালে বর্তমান পত্রিকার পূজো সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাঘবন্দি খেলা’ লেখকের প্রথম দীর্ঘ উপন্যাস। 

1 Comment

  • Sutapa Bandyopadhyay

    খুব ভালো লাগল আপনার গল্প। আপনার পরিচয় জেনে বুঝলাম আপনি সে-ই অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়, যিনি বিখ্যাত গায়িকা ও অভিনেত্রী কানন দেবী-র সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং তা ‘দেশ’ পত্রিকা (শারদীয় ১৯৯২)-য় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে জানাই, সেটি পড়ার সুযোগ আমার হয় এবং সম্প্রতি কানন দেবীকে নিয়ে আমার একটি লেখায় তার থেকে তথ্য গ্রহণ করে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ। লেখাটি ‘ফেসবুক’-এ আমার টাইমলাইনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর কানন দেবীর নামে একটি ‘ফেসবুক পেজ’ তৈরি করে সেখানেও ‘শেয়ার’ করেছি। ভালো থাকবেন। আপনার কাছ থেকে আরও লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।

Comments are closed.

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত !!