জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন – সোমনাথ
বিজিত কুমার রায়
এবার চলুন গুজরাটের এক অপরূপ সুন্দর মন্দির দেখে আসি। বিশাল জায়গা নিয়ে অপূর্ব সুন্দর মন্দির ও মুর্তি (লিঙ্গ) একদম সমুদ্রের ধারে। এই মন্দিরটি প্রভাস পাটান নামক জায়গাতে। একদম ভিড় না থাকাতে আমরা প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে দর্শন করলাম ও পূজা দিলাম। এখানে শিবলিঙ্গের মাথাতে জল দেওয়ার জন্য অনেকটা দূর থেকে একটি পাইপলাইন মতো আছে। এই মন্দিরের দর্শনের অনুভূতি লেখাতে প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই কারণ বহুকাল ধরে স্বপ্ন ছিল এখানে আসার। তবুও সোমনাথের সম্বন্ধে কিছুটা ঐতিহাসিক পটভূমিকা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। গুজরাট রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের ভেরাভলের নিকটস্থ প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে পবিত্রতম। সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত। কারণ, অতীতে ছয় বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি সত্বর পুনর্নিমিত হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জুনাগড়ের ভারতভুক্তির সময় এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান ভারত সরকারের অপর এক মন্ত্রী কে. এম. মুন্সি।
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষ প্রজাপতি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে চন্দ্র প্রভাস তীর্থে শিবের আরাধনা করলে, শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এই কারণে চন্দ্র সোমনাথে শিবের একটি স্বর্ণমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্য ও কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠ দ্বারা মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন। গুজরাটের সোলাঙ্কি শাসক ভীমদেব মন্দিরটি নির্মাণ করেন প্রস্তরে। প্রসঙ্গত, সোলাঙ্কি ছিল ভারতের পাঁচ রাজপুত রাজ্যের অন্যতম। সোমনাথ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা শিব সোমেশ্বর মহাদেব নামে পরিচিত। পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগে সোমেশ্বর মহাদেব ভৈরবেশ্বর, ত্রেতাযুগে শ্রাবণিকেশ্বর ও দ্বাপর যুগে শ্রীগলেশ্বর নামে পরিচিত ছিলেন। চন্দ্র তাঁর স্ত্রী রোহিণীর প্রতি অত্যধিক আসক্তি বশত তাঁর অন্য ছাব্বিশ স্ত্রীকে উপেক্ষা করতে থাকেন। এই ছাব্বিশ জন ছিলেন দক্ষ প্রজাপতির কন্যা। এই কারণে দক্ষ তাঁকে ক্ষয়িত হওয়ার অভিশাপ দেন। প্রভাস তীর্থে চন্দ্র শিবের আরাধনা করলে শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এরপর ব্রহ্মার উপদেশে কৃতজ্ঞতাবশত চন্দ্র সোমনাথে একটি স্বর্ণ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্যে, কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠে এবং রাজা ভীমদেব প্রস্তরে মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন।
সোমনাথের প্রথম মন্দিরটি খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে বিদ্যমান ছিল। গুজরাটের বল্লভীর যাদব রাজারা ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধের আরব শাসনকর্তা জুনায়েদ তাঁর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন। তারপর ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে গুজ্জর প্রতিহার রাজা দ্বিতীয় নাগভট্ট সোমনাথের তৃতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল লাল বেলেপাথরে নির্মিত সুবিশাল একটি মন্দির। ১০২৪ খ্রিস্টাব্দে মামুদ গজনি আরেকবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন। ১০২৬ থেকে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোনো এক সময়ে গুজ্জর পরমার রাজা মালোয়ার ভোজ ও সোলাঙ্কি রাজা আনহিলওয়ারার প্রথম ভীমদেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল কাঠের তৈরি। কুমারপাল (রাজত্বকাল ১১৪৩-৭২) কাঠের বদলে একটি পাথরের মন্দির তৈরি করে দেন। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যবাহিনী পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে। হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসির লিখেছেন, গুজরাটের রাজা করণ পরাজিত হন, তাঁর সেনাবাহিনী পলায়ন করে, “পঞ্চাশ হাজার কাফেরকে তরবারির আঘাতে নরকে নিক্ষেপ করা হয়” এবং “বিজয়ীদের হাতে আসে কুড়ি হাজারেরও বেশি ক্রীতদাস ও অগণিত গবাদি পশু”। ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে সৌরাষ্ট্রের চূড়াসম রাজা মহীপাল দেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। তাঁর পুত্র খেঙ্গর ১৩২৬ থেকে ১৩৫১ সালের মাঝে কোনো এক সময়ে মন্দিরে শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান প্রথম মুজফফর শাহ আবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন। মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হলে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুলতান মাহমুদ বেগদা আবার এটি ধ্বংস করে দেন। কিন্তু এবারও মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেন। আওরঙ্গজেব সোমনাথ মন্দিরের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদে হিন্দু শাস্ত্র-ভিত্তিক মোটিফগুলি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েনি। পরে ১৭৮৩ সালে পুণের পেশোয়া, নাগপুরের রাজা ভোঁসলে, কোলহাপুরের ছত্রপতি ভোঁসলে, ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকর ও গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত পাতিলবুয়া সিন্ধের যৌথ প্রচেষ্টায় মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মূল মন্দিরটি মসজিদে পরিণত হওয়ায় সেই জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধ্বংসাবশেষের পাশে।
তেরো শতকের আরব ভূগোলবিদ আসারু-ল-বিলাদ ওয়ান্ডারস অফ থিংস ক্রিয়েটেড, অ্যান্ড মার্ভেলস অফ থিংস এক্সিস্টিং বইতে লিখেছেন যে “সোমনাথ: ভারতের বিখ্যাত শহর, সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত এবং সমুদ্রের তরঙ্গবিধৌত। এই স্থানের বিস্ময়কর স্থানগুলির মধ্যে একটি হল এক মন্দির যেখানে সোমনাথ নামে একটি বিগ্রহ রয়েছে। বিগ্রহটি মন্দিরের মাঝখানে নিচের কোনোরকম ঠেকনা ছাড়াই উপর থেকে ঝুলে রয়েছে। (এই ব্যাপারটি এখন আর আমাদের চোখে ধরা পড়ে না।) নতুন তৈরি গ্র্যানাইট পাথরের মন্দিরের থেকে প্রায় আধা কিমি দূর থেকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আর আঁটসাঁট পাহারা। সমস্ত মোবাইল ক্যামেরা ইত্যাদি জমা দিয়ে সচিত্র পরিচয় পত্র দেখিয়ে ঢুকতে হয়। এই পাঁচিলের ডান দিক দিয়ে সমুদ্রের দিকে কিছুটা গেলে অহল্যাবাইয়ের প্রতিষ্ঠিত পুরানো মন্দির। মন্দিরে ওপরে ছোট একটি লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ও নীচে গর্ভগৃহে সোমনাথের মূল সুপ্রাচীন জ্যোতিরলিঙ্গ।
নুতন মন্দির চত্বর সুন্দর ভাবে সাজানো বাগান ইত্যাদি দিয়ে। প্রসাদ ইত্যাদি বিক্রয়ের জন্য আলাদা দোকান। মন্দিরের সামনে কিছুটা বামদিকে একটি সুবৃহৎ জায়ান্ট স্ক্রিন যাতে মন্দিরের ভিতর দৃশ্য স্পষ্ট দেখা যায়। তার সামনে বসার সুন্দর ব্যবস্থা। যারা মন্দিরের ভিতরে ভীড়ে দাঁড়িয়ে আরতি দেখতে অসমর্থ তারা বাইরে বসে লাইভ আরতি এই স্ক্রিনে দেখতে পারেন। মন্দিরে পেছন দিকে সমুদ্রের ধারে সুন্দর করে বসার জায়গা সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ও সূর্যাস্ত, যা এক অতুলনীয় দৃশ্য, দেখার জন্য। মন্দিরের ভেতরে দর্শনের ও পূজার অত্যন্ত সুব্যবস্থা। রেলিং দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে দর্শন করার ও পূজা দেওয়ার ব্যবস্থা। সেখান থেকেই একটি ফানেলের মধ্যে জল ঢাললে সেটি পাইপের মধ্য দিয়ে লিঙ্গের ওপরে ধীরে ধীরে পড়ছে। আমরা পূজা দেওয়ার পর আরতি দেখার জন্য প্রায় ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম রেলিংয়ের ধার দিয়ে। ধীরে ধীরে সারা মন্দিরের ভেতরটি ভরে গেল। সত্যই তিল ধারণের জায়গা নেই। আগের থেকে দাঁড়ানোর জন্য আমরা পরিষ্কার ভাবে সমগ্র আরতি যা এক রাজকীয় ব্যাপার তা দেখতে পেলাম। পূজারীরা ও ভক্তরা সমবেত স্বরে কাঁসর ঝাঁজ বাজার সাথে স্তব পাঠ করতে লাগলেন।
ভজ শিব ওমকারা হর শিব ওমকারা
নাথ ভোলে মহাশম্ভু
ওম হর হর হর মহাদেব ।———
রাজকীয় ভাবের সেই আরতি দেখে বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে। এই সুন্দর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে হোটেল ফিরে যেতে যেন মন চায় না।
চন্দ্রস্য যশসে তত্র নামনা চন্দ্রস্য বৈ স্বয়ম।
সোমেশচরশ্চ নামনাসিৎ বিখ্যাতং ভুবনত্রয়ে।।
মাইকে গান ভেসে আসছে “অব শিব পার করো মেরে নাইয়া”।
আজ জীবন যেন সার্থক হলো সোমনাথ মহাদেবের সন্ধ্যা আরতি দেখে একদম মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে। হর হর হর মহাদেব।
শিবলিঙ্গের ছবি তোলা বারণ। সেইজন্য আর রাতের সোমনাথ আমার তোলা হল না।
************************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে।
রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ – পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।