জ্যোতিরলিঙ্গ ত্র্যম্বকেশ্বর
বিজিত কুমার রায়
কোম্পানির কাজের সুবাদে ২০০৬ সালে থাকতে হয়েছিল নাসিকে ৫ দিন। সেই সময়ে সস্ত্রীক ভ্রমণ করি নাসিক, ত্র্যম্বকেশ্বর, শিরডি সাই ও শনি সিংনাপুর। একদিন বৈকাল বেলা বেরিয়ে আমরা নাসিক শহর ঘুরে দেখলাম। বনবাসকালে শ্রী রামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষণ এই নাসিকের পঞ্চবটিতে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। তখন এই জায়গার নাম ছিল “জনস্থান”। এই স্থানেই রামায়ণে আছে শুর্পনখার নাক কেটে দেন লক্ষণ তাই প্রচলিত আছে এই জায়গার নাম নাসিক বলে। চারিদিকে দূরে দূরে সবুজ পাহাড় ঘেরা সুন্দর শহর নাসিক।
প্রথমে আমরা মা গোদাবরীর মন্দিরে দেবীমূর্তি দর্শন ও প্রণাম করে রামঘাটে এসে নদীর জল স্পর্শ করলাম। এই বিখ্যাত রামঘাট। এখানেই প্রতি বারো বছর অন্তর মাঘ মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে বৃহস্পতি গ্রহ সিংহ রাশিস্থ হলে বৃহস্পতিবারের মধ্যাহ্নে কুম্ভ যোগ হয়।
এরপর দর্শন করলাম কপালেশ্বর মহাদেব। তারপরে ‘কালারামের’ মন্দিরে। এখানে তিনজনের মূর্তিই কালো কষ্টিপাথরের। এছাড়া আছে ‘সীতাগুমফা’।
দুই দিন পর এক দিন দুপুরে যাওয়া হলো নাসিক থেকে ৩৭ কিমি দূরে ত্র্যম্বকক্ষেত্র। এসে পৌছালাম এক পাহাড়ের সামনে যার নাম ‘ব্রহ্মগিরি’। এর সামনেই বিশাল একটি চত্বরের মাঝখানে ত্র্যম্বকেস্বর জ্যোতিরলিঙ্গের বিরাট গ্রানাইট পাথরের মন্দির। ৭১২ ফুট উঁচু এই মন্দির। নাটমন্দিরের থামগুলিতে অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য। মন্দিরটির আকৃতির সাথে সোমনাথ ও দ্বারকাধীশ মন্দিরের সাদৃশ্য। মন্দিরের সামনে আরো একটি ছোট মন্দিরে নন্দিকেশ্বরের মূর্তি।চাতালের একপাশে একটি দীর্ঘকায় কালো পাথরের দীপ স্তম্ভ। এরপরে গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করলাম। সাধারণ শিবলিঙ্গের মতো নয়। বিরাট গৌরীপটের মাঝখানে সাত আট আঙ্গুল উঁচু ছোট ছোট তিন ভাগে বিভক্ত শিবলিঙ্গ। একে অপরের গায়ে লাগানো। অসমান আকৃতি। তারই মাঝখান থেকে মাঝে মাঝে জল চুঁইয়ে বেরোচ্ছে। মুছিয়ে দিলেও আবার বেরিয়ে আসছে। আর সেই ক্ষীণ জলধারা বেরিয়ে বাইরে একটি কুণ্ডে পড়ছে। এটিই গোদাবরী নদীর উৎস স্থল। পূজা সেরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। স্থানীয় লোকেরা এই জ্যোতিরলিঙ্গকে বলেন ত্রিম্বকেশ। যখন সাজানো হয়, বেনারসী শাড়ি দিয়ে ঢেকে সোনার তিনটি মুখাকৃতি টোপর পরানো হয়। তার ওপর রত্ন খচিত সোনার মুকুট এবং পিছনে রুপার একটি চেলি লাগানো হয়। মনে মনে আবার প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম মন্দির চত্বর থেকে।
শম্ভো মহেশ করুনাময় শূল পাণে।
গৌরিপতে ত্র্যম্বকেশ পশুপাশ নাশিন।
গোদাবরী তটবাসী মহেশ্বতোহসি।
গৌতমেশ বিশ্বেশ প্রণমামি নিত্যম।।
সংযোজন পাঠকদের অনুরোধে –
ত্র্যম্বকেশ্বর শিবমন্দির বিস্তারিত
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের পশ্চাতে ব্রহ্মগিরি থেকে গোদাবরী নদীর উৎপত্তি। যেতে যেতে বলে নিই ত্র্যম্বকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ ও দেবী গোদাবরীর আবির্ভাব-কথা। এই অঞ্চলে সত্যযুগে ঋষি গৌতম ও তাঁর পত্নী অহল্যা বাস করতেন। চারপাশ পর্বতবেষ্টিত তাই অরণ্যবাসী ঋষিদের বড় জলকষ্ট। ঋষিদের দুঃখ দূর করার জন্য ঋষি গৌতম বরুণদেবে তপস্যায় বসেন। বরুণদেবের কথামত একটি গর্ত খনন করলেন ঋষিবর। বরুণদেব বলেছিলেন, এই কুণ্ডের জল অক্ষয়, কখনও ফুরবে না।
জলকষ্ট দূর হল বটে কিন্তু একদিন আশ্রম-বালকেরা ওই কুণ্ড থেকে জল আনতে গেলে অপর ঋষিপত্নীরা তাদের ফিরিয়ে দিলেন। অহল্যা ছিলেন করুণার আধার—তাই এ কথা শুনে তাঁর বড় দুঃখ হল। তিনি তাঁদের ঝগড়া মিটিয়ে মধ্যস্থতা করলেন। কিন্তু এই ঘটনা গৌতম ও অহল্যাকে ঋষিদের বিষনজরে ফেলল। তারা ভাবল এই মুনিবর ও তাঁর স্ত্রীর তো ভারি দেমাক! তাই তারা ষড়যন্ত্র করল যে ঋষি গৌতমকে শাস্তি দিতে হবে। তখন গণেশের আরাধনা করে তারা এর বিধান চাইল। গণেশ প্রথমে সম্মত না হলেও শেষমেশ পরিণতি জেনেও এক রুগ্ণ গাভীর রূপ ধরে গৌতমের জমিতে ফসল খেতে লাগলেন। গৌতম একগাছি খড় দিয়ে গাভীটিকে আঘাত করতেই রুগ্ণতা হেতু সে প্রাণত্যাগ করল। এবার ঈর্ষাকাতর ঋষিরা গৌতমকে গো-হত্যার পাপে অভিযুক্ত করে বলল, এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। হয় গৌতমকে শতবর্ষ ধরে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে নিজের পাপের কথা বলে বেড়াতে হবে, তার পর শতবার এই ব্রহ্মগিরি প্রদক্ষিণ করতে হবে—অথবা গঙ্গাকে এখানে এনে তার জলে স্নান করে এক কোটি পার্থিব শিবলিঙ্গের পূজা করে এগারো বার এই ব্রহ্মগিরি প্রদক্ষিণ করতে হবে। গৌতম দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়ে শিবের পূজা আরম্ভ করলেন। পুণ্যাত্মা গৌতমের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তাঁকে দর্শন দিয়ে বললেন যে, গৌতম নিষ্কলুষ এবং ঋষিরাই পাপী। শিবের কাছে অহংবোধশূন্য গৌতম প্রার্থনা করেন, ঋষিদের জন্য আজ তিনি শিবের দর্শন পেলেন। গোহত্যার পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য যেন শিব তাঁকে গঙ্গাবারি দান করেন।
শিব তখন তাঁর কমণ্ডুল থেকে গৌতমকে গঙ্গাজল দান করলে গঙ্গা নারীমূর্তি ধারণ করে আবির্ভূত হলেন। গৌতম বললেন, মা, আমাকে পবিত্র করো। গঙ্গা বললেন, আমি শিব শরীরে মিশে থাকব। শিব বললেন, কলির শেষ পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকো। কাশীতে তোমার একাংশ ও এখানে অপরাংশ থাকবে। গঙ্গা বললেন, বেশ, তাই থাকব, যদি আপনি পার্বতীর সঙ্গে এখানে বিরাজ করেন। দেখতে দেখতে ভারতের সব তীর্থ ও দেবতাসকল সেখানে উপস্থিত হলেন আর গঙ্গার পবিত্র জলস্পর্শে মৃত গাভীটিও প্রাণ ফিরে পেল। গাভী বা গরুর প্রাণদানের জন্যই নদীর নাম ‘গোদাবরী’ আর গৌতমের পুণ্যবলে গঙ্গানদীর আগমনের জন্য এর নাম হল ‘গৌতমী গঙ্গা’। তাই গোদাবরীকে ‘গঙ্গা’ও বলা হয়ে থাকে।
ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরের পিছনের পাহাড় ব্রহ্মগিরি থেকে উদ্ভূত হয়ে গোদাবরী গুপ্ত ভাবে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসে ক্ষীণ আকারে বেরিয়ে আসছে জ্যোতির্লিঙ্গ ত্র্যম্বকেশ্বরের মধ্য থেকে। মন্দির থেকে কিছু দূরে কুশাবর্ত কুণ্ড ও গোমতী ঘাট। কুম্ভপর্বে যে তিনটি স্নান হয়, তার একটি রামতীর্থ রামঘাটে ও অপর দুটি হয় এই কুশাবর্ত তীর্থে।
******************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে।
রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ – পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।