শ্রীহরি
সোনালী গুহ
বৈকুন্ঠপুরের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র ব্যবসায়ী মানুষ|পরম বৈষ্ণব|গলায় তুলসীর মালা, দুই বেলা ইষ্ট নাম জপ না করে মুখে কিছুই দেননা| বাড়িতে মাংস দূরের কথা, মাছ ও ঢোকে না| অসম্ভব নিয়ম নিষ্ঠায় জীবন কাটান| বয়েস হয়েছে, চার ছেলেই এখন কারবার দেখা শোনা করে| মিত্রমশাই বাকিজীবন ধর্ম কর্মেই কাটাবেন স্থির করেছেন| স্ত্রী মনোরমা গত হবার পর থেকে আরো যেন পুজো পাঠ বেড়েছে| বাড়িতে চার ছেলে, চার বৌমা, দুই নাতি, একটি নাতনি| ছোট ছেলের এখনো সন্তানাদি হয়নি| এই নিয়ে মিত্রমশাই একটু আক্ষেপ করেন মনে মনে, কিন্তু মুখে কিছু বলেননা| ভাবেন, মনোরমা থাকলে নিশ্চয় যাগযজ্ঞ, তাবিজ কবজ করতেন কিছু| এটা ছাড়া সংসারে আপাত দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই| স্বচ্ছল পরিবারের চাকর বাকরের ও অভাব নেই| সংসারের রথ নির্বিঘ্নেই চলছে বলা চলে|
রাশভারী মিত্র মশাই একবার গঙ্গা স্নানে গেলেন কলকাতায়| বড় বৌমাকে ডেকে বলে গেলেন, “বৌমা, তুমি বড়, এই সংসারের কর্ত্রী| আমি থাকবো না সাতদিন, দেখে শুনে রেখো মা!” বৌমা রা সবাই শ্বশুরের বাধ্য| বড় বৌমা আশ্বস্ত করল শ্বশুরমশাইকে| মিত্রমশাই নিশ্চিন্তে গঙ্গা স্নানে গেলেন| এদিকে ওঁর পালকি রওয়ানা হওয়া মাত্রই ছোট বৌমা এসে উপস্থিত বড় জা উমাশশীর কাছে| ছোট জাটিকে একটু যেন বেশীই স্নেহ করেন উমাশশী| মামরা মেয়েটি বড় মায়ায় বেঁধেছে তাঁকে| বড় জার কাছেই যত আব্দার তার| এখন শ্বশুর মশাই কলকাতায় যেতে তরুবালা বড়জা কে বলতে লাগলো, “ও দিদি, এই কয়দিন তো বাবা থাকবেন না, চলো না, আমরা একটু মাছ খাই কয়দিন, কেউই জানবে না!”
উমাশশী তো চমকে উঠেছেন তরুর কথা শুনে…. “মুখপুড়ি, তোর নোলা দেখি বড্ডো বেড়েছে, জানিসনা, এবাড়িতে মাছ ঢোকে না”
“কেউই জানবেনা দিদি, তুমি মত দাও “….. এই বলে সে বায়না করতে থাকলে বাধ্য হয়ে উমাশশী মত দেন| আসলে সেই কোন ছোটবেলাতে বাপের ঘরে থাকতে শেষ মাছ খেয়েছেন, তাঁরও মনে মনে সাধ হয়েছিলো মাছ খাবার, ভয়ে বলেননি| এখন ছোট জা তরুবালার কথায় রাজি হয়ে গেলেন| চুপিচুপি বাড়িতে ওই সাতদিন চার জা মাছ রান্না করে মহা সমারোহে ভাত খেলো| আনন্দে সকলে আত্মহারা| কিন্তু মিত্রমশাই ফিরছেন খবর আসতেই তাঁরা বাড়িঘর পরিষ্কার করে রাখলো| কেউই জানলো না তাঁদের এই কীর্তির কথা|
যথা সময়ে মিত্র মশাই ফিরে সবার কুশল সংবাদ নিয়ে বিশ্রাম করছেন, গল্পে গল্পে সেদিন দ্বিপ্রাহরিক আহারে বিলম্ব হোল| চার ছেলে, নাতি, নাতনি নিয়ে তিনি খেতে বসেছেন মধ্যমণি হয়ে, বড় বৌমা, মেজ বৌমা, সেজো বৌমা, ছোটবৌমা সব্বাই ব্যস্ত পরিবেশনে| অনেক দিন পর তিনি বেশ তৃপ্তি করে বাড়ির খাবার খাচ্ছেন| এমন সময়ে ঘটলো অঘটন|
মিত্রবাড়িতে একটি কাকাতুয়া ছিলো| নাম শ্রীহরি| ওকে ডাকলে ঈশ্বর নাম নেওয়া হত| শ্রীহরি কথা বলতে পারতো| মিত্রমশাই যখন খেতে বসতেন, শ্রীহরি কে সামনেই একটা তারে দাঁড়সহ ঝুলিয়ে রাখা হত, এই অভ্যাস ওঁর অনেকদিনের| সেদিন ও তাই আছে| খাওয়া যখন প্রায় শেষ, শেষ পাতে ঘন দুধের জাম বাটিটি তিনি সবে টেনে নিয়েছেন, এমন সময়ে শ্রীহরি বলে উঠলো.. “মাছ খেলি না?” চমকে উঠলেন মিত্রমশাই| তাঁর বাড়িতে মাছের প্রসঙ্গ!!!!! শ্রীহরি মাছ ‘কথাটা’ শিখলো কি করে !!!!!! অবাক হয়ে তাকাতে আবারও শ্রীহরি একই কথা বলতে লাগলো| বৌমাদের মুখ গেলো শুকিয়ে! খাওয়া ছেড়ে শত বারণ সত্ত্বেও উঠে শোবার ঘরের আরামকেদারায় গিয়ে বসলেন তিনি| বাড়ির পরিবেশ গেলো পাল্টে| কী হবে এবারে !!! বৌমারা তো খেয়ালই করেননি শ্রীহরি তাঁদের কথোপকথন সব শুনেছিল, দেখেছিলে তাঁদের মাছ খেতে| তাঁরা তো ভাবতেও পারেননি যে এই কথা শ্রীহরি শিখে নিয়েছে এবং এই পরিস্থিতি হতে পারে| ভয়ে হাত পা ঠান্ডা|
সন্ধ্যাতে শ্বশুরমশাই এর ঘরে ডাক পড়লো বৌমাদের| সত্যি ঘটনা তিনি জানতে চাইলেন| গলা শুকিয়ে কাঠ উমাশশীর| তখন তরুবালা সব সত্য বলে শ্বশুর মশাই এর কাছে দোষের জন্য ক্ষমা চাইলেন| স্তম্ভিত মিত্রমশাই! সাহস হয় কী করে!! স্পর্ধা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন| এবারে বড় খোকাকে তলব করলেন| দুরুদুরু বক্ষে প্রৌঢ় বড়খোকা এসে মুখ নিচু করে দাঁড়ালে, মিত্রমশাই তাঁকে দুই সের ওজনের একটা বড় রুই মাছ বাজার থেকে কিনে আনতে বললেন এবং বড় বৌমাকে বললেন, “এবার থেকে এই বাড়িতে মাছ খাওয়া চলবে”|
বৌমাদের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে আরো একটা নির্দেশ দিলেন| সেটা শ্রীহরির জন্য| বললেন, “বড় খোকা কালই স্যাকরা ডেকে শ্রীহরির জন্য একটা সোনার দাঁড় বানিয়ে আনতে হবে, ভুললে চলবে না!”
*******************************************
সোনালী গুহ পরিচিতি
পেশায় শিক্ষিকা। মাতৃভাষায় কিছুটা মনের আনন্দে লেখালিখি করেন। অত্যন্ত অমায়িক, সবার সাথে মিলেমিশে, সবাইকে নিয়ে চলতে স্বস্তি অনুভব করেন।
দারুন লাগলো।
কি চমৎকার গল্প বলার ভঙ্গিমা, ভাষার বাঁধুনি … খুব সুন্দর ❤️
দারুন লাগলো