সবুজ প্রজাপতি
সুরজিৎ সরখেল
“কি হল রে,! মোবাইলটা বন্ধ করে শুয়ে আছিস! আর সকাল থেকেই যতবার ফোন করছি, সুইচ অফ। ঘড়িতে এখন তোর বারোটা বাজতে বারো মিনিট বাকি!”একতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে গম্ গম্ করে কথাগুলো বলতে বলতে সৌমীর ঘরের দরজাটা আস্তে ঠেলে রাজা সৌমীর মাথার কাছে বিছানায় নিঃশব্দে বসে পড়ল। এখনও নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে আছে। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে রাজা। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামার সঙ্গে বুকের মধ্যে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ ভেসে আসছে। কে বলবে ওখানেই মারণ রোগ বাসা বেঁধেছে পাকাপাকি ভাবে! গত বছর কাকু মারা যাবার পরেই রোগটা ধরা পড়ে। এখন সেকেন্ড স্টেজ চলছে।
“কার্সিনোমা” খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীর জুড়ে। ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা না হলে….! একটা আশঙ্কা ঘিরে ধরতেই রাজার চোখটা ছলছল করে উঠল। এ বাড়িতে মাত্র তিনটে মানুষ। সৌমী, সৌমীর মা সুনন্দা,আর ঠাকুমা। ঘুষুড়ি স্টেশনের পশ্চিমদিকে এই চক্রবর্তী পাড়াটা ওদের পাড়ার থেকেও নিরিবিলি। এখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে রাজাদের বাড়ি। এখানকার একমাত্র কো-এড স্কুলে পড়ার সময় থেকে ওদের প্রেম। দুই বাড়ীতেই ওদের সম্পর্ক মেনে নিয়েছে। মোটামুটি অনেকে জানেও। দুই বাড়ির মধ্যে নিবিড় সখ্যতাও আছে। দোতলায় সৌমীর ঘর থেকে সামনের বড় দীঘিটা দেখা যায়। জানালা দিয়ে বেয়ে ওঠা মালতী লতা গাছটায় থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে আছে। একটা ছোট্ট দুর্গা টুনটুনি অনেকক্ষন ধরেই গাছটায় বসে ডাকছিল। রাজা সৌমীর মোবাইলটা হাতে নিয়ে লকটা খুলে দেখল ব্যালান্স নেই। ওর ঘুম ভাঙার আগেই রিচার্জ করে আনবে সামনের দোকান থেকে ভেবে বেরোতে গিয়ে ফিরে এসে সৌমীর ডান চোখের ওপর আলতো করে চুমু খেয়ে বেরোতে গিয়ে পেছন থেকে জামাতে টান অনুভব করল। সৌমী পাশ ফিরল চোখে যন্ত্রণার চিহ্ন!
“এক চোখে চুমু খেলি কেন? আর একটা কি দোষ করল?”
“সত্যি তুই একটা পাগল! ভাবলাম ঘুমিয়ে আছিস,আমি শঙ্কুর দোকানে গিয়ে তোর মোবাইলটা রিচার্জ করে আনি। তুই যে মটকা মেরে পড়ে আছিস বুঝব কি করে!”
“তুই আবার লিঙ্গে ভুল করলি। পাগল না পাগলী!” সৌমী হেসে উঠল।
“চুপ করে শুয়ে থাক,একটু পরেই আসছি”, বলে রাজা বেরিযে গেল। কিছুদিন হল একটা বড় ওষুধের কোম্পানিতে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে চাকরি পেয়েছে রাজা। এখন ট্রেনিং চলছে। সৌমী নিজের স্কুলেই পার্ট টাইম শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছিল। ওর সাবজেক্ট ছিল বাংলা। মেধাবী ছাত্রী বলে ওর চাকরিটা পেতে কোন অসুবিধাও হয়নি। কিন্তু রোগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই স্কুলে যাওয়া ও ছেড়েই দিল। স্কুলের বড়দি ওকে অনেক করে বুঝিয়েছিল। কিন্তু ও আর রাজি হয়নি।
সৌমী ভাবছিল। কারোর গলগ্রহ হয়ে কালাতিপাত করা ভীষণ মানসিক যন্ত্রণার কাজ। ও জানে রাজা ওকে পাগলের মতন ভালবাসে। কিন্তু শরীরে যে রোগ বাসা বেঁধেছে তাতে যে ওর স্বপ্নটাও রোগের কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। ওর এখন কেমো চলছে। মাথার চুলগুলো প্রায় সবই পড়ে গেছে। একরাশ কোকড়ানো কালো চুল ছিল। কোমর ছাপিয়ে যেত। এখন রুমাল বা স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। সারাটা দিনই অসম্ভব ব্যথায় শরীরটা যেন গুটিয়ে থাকে। কিছু খেতেই ইচ্ছে করেনা। কতদিন মায়ের হাতের কচু বাটা, ইলিশ ভাপা খাওয়া হয়নি। তার ওপর ওকে নিয়ে সবার চিন্তা। রাজার মাইনের টাকা ছাড়াও বেশ কিছু সঞ্চয়ের টাকাও খরচ হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজা একেবারে মুক্তহস্ত। তার ওপর ওকে নিয়ে মুম্বাই এর টাটা ক্যান্সার হসপিটালে যাবে বলে তোড়জোড় করছে।সুনন্দা ঘরে ঢুকল।
“কিরে,অমন মুখ ব্যাজার করে বসে আছিস কেন মা? এত ছাইপাশ কিসব চিন্তা করিস? মনটা শক্ত না করলে লড়াইটা কি করে করবি? পাগলটা গেল কোথায়? ওকে দেখলে, ওর কথা শুনলে মনে জোর পাই যেমন, আশ্বস্তও হই। আমাকে বলছে একদম চিন্তা না করতে! যমের মুখ থেকে তোকে ছিনিয়ে আনবে!”
“এসব অলীক কল্পনা ছাড় মা”, সৌমীর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
“ও যে তোকে ভীষণ ভালবাসে সৌমী। ওর বোবা কান্না আমার চোখ এড়ায়নি। আমি তো মা। সব বুঝি। তোকে বাঁচানোর জন্য ওর মরিয়া প্রয়াস টুকু দেখে আমার হারিয়ে যাওয়া মনের জোর ফেরত পাই।” সুনন্দা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চোখের কোণটা মুছলেন৷
“আমি ওর জীবনটা কি করে ছাড়খার করি মা? যে রোগ আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে,তার থেকে আমার রেহাই নেই। আমার যে মৃত্যু আসন্ন মা। আমার এক এক সময় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। আমি চাইনা ধনে প্রাণে শেষ হতে। ওর কথা ভেবে আমি নিজেকে যে মেরে ফেলতে পারিনি মা”,বলে সৌমী ডুকরে কেঁদে উঠল। সুনন্দা মেয়েকে বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরলেন।
“তোর বাবা তোকে কাছ ছাড়া করতেই চাইতো না। যতক্ষণ মানুষটা বাড়িতে থাকত, তোকে কোলে করেই সারা বাড়ি,সামনের বাগান ঘুড়ে বেড়াতো। তার এত আদরের মেয়ে এরকম মারণ রোগে কষ্ট পাচ্ছে, সেই মানুষটাও ওপরে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে রে মা! তুই আমাদের বড় আদরের একমাত্র সন্তান। ভগবান কি এত নির্দয় হবেন?”
“বাঃ,চমৎকার! মা আর মেয়ে এতক্ষণ ধরে কেঁদে কেঁদে বিছানা ভিজিয়ে ফেলল; আর আমি চিৎকার করে করে, আর দরজার কড়া নেড়ে পাড়ার লোকদের বাড়ির সামনে জড়ো করে ফেললাম!”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে রাজা ওদের হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
“তুমি ঢুকলে কি করে বাড়িতে? তুমি বেরিয়ে যাবার সময় আমি তো দরজা বন্ধ করে দিলাম!” সুনন্দার কথা শেষ না হতেই সৌমী দাঁত কিড়মিড় করে চিৎকার করে উঠল, “আবার ঐ উচুঁ পাঁচিল ডিঙিয়েছিস তুই”? বলেই ফলের ঝুড়ি থেকে একটা পেয়ারা তুলে রাজাকে ছুড়ে মারার চেষ্টা করতেই রাজা সুনন্দার পিছনে চলে গিয়ে বলল, “কি কপাল! সারাজীবন তোমার মেয়ের কাছে মার খেতে হবে!” সবাই হেসে ফেলল।
“তুমি এলেই মনে হয়, এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকল। একটু বসো। আমি চা করে আনি!”
সুনন্দা বেরিয়ে যেতেই রাজা সৌমীকে জাপ্টে ধরে বলল, “আমি পাগলামি করলেই দোষ। আর তোর এই ডায়েরিতে কি লিখেছিস তুই?””তুই আমার ডায়েরিতে হাত দিয়েছিস কেন?” শান্ত স্বরে বলল সৌমী।
“একটু লিখতে পারিস বলে আবোলতাবোল লিখবি?” বলেই সৌমীর হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে সুর করে পড়তে লাগল।
“মন ভাল নেই, মন ভাল নেই
মন খারাপের দুপুর,
শুনতে কি পাও, আসছে যে তার
বাজছে পায়ের নূপুর!”
“এখনও তো পুরোটা লিখিনি। অসম্পূর্ণ। তাই তোর খারাপ লাগছে হয়তো৷”
“না দিদিমণি, আমার মাথাটা অতটা নিরেট নয়, যতটা তুই ভাবিস৷”
“তাহলে তুই স্বীকার করছিস, কিছুটা নিরেট তোর মাথা৷”
“দাঁড়া, এবার তোকে মজা দেখাচ্ছি”, রাজার কথা শেষ না হতেই সুনন্দা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠলেন, “তোদের মারামারি শেষ হয়ে গেলে চা টা খেয়ে নিস৷”
সুনন্দা বেরিয়ে যেতেই সৌমী বলে উঠল,”রাজা, আগে ভাবতাম তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না। কিন্তু এখন ভাবছি আমার বেঁচে থাকাটা তোর কাছে না অভিশপ্ত হয়ে যায়। এ রোগ যে মানুষকে ধনে প্রাণে শেষ করে৷”
“চা টা খেয়ে নিই আয়”,গম্ভীর গলায় রাজা বলে উঠল।
চা শেষ করেই রাজা সৌমীর মাথাটা নিজের কোলে রেখে মাথায় বিলি কাটতে কাটতে বলল,”তোকে আমি এভাবে হারিয়ে যেতে দেব না। দরকার হলে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে ছুটে যাব তোকে নিয়ে। সামনের মাসের ১১ তারিখ মুম্বাই এর টাটা ক্যান্সার হসপিটালে আমরা যাব। এয়ার টিকিট কনফার্ম হয়ে গেছে। ডক্টর প্যাটেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি রিপোর্টগুলো দেখেছেন। অপারেশন হবে। কেমো নিতে হবে। হসপিটালের সামনে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হবে প্রায় মাস খানেকের জন্য। সৌমী কত মানুষ, বিভিন্ন বয়সের এমনকি ফুটফুটে শিশুরাও এই রোগের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করছে। কি প্রাণবন্ত সবাই! বাঁচার জন্য কি অদম্য স্পৃহা সকলের। তোকেও ওদের মতন চেষ্টা করতে হবে। মনের জোর এ রোগের মহৌষধ। তোকে বাঁচতেই হবে তোর নিজের জন্য, আমাদের সবার জন্যও৷”
রাজার গরম নিঃশ্বাস চোখে মুখে পড়তেই সৌমী চমকে উঠে রাজার মুখের দিকে তাকাল। রাজার দৃষ্টি তখন জানালার বাইরে দিয়ে দূরের আকাশে পৌঁছে গেছে। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠেছে। সৌমী বলে উঠল,”রাজা আমি বাঁচতে চাই। তোকে কষ্ট দিতে চাইনা৷” দুটো শক্ত হাতে সৌমীকে আাঁকড়ে ধরে রাজা বলে উঠল,” ভয় পাসনা সৌমী। আমি তোর সঙ্গেই থাকব। রবি ঠাকুরের সেই গানটা গাইবি? যেটা স্কুলে প্রায়ই গাইতিস৷”
শরীরের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সৌমী মৃদু স্বরে অথচ সুরেই গানটা ধরল………
“জড়ায়ে আছে বাধা
ছাড়ায়ে যেতে চাই,
ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে,
মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই
চাহিতে গেলে মরি লাজে…….”
গানটার শেষে একটা রেশ থেকে গেল যেন। কয়েকটা মুহূর্ত সব চুপচাপ। খালি দেওয়াল ঘড়িটা টিক্ টিক্ শব্দ করে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সৌমীকে অবাক করে দিয়ে রাজা তার স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় তার প্রিয় কবি জীবনানন্দের একটা কবিতা আবৃত্তি করে ফেলল সৌমীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে। ব্যাপারটা এত আচম্বিতে হয়ে গেল, গানটার পরেই এই কবিতা আবৃত্তি, মনে হয় কত ভাবনা চিন্তা করেই ঠিক হল। কিন্তু তা নয়! রাজা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই কবিতাটা আবৃত্তি করল। অনেকটা মনে হচ্ছিল স্বগতোক্তি। কখনও মনে হচ্ছিল ও যেন অন্য কোন জগৎ থেকে তার প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে বলছে…….
“কত ভোরে দ্বিপ্রহরে সন্ধ্যায় দেখি নীল সুপুরির বন
বাতাস কাঁপিছে ধীরে খাঁচার শুকের মত গাহিতেছে গান
কোন্ এক রাজকন্যা পরনে ঘাসের শাড়ি কালোচুলে ধান,
বাংলার শালিধান আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ
হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার ঘুম নাই নাহিক মরণ
তার আর কোনদিন-পালঙ্কে সে শোয় নাক হয় নাক ম্লানলক্ষ্মীপেঁচা, শ্যামা আর শালিখের গানে তার জাগিতেছে প্রাণ
সারাদিন – সারারাত বুকে করে আছে তার সুপুরির বন……….”
কিছুক্ষন নিস্তব্ধতা। কারো কোন সাড়া নেই। দুজনেই যেন অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছে। মাথার ওপর ফ্যানটা শুধু শব্দ করে ঘুরে চলেছে। হঠাৎ সৌমীর ডায়েরিটা হাতে নিয়ে রাজা একটার পর একটা পাতা উল্টে যেতে যেতে একটা পাতায় এসে থমকে গেল। সেখানে রবি ঠাকুরের একটা উদ্ধৃতি লেখা ছিল-“সকল কিছু সম্ভাব্যপরতার জন্য প্রস্তুত থাকার নামই হল সভ্যতা।” ও যেন এই কথাটাই খুঁজছিল।।
***************************************
সুরজিৎ সরখেল পরিচিতি :
১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্ম। ২০১৮ সালে ভারতীয় জীবন বীমা নিগম থেকে অবসর নিয়েছেন। সঙ্গীতে একটা পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। সেজমাসী এবং মেজমামা প্রখ্যাত সুরকার স্বর্গীয় হৃদয় রঞ্জন কুশারীর তত্ত্বাবধানে সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। কলেজ জীবন শুরু হবার পর সঙ্গীতে আকৃষ্ট হন। অফিসে কর্মজীবনের ফাঁকেই শুরু হয় সাহিত্য চর্চা। কিছু প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাগানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।
খুব ভালো লাগলো পড়ে ৷ আরো লেখা চাই ৷