পিছুটান
রিমিতা কর
প্রায় ষোলো বছর পর পায়রাডাঙা স্টেশনে পা রাখল পৃথা। ট্রেন থেকে নেমে চারদিকটা ভালো করে দেখল। অনেক পাল্টে গেছে সবকিছু। প্ল্যাটফর্মে বড় একটা স্ন্যাক্সের দোকান হয়েছে। টিকিট কাউন্টারের দিকটাও বেশ ঝকঝকে হয়েছে। আগে কেমন একটা মফস্বলের ছাপ ছিল।এখন আর নেই। প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৃথার চোখে পড়ল কৃষ্ণচূড়া গাছটা। লাল ফুল আজও বিছিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। পৃথার জীবনের দীর্ঘ দশ বছরের অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী এই কৃষ্ণচূড়া গাছ, এই স্টেশন।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিক্সাস্ট্যান্ডে এসে পৃথা অবাক হল। স্টেশন রোডের দুপাশে সারি সারি কত নতুন দোকান আর মানুষের ভিড়। রিক্সা টোটো বাইকের জটলা রাস্তার মোড়ে। সেদিনের গ্রাম্য নির্জন পায়রাডাঙার গায়ে রীতিমতো আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে। সময়টাও তো নেহাত কম নয়। পৃথার জীবনেও তো কত অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে।
পৃথা মনে মনে ভাবল ভাগ্যিস দেবরূপের কথায় বাড়ির গাড়িতে আসেনি। গাড়িতে এলে কি এত কাছ থেকে পায়রাডাঙার এই পরিবর্তন সে দেখতে পেত।রিকশায় উঠে সরকার বাড়ি বলতেই রিক্সাওয়ালা ভিড় ঠেলে চলতে শুরু করল। পৃথা এবার ফোনটা বার করে চুমকিকে ফোন করল। হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে চুমকির উচ্ছ্বসিত গলা,
— বৌমনি এসে গেছো!
— এই রিক্সায় উঠলাম।
-‐ তাহলে সত্যি সত্যিই তুমি এলে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। ভাবতে পারবে না। কতদিন পর তোমায় সামনাসামনি দেখব। ভেবেই কেমন একটা হচ্ছে।
— আমি ও তোকে সেই স্কুলে পড়া লাল ফিতে জড়ানো ছোট্টটা দেখেছিলাম। সেদিন ফেসবুকে তোর ছবি দেখে প্রথমটা চিনতেই পারিনি।
— তুমি আমায় শেষ দেখেছিলে বোধহয় ক্লাস ইলেভেনে। আর এখন আমি দুই ছেলের মা। চিনবে কি করে? কত মোটা হয়ে গেছি। তুমি কিন্তু একরকম সুন্দরী আছো বৌমনি। এক ঝলক তোমার ছবি দেখেই চিনতে পেরেছি।
— আচ্ছা শোন্, তুই একটু তালতলার কাছে আয়। আমার কিন্তু খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
— ঠিক আছে। আমি এখনি যাচ্ছি। আর তোমার অস্বস্তির কি আছে? তাছাড়া বিশেষ কেউ জানে না। এদিকে মা কখন থেকে ছটপট করছে তোমার জন্য।
–রাঙাকাকিমাকে দেখব বলে আমিও ছটপট করছি। বড্ড ভালোবাসতেন আমায়। আচ্ছা এখন রাখি। প্রায় চলে এসেছি।
ফোন রেখে পৃথা দেখল শিব মন্দির ছাড়িয়ে রিক্সা টা বাঁদিকে মোড় ঘুরেছে। সেদিনের কাঁচা রাস্তাটা এখন সুন্দর পীচের রাস্তা হয়েছে। দুদিকে কত নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে। ওই তো বড় বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সামনের মাঠটা কই? পৃথা কেমন ঘাবড়ে যায়। তবে কয়েক মিনিট ভালো করে দেখে সে বুঝল মাঠটাতেই কয়েকটা নতুন বাড়ি হয়েছে।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে চোখ তুলল পৃথা। দেখল চুমকি একমুখ হাসি নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে তার দিকে আসছে। এসেই সে দুহাতে পৃথাকে জড়িয়ে বলল,
–এই তো আমার বৌমনি।
চুমকির পিঠে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে পৃথা বলল,
–পাগলি। আগে ভেতরে তো চল।
দুজনে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। শতাব্দী প্রাচীন জমিদার বাড়ি। উঠোনে পা রেখে পৃথা অবাক। দেখল গোটা চত্বরটা ভাগাভাগি হয়েছে কয়েকটা পাঁচিলে। পাঁচিলের গায়ে গায়ে চলে গিয়েছে সরু সরু গলিপথ। পৃথার সবিস্ময় দৃষ্টি দেখে চুমকি বলল,
–পরিবার যত বেড়েছে শরিকি বিবাদ তত বেড়েছে গো। যে যার অংশ আলাদা করে নিয়েছে।
পৃথার মন খারাপ হয়ে গেল। সে মাথা উঁচু করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল। এ বাড়ির আগের চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করল। এই উঠোনেই তো তার বৌভাতের অনুষ্ঠান হয়েছিল। একসাথে পাঁচশো লোকের খাওয়ার আয়োজন হয়েছিল এখানে। ছোটখাটো একটা ফুটবল মাঠের মতো ছিল। কত লোকজন ছিল বাড়িতে। প্রতিদিনই উৎসব মনে হত। কিন্তু এখন কি শান্ত। তেমন কাউকে চোখেই পড়ছে না।
‐-কাউকে তেমন দেখছি না কেন চুমকি?
–কাকে আর দেখবে বৌমনি। এ বাড়ি তো এখন বৃদ্ধাবাস। আমাদের প্রজন্মের প্রায় কেউ থাকে না। যে যার মতো কলকাতায় বা অন্য শহরে চলে গেছে। কতজন তো বিদেশে থাকে।
–বনি পিন্টু রাজা কেউ থাকে না?
–সবাই বাইরে। মা বাবাকে মাঝেমধ্যে নিয়ে যায়। তবে ওই তারা কেউ বাড়ি ছেড়ে থাকতে পারে না। দুদিন পরেই চলে আসে । বৌমনি আগে আমাদের ঘরে চলো। পরে জ্যেঠিমাকে দেখতে যাবে। সাবধানে এসো বড়ো সরু গলি।
জ্যেঠিমা ডাকটা শুনেই পৃথার চোখে এক দাপুটে অবয়ব ভেসে ওঠে। যিনি একদিন পৃথাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজের ছেলেকে সুখী দেখতে যে মহিলা সব করতে পারতেন। অন্ধ প্রশ্রয় দিতেন। কিন্তু কি সুখটা পেল তাঁর ছেলে! মাত্র চল্লিশ বছরে নেশায় ডুবে লিভার পচিয়ে ফেলল। তারপর একদিন মাতাল অবস্থায় রেল লাইন পেরতে গিয়ে প্রাণটাই চলে গেল। পৃথার চোখের কোন অজান্তে ভিজে উঠল।
–এসো পৃথা। কখন থেকে পথ চেয়ে আছি।
রাঙাকাকিমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল পৃথা।
–কেমন আছেন কাকিমা? চেহারা বড্ড ভেঙ্গে গেছে।
–তা আর হবে না। কতো বয়স হল বলো তো। তুমি কিন্তু একরকম আছো পৃথা।
–আমারও তো বয়স অনেক হলো কাকিমা।
প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে আর জল নিয়ে এসে চুমকি বলল,
—বৌমনি এসো। একটু জল খাও। সেই কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছো।
— এই এত মিষ্টি। আমি মিষ্টি খাইনা রে।
–তা বললে শুনব না। আর কবে আসবে ঠিক নেই।
রাঙাকাকিমা পৃথার হাত ধরে সোফায় বসালেন তারপর প্লেটটা টেবিলে রেখে বললেন,
–এটুকু খাও পৃথা। তোমার কথা খুব মনে হয় সবসময়। এ বাড়িতে কত অবিচার তোমার ওপর হয়েছে। সেইদিন গুলো মনে পড়লে বড্ড কষ্ট হয়। তেমনি শাস্তি এখন দিদি পাচ্ছে। সূর্য্যও কি কম পেয়েছে। তোমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর কি দুর্দশা যে মা আর ছেলের হয়েছিল কি বলব। দাদা চলে গেল। নেশা করে করে ছেলেটা মরেই গেল। চোখের সামনে জোয়ান ছেলের শোক পেতে হল দিদিকে।
মাথা নীচু করে রাঙাকাকিমার কথা গুলো শুনছে পৃথা। তার দুগাল বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা।
–আহ মা। কেন এসব শুরু করলে। বৌমনি খাবে কি করে।
একটু লজ্জিত হয়ে রাঙাকাকিমা বললেন
–না না আর বলব না। পৃথা কে দেখে সব পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তাই আর কি। তুমি খাও পৃথা।
একটু চুপ করে থেকে ইতস্ততঃ ভাবে পৃথা বলল,
–মায়ের কি খুব শরীর খারাপ?
–শরীরের থেকেও মাথাটা বেশি খারাপ হয়েছে। কে যে দেখাশোনা করে। একটা কাজের বউ সবাই মিলে ঠিক করেছি। সে রান্না করে। কিন্তু রোজ রোজ একটা পাগলের দেখাশোনা কে করে বলো তো। এ বাড়ির অবস্থা তো দেখছো। আমি যেটুকু পারি করি।
–টাকা পয়সা?
–সে আর কে দিচ্ছে বলো। সূর্য্য তো দোকানটাও পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিল। কিছু ছিল আর বাকিটা চেয়ে চিন্তে চলছে। যাক্ গে তোমার কথা বলো। আবার বিয়ে করেছ শুনে এত খুশি হয়েছি যে কি বলব। তবে আরও খুশি হয়েছি তোমার ছেলে হয়েছে শুনে। কত বড় বদনাম দিদি তোমাকে দিয়েছিল। নিজের ছেলেরই দোষ।
–কাকিমা থাক্ না।
–কেন থাকবে পৃথা। কম অত্যাচার হয়েছে তোমার ওপর। কোনদিন সূর্য্যকে ডাক্তার দেখাতে বলেছে?
–মা থামো না। চলো বৌমনি জ্যেঠিমা কে দেখবে চলো।
–আসি কাকিমা। হাতে বেশি সময় নেই। অনেকটা পথ ফিরতে হবে। একবার দেখে আসি।
–যাও মা। দেখে এসো। কি আর দেখবে?
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাঙাকাকিমার বুক থেকে।
চুমকির সাথে উঠে পড়ল পৃথা। তারপর সরু গলি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকের লাল সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়ির হাল দেখে দোতলার অবস্থা আন্দাজ করতে পারছে পৃথা। একসময়ে লাল সিঁড়িটা যেন সিঁদুর মাখা থাকত। লাল টকটকে। আর এখন নোংরা ধুলোতে লাল রঙটাই চাপা পড়ে গেছে।
–সাবধানে এসো বৌমনি। এ বাড়ির যা হাল। পা ফেলতে গা ঘিনঘিন করে। তোমায় তো জ্যেঠিমা চিনতেই পারবে না। না এলেই হত।
–আচ্ছা চল। মানুষটাকে তো দেখি।
দোতলায় উঠে পৃথা বুঝল চুমকির কথা কতটা সত্যি। শেষ কবে ঘর পরিষ্কার হয়েছে বলা যায় না। পৃথা ভাবল যে মেয়েটা কে কাজে রাখা হয়েছে তার কি চোখ নেই? দরজা জানলা বন্ধ। একটা ভ্যাপসা সোঁদা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল পৃথার। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঘরে ঢোকার আগে জুতোটা খুলতে গেলে চুমকি বারণ করল।
–কি করছ বৌমনি? একদম জুতো খুলো না। যা নোংরা চারিদিকে।
–কিন্তু এই ঘরে তো রাধা গোবিন্দ।
–তুমি সত্যি। দেখে মনে হচ্ছে এই ঘরে রাধা গোবিন্দ থাকবে? ঠাকুরের পাট কবে উঠে গেছে। সেই দাদাভাই মারা যাবার পর থেকে।
পৃথা চুপ করে যায়। চুমকির দোষ নেই। ও সহজ ভাবে কথাগুলো বলছে। কিন্তু পৃথার কোথায় যেন ঘা দিচ্ছে। এ বাড়ির আনাচে কানাচে কত স্বপ্ন কত লাঞ্ছনা কত স্মৃতি তার।
বিয়ের পর প্রথম দুবছর তো ভালই ছিল সে। বনেদিয়ানার কেমন একটা গর্ব অনুভব করত। এত বড় বাড়ির বড় তরফের একমাত্র ছেলের বউ ছিল সে। সূর্য্যকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে চেষ্টা করেছিল পৃথা। সবাই কে নিয়ে রাজরাণী হতে চেয়ে ছিল সে। কিন্তু অদৃষ্টে যে অন্য কিছু লেখা ছিল।
অন্ধকার ঘরে মাটিতে এককোনে প্রেতমূর্তির এক অবয়বের দিকে একটু ঝুঁকে চুমকি বলল,
–জ্যেঠিমা কে এসেছে দেখো।
চুমকির গলায় পৃথা যেন কোন সুদূর অতীত থেকে একেবারে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ল। শেষ দেখা দীর্ঘকায়া ফর্সা লাল বড় টিপ তাঁতের শাড়ি পরা সেই রাশভারি মানুষটির এই হাল। কল্পনাতেও ভাবতে পারছে না পৃথা।
গায়ে অতি ময়লা একটা সেমিজ। মাথায় সাদা রুক্ষ পাটের দড়ির মতো কগাছি চুল। শীর্ণকায়া কঠোরগত চক্ষুর বৃদ্ধা কে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠল পৃথা।
–দেখো বৌমনি অবস্থা দেখো। মেয়েটা কে মাইনে দেওয়া হয় আর সে কি অবস্থায় রেখেছে। দুপুরে খেতে দিয়েছে কিনা কে জানে। সে বাড়ি চলে গেছে। এদের সত্যি বিবেক নেই। গায়ের জামাটার অবস্থা দেখেছ? কোনদিন কাচা হয়েছে বলে মনে হয়?
পৃথার মাথাটা হঠাৎ কেমন ঘুরে যায়। খাটের ছত্রি ধরে ফেলে। একটা অদ্ভুত কষ্ট বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে। কিন্তু এমনতো হবার কথা ছিল না। এ বাড়িতে তার ওপর সবথেকে বেশি যদি কেউ অবিচার করে থাকে তা হল এই মানুষটি। সূর্য্যর সাথে তার সম্পর্কটা ইনি নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। রূপের জোরে গরীবের মেয়ে ফাঁকতালে বিনা পণে ঢুকে পড়েছে। এটাই হয়তো একদিন পৃথাকে মেনে না নেওয়ার প্রধান কারন ছিল। বিয়ের তিন বছর ঘুরতে না ঘুরতে এই মহিলা বাঁজা অপবাদে জর্জরিত করেছিলেন পৃথা কে। সন্তান না হওয়ার জন্য পদে পদে কত কথা শোনতেন। তবু কেন আজ পৃথার চোখে জল আসছে। মনে হচ্ছে খুব নিজের কেউ কষ্ট পাচ্ছে।
–বৌমনি শরীর খারাপ লাগছে? চলো নীচে যাই। এখনে গন্ধে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। এ কি তুমি কাঁদছো?
চুমকি পৃথার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল।
— এই মানুষটার জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছো? আমি মার কাছে সব শুনেছি।
পৃথা একটু সামলে নিয়ে বলল,
–আচ্ছা চুমকি মা কতদিন এমন আছে?
–আগে এতটা খারাপ ছিল না। লোক চিনতে পারত। কিন্তু গত কয়েক মাসে মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে। এদিকে দেখো কেউ খোঁজ নেয়না। ছোট জ্যেঠু কে খবর দেওয়া হয়েছিল। তিনি নিজে অসুস্থ। জ্যেঠিমা নেই। পিন্টুর কাছে দিল্লিতে থাকেন। বললেন কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
–কিন্তু এমনভাবে কোন মানুষ থাকতে পারে? এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। তার ওপরে কোন চিকিৎসা হচ্ছে না।
–তুমি চলো তো। অত ভাবতে হবেনা। মা ঠিক বলে। তোমার মনটা বড্ড নরম। তুমি কি করবে? আর কেনই বা করবে? ও যেমন আছে থাকুক। কদিন বা বাঁচবে?
পৃথা চুপ করে যায়। চুমকির কথার যুক্তি আছে। ভেবে কি-ই বা করবে সে? তবু ওই মানুষটার ভাষাহীন চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই যেন পৃথা চলে আসতে পারছে না। এই ঘর এই বিছানা সব তাকে যেন টেনে ধরছে। এই কড়িবরগার ছাদ, কারুকাজ করা খাট,ওই দেরাজ, লাল সিমেন্টের ভাঙাচোরা মেঝে যেন তার পথ আটকে ধরছে। আরও অনেকক্ষন এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে। সূর্য্য্র কথা ভীষণ মনে পড়ছে পৃথার।
–কি হল বৌমনি। এসো।
–হ্যাঁ যাই।
পৃথা মাটিতে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটার ভাষাহীন চোখের দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখল। তারপর একপ্রকার জোর করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
কিন্তু মনের মধ্যে তার উথাল পাথাল চলছে। নিজের বিবেকের কাছে উত্তর দিতে ভয় করছে পৃথার। এমন ভাবে এই মানুষটাকে রেখে যাবে সে? কিছু কি করা যায় না? একবার কি দেবরূপ কে জিজ্ঞেস করবে? কিছু কি করা যায়?
চুমকির সাথে নামতে নামতে কেবল এই সবই ভাবতে থাকে পৃথা। কতকিছু ভেবে এসেছিল। বাড়িটার চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখবে। ছাদে উঠবে।
দেবরূপকে এসব বলতে সে মজা করে বলেছিল,
–যাও, প্রাক্তন শাশুড়িকে দেখে এসো। তারসাথে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে এসো।
দেবরূপ এমনই। সব কিছু কে হাসির ছলে নেয়। জীবনের তাবড় জটিলতাকে নিমেষে সহজ করে দেয়। জীবন যে এত সুন্দর হতে পারে দেবরূপকে না পেলে পৃথার জানাই হত না। ভাবতে ভাবতে দেবরূপের ফোন।
–পৃথা কি খবর? বেরিয়ে পড়েছ? ট্রেনের ব্যাপার তাড়াতাড়ি চলে এসো।
পৃথা ধরা গলায় বলল
–হ্যাঁ এইবারে বেরবো।
–তোমার গলাটা এমন লাগছে কেন? এনি প্রবলেম?
–না। তবে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
–কেন শাশুড়ি মা কিছু বললেন?
–বলার মতো অবস্থায় তিনি নেই গো। কি ভয়ংকর পরিনতি ভাবতে পারবে না। কি নোংরা পরিবেশ।
চুমকি দাঁড়িয়ে পড়েছে। পৃথাকে দেখে কথা শুনে সে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। পৃথা কাতর হয়ে স্বামী কে বলছে,
— মানসিক রোগীদের রাখার কোন জায়গা তোমার জানা আছে? প্লীজ একটা ব্যবস্থা করে দাও। একটু কথা বলো। এখানে এইভাবে একটা মানুষ থাকতে পারে না। এটা অন্যায়।
–আচ্ছা একটু সময় দাও দেখছি।
–প্লীজ আমি অপেক্ষা করছি। তুমি জানাও। আধঘণ্টার মধ্যে বেরবো।
–ওকে ম্যাডাম। দেখছি। আপনার প্রাক্তন শাশুড়ির জন্য কি করা যায়। জানাচ্ছি।
ফোনটা কেটে যায়। দেবরূপের সাথে কথা বলে নিমেষে মনটা ভালো হয়ে গেল পৃথার।তার বিশ্বাস দেবরূপ ঠিক একটা পজিটিভ খবর দেবে।
চুমকির মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হেসে পৃথা বলল,
–কি দেখছিস অমন করে?
–তোমাকে। জেঠিমার জন্য এত ভাবছ তুমি।
— তাড়াতাড়ি চল। রাঙাকাকিমার সাথে একটু কথা বলে বেরিয়ে পড়ব।
রাঙাকাকিমার কাছে এসে পৃথা নিজের সিদ্ধান্ত জানায়। সে এইভাবে ওঁনাকে ফেলে রাখতে চায় না। ওনার চিকিৎসার প্রয়োজন। ওঁনার জীবনের শেষ কয়েক দিনের সব দায়িত্ব পৃথা নিতে চায়।
পৃথার কথা শুনে হতভম্ব রাঙাকাকিমা ও চুমকি।একরাশ মুগ্ধতা তাদের চোখে। এর মধ্যেই দেবরূপের ফোন আসে।
–পৃথা কথা হয়ে গেছে। আমার পরিচিত এক এন জি ওর সাথে কথা বললাম। ওরা আগামী দুএকদিনের মধ্যে ওঁনাকে নিয়ে আসবে। তারপর মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করাবে। টাকাপয়সার সব দায়িত্ব আমার।
দেবরূপের কথায় আপ্লুত পৃথার গলা বুজে আসে।
–কি হল? কিছু বলছ না।
–কি বলব আর। আমি তো জানতাম তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করবে।
–আচ্ছা এবার তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো। এই নাও রিমোর সাথে কথা বলো। তোমার জন্য অস্থির হচ্ছে।
–কখন আসবে মাম্মাম। কাদের বাড়ি গেছ? আমার ভালো লাগছে না।
–একটু পরেই চলে আসব সোনা। তুমি বাবাইয়ের সাথে খেলা করো। এখন রাখি।
ফোনটা রেখেই ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ল পৃথা। তারপর রাঙাকাকিমাকে প্রণাম করে হাসিমুখে বলল,
–কাকিমা দুদিনের মধ্যে লোক এসে মাকে নিয়ে যাবে। কলকাতায় চিকিৎসা হবে। দেবরূপ সব ব্যবস্থা করছে। ওদিন আমি হয়তো আসতে পারব না। আপনি কিন্তু একটু থাকবেন।
রাঙাকাকিমা দুহাতে পৃথাকে বুকে টেনে নেন। তারপর পরম স্নেহের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
–স্বামী পুত্র নিয়ে সৌভাগ্যবতী হও মা। অনেক সুখী হও।
চুমকিও কাছে এসে দাঁড়ায়। পৃথা তার গালে হাত বুলিয়ে বলল,
–চুমকি তুই আমায় ফেসবুকে খুঁজে পেয়ে জোর না করলে কোনদিনই হয়ত এখানে আসা হত না। এবার ছেলেদের নিয়ে স্বামীকে নিয়ে তোকে আমার বাড়িতে আসতে হবে কিন্তু। আজ ওদের সাথে তো দেখা হল না।
চুমকি পৃথাকে প্রণাম করতে যায়। পৃথা বাধা দেয়।
–একি কি করছিস।
–বৌমনি আমায় আজ একটা প্রণাম করতে দাও। তুমি যে আমায় আজ অনেক কিছু শিখিয়ে দিলে গো। এতকিছুর পরেও ক্ষমা করা যায়।
–দূর পাগলি, মানুষ হিসাবে এটুকু তো করাই যেতে পারে। তাই না?
পড়ন্ত বিকেলের হলদেটে আলোয় মুছে যাওয়া দিনগুলো কে চিরকালের মতো পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে চলল পৃথা।।
****************************************
রিমিতা কর পরিচিতি
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় জন্ম। পড়াশোনা কোলকাতায়৷ বিজ্ঞানের স্নাতক রিমিতার ছোট থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ৷ মায়ের অনুপ্রেরণায় শৈশব থেকেই আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটকের চর্চা শুরু করেন৷ স্কুলের পত্রিকায় লেখা দিয়ে হাতেখড়ি৷ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে সোশাল মিডিয়াতে নিয়মিত লেখেন৷ বেশ কিছুদিন চাকরি করার পর এখন গৃহ শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত।
অসাধারণ হয়েছে ৷ ভীষণ ভালো লাগলো ৷ গল্পের বাঁধুনি খুবই প্রশংসাযোগ্য ৷
খুবই সুন্দর লিখেছেন।আপনার আরও গল্প পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।মনটা ভালো হয়ে গেলো গল্প পড়ে।
কি সুন্দর!!! মানবিকতার সৌরভে ভরা এ লেখা,ক্ষমা পরম ধর্ম, খুব বিরল এ গুণ–তারই এমন সুন্দর প্রয়োগ মনকে পূর্ণ করলো কানায় কানায়…