জ্যোতিরলিঙ্গ নাগেশ্বর
বিজিত কুমার রায়
গুজরাট ভ্রমণের সময় বেট দ্বারকা দর্শন করে ফিরে এলাম নাগেশ্বর শিব দর্শনে যা কোনো কোনো মতে বারো জ্যোতিরলিঙ্গের একটি। ভিড় ছিলোনা তাই সুন্দর দর্শন হলো। কথিত আছে এখানেই পূরাণে বর্ণিত দ্বারুকবন ছিল আর যেখানে বালখিল্য মুনিদের বাস ছিল।
শিব পুরাণ অনুসারে, এই অঞ্চলে পুরাকালে দারুক নামে এক রাক্ষস রাজত্ব করত। দারুকের উৎপাতে সব মানুষ পরিত্রাণের জন্য ভগবান শিবের শরণাপন্ন হয়। দারুকের পত্নী ছিল দারুকী। দারুকী দেবী পার্বতীর উপাসিকা ছিল। পার্বতী দারুকীর প্রতি সন্ত্তষ্ট হয়ে তাঁদের রাজত্ব করা অরণ্যটির নাম দারুকবন আখ্যা দেন। সঙ্গে এই আশীর্বাদ প্রদান করেন যে, দারুকী যেখান দিয়েই যাবে দারুকবনও সেই স্থান দিয়ে গমন করবে। পরবর্তী সময়ে দেবতারা দারুকের রাজ্য আক্রমণ করায় দারুক নিজ পত্নীকে পার্বতীর বরদান সুপ্রয়োগ করার জন্য আদেশ দেয়। সেই হিসাবে দারুকী সাগরতীর দিয়ে পলায়ন করে এবং দারুকবনও সেই জায়গা দিয়ে গমন করে। নিরাপদ স্থান থেকে দারুক পুনরায় সকলের উপর অত্যাচার আরম্ভ করে। এবার দারুক সুপ্রিয় নামে একজন লোক এবং তাঁর সহচরদের অপহরণ করে বন্দী করে রাখে। সুপ্রিয় ছিল মহাদেবএর পরম উপাসক। সুপ্রিয় বন্দীগৃহে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে শিবলিঙ্গ স্থাপন করে মহাদেবের স্তুতি আরম্ভ করে। সুপ্রিয়র প্রার্থনাতে সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব দর্শন দেন এবং দারুককে বধ করার জন্য সুপ্রিয়কে অস্ত্র প্রদান করেন। মহাদেবের বরদানে ধন্য হয়ে সুপ্রিয় দারুককে বধ করতে সক্ষম হয়। এর পর সুপ্রিয় মহাদেবকে সেই স্থানে বিরাজমান হয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করায় মহাদেব নিজ জ্যোতি দ্বারা জ্যোতিরলিঙ্গ স্থাপন করে নিজ ভক্তের মনোকামনা পূরণ করেন। এই মন্দিরে মহাদেবকে নাগেশ্বর অর্থাৎ নাগ (সাপ) এর ঈশ্বর রূপে পূজা করা হয়। দেবী পার্বতী এই স্থানে নাগেশ্বরী রূপে বিরাজিতা আছেন বলে ভক্তরা বিশ্বাস করেন ।
নাগেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গের প্রকৃত অবস্থিতি নিয়ে ভক্তদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ দেখা যায়। পৌরাণিক আখ্যান বর্ণিত সেই দারুকবন আসলে কো্ন স্থানে ছিল সেটি সঠিক ভাবে জানার উপায় নেই। একাংশ, নাগেশ্বর মন্দিরের বর্তমান স্থান গুজরাটের বিরোধ করে বলে যে, মহাকাব্যে বর্ণিত দ্বারকাবনকে একাংশ দারুকবন আখ্যা দিয়ে নাগেশ্বর মন্দিরের স্থান গুজরাটে বলে বিভ্রান্ত করছে। পৌরাণিক আখ্যান সমূহে দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণের সোমনাথ মন্দির এ উপাসনা করার কথা জানা যায়, যদিও নাগেশ্বর মন্দিরের দ্বারকা (বা গুজরাটে) অবস্থিতি সম্পর্কে কোনো বর্ণিত আখ্যান নেই। তারা বলেন যে, দারুকবন শব্দটি আসলে দারু-বন (বা দেবদারু গাছে পরিপূর্ণ বনানি) শব্দ থেকে এসেছে। সেই হিসাবে গুজরাটে দারুকবন ছিল বলে কেউ কেউ কল্পনা করতে অস্বীকার করেন। কারণ দেবদারু গাছের আধিক্য গুজরাট অঞ্চলে দেখা যায় না। দেবদারু গাছে পরিপূর্ণ দারুকবনের ভিত্তিতে তাঁরা নাগেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গের প্রকৃত অবস্থান হিমালয়ের পাদদেশের উত্তরাঞ্চলে বলে মতপোষণ করেন। উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত যোগেশ্বর মন্দিরই প্রকৃত নাগেশ্বর জ্যোতিরলিঙ্গ বলে একাংশ দাবী করে আসছেন।
প্রাচীরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে একটু ওপরে উঠে আবার সামান্য নীচে নামতে হলো। একটি ছোট মন্দির, তার সাথে সংলগ্ন নাটমন্দির। মন্দিরের গর্ভগৃহ খুব ছোট। আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে মন্দিরে ঢুকে পূজা দিলাম।
ছোট কালো পাথরের শিব লিঙ্গ, তবে গৌরিপট্টটি বেশ বড়। আবরণে সজ্জিত লিঙ্গের মাথার ওপর রুপোর তৈরি পঞ্চশীর্ষ নাগছত্র পড়ানো। তার ওপর ফুল দিয়ে সাজিয়ে রুপোর তৃপত্র রাখা।
মন্দিরের ভেতরের মেঝে ও দেওয়াল সাদা-কালো মার্বেল ও লাল-সাদা টাইল দিয়ে মোড়া। বর্তমান ছোট মন্দির বহু প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের জীর্ণ অবশেষের ওপর তৈরি হয়েছে। আরো বড় করার কাজ চলছে।
জ্যোতিরলিঙ্গের অন্যতম হলেও ভিড় এবং আড়ম্বরের কোনো বাড়াবাড়ি নেই। মন্দির দর্শন ও পূজা করে এক শান্তির অনুভূতি হয়।
নাগেশ্বরের পূর্বদিকের দেওয়ালে কুলুঙ্গিতে দন্ডায়মানা দেবী পার্বতীর কালপাথরের মূর্তি।
কপর্দইনে নোমস্তুভ্যং নাগাঙ্গ ভরণায় চ।
নমো ভগবতে তুভয়ং নাগানাং পতয়ে নমঃ ।।
কনকাঙ্গদাহারায় নমঃ সর্প উপবিতীলে।
সর্পকুন্ডলমালায় কটিসুত্রিকৃতহরয়ে ।।
সর্প যার ভূষণ, সর্পের অধিপতি যিনি, সুবর্ণ ভূষণের সঙ্গে সর্প উপবীত, সর্পকুন্ডল ও সর্পমাল্য আর কটিদেশে সর্পের আভরণধারী যিনি – সেই ভগবান নাগেশ্বর কে প্রণাম করি।
ছবি ও তথ্যসূত্র অন্তর্জাল ও মন্দিরের ছবি নিজের।
********************************************
বিজিত কুমার রায় পরিচিতি
জন্ম স্কুল কলেজ সবই কলকাতা। জন্ম ১৯৫৩। স্কুল, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয় শ্যামপুকুর আর কারিগরী স্নাতক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিবপুর মেকানিক্যাল ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। কর্মক্ষেত্র অবশ্য সারা দেশ জুড়ে। বি এইচ ই এল (ভেল) কোম্পানীর তিরুচিরাপল্লী, কলকাতা, দিল্লী, ভূপাল ও ভারতবর্ষের সমস্ত প্রদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে। রথ দেখা ও কলা বেচা হিসাবে দেশে ও বিদেশের বহু স্থানে একলা ও সস্ত্রীক ভ্রমণের সৌভাগ্য আছে। শখ-পারলে সারাদিন বই ও বিভিন্ন পত্রিকা পড়া। এছাড়া বয়সের সাথে কিছুটা ধর্মের দিকে ঝোঁক। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত ও রামকৃষ্ণ সারদা বিবেকানন্দ দর্শনের দিকে উৎসাহ। আর এই বাবদে মিশনের নানা জনকল্যানকারী কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত।