যন্ত্রণা
ব্রততী সেন দাস
কুর্চি,
আমি বিজনের সাথে কথা বলেছি। কাল রাতেও ওর সঙ্গে প্রায় আড়াইটে অবধি কথা হল। কিন্তু না, আমি কোন সমাধান সূত্র খুঁজে পাইনি। হয়ত সত্যি এর কোন সমাধান হয় না। হলে হয়ত আমার জীবন টা আজ অন্য খাতে বইত।….কিন্তু আমি খুব কষ্ট পেয়েছি রে, তিলে তিলে যে জীবন টা আমি গড়ে তুলেছিলাম একার হাতে সেটা যেন তাসের বাড়ির মত হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল… আরো একবার বাস্তুহারা হলাম। আমার সমস্ত লড়াই, জেতার ইচ্ছে, অহংকার মিথ্যে হয়ে গেল। বাইশ বছর আগে যখন বাইরের পৃথিবীতে পা রাখতে হয়েছিল তখন মাথার ওপর কোন ছাদ ছিল না তবুও আমি ভয় পাইনি কারণ আমার ডান হাত টা ধরা ছিল এক সাত বছরের শিশুর হাতে। সে আমার একমাত্র সন্তান বিজু।
ও তার মায়ের অপমান, বঞ্চনা আর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখে শিউরে উঠত। বাবার অনাচার আমাদের পথের যে মোড়ে এনে ফেলেছিল তাতে বিজন ভিষণ জেদি হয়ে গেছিল। মেধাবী ছিল তাই পরীক্ষার নানা কঠিন বাধা টপকে আজ ভিন মহাদেশে কাজ পেয়েছে। সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছে।
বারো ক্লাস পাশ করে যখন ও প্রথম দশজনের মধ্যে স্থান করে নিল আমি প্রথম জয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম,আমার সিদ্ধান্ত সঠিক। আমার আর সুবীরের ঘেঁটে যাওয়া পঙ্কিল দাম্পত্যে থেকে ও কিছুতেই এই ভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত না। এর পর আই আই টি বম্বে থেকে এম টেক করে বিদেশে গেল, ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পি এইচ ডি করল তখন প্রতিটি কঠিন কর্কশ সিঁড়ি পেরিয়ে শ্রমলব্ধ সাফল্যের পালকে আমার মুকুট সাজিয়েছিল, আমাকে পরিপূর্ণ করেছিল। আমি সুবীরকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম ওর হাত না ধরেও আমি অন্ধকারে সঠিক পথে এগোতে জানি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে আমি গেছিলাম। কালো গাউন আর মাথার হ্যাট পড়া আমার বিজুকে দেখে প্রথমবার আমার বাঁধভাঙা চোখের জলে বুকের আঁচল ভিজে গেছিল। অথচ সুবীরকে ছেড়ে এসেও আমি কোনদিন চোখ সজল করিনি।
বিজন ও দেশে বাড়ি কিনল,গাড়ি কিনল। আমাকে বারবার করে ওখানে নিয়ে যেতে চাইত। কিন্তু আমি কিছু পাব বলে এসব করিনি,আমি ছেলেকে বোঝাতে চেয়েছিলাম আত্মশক্তিতে বলীয়ান হলে জীবনে কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
আমার জীবনের পরম আনন্দের দিন ছিল যেদিন তুই আমাদের বাড়িতে পা দিলি,কুর্চি। আমি সুখের সপ্তম স্বর্গে পৌঁছে গেছিলাম….. মাটিতে আমার পা পড়ছিল না। আমার বিজু সবচেয়ে সুন্দর আর দুষ্প্রাপ্য ফুল টা তার মাকে এনে দিয়েছিল রে। তোর হাসি,তাকানো,কথা বলার মধ্যে এক পরিপূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার সংসারের যেটুকু ফাঁক ছিল তুই আসাতে তা ভরে গেছিল। আর ভাল লাগত তোর আর বিজুর মধ্যেকার রসায়ণ। আমি সুবীরের কাছ থেকে যা পাইনি তোরা তা নিয়ে খুশি আছিস দেখলে আমি আহ্লাদে অস্থির হয়ে উঠতাম। ভাবতাম মা হিসেবে এখানেই আমার সার্থকতা। আমি তোদের চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম অক্ষিতারায় যেন শ্রাবণ-মেঘের ছায়া কখনও না ঘনায়। মিঠি এলো,আমার মনে হল এত নিটোল স্বপ্ন শুধু যাদুকরের দেশেই সম্ভব।
কিন্তু কী আশ্চর্য,জীবনের হিসেব নিকেশ কোন অ্যাকাউনটেন্ট কোন দিন কি মেলাতে পেরেছে? পারেনি…তাই বিজুর যত ওপর দিকে উঠতে লাগল ওর চরিত্রে শৈথিল্য ওকে নীচের দিকে টেনে নামাতে লাগল। ঠিক ওর বাবার মত পঙ্কিলতায় ও অবগাহন করতে শুরু করেছে,যেদিন ও থামবে সেদিন অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমি ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু রাস্তা আমি দেখিয়ে দিতে পারি,সে পথে চলা ওর কাজ। এইসবে আজ আবার তার মায়ের হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। যে অনাচারের বিরুদ্ধে সে জেহাদ ঘোষণা করেছিল তার সন্তান নিজেই সে পঙ্কে অবগাহন করছে! আমার রক্ত আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল!!
কিন্তু তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না কুর্চি। আমি এখনো বেঁচে আছি,চাকরিও আছে আরো কয়েক বছর। ও দেশে একা একা কষ্ট করার প্রয়োজন নেই,আর কোথাও যাবি না তুই। মিঠিকে নিয়ে চলে আয় আমার কাছে। বাবার পাপের শাস্তি ছোট মিঠিকে আমি পেতে দেব না। ওকে ঠিকভাবে মানুষ করতেই হবে। এখানে তোর চাকরি জুটে যাবে কোন একটা। দিব্যি চলে যাবে আমাদের সংসার। আমি মা,তবু তার আগে তো একজন নারী…..সে কি করে সইবে আর এক নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচার…হোক না সে নিজের সন্তান! আমার সব চেয়ে বড় যন্ত্রণা হল আমায় অত রক্তাক্ত হতে দেখেও আমার আত্মজ কেন সেই অন্যায় করছে? তাহলে আমি কী মানুষ করলাম! কোথায় কোন বড় একটা ভুল হয়ে গেছে রে! বাকি জীবনটা সেই ভুল খুঁজে বার করাই হবে আমার কাজ! বিজন মুখার্জি আজ আবার দেখুক তার মা অলকানন্দা রায় কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে না!
********************************************
ব্রততী সেন দাসের পরিচিতিঃ
ব্রততী সেন দাসের জন্ম দক্ষিণ দিনাজপুরে কিন্তু পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠা মহানগরে।রবীন্দ্রনাথে আদর্শে দীক্ষিত পাঠভবনে স্কুলে পড়তেন,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন।পরিণত বয়সে লেখালেখি শুরু করেন যখন ছেলে মেয়েরা অনেকটাই বড়।প্রথমে শুরু করেন অনুবাদ দিয়ে।পরে স্বকীয় লেখায় নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন। বাংলার প্রখ্যাত পত্র- পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়েছে।দেশ,আনন্দ বাজার পত্রিকা রবিবাসরীয়, যুগশঙখ,উত্তরবঙ্গ সংবাদপত্র, ফেমিনা ইত্যাদি অন্যতম।এছাড়া ওঁর অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড,প্রতিভাস,পারুল প্রকাশনী, ভাষাবন্ধন ইত্যাদি প্রকাশনালয় থেকে।