সিধু-কানুর দেশ থেকে রাজমহলঃ ইতিহাসের পথ ধরে
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়
বছর কয়েক আগে এক দুর্গাপুজোর অষ্টমীর সকালে গৌড় এক্সপ্রেস আমাদের ছয়জনকে নামিয়ে দিল পাকুড় স্টেশনে। পূবাকাশে সূর্য তখনও উঁকি দেয়নি। পাখিরা গলা সাধা শুরু করেনি। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা যাত্রীরা কেউ ঘুমে ঢুলছেন। কেউবা আবার স্টেশন-মাস্টারের ঘরের সামনে ট্রেন আসার সময় জানতে উদগ্রীব। স্টেশনের বাইরের দেওয়ালে লাগানো একটা ইলেকট্রনিক বোর্ড স্থানীয় তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা ইত্যাদি আবহাওয়া-সংক্রান্ত তথ্যাদির জানান দিচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের এক মফস্বল শহরের স্টেশনে যাত্রী পরিষেবার এই অতিরিক্ত ব্যবস্থা যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ করল। স্টেশন-সংলগ্ন একটি দোকানে চা খেয়ে আমরা রিক্সায় উঠলাম। গন্তব্য পাকুড় রাজবাড়ি।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই বীর বিপ্লবী সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে এক বিরাট সাঁওতাল বাহিনী সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ও উৎপীড়নের প্রধান কেন্দ্র পাকুড় রাজবাড়িতে হামলা চালিয়ে ধন-সম্পদ লুঠ করে। গোপন সূত্রে আগে থেকেই আক্রমণের খবর পেয়ে রানী ক্ষেমাসুন্দরী প্রাণের ভয়ে মেয়ে, নাতি ও গৃহদেবতা মদনমোহনকে নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান জঙ্গীপুরে। ব্রিটিশ সরকার কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করার পর তিনি আবার পাকুড়ে ফিরে আসেন। অতীত ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে পাকুড় রাজবাড়ি।
রাজবাড়িতে প্রবেশাধিকার মিলল না। কেননা সেখানে রাজার ভাগ্নের বংশধরেরা বাস করেন। রাজবাড়ির দেবালয় দর্শন করলাম। রাজকীয় ছাপ ঠাকুরদালানে। দালানের মাঝে বলিস্থান। এক পাশের মন্দিরে কালী মূর্তি। অন্য পাশের মন্দিরে গণেশ মূর্তি। একটি শিবলিঙ্গও রয়েছে। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি-ওড়াওড়ি করছে প্রচুর পায়রা। দেবালয় থেকে বেরিয়ে পরিচয় হল দীপক কুমার ওঝা নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার সাথে। তিনি পেশায় আইনজীবী।
তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন রাজবাড়ির পূর্ব দিকের এক পুকুরঘাটে। এই পুকুরে স্নান করার সময়েই সাঁওতাল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন পাকুড়ের অত্যাচারী সুদখোর মহাজন দীনদয়াল রায়। সাঁওতালরা তাঁকে হত্যা করে তাঁর কাটা মুন্ডু রেখে দিয়েছিল কাছের শিব চক্রপানিশ্বর মন্দিরের কুলুঙ্গিতে। মন্দিরটি আজ আর নেই। সেই জায়গায় নতুন মন্দির স্থাপিত হয়েছে। পুকুরে বাসন মাজা, কাপড় কাচা ও স্নানে ব্যস্ত মহিলারা। ছেলেপুলেদের হইহল্লা ও মাইকের আওয়াজে সরগরম মন্দির-চত্বর।
সামান্য প্রাতরাশ সেরে পাকুড় থেকে ট্রেন ধরে চললাম বারহারোয়ায়। ঘন্টাখানেক লাগল পৌঁছতে। বারহারোয়া জমজমাট স্টেশন। মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজতে রিক্সায় চেপে গেলাম বিন্দুবাসী আশ্রমে। ছোট এক পাহাড়ের শীর্ষে আশ্রম। চারদিকে সবুজের সমারোহে মোহময় পরিবেশ। প্রবেশ তোরণ পেরিয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখি আশ্রমের দুর্গামন্দিরে অনেকে পুজো দিতে এসেছেন। রামনবমীর সময় এখানে বিশাল মেলা বসে। মেলার সময় আশ্রমে থাকার ঘর পাওয়া দায় হয়। আমরা ঘর পেলেও ব্যবস্থাদি মনোমতো না-হওয়ায় ফিরে এলাম। স্টেশনের কাছেই ছিমছাম একটা গেস্টহাউসে উঠলাম। দুপুরের খাবার খেলাম অনতিদূরের ‘বিজয়’ হোটেলে।
বিকেলে ট্রেকার রিজার্ভ করে রওনা হলাম বারহেটের উদ্দেশে। লাল পাথুরে মাটির পথে পড়ল পটে আঁকা ছবির মতো শান্ত এক নদী। নাম ‘গুমানি’। বাংলায় যার অর্থ– অভিমানী। রাস্তা কখনও সোজা, কখনও আঁকাবাঁকা। দূরের পাহাড়, ছোট-বড় ফসলের খেত ও পথ চলতি মানুষদের দেখতে দেখতে পৌঁছলাম বারহেট বাজারে। সেখানে মঙ্গলবারের হাট বসেছে। গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে আসা আদিবাসী পুরুষ-মহিলারা বিকিকিনি করছে।
বিদ্রোহের শুরুতে সাঁওতালরা প্রথমেই তৎকালীন সাঁওতাল পরগণার সদর শহর বারহেট অধিকার করেছিল। সিধু-কানুর নির্দেশে তারা বারহেট বাজার লুঠ করে। ধনী মহাজনদের হত্যা করে তাদের ঘরবাড়ি, ইংরেজদের নীলকুঠি-রেশমকুঠি জ্বালিয়ে শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিশোধ নেয়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশবাহিনী বারহেট দখল করে সেখানকার ও আশেপাশে ভগনাডিহি সহ সব সাঁওতাল গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। বাসভূমি ও পরিবার-পরিজনদের রক্ষার জন্য লড়াই করে প্রাণ দেয় হাজার হাজার সাঁওতাল।
সাঁওতাল বিপ্লবী সিধু-কানুর বাড়িতে তাঁদের মূর্তি
হাটে কিছু সময় কাটিয়ে চললাম ভগনাডিহি গ্রামে। এই গ্রামেই থাকতেন চুন্নু মূর্মু ও তাঁর চার ছেলে – সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। কানু, চাঁদ ও ভৈরবের কোনও বংশধর ছিলনা। সিধু মূর্মুর উত্তরপুরুষেরা এখনও গ্রামের ভিটেতেই বাস করেন। বর্তমানে তাঁর পঞ্চম প্রজন্মের দুটি ছেলের নাম – সিধু ও কানু। যদিও স্কুল-পড়ুয়া ছেলে দুটি জানেনা কেন তাদের এই নাম। বুঝলাম প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই এই অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। কৃষিজীবী পরিবারটির হতদরিদ্র অবস্থা দেখে চোখে জল এল। মাটির বাড়ির সর্বত্র অভাবের চিহ্ন। উঠোনে সিধু ও কানুর মর্মর মূর্তি জায়গায় জায়গায় ভাঙা। প্রতি বছর হুল দিবসে মূর্তি দুটির সংস্কার করে পুজো দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে কাছের একটা বড় মাঠেও সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পার্ক বানানো হয়েছে। পার্কের গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে ঢোকা গেল না।
ভগনাডিহি থেকে বারহেট হয়ে দুমকা-সাহেবগঞ্জ রোড ধরে কিছুটা গেলেই পাঁচকাটিয়া। মানিক চৌধুরী, গোরাচাঁদ সেন, সার্থক রক্ষিত, নিমাই দত্ত ও হীরু দত্ত–এই পাঁচজন কুখ্যাত মহাজনকে পাঁচকাটিয়া বাজারে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা হত্যা করেছিল। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন এখানকার এক বটগাছের তলায় আয়োজিত বিশাল জনসমাবেশে সিধু ও কানুর ভাষণের পর দশ হাজার সাঁওতাল হুল বা বিদ্রোহের শপথ গ্রহণ করে। ভারতের গভর্নর জেনারেলের কাছে অভিযোগ জানাতে এখান থেকে প্রায় তিন হাজার সাঁওতালের একটি দল ১৪0 মাইল দূরবর্তী কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। ভারতের ইতিহাসে এটাই প্রথম গণ-পদযাত্রা।
প্রাচীন সেই বটগাছ দেখতে পাঁচকাটিয়া গেলাম। চারদিকে পাঁচিল দিয়ে সংরক্ষিত বটতলা। প্রবেশ দরজার ওপর দেবনাগরী হরফে লেখা – ‘অমর শহীদ সিদো কান্হু মূর্মু – ১৮৫৫ হুল ক্রান্তি স্থল’। বটগাছ থেকে প্রচুর ঝুরি নেমেছে। কিন্তু গাছটিকে ঘিরে সিমেন্টের বেদি তৈরি করায় এবং ঝুরিগুলো সমানে কেটে নেওয়ার ফলে এটি কতদিন টিকে থাকবে সন্দেহ।
পরদিন সকালে আমাদের গন্তব্য তিনপাহাড় ও রাজমহল। বারহারোয়া থেকে তিনপাহাড় যেতে বেশি সময় লাগল না। এককালে চা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল তিনপাহাড়। স্টেশনে নামতেই পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকল। তবে যানবাহন ও মানুষের ভিড়ে স্টেশন-সংলগ্ন অঞ্চল খুবই ঘিঞ্জি। গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পাহাড়ের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যকে অনেকটাই চোখের আড়াল করেছে। এসবের ফাঁকফোকর দিয়েই আমরা পাহাড়ে চড়ার রাস্তা খুঁজতে থাকি। অবশেষে একটা দোকানঘর ও একটা বাড়ির মাঝখানে সংকীর্ণ সিঁড়িপথ পেলাম যা একেবারে পাহাড়ের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে পাঁচিল টপকে আমাদের দলের একটি ছেলে তরতরিয়ে পাহাড়ে উঠে গেলেও বাকিরা কেউ পারলাম না। অগত্যা পাশের একতলা বাড়ির সামনে গল্পে মশগুল কয়েকজন অবাঙালি মহিলাকে অনুরোধ করে বাড়িটার ছাদে যাওয়ার অনুমতি আদায় করলাম। উদ্দেশ্য–ভালোভাবে পাহাড়ের ছবি তোলা। ছাদে উঠে মন ভরে গেল। এক দিকে লতা-পাতা-গুল্মে ঢাকা লাল পাহাড়ের তিন চূড়া, অন্য দিকে রেললাইন ছাড়িয়ে যতদূর চোখ যায় রাঙা মাটির বুকে সবুজে সবুজ একের পর এক ধানক্ষেত।
মিটারগেজ লাইনে সারা দিনে অনেকগুলো ট্রেন চলে তিনপাহাড়-রাজমহল পথে। আমরা মোটর ভ্যানে সওয়ার হলাম। ভ্যান চালক মহম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হল তিনি আমাদের রাজমহলের সব দ্রষ্টব্য দেখিয়ে আবার তিনপাহাড়ে নিয়ে আসবেন। তারপর আমরা ফেরার ট্রেন ধরব।
গঙ্গার পশ্চিম তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক জনপদ রাজমহল প্রাচীনকালে ‘আগমহল’ নামে পরিচিত ছিল। ১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে উড়িষ্যা জয় করে ফেরার পথে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ এই নাম পরিবর্তন করে ‘রাজমহল’ করেন। বাংলার সুবাদার হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পর ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রাজমহলে রাজধানী স্থাপন করে সম্রাটের নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করেন ‘আকবরনগর’। বাংলায় শাহজাহান-পুত্র শাহ সুজার সুবাদারির সময়েও (১৬৩৯-১৬৬০) এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল। গঙ্গার তীরে এক প্রাসাদে যুবরাজ শাহ সুজা বাস করতেন। সেই প্রাসাদ তাঁর আমলেই আগুনে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কালক্রমে গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। রাজমহল স্টেশনের কাছে ‘সং-ই-দালান’-কে শাহ সুজার প্রাসাদের টিকে থাকা অংশবিশেষ বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে, শাহ সুজা নন, মানসিংহ ‘সং-ই-দালান’ নির্মাণ করিয়েছিলেন। ১৮২০-তে সম্পূর্ণ রাজপুত ঘরানায় তৈরি এই অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তির ছবি এঁকেছিলেন ভারতীয় চিত্রকর সীতা রাম, যা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। ‘সং-ই-দালান’-এ ঢুকতে গিয়ে দেখি পাশেই একটা গাছে বাসা বেঁধেছে প্রচুর শামুকখোল পাখি। দালানের খিলানের ফাঁক দিয়ে গঙ্গা দর্শনের স্মৃতি অবিস্মরণীয়।
কাছেই ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি ‘আকবর শাহী মসজিদ’। কথিত আছে, মান সিংহ এই মসজিদ নির্মাণ করানোর পর এখানে প্রথম নামাজ পড়েন সম্রাট আকবর। মসজিদ দেখে বেরোনোর সময় আজানের সুরে মন আবিষ্ট হল। আর ঠিক তখনই শুরু হল বৃষ্টি। দৌড়ে পাশেই গঙ্গার ধারে সূর্যদেব ঘাটের এক মন্দিরে গিয়ে সবাই আশ্রয় নিলাম। ছট পুজো ও ‘আদিবাসীদের মহাকুম্ভ’ নামে পরিচিত মাঘী পূর্নিমা মেলার সময় মানুষের ঢল নামে এই ঘাটে।
মন্দিরের সামনে নদীর ওপারে মালদহের মানিকচক। এপারে ফেরিঘাটে নদী পারাপারের লঞ্চ যাত্রীর অপেক্ষায়। বাঁদিকে বহু দূরে অঝোর বৃষ্টিতে ঝাপসা রাজমহল পাহাড়ের রেঞ্জ। সেদিকেই তেলিয়াগড় ও সকরিগলির সংকীর্ণ গিরিপথ ঘেঁষে গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতে প্রবেশ করেছে। এসব দেখছি, আর ভাবছি কতক্ষণে বৃষ্টি কমবে। যেতে হবে আরও অনেকগুলো জায়গায়। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে বলে খিদেও পেয়েছে সকলের। এদিকে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই।
কথায় বলে, ‘খালি পেটে গান হয়না’। কিন্তু কি খেয়ালে জানি না বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার গান গাইতে ইচ্ছে হল। বেশ উঁচু গলাতেই গান ধরলাম। সংগীতশিল্পী হরি ওম শরণের গাওয়া বিখ্যাত ভজন–‘জয় নন্দলালা জয় গোপালা’। গান শুনে ছুটে এলেন মন্দিরের পুরোহিত ও সেবায়তরা। গান শেষ হতেই করতালি, আবার গাওয়ার অনুরোধ। আরও দু-একটা গান গাইলাম। বেজায় খুশি হয়ে মন্দির-চাতালে বসিয়ে তাঁরা আমাদের ভোগের খিচুড়ি খাওয়ালেন।
বৃষ্টি থামার শেষে প্রকৃতির এক বিস্ময় দর্শনের উদ্দেশ্যে গঙ্গাপাড়ের পথ ধরে চললাম মহাসিংপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কাঠঘর গ্রামে। রাস্তার ডান দিকে নদীর ধারে বড় বড় আমবাগান। কিন্তু সরু এই সড়কের পিচঢালাই উঠে যাওয়ায় স্থানে স্থানে প্রচুর খানা-খন্দ। সেগুলোতে বৃষ্টির জল জমে আরও বেহাল দশা। আমাদের বাহন বহুবার গাড্ডায় পড়েছে। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে সেটিকে ঠেলে তুলেছি। মহম্মদ ভাই বৃদ্ধ হলেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গাড়ি চালিয়েছেন বলে কোনও বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে এভাবে অনেকখানি সময় নষ্ট হওয়ায় পথে চিনামাটির খাদান এবং মান সিংহের শাসনামলে নির্মিত জামি মসজিদ ও বারাদরী সৌধ নজরে এলেও গাড়ি থেকে নেমে দেখার সুযোগ হলনা। শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিধন্য কানাই নাটশালা ও মোতি ঝরনা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল করতে হল।
খুঁজলে আরও অনেক দ্রষ্টব্য দেখা যায় রাজমহলে। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লার জন্ম হয়েছিল রাজমহলে। সেই সময় তাঁর মাতামহ আলীবর্দী খান ছিলেন রাজমহলের ফৌজদার। পলাশীর বিপর্যয়ের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় রাজমহলের কাছেই সিরাজ-উদ্-দৌল্লা সস্ত্রীক ধরা পড়েন। পরে মীরজাফর-পুত্র মীরনের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয়। রাজমহলে মীরনের সমাধি আছে। নবাব মীরকাশিমের প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আছে। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলের কাছে উধুয়ানালায় ইংরেজদের কাছে যুদ্ধে (উদয়নালার যুদ্ধ) পরাজিত হন মীরকাশিম। কিন্তু এ সব স্থান ঘুরে দেখতে হলে হাতে অনেক সময় থাকা প্রয়োজন।
প্রধান সড়কে পৌঁছনোর পর কাঠঘর যাওয়ার বাকি পথ পুরোনো পথের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিমেষে ভুলিয়ে দিল। প্রধান সড়ক থেকে বাঁদিকে যাওয়া সেই গ্রামীন পথের দুধারে মৌ মৌ গন্ধে আকুল করানো পাকা ধানের খেত। গন্তব্যের দিক-নির্দেশ পেতে স্থানীয় এক কিশোরের সাহায্য নিলাম। সে আমাদের গাড়িতে উঠে বসল। তার কথায় একটা শিব মন্দিরের সামনে মহম্মদ ভাই গাড়ি থামালেন। মন্দিরের পাশে শালুক ও পদ্ম ফুলে ভরা পুকুর। পুকুরের পাড়ে এক বিশাল বটগাছ। তার তলায় পড়ে আছে ছোট ছোট অজস্র পাথরের টুকরো। দেখতে অবিকল চাল, ডাল ইত্যাদি বিভিন্ন রকম খাদ্যশস্যের মতো। আসল-নকল আলাদা করা দায় হয় বলে এগুলো দিয়ে গ্রামের নতুন জামাইকে ঠকানো হয়ে থাকে। বহুকাল আগে এখানকার এক রাজার কাছে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষজনের জন্য ভিক্ষা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া এক সাধুর অভিশাপে রাজার শস্যভান্ডারের সব শস্য পাথর হয়ে গেছে – প্রচলিত বিশ্বাস এমন কথাই বলে। কিন্ত ভূতাত্ত্বিকেরা একে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ঘটনা বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় ভূতাত্বিক সর্বেক্ষণ (Geological Survey of India)-এর মতে, রাজমহল অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ব্যাসাল্ট শিলা আছে। প্রাচীনকালে আবহবিকারের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত সেইসব শিলার থেকে রকমারি রঙ ও আকার-আকৃতির সিলিকা কণা বেরিয়ে পড়ে। নিকটে প্রবাহিত কোনও ছোট বা বড় নদীই ওই শস্যোপম কণাগুলোকে বয়ে এনে কাঠঘরে সঞ্চিত করে।
অন্যদিকে, বিশিষ্ট ভূতাত্ত্বিক এ. কে. সাহানির অনুমান, ক্রিটেসিয়াস যুগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের ফলে শস্যসদৃশ সিলিকা-নির্মিত পাথরগুলির উৎপত্তি হয়েছে। জ্বালামুখ থেকে উৎক্ষিপ্ত উত্তপ্ত সিলিকা যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শীতল হয়, তাতেই পাথরগুলি এমন বিচিত্র আকার পেয়েছে।
গ্রামের কয়েকটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে সামান্য টাকার বিনিময়ে তাদের সংগ্রহ থেকে মুঠো ভর্তি করে পাথর তুলে দিল আমাদের হাতে। পর্যটকদের কাছ থেকে এভাবেই ওরা কিছু রোজগার করে। যদিও এখানে খুব বেশি পর্যটক আসেনা। সেদিনও আমরা ছাড়া আর কোনও পর্যটক ছিলনা। বয়স ভুলে সবাই মেতে উঠলাম পাথর কুড়োতে। আকাশে তখন ছড়িয়ে পড়ছে অস্তগামী সূর্যের সোনালি আলো।
তথ্যসূত্রঃ
(১) সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস – ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে
(২) মুর্শিদাবাদ কাহিনী – শ্রী নিখিলনাথ রায়
(৩) No Need to Grow Grains, Dig the Earth and Get ‘Cereals’ (http://www.pointblank7.in/?p=2442 )
***********************************************
সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতিঃ
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনএ স্নাতকোত্তর সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত একজন লেখিকা, সংগীতশিল্পী এবং বিজ্ঞান ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী। ‘কালান্তর’, ‘সুস্বাস্থ্য’, ‘উৎস মানুষ’, ‘টপ কোয়ার্ক’, ‘যুক্তিবাদী’, ‘এখন বিসংবাদ’, ‘মানব জমিন’, ‘আবাদভূমি’, ‘সাহিত্য সমাজ’, ‘সারথি’, ‘অভিক্ষেপ’ইত্যাদি পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘আজকাল’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’, ‘ভ্রমণ’ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর চিঠিপত্র ছাপা হয়েছে। ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’-র উদ্যোগে তাঁর সম্পাদনায় ‘র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন’প্রকাশন থেকে ড. পবিত্র সরকারের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয়েছে ‘ছোটোদের কুসংস্কার বিরোধী গল্প’গ্রন্থের দুটি খন্ড। তাঁর লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে মরণোত্তর দেহদান-আন্দোলন ও উত্তরণ’বইটি উচ্চ-প্রশংসিত। দূরদর্শনে ‘মরণোত্তর দেহদান’নিয়ে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্যও রেখেছেন। সম্প্রতি গায়িকা-অভিনেত্রী কানন দেবীর জীবন নিয়ে তাঁর গবেষণামূলক লেখা ‘ফেসবুক পেজ’-এ প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রসংগীতে তিনি ‘সংগীত প্রভাকর’ ও ‘সংগীত বিভাকর’। তালিম নিয়েছেন শাস্ত্রীয় সংগীতেও। স্কুলজীবনে বেতারে ‘শিশুমহল’, ‘গল্পদাদুর আসর’ ও ‘কিশলয়’-এ নিয়মিত গান গেয়েছেন। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গে ও এই রাজ্যের বাইরে রবীন্দ্রসংগীত, পল্লীগীতি ও গণসংগীত ছাড়াও তাঁর ভাই রাজেশ দত্তর কথায়-সুরে ‘মানবতার গান’ মঞ্চস্থ করেছেন। রাজেশের কথায়-সুরে তাঁর গাওয়া ‘পাল্টা স্রোতের গান’ অডিও ক্যাসেট ও সিডি আকারে প্রকাশিত। কয়েকটি নাটক ও শ্রুতিনাটকে তিনি অভিনয় করেছেন, পুরস্কৃতও হয়েছেন। আবৃত্তি, সংগীত ও কয়েকটি ‘রিয়্যালিটি শো’ প্রতিযোগিতায় বিচারকের পদ পেয়ে সম্মানিত হয়েছেন। খেলাধূলার ক্ষেত্রে ‘কবাডি’-তে কৈশোরে স্কুলে নিজের ক্লাসের দলে অধিনায়কত্ব করেছেন, ‘জিমনাস্টিকস্’-বিশেষত ‘তারের খেলা’ শিখেছেন, ব্রতচারী নাচে শংসাপত্র পেয়েছেন। আঁকা, ছবি তোলা, রন্ধন ও ভ্রমণ-ও তাঁর শখের বিষয়।