ভুয়ো
চন্দ্রকান্তি দত্ত
চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর দক্ষিণবাংলার কোন ছোট শহরে স্হায়ীভাবে বসবাস করব ভেবে রেখেছিলাম। সেইমতো খোঁজখবর করে কোন্নগরে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সমস্তিপুর থেকে সোজা এখানে এসে উঠেছি। বাড়িটা মূল লোকালয় থেকে একটু তফাতে, গঙ্গার ধারে। পুরনো বাড়ি, একতলা। তবে যত্নে বেশ ঝকঝকে রাখা হয়েছে। সামনে পিছনে খানিকটা জমি। তারপর পুরো চত্তরটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরের জমিতে বড় বড় কয়েকটা গাছ-আম, কাঁঠাল, নিম, সজনে ও পেঁপে। কিছু ফুলের গাছও আছে। একজন মালি দেখাশোনা করে। আমি একা মানুষ। তিনকুলে এক বৃদ্ধা পিসি ও নবতিপর পিসেমশাই ছাড়া আর কেউ নেই। খুব ছেলেবেলায় অনাথ হওয়ার পর এই পিসিই আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেন। পিসেমশাই রেলে চাকরী করতেন। আমার রেলের চাকরীটাও পিসেমশাই-এরই বদান্যতায়। আমার বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায় আমাদের প্রথম সন্তানের জন্মের অনতিবলম্ব পরেই সন্তান ও তার মা দুজনেই আমাকে ছেড়ে গেল। সেই থেকে আমি একা। পিসি বহুবার আমাকে আবার বিয়ে করার কথা বলেছেন। বংশে বাতি দেওয়ার জন্য কেউ না থাকাটা অমঙ্গলজনক। কিন্তু মাত্র দুটি বছরে অমিতা আমার জীবনে যে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে, সেখানে অন্য কাউকে বসাতে মন সায় দেয় নি। পিসি ও পিসেমশাই-এর সাথে ক্রমে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে ও দূরত্ব বাড়তে বাড়তে প্রায় অনতিক্রম্য হয়েছে।
অমিতার অকাল বিয়োগের পর রঘুয়া নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়েছিলেন আমাদের সুপারভাইজার দেওনন্দনবাবু। সেই থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর রঘুয়া আমার কাছেই আছে। কোন্নগরে চলে আসার সময় ওকে রেখে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা, অকৃতদার রঘুয়াকে কোনমতেই বোঝানো যায় নি। এখন এখানেও সে-ই আমার একান্ত সঙ্গী ও সহকারী। আশেপাশে এখনও বাড়িঘর বিশেষ নেই। তবে একেবারেই যে নেই তাও নয়। ফুট পঞ্চাশেক তফাতে অনেকটা একই ধাঁচের আরও একটা বাড়ি আছে। সেটাও পুরনো ৷ আমি আসার আগে গত প্রায় সাত-আট বছর আমার বাসাটিতে কেউ থাকতেন না। ফাঁকাই পড়ে ছিল। কিন্তু পাশের বাড়িটা ফাঁকা থাকে না। সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে একজন নায়েব গোছের মানুষ থাকেন। সপ্তাহান্তে মালিকের আবির্ভাব ঘটে। আমি দেখেছি, প্রতি রবিবার বাড়ির মালিক এলে দুর-দুরান্ত থেকে নানা স্তরের মানুষের সমাগম ঘটে। স্বাভাবিক কৌতূহলবশতঃ এক রবিবার সকালে বেড়াতে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে একটু বেশী সময় কাটালাম। উদ্দেশ্য, লোক সমাগম আরম্ভ হলে কারনটা জানার চেষ্টা করা। ফেরার পথে নজরে পড়ল, যাঁরা আসছেন সকলেই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আসছেন। অর্থাৎ এটি ডাক্তারখানা। এরমধ্যে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই। হালফিলের এটাই চল। কলকাতার ডাক্তাররা সপ্তাহান্তে একদিন বা দুদিন বিভিন্ন মফস্বল শহরে চেম্বার করেন। মফস্বলের মানুষও অভিজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসার সুযোগ পায়। ফিরে এলাম। ইনি ডাক্তার এটা জানলাম, কিন্তু নামটা জানা হল না।কলকাতা থেকে চিঠি এসেছে। পিসেমশাই সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন। যেতে হবে। রঘুয়ার হাতে সংসারের দায়িত্ব সঁপে দিয়ে কলকাতা গেলাম। পিসি একদিকে প্রচুর কাঁদলেন, অন্যদিকে আমার প্রতি অভিমান বশতঃ কিছু কড়া কথাও শোনালেন। পিসেমশাই-এর পারলৌকিক কাজ শেষ হলে পিসী বললেন, “হ্যাঁরে নব! বিয়েটা নাহয় না-ই করলি। এই বয়সে আর ওটা সম্ভবও নয়। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সে কোথায় একা পড়ে আছিস বাবা! আমার কাছে চলে আয়। এখানে তো তোর পুরো অধিকার আছে।”
আমি পিসিকে বোঝালাম, “এই বয়সে বহু দুর থেকে এসে এক জায়গায় থিতু হয়েছি। বারবার ঠাঁই নাড়া হওয়া প্রায় অসম্ভব।”
কোন্নগরের বাসায় ফেরার পরের রবিবার, কেন জানি না, ডাক্তারের চেম্বার খুলল না। আমি একটু অবাক হলাম। আমি এখানে বাসা নিয়েছি প্রায় চারমাস। অথচ, এরকমটা এই প্রথমবার দেখলাম। রঘুয়াকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে ও বলল, “ডাগ্ডরখানা খোলবে না। মনিবাবু বললেন কি, মিটকেল কনসিল মনা কিয়া হ্যায়।” মেডিক্যাল কাউন্সিল বারন করেছে? এর অর্থ একমাত্র এই হতে পারে যে, ডাক্তারবাবুর নামে কোন কেস-টেস হয়েছে। সেই হেতু মেডিক্যাল কাউন্সিলের তদন্তের কারনে প্র্যাকটিস বন্ধ। বহুকাল বিহার প্রবাসী হওয়ার কারনে একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “এখানেও ঘোটালা?”
কথাটা রঘুয়ার সামনে বলা ঠিক হয় নি। রঘুয়া যেন কথাটা লুফে নিল। বলল, “হাঁ সাব। ঘোটালা হি ঘোটালা। মনিবাবু বললেন কি, উহ বাবু কলকত্তামে ডাগ্ডরী নহী করতে হ্যাঁয়। উও তো এক পেরাইবেট বেঙ্কমে কাম করতে হ্যাঁয়। খালি ইতোয়ার কো ইয়াহাঁ পেরেকটিস করতে হ্যাঁয়। রাম জানে নকলী ডাগ্ডর হ্যাঁয় ইয়া নহী।”
মানুষের মন অনুভূতিপ্রবণ। মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। শুনেছিলাম বিগত প্রায় ষোল-সতের বছর ধরে উনি এখানে প্র্যাকটিস করেন। অথচ, আদতে উনি ডাক্তার নন। ব্যাঙ্কের চাকুরে। এই জালিয়াতিটা ধরতে এতদিন সময় লেগে গেল।
অন্য আর পাঁচটা দিনের মতই সেদিনও আমরা চার বৃদ্ধ প্রাত:ভ্রমণ সেরে গঙ্গার ধারে এসে বসলাম। আমার সাথে ছিলেন স্হানীয় বিদ্যাসুন্দর হাই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্রী সমীর চক্রবর্তী, কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন সহকারী রেজিষ্ট্রার শ্রী অজিত দত্ত ও প্রাক্তন বেসরকারী চাকুরে শ্রীহরকালি মিত্র।
কথাটা তুললেন মিত্রবাবু। বললেন, “দেখুন নবকুমারবাবু, লোকে বলছে বটে যে লোকটা নাকি ভুয়ো ডাক্তার। আমার কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হয় না। অনেকদিন ধরেই তো দেখছি। কই, কোন রোগীর ক্ষতি হয়েছে বলে তো শুনিনি।”
অজিত দত্ত কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন, “ক্ষতি কি বলছেন মিত্রবাবু! সেবার হেপাটাইটিসে আমার গিন্নীর তো প্রায় যায় যায় অবস্হা। অথচ নৃপেন ডাক্তারের চিকিৎসায় মাস দুয়েকের মধ্যে ম্যাজিকের মত ভাল হয়ে গেল। আমি যেখানে বুড়ো বয়সের ভয়ে মুরগি পর্যন্ত ছুঁই না, সেখানে তিনি তো ছেলে-বৌয়ের সাথে রীতিমত পাঁঠা চিবোচ্ছেন।”
সমীরবাবু এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। এবার বললেন, “সবই তো হল ভাই। নাহয় মানছি যে ডাক্তারটা ভুয়ো নয়। কিন্তু একটা ধাঁধার যে সমাধান হচ্ছে না। নৃপেন গোস্বামী যদি এত ভাল ডাক্তারই হবে, তাহলে কলকাতায় ডাক্তারী না করে ব্যাঙ্কে চাকরী করে কেন?”
ধাঁধাই বটে। একজন মানুষ, যে কিনা বেসরকারী ব্যাঙ্কে চাকরী করে, সে গত ষোলো-সতের বছর ধরে মাত্র তিরিশ কিলোমিটার দূরে ডাক্তারী করে গেল, অথচ কেউ ধরতে পারল না? এও কি সম্ভব? কি জানি বাবা! আজকাল সমাজটার সবই যেন কেমন গোলমেলে। এই জন্যই হয়ত নন্দবাবু কথায় কথায় বলতেন, দেশটা উচ্ছন্নে গেল। পরপর তিনটে রবিবার নৃপেন গোস্বামী এলেন না। চেম্বারও খুলল না। নানা প্রান্ত থেকে অসুস্থ মানুষেরা আসেন ও শুকনো মুখে ফিরে যান। প্রথম দিকে কিছু মনে না হলেও এখন এদের দেখে খারাপ লাগে। এতগুলো মানুষের বেদনাক্লিষ্ট মুখ আমার মধ্যেও বেদনার সঞ্চার করে। সাতপাঁচ ভেবে শেষে শহরে বিবেকানন্দ স্মৃতি সংঘের সম্পাদক তপন চৌধুরীর সাথে দেখা করলাম। উদ্দেশ্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা করা। তপন চৌধুরীর সাথে আমার পরিচয় আছে। বাজারে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। ছেলেটি ভাল। ভাল কাজের চেষ্টা করে। অনেক সেবা মূলক কাজের সাথে যুক্ত।
চৌধুরীকে বললাম, “আচ্ছা তপন, নৃপেন ডাক্তার তো দীর্ঘদিন আসছেন না। এদিকে ওর পেশেন্টদের অবস্থা তো খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে কি অন্য কোন ডাক্তারকে আনা যায় না? একটু কম ফি নেওয়া কোন ডাক্তার।”
তপন চৌধুরী যেন আকাশ থেকে পড়ল, “ফি এর কথা কি বলছেন কাকাবাবু! ডাঃ গোস্বামী তো বিনে পয়সায় চিকিত্সা করেন। আর শুধু রোগী দেখাই নয়, খুব গরীব যারা, তাদের নিজের খরচে ওষুধও দেন। ওরকম কোথায় পাবেন?”
-“তাহলে উপায়?” আমি হতাশা ব্যক্ত করলাম, “এই মানুষগুলোর কষ্ট যে আর চোখে দেখা যাচ্ছে না বাবা।”
-“কাকাবাবু, আজকাল আপনার মতো মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। কার কথা কে ভাবে! অথচ আপনি, কিছু একটা করতে হবে বলে ছটফট করছেন।”
-“পাশের বাড়িতেই থাকি তো। এতগুলো মানুষের কষ্ট আমাকেও কষ্ট দিচ্ছে। তাই এত ভাবছি।”
-“আচ্ছা কাকাবাবু, একটা কাজ করলে কেমন হয়? মনিদার সাথে কথা বলে আপনি আর আমি যদি ডাঃ গোস্বামীর কলকাতার বাসায় ঢুঁ মারি?” ডাক্তার কি দেখা করতে রাজি হবেন? বিশেষ করে মেডিক্যাল কাউন্সিলের এই বারণের পরে?”
-“দেখি না চেষ্টা করে। নেহাত কোন কাজ না হলে তখন অন্য কিছু ভাবা যাবে। ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে, তাই না।?”
পরের শনিবারই আমরা কেয়ারটেকার মনিবাবুকে সাথে নিয়ে ডাঃ গোস্বামীর ভবানীপুরের বাড়িতে হাজির হলাম। ভদ্রলোক হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। ভদ্রলোকের চোখেমুখে গ্লানির লেশমাত্র নেই। এতবড় একটা কান্ডের পরেও মানসিকভাবে বেশ শক্ত আছেন মনে হল।
আমাদের সাথে কোনরকম মেকি ভদ্রতা না করে সরাসরি হাঁক দিলেন, “এঁদের জন্য আগে কিছু জলখাবার পাঠাও, পরে চা।”
তারপর মুখোমুখি বসে বললেন, “আপনি তো আমার নিকটতম প্রতিবেশী নবকুমারবাবু, তাই না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমার নামটা জানেন দেখছি!”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ! কিন্তু আলাপ করা হয়ে ওঠে নি। আসলে, এত কম সময়ের জন্য যাওয়া হয় যে, রোগী দেখে আর সময় বা উদ্দম, কোনটাই থাকে না। দু-একদিন যে থাকব সে উপায়ও নেই। প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ম্যানেজারী। বুঝতেই পারছেন, স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। তবু আপনারা বাড়ি বয়ে এসেছেন, তাই একটু আলাপ করতে পারছি।”
আমার যেন আর বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকছে না। এতবড় একটা অপমানজনক ঘটনার পরে একটা মানুষ এত সহজ সাবলীল আছেন কি করে!
ডাক্তার তপনের দিকে ফিরে বললেন, “কি চৌধুরী! তোমার সমাজ সেবা কেমন চলছে?”
-“সেই জন্যেই তো ছুটে আসা স্যার! আপনি যাচ্ছেন না। আমার সমাজসেবা তো লাটে উঠেছে।”
-“কি আর করি বলো? সে দোষ কি আর আমার? দেখ না, বলা হল ভুয়ো ডাক্তার ধরতে। এমন সব কর্মঠ লোক যে, ভুয়ো ডাক্তারের নামে আসল ডাক্তারকে পাকড়াও করল। আরে বাবা, কাঁড়ি কাঁড়ি বই পড়ে, স্বদেশ বিদেশ ঘুরে ডাক্তার হলাম। আর বলে কি না সব জাল। আমার কথা হল, জাল কিনা আগে প্রমাণ করো, তারপরে বাঁধো। তা নয়, আগেই দিলে পায়ে বেড়িটা পরিয়ে। এবার কতদিনে ছানবিন হবে, বিজ্ঞ জনেরা তাঁদের মতামত দেবেন, তারপর যদি মুক্তি পাই।”
ডাক্তার থামলে আমি বিনীতভাবে বললাম, “ডাক্তারবাবু, আমি কিন্তু কোনরকম সন্দেহের বশে নয়, নিছক কৌতুহলবশতঃ একটা প্রশ্ন করতে চাই। দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না।”
-“আমার ব্যাঙ্কের চাকরীর কারনটা তো? ওতে কোন লুকোছাপা নেই। বিদ্যার দম্ভ, পয়সার মোহ, আমার চোখে যে ঠুলিটা পরিয়ে দিয়েছিল, সেটা খুলে ফেলে ডাক্তারীটা ছেড়ে দিয়েছি। Actually it was the result of a very shocking episode in my professional লাইফ।”
ডাক্তার থামলেন। এতক্ষণের উজ্জ্বল মুখমন্ডলে একটা ম্লান আভা ফুটে উঠল। বুঝলাম, প্রেক্ষাপটে কোন একটা ঘটনা বা ঘটনা পরম্পরা আছে, যা ভাবলে আজও তিনি কষ্ট পান। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। বাতাসটা কিছুটা ভারী। ইতিমধ্যে আমাদের জন্য চা-জলখাবার এসে গিয়েছিল।
ডাঃ গোস্বামী প্লেটগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, “অনেকক্ষণ বেরিয়েছেন। নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। একটু খান।”
আমি বললাম, “কি এমন ঘটনা ঘটেছিল ডাক্তারসাহেব, যে আপনি এতবড় ডাক্তার হওয়া সত্বেও প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলেন?”
-“ওই যে আপনাকে বললাম না, শিক্ষার অহংকার, পয়সার মোহ, আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। দুহাতে পয়সা রোজগারের মেশিন হয়ে গিয়েছিলাম। দয়া, মায়া, মনুষ্যত্ব সব হারিয়ে গিয়েছিল। অথচ ছোট্ট একটা ঘটনা এক লহমায় আমাকে বদলে দিল জানেন।
“নার্সিংহোমে একটা কেস এসেছিল। বাচ্চাটার হার্টে ফুটো ছিল। সেই কারনেই হঠাৎ প্রাণশংসয় দেখা দেয়। জুনিয়ার পরীক্ষা করে অপারেশানের নিদান দেয়। অপারেশানটা জরুরী। ওটা আমি করব। কিন্তু নার্সিংহোম তিরিশ হাজার টাকা জমা করতে বলে। ওরা পারলেন না। ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বাচ্চাটাকে। কেউ বাধা দিল না। কিন্তু নিয়ে যাওয়ার দরকার হল না। দেরী হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাটা ওখানেই শেষ হয়ে গেল।
“এ পর্যন্ত ঘটনাটা আমার আড়ালে ঘটলেও, আগাম টাকা জমা করার নিয়মটা কিন্তু আমিই চালু করেছিলাম। বাচ্চার বাবা-মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ আমার অন্তরে যেন হঠাৎ একটা ঘা মারল। বেরিয়ে এসে বাচ্চাটাকে দেখলাম। চারবছরের ছোট্ট শেলী। ফুটফুটে সুন্দর প্রাণহীন মুখখানা এক ঝটকায় আমার সমস্ত দম্ভ ঘুচিয়ে দিল। সেই প্রথমবার আমি অনুভব করলাম, আমিও কাঁদছি। তবে বাইরে নয়, হৃদয়ের এক বিশেষ জায়গায়।
“বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। সারারাত পায়চারী করলাম। সকালে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে শপথ নিলাম, অনেক হয়েছে। আর নয়। এখন থেকে অর্থ নয়, শুধু মনুষ্যত্বের গান গাইব। ব্যাঙ্কের চাকরীটা জুটিয়ে নিতে অসুবিধা হয় নি।
“চৌধুরীকে দেখে ভাল লাগত। মানুষটা কতটুকু সামর্থ্য নিয়ে সমাজের জন্য কত কাজ করে। সেই থেকে প্রতি রবিবার দেশের বাড়িতে চিকিৎসা করি। যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমেছিল, সেগুলো গরীবের চিকিৎসায় কাজে লাগাই। কিন্তু আজও শান্তি পাই নি। ছোট্ট শেলীর মুখখানা যখনই মনে পড়ে, একটা অপরাধবোধ চাগিয়ে ওঠে। মনে হয়, এখনও প্রায়শ্চিত্তের অনেক বাকি।
“নবকুমারবাবু, আমি জাল ডাক্তার নই। তবে ওদের আমি নেপথ্যের এই ঘটনাটা কখনই বলব না। ওরা যা পারে করুক। শুধু একটাই দুঃখ, ওরা প্রায়শ্চিত্তটুকুও করতে দিচ্ছে না।”
চা জুড়িয়ে জল হয়ে গিয়েছিল। তিনজনের কেউই চুমুক দিই নি।
একটা বদলে যাওয়া মানুষের নিঃশব্দ আর্তনাদ যেন বাতাসে গুমরে গুমরে বেড়াতে লাগল।
*********************************************
লেখক পরিচিতি (চন্দ্রকান্তি দত্ত):
ভারতীয় জীবন বীমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী। জন্ম মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনা শহরে ১৯৫৯ সালে। স্কুল শিক্ষার শুরুটা পুরুলিয়ায় হলেও, প্রায় পুরোটাই হয়েছে দুর্গাপুরে। উচ্চ শিক্ষাও সেখানেই। নিজেকে লেখক না বলে গল্পকার বলতেই বেশী ভালবাসেন। লেখার শুরু গত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে, তাও একজন সিনিয়র সহকর্মীর উৎসাহ ও চাপে। সেই থেকে টুকটাক লিখলেও, শারীরিক অসুস্হতার কারণে লেখাতে ছেদ পড়েছে অনেকবার। এখন, চাকরী থেকে অবসরের পরে, প্রায় নিয়মিত লেখেন। গল্প ছাড়াও কয়েকটি কবিতাও লিখেছেন-বাংলা ও হিন্দিতে।